শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮০
সালেহা খাতুন
সাঁতার একবার শিখলে যেমন কেউ ভোলে না তেমনি যাঁর জীবনে এন.এস.এস.একবার যুক্ত হয়ে গেছে তিনি কোনো দিন এটা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবেন না। যেদিকে চোখ ফেলবেন, মন দেবেন, অমনি এন.এস.এস.এর মহিমা কীর্তন করতে থাকবেন। রাজীব গান্ধী ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ইয়ুথ ডেভলপমেন্ট এবং ন্যাশনাল সার্ভিস স্কিম আয়োজিত “ট্রেনিং অফ ট্রেনার্স অন হিউম্যান রাইটস অ্যাণ্ড সোশ্যাল হারমোনি”তে যোগ দিয়েছিলাম ২০১০ - এর জুন মাসে। নরেন্দ্রপুরে গিয়ে এবারও অনেক মানুষের সংস্পর্শে এলাম। মনের অন্ধকার ক্রমেই দূর হচ্ছিল, এই ট্রেনিং আরো উজ্জ্বল করে তুলেছিল।
আমাদের সময়কালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এন.এস.এস. এর প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর রূপে প্রথম তিনবছর পেয়েছিলাম এমেরিটাস ফেলো ড.অনিল কুমার জানাকে। তিনি চমৎকার একটি পত্রিকা “সমাজ জিজ্ঞাসা” সম্পাদনা করতেন। তাঁর উৎসাহে এই পত্রিকার নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠে ছিলাম। এন.এস.এস.- এর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি এসেছেন আর আমার কলেজের বাইরে কোনো প্রোগ্রাম হলে তিনি বলতেন ভলান্টিয়ারদের নিয়ে তুমিই আসবে। অনেক পোস্টার কম্পিটিশনে আমার কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গেছি। এই উদ্দেশ্যে রাজা নরেন্দ্রলাল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়েও গেছি। পুজোর ছুটিতে এন. এস. এস. এর কাজে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা করতে গেলে তিনি মেয়েকে কী খাওয়াবেন এই নিয়ে ব্যস্ত হলে, মেয়ে বলে - “আমি এমন কোনো জিনিস নেবো না যা খেলে শেষ হয়ে যায়”। স্যার যারপরনাই আনন্দিত হয়ে বললেন, “বাহ্ ,এই টুকু বাচ্চার বোধ দেখে অবাক হচ্ছি”। সঙ্গে সঙ্গে ড্রয়ার খুলে এন. এস. এস. – এর একটি ব্যাচ ওকে পরিয়ে দেন। এন. এস. এস. এর কাজে ও আমার সঙ্গে স্লামে যেতো, ক্যাম্পেও থাকতো। এজন্য শিক্ষার্থী ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে ওর যোগ ছিল নিবিড়। ছোট্ট মেয়েটা বড়ো হয়ে গেছে দেখে ওরা বিস্মিত হয়। আর আমি বিস্মিত হয়েছি, যখন ওর কন্যাশ্রীর টাকা ও নিজের স্কুলে ডোনেট করে। পরিবেশ তাহলে প্রভাব ফেলে! আর এক মেয়ে জাগ্রতির কথা মনে পড়ে গেল। সংস্কৃত অনার্স পড়তো। আমার এন. এস. এস. ভলান্টিয়ার ছিল। আমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকতো। এখন স্কুলে পড়াচ্ছে। ও এখন একটি দারুণ কাজ করছে, ‘জাগরণ’ নামে ছোটো শিশুদের জন্য একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছে। উদ্দেশ্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো। দেবারতি আঢ্য, এন.এস.এস. এর আর এক ভলান্টিয়ার। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, ক্যাম্পে ওর নাচ ছিল অপরিহার্য। ভালো লাগে, ও নাচের স্কুল খুলেছে এবং নিজের নাচ বজায় রেখেছে দেখে। আমার কলেজের রোহনের বোন মৌসুমীও স্লামে গেলে সব সময় আমার পাশে পাশে থাকতো। এন.এস.এস. থেকে ওদের ফিল্ড ভিজিটে একবার আই. আই. টি. ক্যাম্পাসে এবং কর্ণগড় মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই স্মৃতি ও ধরে রেখেছে।
🍂
২০১১- এর কুড়ি জুলাই বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এন. এস. এস. এর তৎকালীন অ্যাক্টিং প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর বর্তমান ডীন অফ আর্টস ড. তপন কুমার দে প্রিন্সিপাল এবং প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটরদের আর একটি ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রামে ডাকলেন। অনেক আলোচনা হলো। কলকাতার এন. এস. এস.- এর রিজিওনাল সেন্টারের ইয়ুথ অফিসার এবং প্রধান পি. পট্টনায়কের একটি কথা মনে গেঁথে গেল। যা আমি অনুসরণ করছি এখনও। তিনি বলেছিলেন আপনারা অনেক কাজ করেন কিন্তু তার ডকুমেনটেশন করেন না। “বন মে মৌর নাচা কিসনে দেখা? এই দেখার ব্যবস্থা করতে হবে”। তো আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকথায় সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।
নিজেকে ভালো রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে নিজেকে ব্যস্ত রাখা। ২০১০-এ এতো বেশি কাজ করেছি, নিজের জীবনী শক্তি এমন বিপুল পরিমাণে ক্ষয় করেছি দেখে এখন শিউরে উঠি। কিন্তু এম.এ. ক্লাসের সহাধ্যায়ী বন্ধু নন্দিতা এপ্রসঙ্গে আমাকে বলেছিল, দেখ, “তখন তো আনন্দ করেই কাজগুলো করেছিলি, তার গুরুত্বও কম নয়”। ঐ বছর ২০১০ – এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন চলছিল, কলেজে এবং কলেজের বাইরে নানান কাজে নিয়োজিত রেখেছিলেন আশপাশের মানুষজন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পর্যায়ের নানান প্রতিযোগিতা – বাগ্মিতা, প্রবন্ধ রচনার বিচারকরূপে বিভিন্ন স্থানে উপস্থিত থাকতে হয়েছে। তবে সবথেকে ভালো লেগেছিল আজহারউদ্দিন খান যখন ফোন করে “শব্দের মিছিল”-এর বিশেষ 'রবীন্দ্রনাথ' সংখ্যায় লিখতে বলেন।
২০১০ এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি এবং নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে দুটি রিফ্রেশার্স কোর্সে যোগ দিয়ে নতুন এবং পুরোনো বন্ধুদের ফিরে পেয়ে সত্যি সত্যিই বিশেষভাবে উজ্জীবিত হই। অজস্র বক্তৃতা মালায় নিজেকে সমৃদ্ধ করি। “বাংলা ভাষা ও তুলনামূলক সমীক্ষা” এবং “সাহিত্যতত্ত্ব : সৌন্দর্যতত্ত্ব এবং শৈলীতত্ত্বের প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্য” শীর্ষক এই উজ্জ্বীবনী পাঠমালাদ্বয় যে কেবল পদোন্নতির ক্ষেত্রে কাজে লেগেছিল তা নয় পাঠদানে এবং লেখালেখির ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। আর কোঅর্ডিনেটররূপে দ্বিতীয় কোর্সটির পরিচালক অধ্যাপক ড. সুচরিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দক্ষতা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি। আর কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন বিভাগ ও অনুষ্ঠান পরিচালনায় তা কাজে লাগিয়েছি।
জানুয়ারির কোর্সটিতে নীলাঞ্জনা আমি মেদিনীপুর থেকে সকাল সাড়ে ছটার ট্রেনে প্রায় দিনই কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে গেছি। দশটায় পৌঁছে যেতাম। অন্যরা কাছে থেকেও দেরি করতেন বলে অধ্যাপক বিশ্বনাথ রায় আমাদের কাছে কতবার অভিযোগ করেছেন। আবার শীতের রাতে শুনসান রাস্তায় দুজনে মিলে মেদিনীপুর ফিরেছি। আমাদের পারস্পরিক নির্ভরতা ছিল। প্রায়দিনই বলছি একারণে যে মাঝে মাঝেই ও কোন্নগরে আর আমি বাউড়িয়ায় থেকে গেছি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই কোর্সে অংশ নিয়েছিল। এর আগে ২০০৫ এর ওরিয়েন্টশন প্রোগ্রামেও আমরা একসঙ্গে যোগ দিয়েছিলাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরূপে ও আমাদের জুনিয়র। তবে এই কোর্সদ্বয় আমাদের সম্পর্ক আরো মজবুত করে। ওই প্রথম আমাকে বলে, “সালেহাদি তোমার মাইক সেটিং গলা। তোমার খালি গলায় সাধারণ কথা বলা আর মাইক্রোফোনে কথা বলায় বেশ তফাত আছে”।
২০১০ - এর এপ্রিলে আমি পিএইচ. ডি. অ্যাওয়ার্ডেড হই। মেদিনীপুরের স্পোর্টস কমপ্লেক্সে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনের হাত থেকে কনভোকেশনে সার্টিফিকেট নিই। কিন্তু ছবি তোলা হলেও আমি সংগ্রহ করিনি। ২০০৮ - এর ডিসেম্বরে থিসিস সাবমীট করেছিলাম। অনেক রকম পর্যায় অতিক্রম করে এই ডিগ্রি লাভ। তবে এর জন্য কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা লাভ করিনি। আর আর্থিক বেনিফিটও পাইনি। কিন্তু সম্মান পেয়েছি অনেক। ওয়েবকুটা জুন মাসে সংবর্ধনা দেয়। নরেন্দ্রপুর থেকে হিউম্যান রাইটসের ট্রেনিং নিয়ে যেদিন ফিরেছি সেদিনই এই সম্মান দেওয়া হয় বিদ্যাসাগর টিচার্স ট্রেনিং কলেজের হলে। তিন চার দিন মেয়ে আমাকে ছেড়ে আমার মা-বাবা এবং ওর বাবার সঙ্গে আছে। অতএব আমাকে ফিরে পেয়ে আর ছাড়তে চাইলো না। ওকে সঙ্গে নিয়েই গেলাম। কে কী ভাববেন দ্বিধায় পড়েছিলাম। কিন্তু সব নিরসন হলো যখন শ্রুতিনাথ প্রহরাজ ওকে মঞ্চে ডেকে নিজের ফুলের তোড়াটি দিলেন। মা মেয়ে দুজনের দুটো ফুলের তোড়া হলো। আমার পিএইচ.ডি. আর ওর পড়াশোনা একসঙ্গেই চলেছে কিনা। ও নার্সারি থেকে ক্লাস টু-এ পৌঁছতে আমার পিএইচ.ডি. ডিগ্রিলাভ হলো। আর আমার গর্বিত পিতা আমাকে দশ হাজার টাকা হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি একটি সোনার আংটি কিনে নিও”। বোনকে সঙ্গে নিয়ে পরে গড়িয়াহাটে গিয়ে আংটি কিনে নিলাম।
রিফ্রেশার্স কোর্সের আর একটি স্মৃতি।
পিএইচ.ডি. হয়ে গেছে, কর্মক্ষেত্রে দশ বছরের অভিজ্ঞতাও হয়েছে, পাবলিকেশন বেড়েছে, সেমিনার ওয়ার্কশপ, কনফারেন্স, বিভিন্ন কোর্স প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের সার্টিফিকেটও আছে। অতএব ২০১০-এর নভেম্বরে কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার জন্য অ্যাপ্লাই করলাম। খুব একটা ইচ্ছা ছিল না কিন্তু বড়োদের কথা ফেলতে না পেরে এই আবেদন করি। ইসলামিক কালচারে নলেজ থাকলে প্রেফারেন্স পাওয়া যাবে, বিজ্ঞাপনে এই বাক্য থাকায় সবাই ধরে নিল ওখানে সালেহার নিযুক্তি শুধু সময়ের অপেক্ষা। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারিদিকে রটে গেল সালেহা আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাচ্ছে। যাক গে বাবা, সল্টলেকে গিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম; কিন্তু সে ইন্টারভিউ ক্যানসেল হয় অজানা কারণে। এবারও ইন্টারভিউ দিতে ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরে আবার আমায় ইন্টারভিউয়ে ডাকা হয় কিন্তু আমি আর যাই নি। এর বেশ কয়েক বছর পর রেজাউলদা আমাকে আবার আবেদন করতে বলেন, আমি আর আগ্রহ দেখাই নি। চিরকালই আমার কাছে সুখের চেয়ে স্বস্তি বড়ো। এজন্য কেউ কেউ যখন সালাউদ্দিনের মহত্ব প্রসঙ্গে বলেন আমি তাঁদের বলি আপনারা হাইপ্রোফাইল ছাড়া সঙ্গী নির্বাচন করেন নি আর করতেও পারবেন না, অতএব "এহো বাহ্য, আগে কহ আর"।
২০১১ – এর জানুয়ারিতে আনন্দবাজার পত্রিকায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখেও আবেদন করেছিলাম। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের চিঠি পেয়ে কলকাতায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে নোটিশ দেখি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ইন্টারভিউ পোস্টপন্ড হয়েছে।
তবে কলেজে ২০১০–এ আমার উপর অতিরিক্ত আর একটি দায়িত্ব চেপেছিল। সেটি হলো ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টারের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব। সে ভার পালন করি দুহাজার বাইশ-তেইশ সাল পর্যন্ত। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে প্রথম যখন এই সেন্টারের হয়ে একটি সেমিনারের আয়োজন করে দুশো অভিভাবককে চিঠি পাঠিয়ে প্রতীক্ষা করছি সেমিনারের আগের দিন বক্তা অত্যন্ত তিক্ত স্বরে জানান তিনি আসতে পারবেন না। ব্যর্থ হলাম। ডিপ্রেশনে চলে গেলাম। কিন্তু ব্যর্থতাও অনেক কিছু শিখিয়ে যায়।
(ক্রমশ)
0 Comments