আত্মারাম খাঁচাছাড়া। পর্ব ৩
সবাই বেশ ঘন হয়ে বসে গেছে মনে হোলো বংশীর। ও কথাটা পাড়ল।
দেখুন, আমি অনেক দিন ধরে ভাবছি এখানে এই আঁদাড়ে পচতে থাকাটা কি নোবল আত্মাদের মানাচ্ছে? এ নিয়ে অনেক ভাবলাম কি করা যায়। অনেক যোগাযোগ করলাম। না না আপনাদের সিক্রেট ফাঁস হয় নি। এবার শুনুন মন দিয়ে। আপনাদের জন্য নতুন এক স্কীম ভেবেছি। আগে আপনাদের মতামত চাই। আপনারা আমেরিকা যাবেন?
বলতেই একটা ঘসঘস আওয়াজ অনেকক্ষণ ধরে শোনা গেল। যেন একশটা চামচিকে একসঙ্গে টেক অফ করছে। বোঝা গেল মনে ধরেছে। উত্তরের বদলে প্রশ্ন এল সোজাসুজি।
-আমেরিকার কোথায়?
-কি মুস্কিল আমেরিকা যাবেন এটাই তো অনেক। এই সল্টলেকের এঁদো ফ্ল্যাট থেকে লিবারটীর মূর্তির ওপর দিয়ে উড়ে সোজা হুস আমেরিকা। আবার কোথায় জানতে চান। কেন কোথায় জেনে হবেটা কি শুনি।
-ব্যাপার আছে। আমরা কালিফোর্নিয়ার সিলিকন ভ্যালিতে যাবো না। ওখানে গেলেই কোন এক স্টার্ট আপ আত্মা ডেলিভারী সারভিসেস খুলে ফেলবে, আমাদের আবার আমাজনের চেক আউট করাতে বসিয়ে দেবে। আত্মাকে তো মাইনেও দিতে লাগবে না। কিন্তু আমরা আর কুলির কাজ করতে চাই না। আমরা তো ভূত না। কালো কুচ্ছিত না। রংটাও সাদা।
-সাদা কোথায়? দেখাই তো যায় না।
-ও বুঝবেন না পদার্থ বিজ্ঞানের ব্যাপার। ভূত কালো, আত্মা সাদা, এটাই ইউনিভারসাল ল। মোটমাট আমরা যাবো। কিন্তু বিজনেস ক্লাসে। আর আলাবামা আরিজোনা এসব জায়গায়। বড় বড় ফাঁকা জায়গা। এই ঘিন্জি ঘরে থেকে থেকে গায়ের ব্যথা তো বেড়েই চলেছে।
ভাগ্যিস দেখতে চায় নি টিকিট। আমেরিকা যাবার টিকিট যে ওদের লাগবে না সেটা বোঝাবার একটা প্ল্যান বংশীর মাথায় ছিল। বা বেশি চালাকের মত, কৈ ভিসা দেখি বললে একটু ঝামেলা করতে হত। যাই বলুক আইটির ভূত মানে নাকি আত্মা। ধূস। আত্মা না ছাই? প্রেতাত্মা। মানে ভূত। বংশী প্ল্যান করতে থাকে। ওদের নিয়ে ফেলে আসবে গাজায়। বলব আত্মাদের চাকরি হচ্ছে সেখানে। জায়গাটায় মানুষের থেকে এখন আত্মার সংখ্যা বেশি। কিন্তু সবাই অসুস্থ। হাত পা নেই, পোড়া পোড়া শরীর। আর বড্ড বেশি বাচ্চা আত্মা। সেখানে এখন বাংলা থেকে আমদানী সচ্ছল গাঁট্টা গোট্টা আত্মার অনেক কাজ। রোজ টিভিতে দেখায় লোকে লাইন দিচ্ছে।
🍂
গাজায় নাকি রোজ দেওয়ালি। কোন ডেসিবেল গ্রীন এসব ঝামেলা নেই, সারাক্ষণ বোম ফাটছে। মিসাইল উড়ছে আর দুমদাম মানুষ ফাটছে বেলুনের মত। সেটা দুঃখের, হাজার হোক একই স্পেসিজ, তবে বিজনেসটা তো বুঝতে হবে। যত বোম ফাটাবে তত কাজ। বাড়ী ভাঙবে স্কুল গুঁড়ো হবে হাসপাতাল উড়ে যাবে। যত ভাঙবে তত সাহেবদের ভিলা বানাতে হবে। আত্মাদের বোম খাওয়ার ভয় নেই। সাহেবদের রং সাদা। আত্মার সাদা। কোন ঝামেলা নেই।
বংশী ফোন লাগালো জামতাড়া জয়েনট জব একাডেমীতে। ইংরিজীতে কায়দার নাম J3A.
আত্মাদের এই খবরটা ঘুণাক্ষরেও দেওয়া চলবে না। ওদের বলা হলো আমেরিকা যাবে। ওরা তো গায়ের ব্যথা ভুলে বিভোর হয়ে গেল। কি সুন্দর সব নাম। মিসিসিপি কানেকটিকাট ঠেকসাস। কতবার সিনেমার দেখা। আর ফিংগার লেক। সেখানে কোনদিন মাছ ফুরোবে না। ভূতের মত কাঁচা মাছ না খেলেও, আত্মাদের খুব মাছপ্রীতি, রোদে শুকিয়ে নিলেই খুব টেস্টি হয়ে যায়। দেবেন তো মাছ খেতে? আত্মাদের প্রবল প্রশ্নের মুখে আত্মাদের জন্য ল্যাপ্টপে ভারচুয়াল ধোসা ভাজতে ভাজতে বংশী আশ্বাস দেয় হবে হবে। সব হবে।
J3Aর জয়েন্ট ভেন্চার আছে মহাসংযোগী জাগরণ সংস্থার সংগে। ওরা ট্রেনিং দেবে এক মাস। তারপর যাবার ব্যবস্থা করবে জাগরণ সংস্থা। বংশী কাঁচা আত্মা সাপ্লাই দেবে । একশো আত্মা সাপ্লাই। কোটেশন দিলো। । দরদাম হলো। ঠিক হলো শ্রাবণের পুণ্য মাসে যাত্রা হবে।
এডভান্স পেমেন্ট পেয়ে বংশী ঘোষণা করে সামনের মাসে শ্রাবণী অমাবস্যাতে আমরা আমেরিকা যাচ্ছি। প্রচুর ভারচুয়াল পাকোড়া ভাজল ল্যাপ্টপে। আত্মারা সেগুলো কচমচ করে খেয়ে প্ল্যান করতে বসলো আমেরিকায় কেমন মজা করবে। বড় বড় ভাঙা গাড়ীর জাংক ইয়ার্ডে বিএমডব্লু পোরশে এসব গাড়ীর আত্মা ড্রাইভ করবে চাঁদনী রাতে। এই বংশীবদনের এঁদো ফ্ল্যাটে আর থাকতে হবে না।
প্যাক করতে অসুবিধে হলো না। প্যাকিং মেটিরিয়াল আর কুইক আত্মা পিকার J3A থেকেই পাঠিয়ে দিল। দুটো অংশ। একটা মাইক্রোওয়েভ ইন্ফ্রা রেড প্রুফ কুচকুচে কালো থলি। আর একটা হ্যান্ড হেল্ড ভ্যাকুম ক্লীনার। ক্লীনারের মুখটা সফট প্লাস্টিকের তৈরী। গোল। লাল। ভিতর দিকে টেপার করা। আগেই ওরা একটা অডিও পডকাস্ট পাঠিয়েছিল। তাতে সুন্দর করে বাংলায় বচ্চন সাহেবের ডিপ ফেক ব্যারিটোন ও বাচনভন্গীতে বোঝানো আছে কি ভাবে তাদের ট্রান্সপোর্ট ভেহিকলে বোর্ডিং হবে, কিভাবে খুব অল্প স্পেসে তাদের গাদাগাদি হবে একটু কিন্তু সেটুকু কষ্ট তো আমেরিকা যাবার জন্য করতেই হবে।
স্ স্ স্ স্।
পা টিপে টিপে ঢুকে পড় এই ব্যাগটার মধ্যে। এটাই তোমাদের ট্রান্সপোরট ভেহিক্ল । টুঁ শব্দটিও নয়। একদম চুপ । লাইন করে দাঁড়াও। এক এক করা ঢুকে পড়। বংশী নির্দেশ দিতে থাকে আর আত্মারা এক এক করে ঢুকে পড়ে থলির মধ্যে।
বংশী চট করে থলির মুখটা খুব ভালো করে বেঁধে ফেলে । তারপর সদ্য কেনা ট্যুরিস্টারের মধ্যে সেঁধিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে প্লেন ধরতে। এয়ার ইন্ডিয়া ডাইরেক্ট প্লেন তেল আভিভ। দিনে চারটে। বেশিরভাগ প্যসেন্জার আত্মা, তাদের ভিসা আছে, আত্মাস্থানের পাস্পোরট আছে। বংশীর মত ইল্লিগ্যাল পাচার নয়। সাপ্লাই দিতে কিছু মানুষও আছে। আট ঘণ্টার ফ্লাইট খুব বোরিং। মাঝে একবার চিকেন কারি রাইস দিয়ে গেল লাঞ্চে। বংশী বেশ ঘুমিয়ে পড়েছিল খাবার খেয়ে, হঠাত ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বুঝল প্রায় চলে এসেছে আর প্লেন নীচে নামতে শুরু করেছে।
প্লেন ল্যান্ড করার আগেই হঠাৎ প্লেনটা ধপাস করে নেমে গেল অনেকটা। একজন দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গছিল, সে সোজা উঠে ধাক্কা খেল লাগেজ র্যাকে। একটা দাঁত ছিটকে গেলো। বংশী জানে এরকম এয়ার পকেট মাঝে মাঝেই হয়, কোন ব্যাপার নয় কিন্তু যার দাঁতটা গেল, সে এক উতসাহী এক মহিলা রিপোরটার। সে কাঁদতে লাগল, এদিকে মাইক বা জনঘোষণাযন্ত্রে যা শোনা গেল তা সবাইকেই কাঁদিয়ে দেওয়ার মত। একটা মিসাইল নাকি প্লেনের পাশাপাশি সাঁতার কাটছিল তাই প্লেন অটোকারেকেট করেছে। পাইলটের কোন দোষ নেই। এয়ার পকেটও নয়। শুনে আশ্বস্ত হওয়া গেল কিনা বংশী ঠিক বুঝল না। ফিসফিসিয় করে বস্তাকে বলল এসে গেছি। প্রবল নড়াচড়ার আওয়াজ হতে বংশী বলল স্ স্ স্। ল্যান্ড করার সময় চুপচাপ থলের মধ্যে বসে থাকো।
নীচে নেমে একের পর এক প্রতিবন্ধক। কন্ট্যাক্ট গায়েব । কথা ছিল প্ল্যাকার্ড নিয়ে থাকবে। কিন্তু কোথায় কি। হোয়াটসাপে উত্তর এলো সে আর এদিকে নেই, উড়ে গেছে মিসাইলে। কাদের? বলা যাচ্ছে না। হামস না হেজবোল্লা যে কেউ হতে পারে। এদিকে ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটে গেছে। সবাইকে লুকিয়ে একটা ডিগিং সাইটে খনিজ গ্যাসের খোঁজ চলছিল, মিসাইল প্লেন মিস করে সেখানে ঢুকে পড়তে চারদিকে আগুন ধরে গেছে। আর মাটির নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছে এল পি জির বদলে এসিডের স্রোত। লক্ষ লক্ষ গ্যালন সেই কেমিক্যাল বেরিয়ে এসে বালির ওপর ধীরে ধীরে তৈরি করেছে একটা বিশাল লেক, সেখানে গ্যাসের ধাক্কায় ঢেউ উঠছে বড় বড়, সেই ঢেউ এসে পৌঁছে গেছে এয়ার পোরটের চারদিকেও।
সত্যি? বংশী একবার চোখ রগড়ায়। এয়ারপোর্টের কাঁচের জানলা দিয়ে দেখতে পায় ধীরে ধীরে লাল রঙে ভরে যাচ্ছে চারদিক। লাল টকটকে এসিড। সোনা গলানো এসিড। মাইকে ঘোষণা হয় ড্রোন আর্মি চলে গেছে ড্যামেজ সারানোর জন্য। কোন চিন্তা নেই। হামানটাশেন আর কফি পাওয়া যাচ্ছে কাফেতে।
হঠাৎ খেয়াল হয় হাতের থলিটি খুলে গেছে আর তার থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসছে সাদা সাদা চামচিকের মত ভারত থেকে ইম্পোর্ট করা আত্মা। সর্বনাশ। কাস্টমস জানলে তো সোজা জেল। সরকারী চ্যানেল ছাড়া আত্মার চোরাচালান বেআইনী। চারদিকে নোটিশ দেওয়া আছে।
থলের মুখ খুলতেই হুড়মুড় করে সবাই ছুটতে শুরু করল। দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য। কোথায় যাবে? আরে এদিকে তো সমুদ্র। রেড সি রাস্তা করে দিচ্ছে না। দূর সিনাই পাহাড়ে কেউ কি দাঁড়িয়ে আছে তার দশটা উপদেশ নিয়ে, তাও নয়। এ তো জল নয়, এসিড, সোনা গলানো এসিড, একোয়া রিজিয়া। এদিকে এসো, যেওনা, উদ্ভ্রান্তের মত বংশী চিৎকার করতে থাকে।
কে কার কথা শোনে। হাজার হাজার আত্মা কলম্বাস হয়ে আমেরিকা আবিষ্কার করার আনন্দে আত্মহারা। দৌড়ে দৌড়ে ঝাঁপ দিতে লাগল লাল টকটকে এসিডে। কিসের আশায়, কে জানে।
এই এই এই কোথায় যাচ্ছো। পালাচ্ছো কেন?
বংশী অসহায় ভাবে চেয়ে চেয়ে দেখে এত পাখী পড়ানো একেবারেই বৃথা গেল। সবাই ছুটতে শুরু করল। হুড়োমুড়ি ঝাপ্টাঝাপ্টির চোটে পা ফস্কে ভীড়ের ঠেলায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল বংশী। যেতে যেতে একজন বলে গেল অত ভাববেন না, আমরা ঠিক রাস্তা করে নেবো। দেখবেন নদী দুভাগ হয়ে দুটি স্রোত হয়ে দাঁড়াবে, জল সাহসই করবেনা উচ্ছসিত হতে। বংশীর খেয়াল হল এ সেই এ আইএর অধ্যাপক। পুরস্কারপ্রাপ্ত। যশস্বী। হাঁসজারু নিয়ে গবেষণা ছিল। তারো চাকরি খেয়ে নিয়েছিল এ আই এসে। মনটা খারাপ লাগে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়, একের পর এক ঝাঁপ দিচ্ছে, একটার পর একটা বৃত্ত তৈরি হচ্ছে, তারপর মিশে যাচ্ছে বহমান তরলে। নদী দু ভাগ হচ্ছে না। রাস্তা করে দিচ্ছে না ওপারে যাবার। সে কি কোন মেসাইয়া নেই বলে? । তার কি আসার সময় হয়নি এখনো?
-শেষ-
0 Comments