মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৩৮
দেবাশিষ চক্রবর্তী (আবৃত্তিশিল্পী, কবি, কোলাঘাট)
ভাস্করব্রত পতি
স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী পালিত হবে - তখন মাত্র কয়েকদিন হল ও স্কুলে যাচ্ছে। ওর বায়না অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার। হাতে বেশি সময় নেই। মা ওকে শিখিয়ে দিলেন -
"ফুল কহে ফুকারিয়া, ফল ওরে ফল,
কতদূরে রয়েছিস, বল মোরে বল।
ফল কহে, 'মহাশয় কেন হাঁকাহাকি
তোমারই অন্তরে আমি নিরন্তর থাকি।"
ওর প্রথম স্টেজে উঠে আবৃত্তি করা। কিন্তু ঐটুকু বয়সেই কী স্টেজ ফ্রি। গট্ গট্ করে স্টেজে উঠলো। সুন্দর করে বললো। তারপর বলার শেষে নমস্কার করে বেরিয়ে এল। সেই বুঝি ছোট্ট দেবাশিসের 'নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ' হ'ল। সেদিন থেকেই শুরু হল বিরল পথে এগিয়ে চলা।
এভাবেই নিজের ভাই দেবাশিষ চক্রবর্তীর প্রথম স্টেজ আবৃত্তি ক্ষনের বিবরণ তুলে ধরেছেন দিদি ড. কবিতা চক্রবর্তী। সেই ছোট্ট দেবাশিষ আজ পূর্ণবয়স্ক দেবাশিষ। তাঁর মাধুর্যময় কন্ঠের আবৃত্তিতে গর্বিত হয়েছে মেদিনীপুর। আলোড়িত হয়েছে আবৃত্তির জগত। আলোচিত হয়েছে প্রতিভা। এই আবৃত্তিকে পাথেয় করেই দুই মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকায় অবাধ বিচরণ তাঁর। জেলা এবং জেলার বাইরেও তিনি তাঁর কন্ঠের ছাপ রেখেছেন অগুনতি অনুষ্ঠানে। অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীদের জারিত করেছেন সুমধুর স্বরক্ষেপনের মাধ্যমে। তিনি আবৃত্তিচর্চায় আলোকিত করেছেন পুরুলিয়া, কোলাঘাট, আদ্রা, ডিমারী, তমলুক, রাধামনি, মেছেদা, মেদিনীপুর শহর, ভোগপুর, সুলোচনা, সাঁওতালডিহির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। আজ টানা ৪৪ বছর ধরে কবিতা আবৃত্তির সঙ্গে আচ্ছাদিত রেখেছেন নিজেকে আবৃত্তির সাথে মজে থেকে, প্রেম করে, ভালোবেসে। দীর্ঘদিন আবৃত্তি শিল্পের সাথে জড়িয়ে থাকলেও কখনও নামের পেছনে দৌড়াননি। যদিও তিনি এখনকার বহু নামি দামী শিল্পীর স্নেহধন্য।
লাবনী সরকারের সঙ্গে
১৯৫৮ এর ১৬ ই জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আবৃত্তিকার দেবাশিষ চক্রবর্তী। বাবা ফণীভূষণ চক্রবর্তী এবং মা লীলা চক্রবর্তী। বাবা ছিলেন পেশায় শিক্ষক এবং নেশায় একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। সাহিত্যপ্রীতির জন্য একাধিকবার চাকরি ছেড়েছেন, জমি বেচেছেন, গয়না বেচেছেন। সেই পরিবারের সন্তান দেবাশিষও বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন আবৃত্তিকে ভালোবেসে। মায়ের কাছেই শিখেছেন প্রথম কবিতা বলা। ১৯৮০ সাল থেকে শুরু আবৃত্তি চর্চা। আবৃত্তিচর্চার গুরু হিসেবে মানেন জগন্নাথ বসু, স্বরাজ বসু, শিবসুন্দর বসুকে। আবৃত্তির প্রতি নিরেট অনুরাগ এঁদের সান্নিধ্যে থেকেই। আর বিশিষ্ট শিক্ষকনেতা তাপসকান্তি রাজপণ্ডিতের অনুপ্রেরণায় সুন্দর হাতের লেখার প্রতি আকৃষ্ট হন। হাতের লেখা নিয়েও চর্চা করেন নিয়মিত।
যেকোনো পত্রিকা পড়তে ভালোবাসেন কবি আবৃত্তিকার দেবাশিস চক্রবর্তী
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নাটকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। একসময় আকাশবাণীর যুববাণীর নাটক বিভাগে চাকরি করেছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। ১৯৮৫-১৯৮৮ পর্যন্ত তিনি আকাশবাণী কলকাতার নাটক বিভাগের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন। এরপর আবৃত্তিই হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের অন্যতম ভালোবাসা। একসময় 'উল্টোরথ' এবং 'নবকল্লোল' পত্রিকায় প্রুফ রিডিং করেছেন। কিন্তু আবৃত্তির প্রতি অনুরাগ তাঁকে এখানে আটকে রাখতে পারেনি। 'সাহিত্য সংসদ' প্রকাশনীতেও একবছর প্রুফ রিডিং করেও সবকিছু ছেড়ে মিশে যান স্বরচর্চার জগতে। আজ মেদিনীপুরের বুকে আবৃত্তি চর্চার বাড়বাড়ন্তের পেছনে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি যেন আবৃত্তির 'হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা'।
স্বাগত ২০২৫
তিনি একাধারে আবৃত্তিকার, অন্যদিকে আবৃত্তি প্রশিক্ষক, শ্রুতিনাটক শিল্পী, আবৃত্তির বিচারক, আবৃত্তি কর্মশালার প্রশিক্ষক, সঞ্চালক। আজ আবৃত্তির পাশাপাশি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা এবং শ্রুতি নাটকেও বলীয়ান তিনি। আসলে এইএইসব তিনি অর্জন করেছেন পারিবারিকভাবেই। ছোট থেকে সাংস্কৃতিক আবহে আবর্তিত হয়েছেন। ছোটবেলার সেইসব স্মৃতি হাতড়ে ড. কবিতা চক্রবর্তী লিখেছেন, "ছোট্ট থেকেই আমার ভাইটির ছন্দের প্রতি তীব্র আকর্ষণ। কান সজাগ, দোলনায় দোল দিতে দিতে মা যখন ঘুম পাড়ানি গান গাইতেন - 'উড়কি ধানের মুড়কি দেব, পথে জল খেতে'। ওর চোখ থেকে ঘুম পালাত। ওইটুকু বয়সেই 'উড়কি ধানের মুড়কি' শুনেই ও উৎফুল্ল হয়ে উঠতো। পরে যখন একটু একটু কথা বলতে শিখল, তখন ওই পংক্তিটি শুনলেই বলতো- 'আবাৎ বল, আবাৎ বল', অর্থাৎ কিনা 'আবার বল, আবার বল"।
১৯৯০ সালে গড়ে তোলেন 'আবৃত্তিতীর্থ' নামে আবৃত্তির স্কুল। শুরুতে বিনা পারিশ্রমিকে এলাকার দুঃস্থ আবৃত্তি শিল্পীদের শেখাতেন। এখনও শিখিয়ে যাচ্ছেন নামমাত্র পারিশ্রমিকে। এই মুহূর্তে অবিভক্ত মেদিনীপুরের সাতটি আবৃত্তি স্কুলের সাথে যুক্ত তিনি। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এমন কোনও বিখ্যাত আবৃত্তি শিখন সংস্থা নেই, যেখানে দেবাশিস চক্রবর্তীর ছোঁয়া নেই। বর্তমানে দুই মেদিনীপুরে প্রায় পাঁচশো শিক্ষার্থীকে আবৃত্তির নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেন তিনি।
কবিতা লেখায় মগ্ন দেবাশিস চক্রবর্তী
স্কুল জীবনে অষ্টম শ্রেণী থেকে একাদশ শ্রেণী পর্যন্ত স্কুল ম্যাগাজিন 'রূপায়ন' এর সম্পাদক ছিলেন। কলেজ জীবনে চুটিয়ে সাহিত্য চর্চা করে গিয়েছেন। কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে কবিতা লিখতেন আর পত্রিকা প্রকাশ করতেন। ১৯৭৬ সালে তাঁর সম্পাদিত 'জোনাকি' পত্রিকা ছিল হট ফেভারিট। এর সহযোগিতায় ছিলেন দিব্যগোপাল ঘটক। সেইসাথে মুখে আওড়াতেন -- 'ওই ক্ষেপেছে পাগলী মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই / অসুরপুরে শোর উঠেছে জোরসে সামাল, সামাল ভাই'। বন্ধুদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন 'কামালপাশা' খ্যাত আবৃত্তিকার। পরবর্তীতে যুক্ত হন 'প্রত্যাশা' পত্রিকার সাথে। ২০০৬ সালে পূর্ব মেদিনীপুর থেকে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করতে থাকেন 'আবৃত্তি সংবাদ' নামে একটি মাসিক আবৃত্তি বিষয়ক পত্রিকা। যা জেলায় প্রথম এধরনের পত্রিকা। সহ সম্পাদক ছিলেন শাশ্বতী দে। এখানে প্রকাশিত হয়েছে প্রদীপ ঘোষ, উৎপল কুণ্ডু, জগন্নাথ বসু, পার্থ ঘোষদের আবৃত্তি ভাবনা। মোট ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। আবৃত্তিকে বিষয় করেও যে ভিন্ন স্বাদের পত্রিকা করা যায়, তার ধৃষ্টতা তিনি দেখাতে পেরেছিলেন।
২০১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর সংকলিত 'কবিতা যখন আবৃত্তি' বইটির আজ পর্যন্ত সাতটি এডিশন প্রকাশিত হয়েছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে সময় কাটানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন 'ডাউন মেমোরি লেন'। দেবাশিস চক্রবর্তীর প্রথম আবৃত্তির সিডি 'জীবনের জলছবি'। যা ছিল আধুনিক ও আঞ্চলিক কবিতার একটি মহামূল্যবান সংকলন। যেকোনো আবৃত্তি শিল্পীর কাছে এক শিক্ষনীয় উপাদান।
তিনি পেয়েছেন 'মেদিনীপুরের গর্ব' সম্মান। 'অমিতেশ মাইতি স্মারক পুরস্কার' পেয়েছেন। এছাড়াও আদ্রা আবৃত্তি পরিষদ, মেছেদা স্পোর্টস ইউনিট, সাগরবাড়ের গৌড়িপাড়া রাইজিং স্টার, সৃজনী সাহিত্য একাডেমি, আন্দুলের অনুশীলন আবৃত্তি সংস্থা, তমলুকের ছন্দায়ন থেকে পেয়েছেন বিভিন্ন সম্মাননা।
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, 'দেবাশিষ চক্রবর্তী আমার একজন অত্যন্ত প্রিয় একজন আবৃত্তি শিল্পী। বিগত তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেবাশীষ পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়ে এই শিল্পের প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছেন, সেইসঙ্গে শহর কলকাতার আবৃত্তি সংস্থাগুলির সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। আবৃত্তি সম্পর্কে লেখালেখিতেও দেবাশিস বিশেষ দক্ষ'।
তিনি হলেন সংস্কৃতির বাতিওয়ালা। আবৃত্তির পথপ্রদর্শক। অর্থের জন্য নয়, মানসম্মান প্রভাব প্রতিপত্তির জন্য নয়। একটা শিল্পকলাকে কতখানি হৃদয় দিয়ে ভালোবাসলে এবং সেখান থেকে মনিমুক্তো সেঁচে আনা যায়, তা তিনি দেখিয়েছেন নিজের দক্ষতায় এবং প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে। তাঁর ছত্রছায়ায় থেকে এই শ্রবণশিল্প সম্পর্কে আগ্রহান্বিত হয়েছে বহুজন। আনকোরার মুখেও ব্যাকরণসমৃদ্ধ আবৃত্তির বোল ফোটাতে পেরেছেন একজন সপ্রতিভ আবৃত্তি শিক্ষক হিসেবে। তাঁর দেহের শিরা উপশিরা ধমনী মহাধমনীতে আবৃত্তিশিল্পের অবাধ বাসস্থান। 'হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোনোখানে' কবিতায় কবি দেবাশিস চক্রবর্তী তুলে ধরেছেন নিজস্ব ভাবনা নিজস্ব অনুভব --
'খোড়ো ঘর, নড়বড়ে সিঁড়ি আর একচিলতে বারান্দা
এ নিয়ে অবিন্যস্ত আমার সংসার।
আমি, মানে হাবাগোবা চেহারার ঢ্যাঁড়শমার্কা লোকটা।
এই সংসারে থাকি।
আর ধম্মপুত্তুর যুধিষ্ঠিরের মতন
দিনরাত পাশাখেলা খেলে যাই।
নিশ্চিত পরাজয় জানি
আর জানি বলেই রাজি রেখে খেলে যাই হররোজ।
আসলে এক অনিশ্চিত ভবিতব্যের ওপর
দাঁড়িয়ে রয়েছে আমার জীবন
আর সমাহিত ভূবন জুড়ে
শুধুই অন্ধকার ও যন্ত্রনা।
কখনো সখনো এইসব যন্ত্রনার ভেতর
ফুটে ওঠে দু একটি সুগন্ধি ফুলের মতন
কিছু শুভ্র প্রশান্তি। ঠিক তখনই আমি
ছেড়ে দিয়ে খেলা, লাগাম ধরি কোনও
ছুটন্ত অশ্বের, সে আমাকে নিয়ে যায়
অপার্থিব আনন্দ জগতে --
যেখানে গেলেই আমার জীবনের বেদনার ভার
কমে যায় অনেক'।
🍂
0 Comments