জ্বলদর্চি

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৯ / সালেহা খাতুন

SAM  ওয়ার্কশপের কোঅর্ডিনেটর সোমা দেবরায়ের সঙ্গে আমরা।

শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৭৯ / সালেহা খাতুন 

এক পণ্ডিতপ্রবর বন্ধু লিখেছেন জীবন নিয়ে তিনি খুব একটা ভাবেন না। কেননা জীবনের বেশির ভাগটাই তো অতীত আর ভবিষ্যতে কী আছে জানি না। অতএব অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে আমার ফের একটু দ্বিধা জাগলো। কিন্তু বন্ধু-কলিগ ইতিহাসের অধ্যাপক অপর্ণীতা ভট্টাচার্যের একটি বাক্য অনুপ্রাণিত করলো – “ইতিহাসকে কথা বলানো সহজ কাজ নয়”। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগানোর মতোই অতীত খুঁড়ে খুঁড়ে নিজেকে দেখার আয়না নির্মাণ করছি আর সে আয়না সায়েন্স সিটির সেই সব বিচিত্র আয়নার মতোই। কখনও নিজেকে খাটো করে দেখি, কখনও সে আয়না লার্জার দ্যান লাইফের গল্প বলে, কখনও ভয়ে কেঁপে উঠি আর ছবি বেঁকে বেঁকে চলে। 

দর্পণে যে সব প্রতিবিম্ব নির্মিত হয়েছিল, তাতে মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা একটু বেশিই ছিল। বলি কম শুনি বেশি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের স্কলাররূপে অনেকগুলো সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছি। ২০০৮ এর মার্চের পঁচিশ-ছাব্বিশে “শতবর্ষের আলোয় মানিক ও বুদ্ধদেব” শীর্ষক সেমিনারে যোগ দিলাম। এসব আলোচনাচক্রে যেতে অধ্যক্ষের অনুমোদন অপরিহার্য। প্রায়ই অধ্যক্ষ ছাড়তে চাইতেন না, কেননা ঐ সেমিনারে বক্তা অশোকবাবু(বীতশোক)। ফলে শ্রোতারূপে আবার আমি যদি যাই, তাহলে ক্লাস হ্যাম্পার হবে। ফলে যেসব সেমিনার আমার অফ ডে অথবা রবিবারে হতো সেগুলিতেই বেশির ভাগ অংশ নিয়েছি। “শতবর্ষের আলোয় মানিক ও বুদ্ধদেব” আলোচনাচক্রে অধ্যাপক বিপ্লব চক্রবর্তী, অধ্যাপক অশোক ভট্টাচার্য এবং অধ্যাপক রবীন পাল ছিলেন বক্তা।

🍂

এসব সেমিনারে নীলাঞ্জনার সঙ্গে প্রায়ই যোগ দিতে ছুটেছি। এবার সুযোগ এলো ওর কলেজে যাওয়ার। ২০০৮ এর দশ এপ্রিল গেলাম নাড়াজোল রাজ কলেজে। যোগ দিলাম ওর আয়োজিত “মেদিনীপুরের লোকশিল্প ঐতিহ্য সম্ভাবনা বিলয় এবং নবীকরণ সম্ভাবনা”
শীর্ষক আলোচনাচক্রে। গহনাবড়ি, পটচিত্র, খোটান পরব আরো নানান বিষয়ে চর্চা চলেছিল। নভেম্বরের একুশ বাইশে “বহুভাষী ভারতীয় সমাজ ঔর সংস্কৃতি কি একতা- হিন্দি ঔর হিন্দিত্তর” নামক আলোচনাচক্রে আবার গেলাম বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসলে সেই সময়ে প্রায় দিনই বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হতো। স্কলার হিসেবে যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে তখন ২০০৮ এবং ২০০৯ – এ বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি অধ্যাপকরূপেও পড়াতাম। পড়িয়েছি “পুতুল নাচের ইতিকথা” এবং সুনীতিকুমারের কয়েকটি প্রবন্ধ। ফলে ঐ সামান্য কয়েকটি ক্লাস আর সামান্য সময়ে শিক্ষার্থীদের ঘরের লোক হয়ে উঠতে পারি নি অতিথিই থেকে গেছি। তবে এটাই আনন্দের যে, সেই সময়ের শিক্ষার্থীদের একজন অধ্যাপক হয়ে ২০১৫ তে আমার মেদিনীপুর কলেজে সহকারী অধ্যাপকরূপে জয়েন করে। ছাত্র আমার সহকর্মী হয়ে গেল। এর থেকে বড়ো প্রাপ্তি আর কী আছে। বিভাগীয় প্রধান এবং পিজি কোঅর্ডিনেটরও হয়েছে সে। তার অধীনেই এখন কাজ করছি। সে অধ্যাপক রবীন্দ্র শীট। 

অধ্যাপক রঞ্জিত আদকও আমার ছাত্র। আমার এন. এস. এস. ভলান্টিয়ার আর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে তাকে আমি আমার কন্যার অগ্রজ রূপেই দেখি। শ্রীকান্ত, শুভদীপও আছে এই তালিকায়। শুভদীপকে কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় দুজায়গাতেই ছাত্ররূপে পেয়েছি। আমার এন. এস. এস.কে ওরা সমৃদ্ধ করেছে। ক্যাম্পে ও অন্যান্য সেমিনারে ভলান্টিয়ার-শিক্ষার্থীদের এবং বিভাগ থেকে বেলপাহাড়িতে ফিল্ড সার্ভেতে গিয়ে ঐ অঞ্চলের কচিকাঁচাদের শুভদীপ বিভিন্ন সময় আবৃত্তির কলাকৌশল শিখিয়েছে। আর ক্যাম্পে শ্রীকান্তের ভূমিকা ছিল অনন্য। নানান দায়িত্ব পালনের মাঝেও আমার এবং মণিশ্রীদির ঘরের মানুষদের খাওয়াদাওয়ার দেখভালে তীক্ষ্ণ নজর রাখতো। ওর কেশপুরের কলাবাগান গ্রামের বাড়িতে ওর বিয়েতে যোগ দিয়েছি সপরিবারে। ছাত্র চিন্ময় পাল ছিল বেস্ট ভলান্টিয়ারদের অন্যতম একজন। ক্যাম্পের বাজার করা, খাবার পরিবেশন করা অত্যন্ত নিপুণ হাতে করতো। 


আমার আর এক ছাত্র উজ্জ্বল কলেজ হোস্টেলে থাকতো আর এন. এস. এস. ভলান্টিয়ারও ছিল। কলেজ ছুটির সময় আয়োজিত ক্যাম্পে ওরা যাতে হোস্টেলে থাকতে পারে, কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করে অনুমতি নিয়ে রাখতে হতো। এই অনুমতি অন্যান্য কাজেও নিতে হতো। একবার প্রচণ্ড বিরক্তিতে মন ভরে যায়। যে বার ভিসি এসেছিলেন ক্যাম্পের উদ্বোধনে, সে বার সারাদিন ধরে সেমিনার হল সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে সন্ধেতে কোয়ার্টারে ফিরে যাই। সকালে কলেজে এসে দেখি রাতারাতি রেনোভেশনের নিমিত্ত সেমিনার হলের দরজা জানালা দেওয়াল সব খুলে দেওয়া হয়েছে। রেগে গিয়ে অধ্যক্ষ প্রবীরকুমার চক্রবর্তীকে ফোন করলাম। বললাম, স্যার আগাম অনুমতি নিয়ে কী লাভ হলো। এই রেনোভেশনের কাজ এক সপ্তাহ পরে করলে কী এমন ক্ষতি হতো? এন. এস. এস. তো কলেজেরই আমার পৈতৃক সম্পদ তো নয়। একটা ক্যাম্প আয়োজনে কতটা অমানুষিক পরিশ্রম থাকে সে দায়িত্ব যাঁরা পালন করেছেন তাঁরাই জানেন। মাননীয় ভিসি নন্দদুলাল পড়িয়া আসবেন। এজন্য আমাদের একটা পরিপাটি জায়গা দরকার। এখন যেখানে কন্ট্রোলার সেকশন সেটি তখন বিরাট হলঘর রূপে সদ্য নির্মিত হয়েছে। ৬০০ টাকা লেবার চার্জ দিয়ে হল পরিষ্কার করে ওখানেই দশ দিনের জন্য ক্যাম্পের বিভিন্ন কাজকর্ম চলতে লাগলো। 

২০০৯ এর ফেব্রুয়ারি আর মার্চের বেশ কয়েকটা দিন আবার বিভিন্ন সেমিনার আর ওয়ার্কশপ উপলক্ষে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কেটে গেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ স্কলার অ্যাসোশিয়েশন আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার “হায়ার এডুকেশন এন্ড এপ্লয়বিলিটি” তে যোগ দিলাম সাতাশ ফেব্রুয়ারি। এদিকে মার্চের সাত আট আমার নিজের কলেজে ন্যাক আয়োজন করলো “রোল অফ আইকিউএসি অন কোয়ালিটি এনহ্যান্সমেন্ট এন্ড কোয়ালিটি সাসটেনেন্স ইন হায়ার এডুকেশন” শীর্ষক সেমিনার। তেরো মার্চ  বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আয়োজিত “শতবর্ষে তিন কবি : বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য” শীর্ষক সেমিনারে কবি অরুণ মিত্রের কবিতার ওপর একটি পেপার প্রেজেন্ট করলাম।
হাসিমুখের এই কন্যাটির হাতেই দিয়ে যাই NSS  এর ব্যাটন।

২০০৯ এ হায়ার এডুকেশন সংক্রান্ত নানান সেমিনারের পাশাপাশি এবার ইউ জি সি আয়োজন করলো “ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ওয়ার্কশপ অফ উইমেন ম্যানেজারস ইন হায়ার এডুকেশন”। মার্চের তেইশ থেকে সাতাশ পর্যন্ত ভি ইউ তে হয়ে গেল এই ওয়ার্কশপ “সেনজিভিটি, অ্যাওয়ারনেস এবং মোটিভেশন” সংক্ষেপে স্যাম ওয়ার্কশপ। এই পাঁচ দিনের ওয়ার্কশপ আমাদের গড়ে পিটে নিল। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর সর্বাণী চৌধুরী, টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. লতা নারায়ণ, ইউনিভার্সিটি অফ বরোদার অবসরপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলার প্রফেসর পদ্মা রামচন্দ্রন,অ্যাসিসটেন্ট ট্রেনার সুতপা নিয়োগী, মাস্টার ট্রেনার ড. মুকুল সেনগুপ্ত, সরোজিনী নাইডু কলেজের ড. সোমা ঘোষ, রবীন্দ্রভারতীর অধ্যাপক রাজশ্রী বসু, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন স্টাডিজের অফিসার সর্বাণী গোস্বামী প্রমুখ আমাদের ট্রেনিং দিলেন বিভিন্ন বিষয়ে। উইমেন স্টাডিজ পার্সপেক্টিভ, উইমেন এন্ড গভর্নেন্স, উইমেন এন্ড অ্যাকাডেমিক লিডারশিপ, লিগাল এমপাওয়ারমেন্ট অফ উইমেন, পার্সোনাল এন্ড প্রফেশনাল রোলস, উইমেন এন্ড রিসার্চ বিভিন্ন বিষয়ে বেশ গভীর জ্ঞান অর্জন করি আমরা আর কর্মক্ষেত্রের নানাবিধ কাজ দক্ষ হাতে সামলাতে থাকি। মেদিনীপুর কলেজ থেকে আমরা ছজন- মাধবীদি, ব্রততীদি, অন্নপূর্ণা, অপর্ণীতা, আমি এবং মণিশ্রীদি অংশগ্রহণ করি। অপর্ণীতা এবং মাধবীদি পরে মাস্টার ট্রেনার রূপে অন্যত্র ট্রেনিং দিয়েছে। এই যে আমরা কর্মক্ষেত্রে দাপটের সঙ্গে টিকে আছি তার খানিকটা স্যাম ওয়ার্কশপ দিয়েছে বৈকি। 

ওদিকে এন. এস. এস-এ আমাদের সময়কাল শেষ হলে ব্যাটন দিয়ে গেলাম অপর্ণীতার হাতে। সঙ্গে ছিলেন মমতা রহমান জানা, ড.স্বপন কুমার শী এবং ড.ইন্দ্রনীল মান্না। আমাকে ওরা পরে এন এস এস ডে উদযাপনে বক্তারূপে আহ্বান করে। সেটি অনেকটা আমার এন. এস. এস. থেকে ফেয়ারওয়েল নেওয়ার সম্ভাষণের মতোই ছিল। কিন্তু এন. এস. এস.  গভীরে প্রোথিত করে দিল মানুষ হওয়ার শিক্ষা আর দিল মনুষ্যত্ব অর্জনের দীক্ষা।

(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments