জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনা, সঙ্গীত ও সমাধি /পি.শাশ্বতী

শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনা, সঙ্গীত ও সমাধি

পি.শাশ্বতী

একজন সাধকের সাধনায় অঙ্গাঙ্গী  ভাবে জড়িয়ে আছে সমাধি। সাধনায় পূর্ণ সমর্পণই হল সমাধি। যুগপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের সাধনায় আমরা সেটাই লক্ষ করেছি, জানতে পেরেছি। তাঁর সাধনায় বারবার সেটাই হয়েছিল। এই সাধনা এবং সমাধি একজন সাধকের জীবনে নানা ভাবে আসতে পারে। যেমন সঙ্গীত। সঙ্গীতও সেই সাধনার অঙ্গ হতে পারে। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাববিহ্বল সঙ্গীত ও সংকীর্তনের অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
মহেন্দ্রদত্তের ভাষায়— "পরমহংস মশাই দক্ষিণ দিকের ছোট উঠোনে গিয়া কীর্তন করিতেন। এই সময়...কোঁচার কাপড়টি ফেটি করিয়া কোমরে বাঁধিতেন...। জামাটি গায়ে থাকিত....রামদাদা ও মনোমোহনদাদা প্রথমে কীর্তনের গান আরম্ভ করিলে, পরমহংস মশাই মৃদুস্বরে সামান্য কীর্তন গাহিতেন এবং মাঝে মাঝে করতালি দিতেন। তাহার পর তাঁহার ভাবাবেশ হইত, একেবারে বিভোর হইয়া যাইতেন, তখন ঘাড় একটু ডানদিকে বাঁকিয়া যাইত, চোখ নিমীলিত হইত।
তিনি তখন হাত দুটি সম্মুখের দিকে লম্বা করিয়া প্রসারিত করিতেন এবং ভাবের আবেশে সম্মুখের দিকে কয়েক হাত অগ্রসর হইতেন আবার পিছন দিকে ফিরিয়া আসিতেন। এই নৃত্যের সময় পরমহংস মশাইয়ের মুখ দিয়ে কোন কথা বাহির হত না। তিনি তখন একেবারে ভাবে বিভোর হইয়া যাইতেন, ঘাড়টি বাঁকাইয়া অতি গম্ভীর মুখ করিয়া সম্মুখে ও পিছনে কেবল যাওয়া আসা করিতেন।" 
তাঁর ব্যক্তি সত্তার পরিবর্তনও মহেন্দ্রনাথের চোখ এড়াত না। তখন তাঁর দেহ থেকে যেন আর একটি অতি উচ্চ অবস্থার  ভাবদেহ বিকশিত হত। গন্ধর্ববিনিন্দিত কণ্ঠে মন্দিরে, ঘরে ও ভক্তগৃহে গাওয়া অজস্র গান তাঁর দিনযাপনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। তাঁর কথায়, কাজে, গল্পে, গানে ও নৃত্যে ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুই থাকত না। তিনি যখনই কোনো গাইতেন, সেটি হত প্রাসঙ্গিক ও গভীর অর্থবহ। আমরা জানি, ঠাকুর ছিলেন একজন শ্রুতিধর মানুষ। যে-কোনো কিছুই একবার শুনলেই মনে রাখতে পারতেন। তেমনি কোনো গানও একবার শুনলেই তাঁর কণ্ঠস্থ হয়ে যেত। এই যে বলা হল, তাঁর কণ্ঠে সব সময়ই গান উচ্চারিত হত প্রাসঙ্গিক ও গভীর অর্থবহ। অর্থাৎ ঠিক সময়ে মানানসই গানটি নিবেদন করতেন ভক্তদের কাছে। অনেক সময় যখন একাকী তিনি হয়তো ভাবে বিভোর হয়ে কোনো গান গাইতেন, তখনও সেই গান হয় তখনকার অবস্থার সঙ্গে মানানসই। সব থেকে বড় কথা, তাঁর মধুর কণ্ঠে ভাবাবেগপূর্ণ ভক্তি সঙ্গীত যে একবার শুনত সে আর ভুলত না। বিশুদ্ধ তাল লয়ে আপন ভঙ্গীতে তিনি গানের ভাবটি গাইতেন নিজের করে। 

🍂

রানি রাসমণি ঠাকুরের গান শুনতে খুব ভালোবাসতেন। মন্দিরে এলেই তাঁর অন্যতম আকাঙ্ক্ষা থাকত ঠাকুরের কণ্ঠে গান শোনা। ঠাকুরের গাওয়া “কোন হিসাবে হরহৃদে দাঁড়িয়েছ মা পদ দিয়ে” গানখানি শুনতে রানিমা বড় ভালবাসতেন। গান গাইতে গাইতে চোখের জলে ঠাকুরের বুক ভেসে যেত। ঠাকুরের ভাব সমাধি ঘটত। ঈশ্বর সাধনার অন্যতম পথ যে সঙ্গীত তা রামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপা, রামপ্রসাদ-সহ অনেকেই দেখিয়েছেন। 
‘শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় সঙ্গীত' গ্রন্থে মোট ৩৫২টি গানের উল্লেখ আছে; যার মধ্যে ২৪৭টি গানই কথামৃতের। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বাড়ি গিয়েও তাঁকে ঠাকুর রামপ্রসাদের গান শুনিয়েছেন। যার মূল বক্তব্য, শুধু পাণ্ডিত্যে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না— বিশ্বাস আর ভক্তি চাই। চাই আবেগ। তাইতো প্রবচন আছে  'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর'। গান গাইতে গাইতে তিনি সমাধিস্থ হয়েছেন এবং সেই অদ্ভুত অবস্থা অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে দেখেছেন বিদ্যাসাগরমশাই। 
ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ তোতাপুরীজি ভিন্ন ভাষী হয়েও পঞ্চবটীতে ঠাকুরের কণ্ঠে "জীব সাজ সমরে/ রণবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে..." এবং “দোষ কারো নয় গো মা/ আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা...." গান দুটি শুনে অজস্র অশ্রুপাত করেছেন। পুত্রশোকে কাতর মণিলালও ঠাকুরের কণ্ঠে এই গান শুনে শান্ত হয়েছিলেন।
খুব ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সঙ্গীতপ্রিয়তার একটি সহজাত গুণ ছিলই। কামারপুকুরে তাঁর গ্রামে যাত্রাদলের তিনি ছিলেন অন্যতম সঙ্গীত কুশলী অভিনেতা। পরে কলকাতায় দাদার কাছে এসে তাঁর সেই অভ্যাস প্রায় নির্মূল হতে বসেছিল। কিন্তু মনের খিদে তো আর হারিয়ে যায়নি। তাই, দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিণীর পুজোর দায়িত্ব পেয়ে প্রথম জীবনের সেই ভক্তিসঙ্গীত তাঁর মধ্যে আবার সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর প্রায় ত্রিশ বছর লীলা করেছেন। সেটা ছিল তাঁর মধ্যজীবনের  মধ্যলীলা। প্রথম জীবনে কামারপুকুরে ও শেষজীবনে কাশীপুরে ঘটেছে তাঁর সেই লীলার প্রকাশ। 
তাঁর এই লীলায় ভক্তরা শুধু যে আধ্যাত্মিক আনন্দ ও তৃপ্তি পেয়েছেন তা নয়, সঠিক পথে পরিচালিত হয়েছেন। আর তাই তো আমরা স্বামীজির মতো এক বিশ্ববরেণ্য সন্ন্যাসীকে ভারতবাসীর গর্ব হিসাবে আজ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারছি। তাঁর অসংখ্য গুরুভাইয়ের ওই একই অধ্যাত্ম চেতনার ফসল হিসাবে আজ আমরা যে বিশ্বব্যাপী রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের হাজারও সেবার উদাহরণ চোখের সামনে দেখতে পাই, তার ব্যাপ্তি কি কোনো ওজন পরিমাপ করা সম্ভব!
ভারতীয় সনাতন শাস্ত্র ধর্ম, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতার জীবন্ত আকর। বহুযুগ ধরে ধর্ম, দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা বিভিন্ন ভাব ও মতবাদে সম্প্রদায়ভিত্তিক গোষ্ঠীসমূহের ভিতরে অনেকটা লোকচক্ষুর অগোচরে সাধকের ব্যক্তিগত সাধনা ও সিদ্ধির মধ্য দিয়ে বিকশিত ও সংরক্ষিত হয়ে এসেছে। প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবাদর্শ ইসলাম ও খ্রিস্টধর্ম সমন্বিত হল। এটা ছিল তাঁর জীবনের অদৃষ্টপূর্ব সাধনা, অপরিমিত সিদ্ধি এবং লোকমানসে অভিনব এক নতুন যুগের বার্তা পৌঁছে দেবার অসীম আকুতি। 
ঈশ্বরের ব্যাপ্তি ও কার্যকারণ বোঝা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, তবুও ছোট ছোট ঘটনার মাধ্যমে আমরা কিছুটা হলেও সেই অন্তর্যামীকে উপলব্ধি করে থাকি। বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন মনে করে আমরা ধূলিকণাতেই তাঁকে দর্শন করি। মায়ের কাছে ঠাকুর সাধারণ মানুষের জন্য বলেছেন, "মা, সংসারে যদি রাখো, তো এক-একবার দেখা দিস। না হলে উৎসাহ কেমন করে হবে মা!" মায়ের কাছে তাঁর এই মিনতি থেকেই বোঝা যায় যে, তিনি যে লোকশিক্ষার কথা বলতেন, এটি তারই একটা অঙ্গ। অর্থাৎ মানুষের জন্য ভাবা। মানুষের কল্যাণের পথকে মসৃণ করা।
'আত্মানোং মোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ'। সব সাধনার ইতি হলে শ্রীরামকৃষ্ণের সিদ্ধিরূপ ফল জগৎকল্যাণে নিয়োজিত হবে বলে জগন্মাতা তাঁকে কয়েকটি অনুভূতি দিয়েছিলেন। তার অন্যতম হল, তাঁকে জগন্মাতার যন্ত্র হিসেবে একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্মসম্প্রদায়ের প্রবর্তন করতে হবে। সেই উদ্দেশ্য সাধনে জগদম্বার প্রদেয় একটি বিষয় ছিল শ্রীরামকৃষ্ণকে ভাবমুখে থাকার নির্দেশ প্রদান। সমবেত ত্যাগী ও গৃহী ভক্তের দল শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাদর্শে নিজেদের নিঃশেষে সঁপে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ওই যুগ্ম আদর্শকে জগতে বাস্তব রূপ গ্রহণ করার প্রয়াস করেছেন। আজকের দিনেই তিনি হয়েছিলেন কল্পতরু। প্রণাম ঠাকুর। 

তথ্যসূত্র: 
১) ধ্যানলোকে শ্রীরামকৃষ্ণ-- স্বামী চেতনানন্দ।
২) অনুধ্যান
৩) শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি।

Post a Comment

0 Comments