প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়
একান্নতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
আপাত নিঃস্বতার মধ্যেও হেমন্তের এক অন্তর্লীন মনকেমনিয়া বৈভব আছে।মাঠে মাঠে ধান ওঠার গভীর সুগন্ধে, সুটকেস, ট্রাঙ্ক থেকে চাদর-সোয়েটার আর লেপ তোষক রোদে ফেলে তোলার সময়কার ন্যাপথলিনের গন্ধে কেমন যেন ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।ধূসর সন্ধ্যা নামে, মিটিমিটি তারার নীচে নৈঋতকোনের আকাশ প্রদীপের বাঁশ একলা পড়ে থাকে।পুকুড়পাড়ের আমড়া গাছটিতে একটিও পাতা নেই। থোকা থোকা ঝুলন্ত পাকা আমড়ার সুগন্ধ হাওয়া দিলেই রান্নাশালে পৌঁছায়,ভোমরার উৎপাত বাড়ে।
এইসময়কার আলগা ঠান্ডা কচি-বুড়ো কারো জন্যই নাকি ভালো নয়,সন্ধ্যাসন্ধ্যি রান্নাবান্না মিটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে হয় তাই, খানিক গল্পগাছার অবসরও অবশ্য মেলে।
সই পিসিমা ঘুরে যাওয়ার বেশ কয়েকদিন পর্যন্ত তাঁর গল্প, তীর্থযাত্রার গল্পেই কাকে এখন সন্ধ্যেগুলো। সেদিনও রাতের রান্না সেরে লন্ঠনের আলোয় বসেছিল অহনা, পিসিমার কাছে,পাশে ঘুমন্ত ছেলে। দাওয়ায় বসে একাই নারকেলের কাঠি ছুলছেন জ্যাঠাইমা,তাঁর জুড়িটি এখনও তাঁকে সঙ্গ দেওয়ার মতো সুস্থ হয়ে ওঠেননি।
দিদিভাই ছেলেদের পড়ার ঘরের তক্তপোষে বাবুর কাঁথা সেলাই করছে,শাশুড়ি মা বসেছেন পানের বাটা সাজিয়ে,চুন,খয়ের,দোক্তা,মৌরী, লবঙ্গ, এলাচের মিলিজুলি একটা ঘন গন্ধ এসময় বারান্দাময় ঘুরে বেড়ায়,লন্ডনের মিজমিজে আলোয় যেন বাবার অশরীরী নড়াচড়া টের পায় অহনা,ওর বাবা পান খেতে খুব ভালোবাসতেন।
ভুত প্রেতে বিশ্বাস করতো না কোনও দিন, এখনও করেনা।তবু ব্যাখ্যাতীত কিছু ঘটনা আজকাল কেন কে জানে, ছায়া ফেলে মনে। এই যেমন, লক্ষ্মীপুজোর রাতে ও বাচ্চাসহ প্যাঁচা দেখলো, উঠোনময় জোৎস্নায় এককোনে লালপাড় শাড়ি পরা কোন এক অবগুণ্ঠনবতী মহিলার অবয়ব দেখলো,তার পরের সকালেই পিসিমার পায়ে জোর ফিরে এলো। গর্ভবতী অবস্থায় কবেকার ফেলে যাওয়া কার রূপোর ঝিনুক খুঁজে পাওয়াটাও তো এক বিস্ময়ের ব্যাপার আজও তার কাছে। এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়,কোন অনির্দেশ্য টানে সেদিন দুপুরবেলা নিজের বিছানা ছেড়ে ও উঠোন পেরিয়ে পুরোনো বাড়ির ধুলোভরা সিঁড়ি পেরিয়ে তিনতলায় গেল, দরজা খুললো,তোরঙ্গ হাতড়ে রূপোর ঝিনুক নিয়ে নেমে এলো…কেমন যেন ঘোরের মতো! ভাগ্যিস দিদিভাই সারাগায়ে ঝুল ধুলোমাখা ওকে দেখতে পেয়ে নামিয়েছিল,তা নাহলে যে কি হোত,কে জানে!
ওরা তো তারপরেই ওকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল,বাবু হওয়ার প্রায় পাঁচ মাস পর অবধি ওখানেই ছিল, তাই মনে পড়েনি ওসব কথা।মনে পড়তেই কৌতূহল বশে পিসিমাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়েছিল,
-’আচ্ছা পিসিমা! আমাদের ঐ পুরনো বাড়ির তিনতলায় কি আছে গো!’
বিরজার স্মৃতি এখন মোটামুটি ফিরে এসেছে।তিনিও কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলেন,চিরমুক্তি রং আগে কাউকে না কাউকে বন্ধকী ধনের কথা বলে যাওয়া উচিত।তা নাহলে তো ওরা জানবেই না কিছু…
কয়েকদিন ধরেই ভাইপোদের মুখে শুনেছিলেন,পুরনো বাড়িতে সাপখোপের উৎপাত বাড়ছে, অব্যবহার্য হয়ে পড়ে আছে বহুদিন,ওটা ভেঙে ফেলা উচিত।
আজকাল আর ধান আসে না,ওসব ঝামেলা করার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই কারো নেই; জমি থেকেই তা বিক্রি করে দেওয়া হয়।দক্ষিণ দিকের ধানের মরাইটাও অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে আছে,ওটাও ভাঙা হবে,ঠিক হয়েছে।
বিরজার এসব ব্যাপারে আপত্তি নেই, সময়ের প্রয়োজনে সংস্কার যে বিসর্জন দিতে হয়,তা তিনি জানেন,শুধু চিন্তা করছিলেন, উত্তরাধিকার যেন যোগ্য হাতে সমর্পিত হয়, সুরক্ষিত হয়।
🍂
নতুন বৌমার প্রশ্ন আচম্বিতেই তাঁকে সে সুযোগ দি’ল। শুরু করলেন গল্প…
‘সে কি আজকের কথা নাকি রে মা! তখন বলতে গেলে আমিও ছোট্ট।জ্যাঠাইমার বাপের বাড়ির জমিজমা বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা হাতে এসেছিল জ্যাঠামশায়ের। তিনি চেয়েছিলেন, টাকাগুলো দিয়ে জ্যাঠাইমার নামে জমি কিনতে।জ্যাঠাইমাই জোরাজুরি করেন,ঘরের জন্য,তাঁর ইচ্ছেতেই টিনের চাল দেওয়া তিনতলা কোঠাবাড়ি হয়,এ তল্লাটে তখনকার দিনে যা কারো ছিলনা। সংসার যদিও খুব বেশিদিন করা হয়নি,তবু শুনেছিল, এই বাড়ির জন্যই তার সম্বন্ধ পাকা হয়,বৌদিদির বাবাও ভালো ঘর দেখেই এ বাড়িতে তাঁর মেয়ে দেন।পরে পরে অন্যেরাও এমন ঘর করেছে, তাঁদেরও পাশে পাশে ঘর উঠেছে,পাকাঘরও; কিন্তু এখনও ও বাড়ির প্রতি টান যেন কমেনা আমাদের…’
অন্ধকারে ওবাড়ির দিকে তাকিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন বৃদ্ধা,চোখ তাঁর অতীতে, এবং তাঁর দিকে তাকিয়ে তরুণী, নতুন পাওয়া ব্যতিক্রমী জীবনে যে খুঁটে নিতে চায় জীবন ঘ্রাণ।
হঠাৎ কি মনে হতে পিসিমা কথা থামিয়ে মুখ ফেরালেন বৌমার দিকে,
-’তা হ্যাঁ লো! তুই হঠাৎ আজ এসব জানতে চাইছিস কেন?’
-’আপনাকে বলা হয়নি পিসিমা,তখন আপনি খুব অসুস্থ, আমিও মা হওয়ার আগের অস্বস্তিতে জেরবার।কোন এক দুপুরবেলা কি যে আমার হয়েছিল, আমি নাকি কাউকে কিচ্ছু না বলে ঐ পোড়ো বাড়ির তিনতলায় পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাযম’
-’সে কি! সর্বনাশ!তারপরে!’
-’দিদিভাই বলেছিল,পরে ও যেয়ে দেখেছে,দরজায় পুরনো তালা ভাঙা। আমি নাকি সটান উঠে দরজা খুলে তোরঙ্গ ঘেঁটে একটা রূপোর ঝিনুক নিয়ে নেমে এসেছিলাম,সারা গায়ে ঝুল মাখা ছিল,হাতে সিঁদুর।নেমে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়ি, ওরা তড়িঘড়ি ডাক্তার দেখিয়ে আমায় আমার বাবার বাড়ি পৌঁছে দেয়, ওখানে তো ভালোই থাকি, ওখানেই বাবু জন্মায়।’
-’ঝিনুকটা কই!’
-’আমার কাছেই আছে।আনবো?’
-’না।থাক।তোকে একটা কথা বলি। তোরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস করিস বা না করিস, অতীন্দ্রিয় কিছু আছেই।বংশের ধন বংশের কাছেই ফিরে আসে।’
বড়ো আত্মগত গলায় বললেন বৃদ্ধা।
-’আমি কিন্তু সবটা শুনতে চাই’
ভাববিলাসী তরুণীর গলায় যেন আবহমান কলম্বাসের আগ্রাসী আগ্রহ;
বলুন,পিসিমা!বলুন’
-’বলবো, বলতেই তো চাই।সব বলে দায়িত্ব না ছেড়ে গেলে যে আমার মুক্তি নেই।দেখলি না,মরণের দ্বারে পা ঠেকিয়েও ফিরে আসতে হলো,যখের ধন দিয়ে যাইনি বলে!’
-’যখের ধন! দায়িত্ব!... আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না পিসিমা!’
ধৈর্য্য ধর। বলছি।তবে তোকেও কথা দিতে হবে কিন্তু,যে দায়িত্ব দেব,তা জীবনভ’র যথাযথভাবে পালন করবি।’
বাইরে হেমন্তের বিষন্ন রাত তখন কুয়াশায় ভারী হয়ে ক্রমে নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে,কি এক অনিকেত সুখাবগাহী বেদনার মতো,সদ্যস্ফুটনোন্মুখ কমলকলিকার মতো সুপ্তোত্থিত গলায় প্রবীণা শুরু করলেন চক্রবর্তী বংশের কথকতা…ক্রমশঃ
0 Comments