জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা/ অর্ণব সামন্ত

গুচ্ছ কবিতা 
                 
অর্ণব সামন্ত        
               
সত্য ও সমুদ্রমানবী 
                    
সত্য দাঁড়ায় মুখোমুখি একা ডাকাবুকো 
যুদ্ধ শেখায় কৌশলে রমণে রমণে 
রম্য কোষ-স্নায়ু-রক্ত-মেদ-মজ্জা মন্থনে মন্থনে 
সোরা সাইকোসিস সিফিলিস দহনে দহনে 
আহা জ্বালা পোড়া জ্বালা জ্বল জ্বল অগ্নি স্বাহা 
সূর্যের তেজ ঢলে পড়ে ভাবালু চন্দ্রকরতলে 
মারুবেহাগে খরগোশ মুখে নেয় ঘাস মুথাঘাস 
নির্যাস গ্রহণ করে দেয় না কিছুই 
নাহ্ দিয়েছে উজাড় করে উজানে ভাটিতে 
স্রোতস্বিনী মোহনায় সমুদ্র উত্তাল মাতাল 
শব্দের গর্জন বহমান নৈঃশব্দের দিকে 
আদরে আদরে কবুতর বুঝি বা উড়াল দেয় 
সে টের পেয়েছে ভূমিকম্প , সাইক্লোন , বৃষ্টি ধারাপাত 
কাজল পরে আর চোখের নজর বাড়ায় না 
সমুদ্রের ডাগর চোখ পেয়ে যায় সে , দ্রাঘিমাপরির ডানা 
জড়ানো ভাঙা ভাষায় তরতাজা জীবন 
ভাবে জ্যামিতিতে নির্মাণ সম্পূর্ণ করে জ্যামিতির কবিতা 
কবিতার জ্যামিতি তখন মগ্নতা মুগ্ধতায় আগাপাছতলা নিমজ্জমান 
দুরন্ত ভাসানে যাবে অবাধ অবাধ্য হৃদয় নৌকায় 
ফিরেছে নির্ভেজাল অরণ্য ঘরের ভাঙা চালে যুবতীজ্যোৎস্না 
কখনও অক্ষরবৃত্তে , মাত্রাবৃত্তে , স্বরবৃত্তে করে যায় খেলা 
কোষে কোষে চিনে রাখে , স্নায়ুকে স্নায়ু জানে 
বিদ্যুচ্চমকে বিদ্যুচ্চমকে হয়ে যায় সৃজন ও ধ্বংসের পার 
ঘরের ব্যালকনি খোলে , ব্যালকনির ঘর 
দোদুল্যমান জীবনের এক নির্ভার নির্বিকার যাপন‌ 
পদচ্ছাপ যেখানে যেখানে ফ্যালে ভাস্কর্য হয় 
জানি না গ্যালন গ্যালন কবিতা নিয়ে সমুদ্রমানবী 
সংস্কারবিহীনভাবে কিভাবে আলোর সঙ্গম খুঁজে পায় !


              
লালিত্যে সাহিত্যে 
           
সেই তুই লালিত্যে গ্রহণে বুঝিয়েছিলি 
শ্রাবণের ধারাপাতের অগ্নি দাবানলের থেকে ভয়ংকর 
সেই তুই বুঝিয়েছিলি মধ্যদিন ও মধ্যরাতের পার্থক্য 
সেই তুই মধ্যশরীরে অনুভব করিয়েছিলি 
আত্মার সঙ্গে আত্মার সংঘর্ষে পরমাত্মীয় তৃষ্ণা জেগে ওঠে 
যুবতীজ্যোৎস্নার ক্ষুধা জ্যোৎস্না দিয়েই মেটাতে হয় 
সংস্কারের খোলস বদলাতে বদলাতে বদলাতে 
শরীরও পঞ্চভূতে বিলীন হয় জ্যোতিঘন অবয়বের লাস্যে 
সেই প্রথম কথার শরীর ছেনে ছেনে ছেনে 
ভাবনার ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম চিলেকোঠায় 
সেই সময় গুলিয়ে গেছিল মাধ্যাকর্ষণের টানে 
আপেল আপতিত নাকি আপেলের টানে মাধ্যাকর্ষণ আপতিত 
সময়ের সুসময় কুসময় বলে কিছু নেই 
তবু সেই সময়কে মোহর করে দ্রাঘিমাংশ করে 
রেখে দেই হৃদয়ের দেরাজে সাত সাত জন্মের হলুদ ফুল 
সেই তুই মল্লারের বুকে দীপক আনিস 
সেই তুই দীপকের গর্ভে মল্লারের বেনো জলের ছলাৎছলাৎ 
ঝঙ্কারে ঝঙ্কারে বিদ্যুচ্চমকও ফিকে ফিকে লাগে 
নীল নীল বিষ মন্থনে মন্থনে অমৃত কিসসার সুখ 
সেই তুই জীবন ছোট ক্যানে ছোট ক্যানে বলে 
খেদকে নিয়ে যাস সাধ্যের বাইরে অনির্বচনীয় মুক্তির প্রসবে !

🍂


               
তিশানের নারী 


তিশানের নারীর মতন বিকেল আসে 
বাস্তুভিটের ঝাউবনে , প্রান্তরের সবুজ ঘাসে 
বায়বীয় নারী হয়ে ইছামতী উড়াল দিলেই
ভাঙা চালে ভাঙা ঘরে এসে হাজির কিশোরীজোছনা 
রোদ্দুরের ক্রোধ বাড়ে স্রোতস্বিনী প্রশমিত করে 
ফল্গুস্রোতে চুবিয়ে রাখে বেদম ভালোবাসা
অলৌকিক জলযানে চলে যায় জলের গহীনগভীরে 
নিমজ্জনে নিমজ্জনে ডুবুরি তুলে আনে অমল ভাসান
আশ্লেষ ও আবেশের দ্বিপদের তরকারি দিয়ে 
শিউলি সাদা ভাত বাড়ে নারীমাতৃক সভ্যতা তীরে 
সমুদ্র শুকিয়েছে তার তবু জীবন্ত ভিসুভিয়াস 
মগ্নমুগ্ধ করে রাখে লাভার মতন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে জড়িয়ে 
বহমান জীবনে লাবণ্য ফুরালেও আগুন থাকাটা জরুরী 
সেই টেনে নেয় মাধ্যাকর্ষণে , সেই দেয় মুক্তিবেগের ডানা 
সেজানের সাত স্তর খুঁড়ে খুঁড়ে রেমব্রান্টের আলো 
কথ্য সর্বনামে ডাকে হৃদয়ের ঈশ্বরী দরজা খুলে 
ব্যালকনিতে জ্যোৎস্না নামে আড়ি নয় ভাব করতে এসে 
দেরাজে রেখেছে সুখ পরজন্মের জাতককে নিয়ে 
রামধনু কেশে তার সৃজনের বৃষ্টি বিন্দু বিন্দু লেগে 
তখনি জেনেছে সর্বনাশের পরবর্তী সর্বপ্রাপ্তির অমৃতযোগ !

                                                             

       ‌‌        
বেহালাবাদিকা 

একদিন ছিল খরস্রোতা , সুনাব্য 
ষাঁড়াষাড়ির কোটালে প্লাবিত করেছে সমস্ত সংসার 
মিটিয়েছে প্রিয়জন ক্ষুধা , বেড়েছে সাত ব্যঞ্জন 
গেরস্থালিতে মোহমুগ্ধ ভাবব্যঞ্জনায় 
আজ হে ঝড়ের পাখিনি গোধুলির লগ্নে 
বেহালার ছড়ে সুর তুলে লন্ডভন্ড খন্ড করে দিচ্ছ 
যত মেঘ যত স্রোত যত স্বরবিতান 
মজে যাওয়া নদীটির অন্তঃস্থলে ফল্গুস্রোতও নেই 
' নাব্যতা ' শব্দটি হারিয়েছে অভিধান থেকে , শুধু কালো দিগন্তরেখা 
পাখিনি যখন তখন উড়ে যেতে পারে 
নীলকন্ঠ হয়ে অচেনা কৈলাসে , অজানা আকাশে ।


                      
দ্রাঘিমা সিঁড়ি             

পাথরের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে অলকানন্দা 
দ্রাঘিমা স্খলিত করে তোড়ে ভাসায় সমস্ত সমুখ 
খরস্রোতা , সুনাব্য নদী হয়ে পাহাড় পর্বত ছাড়িয়ে 
উপত্যকা পথে ছোটে মালভূমে , সমভূমে ...
তারপর সমস্ত ভালোবাসা নিয়ে ঝপাং সমুদ্রে 
সংসারের দু'কূল ভাসি যায় উজানে উজানে 
ভাটিতে গেয়ে ওঠে ভাটিয়ালি জ্বালা জুড়াতে একান্নবর্তীর 
পাগলি এখনও হৃৎকমল ভাসাতে পারে আশ্লেষে উচ্ছ্বাসে 
গোধূলির অস্তরাগে জ্বেলে দিতে পারে 
নুড়ি নুড়ি সংঘর্ষে চকমকি আলো 
দ্রাঘিমাকে ডাকতে পারে স্খলনে , ধারনে 
একেক নদী নাব্যতা স্রোত ধরে রাখে আজীবন 
আর কবিকে দিয়ে যায় অনন্তের পান্ডুলিপি 
ভালোবেসে , সুগভীর ভালোবেসে 
যুবতীজোছনা অমল ভাসানে ডাকে কবিকে।

Post a Comment

0 Comments