রবীন্দ্র গীতিনাট্যে ও নৃত্যনাট্যে সঙ্গীতের মাধুর্য্য
প্রসূন কাঞ্জিলাল
শিল্পী সৃষ্টির আনন্দে বা প্রেরণাতেই শিল্প রচনা করেন, শিল্পের মূলে থাকে অলৌকিক আনন্দ এবং ঐ সৃষ্টি স্বতউৎসারিত। শিল্প
বিচার করতে বসে অথবা শিল্পের স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে সমালোচক তত্ত্ব,তথ্য, আঙ্গিক ইত্যাদির প্রসঙ্গ তোলেন। বলা বাহুল্য, এসব নিতান্তই বাহ্যিক বিশ্লেষণ। শিল্পী সৃষ্টি করেই খুশী। কোন্ সমালোচক তার মধ্যে
কী তত্ত্ব বা তথ্য খুঁজে পেলেন, তা তাঁর বিবেচ্য নয়। রবীন্দ্রনাথ যখন গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন, তখন তার মূলে ছিল সৃষ্টির ওই আনন্দ বা প্রেরণা। অবশ্য, শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে শিল্পের অনুশীলনজাত অভিজ্ঞতাও মূল্যবান সম্পদ ও উপাদান।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের কয়েকটি উদাহরণ হল:
বাল্মীকিপ্রতিভা (১৮৮১)
কালমৃগয়া (১৮৮২)
মায়ার খেলা (১৮৮৮)
শাপমোচন (১৯৩১)
নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা (১৯৩৬)
নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা (১৯৩৮)
নৃত্যনাট্য শ্যামা (১৯৩৯)
নটরাজ
বস্তুত, গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্যের একটা রসের বা উপলব্ধির দিক আছে, যা এই ধরনের আলোচনার মধ্যে পাওয়া সম্ভব নয় । বস্তুত, আমার মনে হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথের শিল্পী জীবনের প্রথম পর্বের সৃষ্টি গীতিনাট্য এবং শেষ পর্বের সৃষ্টি নৃত্যনাট্যের নির্দিষ্ট সংস্থান আকস্মিক বা পারম্পর্যহীন কোন ব্যাপার নয়। গীতিনাট্য থেকে নৃত্যনাট্য পর্যন্ত যে সৃষ্টিধারা অন্তঃস্রোতের মতো এগিয়ে গিয়েছে, তার মধ্যে এক অদৃশ্য যোগসূত্র রয়েছে বলেই আমার ধারণা। কীভাবে এই যোগসূত্র
রচিত হয়েছে, অথবা তার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের কোন্ বিশেষ শিল্পচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়, এই আলোচনার লক্ষ্য বা উপজীব্য তা'ই । এই আলোচনা আসলে রবীন্দ্র-শিল্প, বিশেষভাবে নাট্যকলার ক্রমবিকাশ ও পরিণতির আলোচনা ; সঙ্গীত ও নৃত্যের প্রসঙ্গই মুখ্যত এই আলোচনার মধ্যে এসে পড়লেও, মনে রাখা দরকার- আসলে এই আলোচনা সঙ্গীতের বা নৃত্যের নয়।
রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য -- যা গতিশীল, একমাত্র তারই বিকাশ, অর্থাৎ সূচনা স্থিতি প্রবৃদ্ধি ও পরিণতি থাকে। রবীন্দ্র-শিল্পসাধনা সম্পর্কেও এ কথা প্রযোজ্য ।
বস্তুতঃ, রবীন্দ্রনাথের শিল্পীসত্তা চলিষ্ণু গতিশীল বলেই 'বিচিত্রের দূত' হতে পেরেছেন তিনি, 'বিচিত্র রূপকগুলিকে অন্বেষণ করে সেগুলি সাজিয়ে তোলবার চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সেই বিচিত্রকে খুঁজেছেন, বৈচিত্র্যকে মেলাবার চেষ্টা করেছেন। কাব্যের, নাটকের, সঙ্গীতের বিবর্তনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সেই বৈচিত্র্য-পিপাসু মনটিকে সহজেই খুঁজে পাওয়া যায়। এইভাবেই রবীন্দ্রনাথের প্রথম গীতিনাট্য 'বাল্মীকিপ্রতিভা' থেকে নৃত্যনাট্য 'শ্যামা' পর্যন্ত সুস্পষ্টভাবেই এক বিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা যায় এবং তার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের এক বিশিষ্ট শিল্পচেতনাও অনুভব করা সম্ভব। এই বিশিষ্ট শিল্পচেতনার মূলকথা ছন্দোবোধ। বিশ্বের প্রাণ-প্রবাহ ছন্দ-বিস্তৃত। কবি বারবার বলেছেন যে, বিশ্বসৃষ্টির এই-যে
প্রবাহ বা লীলা— তার মধ্যে রয়েছে এক মহাছন্দ। সেইজন্যেই বিশ্বের সব-কিছু গতিশীল, প্রাণবান এবং রূপময়। সামান্য তৃণ থেকে
শুরু করে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যন্ত সব-কিছুই চলিষ্ণু, জন্ম ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তারা বারবার নতুন হয়ে চলেছে বলেই সৃষ্টিলীলা
বজায় থাকছে এবং এই-যে চলা— তার মধ্যে আছে এক মহাছন্দ। তিনি অনুভব করেছেন যে, বিশ্বগীতি এই মহাছন্দের অনুশাসনে বাঁধা পড়েছে। এমনও অনুভব করেছেন— ছন্দের মধ্যে দিয়েই সমস্ত জগতের, সমস্ত বিশ্বের প্রকাশ।
নাটক নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন তার ফলশ্রুতি নৃত্যনাট্য এবং গীতিনাট্যগুলি। কবি প্রথমে গানকে মাধ্যম করে গীতিনাট্য রচনায় মনোনিবেশ করেন এবং একে একে রচনা করেন বাল্মীকি প্রতিভা, মায়ার খেলা এবং কালমৃগয়া। এই নাটকগুলির ঘটনা তথা সংলাপ বিবৃত হয়েছে গানের মাধ্যমে। ‘বাল্মীকি প্রতিভা' নাটকটিকে কবি বলেছেন “ইহা সুরে নাটিকা।” ‘মায়ার খেলা' নাটকটির প্রসঙ্গে
আবার তিনি বলেছেন -----
“বাল্মীকি প্রতিভা যেমন গানের সূত্রে নাট্যের, মায়ার খেলা তেমনই নাট্যের সূত্রে গানের মালা। ঘটনাস্রোতের পরে তাহার নির্ভর নহে, হৃদয়াবেগই তাহার প্রধান উপকরণ।” গীতিনাট্য সৃষ্টি করে রবীন্দ্রনাথ প্রমাণ করেছেন যে গানকে সার্থকতার সঙ্গে নাট্যকার্যে নিযুক্ত করা যায়। গানের পর কবি নৃত্যকে নাট্যকার্যে প্রয়োগ করলেন এবং একে একে রচিত হল চিত্রাঙ্গদা, চণ্ডালিকা, শ্যামা, নটীর পূজা, শাপমোচন ইত্যাদি। এই নৃত্য নাট্যগুলিতে কবি ভারতের বিভিন্ন নৃত্যশৈলী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন এবং এখানে নৃত্যেরই প্রাধান্য। যেমন “শ্যামা” নৃত্যনাট্যে কথাকলি, মণিপুরি এবং কত্থক নৃত্যশৈলীর এক সার্থক সংমিশ্রণ দেখা যায়। নাটকের অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনাকে অধিকতর সুস্পষ্ট করে অবাানসগোচর করবার
জন্যই কবি গানের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যভঙ্গিমা তথা দেহছন্দের প্রয়োগ করেন। “রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য অতি উচ্চাঙ্গের এক অভিনব শিল্পরূপ। সংগীত, সাহিত্য, নৃত্য এই ত্রিবেণী সঙ্গমে ইহার অনিন্দ্যসুন্দর রসমন্দির প্রতিষ্ঠিত। সাহিত্যকে গীতরসে এলাইয়া তাহার অন্তরের অনির্বচনীয় মাধুর্যটিকে দেহছন্দের পাত্রে ধরিয়া অনাস্বাদিত চমৎকার এক আহার্য পরিবেশন করিয়াছেন কবি রসিকজনের নিকটে”
🍂
(রবীন্দ্রনাট্য পরিক্রমা—উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, পৃঃ ৫৪১)।
নৃত্যনাট্যের গানগুলিকে কবি তাই নাচের উপযোগী করে রচনা করেছেন এবং “চিত্রাঙ্গদা” নাটকে তাঁর স্বীকৃতি —
“ এই গ্রন্থের অধিকাংশই গানে রচিত এবং সে গান নাচের উপযোগী।” রবীন্দ্রনাথ গীতিনাট্য নিয়ে যে নতুন সৃষ্টির নেশায় মেতেছিলেন, নৃত্যনাট্যে দেখা যায়
তারই সার্থক পরিণতি।
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের পার্থক্য ঃ সাধারণভাবে ভাবাবেগপূর্ণ গীতপ্রধান নাটককে বলা হয় গীতিনাট্য। এখানে নাটকের আখ্যানভাগ সুরের মাধ্যমে বিবৃত করা হয়। গীতিনাট্যের গানগুলি কোন বাঁধাধরা শানবাঁধানো রাস্তা ধরে চলে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
“ছন্দ হিসাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দ যেমন, গান হিসেবে এও সেইরূপ, ইহাতে তালের কড়াক্কড় বাঁধন নাই, একটা লয়ের মাত্রা আছে, ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য কথার ভিতরকার ভাবাবেগকে পরিস্ফুট করিয়া তোলা। কোন বিশেষ রাগিণী বা তালকে বিশুদ্ধ করিয়া প্রকাশ করা নহে।”
অপরদিকে যে নাটকের আখ্যানভাগ প্রধানতঃ নৃত্যের মাধ্যমে বিবৃত করা হয় তাকেই বলা হয় নৃত্যনাট্য। এ ধরণের নাটক গুলিতে রবীন্দ্রনাথ 'নৃত্যের নানা আঙ্গিকের সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গীতিনাট্যের একমাত্র উপজীব্য এর সংগীতাংশ, কিন্তু নৃত্যনাট্যে নৃত্যের সঙ্গে গানেরও প্রায় সমপ্রাধান্য থাকে।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাত্রা করেছিলেন। যাত্রার তারিখ ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮ ( ৫ আশ্বিন১৮৮৫ ) । ব্রাইটনে থাকতে কবি য়ুরোপীয় নৃত্য ও সঙ্গীতের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে পরিচিত হলেন। এই প্রবাসজীবনে তিনি
পাশ্চাত্য সঙ্গীত শোনবার ও শেখবার চেষ্টা করেন। ১২৮৬ সালের মাঘ মাসের ( ফেব্রুয়ারী ১৮৮০ ) মাঝামাঝি তিনি ফিরে এলেন
কলকাতায়। যেজন্যে বিলেত গিয়েছিলেন, তা হ'ল না। কিন্তু এই প্রবাসজীবন নানাদিক থেকেই উল্লেখযোগ্য; বিশেষভাবে সঙ্গীতের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ে লেখা চিঠিপত্র থেকে কবির
সঙ্গীত সম্বন্ধে অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার কথা স্মরণযোগ্য :---
১. আমরা যেদিন ফ্যান্সি-বলে অর্থাৎ ছদ্মবেশী নাচে
গিয়েছিলাম— কত মেয়ে-পুরুষ নানারকম সেজে গুজে সেখানে নাচতে গিয়েছিল...
[৩ সংখ্যক পত্র ]
২. গত মঙ্গলবারে আমরা এক ভদ্রলোকের বাড়ীতে নাচের
নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম...
[ সংখ্যক পত্র ]
৩.এক-একদিন আমাদের গান-বাজনা হয়। আমি ইতিমধ্যে অনেক ইংরেজি গান শিখেছি। আমি গান করি । মিস ক বাজান । মিস ক— আমাকে অনেকগুলি গান শিখিয়েছেন ৷
৪. যা হ’ক এই পরিবারে সুখে আছি। কেটে যায় ৷ গান বাজনা, বই পড়া ৷
[ ১০ সংখ্যক পত্ৰ ]
সন্ধেবেলা আমোদে
[ ১- সংখ্যক পত্ৰ ]
একই সঙ্গে ‘জীবনস্মৃতি'র 'বিলাতি সংগীতের কিছুটা অংশ মিলিয়ে দেখা চলে :--
১. ইহার পরে গান শুনিতে শুনিতে ও শিখিতে শিখিতে য়ুরোপীয় সংগীতের রস পাইতে লাগিলাম।... য়ুরোপের গান এবং আমাদের গানের মহল যেন ভিন্ন...
২. দেশে ফিরিয়া আসিয়া এইসকল এবং অন্যান্য বিলাতি গান স্বজনসমাজে গাহিয়া শুনাইলাম। সকলেই বলিলেন, রবির গলা
এমন বদল হইল কেন, কেমন যেন বিদেশী রকমের, মজার রকমের হইয়াছে। এমন-কি, তাঁহারা বলিতেন, আমার কথা কহিবার গলারও একটু কেমন সুর বদল হইয়া গিয়াছে। অর্থাৎ, প্রবাস-জীবনে রবীন্দ্রনাথের য়ুরোপীয় সঙ্গীতের যে অভিজ্ঞতা দেখা গেল, তাতে মনে হয়— তিনি য়ুরোপীয় সঙ্গীতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছেন। দ্বিতীয়বার বিলাত-প্রবাসে এ অভিজ্ঞতা আরো গভীরতা পায়, কিন্তু সে আলোচনা আপাততঃ প্রাসঙ্গিক নয়।
দেশে প্রত্যাগমনের পর য়ুরোপীয় সঙ্গীতের সুরে গান রচনার চেষ্টা করা তাই তাঁর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে জ্যোতিরিন্দ্র-
নাথের ‘মানময়ী' রচিত ও অভিনীত হয় বিদ্বজ্জনসমাগম উপলক্ষে ।
এরই কিছু আগে ‘বসন্ত উৎসব' গীতিনাট্যও অভিনীত হয়েছিল।
এই সময়েই —
‘এই দেশী ও বিলাতী সুরের চর্চার মধ্যে বাল্মীকি-প্রতিভার
জন্ম হইল ৷'
১৮৮১ খৃষ্টাব্দ এর জন্মকাল । পরের বছর 'কালমৃগয়া'। তারও পরে 'মায়ার খেলা'র । প্রথম গীতিনাট্যের মধ্যে যে কী অপরিসীম আনন্দ রূপায়িত হয়ে উঠেছে তা বোঝা যায় সহজেই—‘বাল্মীকি-প্রতিভা' ও ‘কালমৃগয়া' যে উৎসাহে লিখিয়াছিলাম, সে উৎসাহে
আর কিছু রচনা করি নাই। এই দুটি গ্রন্থে আমাদের সেই
সময়কার একটা সঙ্গীতের উত্তেজনা প্রকাশ পাইয়াছে। অবশ্য,এই গীতিনাট্যের পিছনে প্রত্যক্ষভাবে অন্য কোন গীতিনাট্যের
প্রভাব আছে কিনা বলা কঠিন। তবে একটা কথা বলে চলে যে,তিনি নিঃসন্দেহে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও বিহারীলালের কাছে
ঋণী। বিহারীলালের প্রভাব কবি নিজেই স্বীকার করেছেন
তাঁর আত্মজীবনীতে। সর্বোপরি, সবগুলি গান রবীন্দ্রনাথেরই সুরারোপ কিনা, তাও সঠিকভাবে বলা তর্কাতীত নয়। এ ক্ষেত্রেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যে হাত ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে।
জীবনস্মৃতি গ্রন্থে 'বাল্মীকি প্রতিভা' সংক্রান্ত স্মৃতিচারণে বলেছেন, "দেশে ফিরিয়া আসিয়া এই সকল এবং অন্যান্য বিলাতি গান স্বজনসমাজে গাহিয়া শুনাইলাম। সকলেই বলিলেন, রবির গলা এমন বদল হইল কেন, কেমন যেন বিদেশী রকমের মজার রকমের হইয়াছে। এমন কি, তাঁহারা বলিতেন আমার কথা কহিবার
গলারও একটু কেমন সুর বদল হইয়া গিয়াছে। এই দেশী ও বিলাতি সুরের চর্চার মধ্যে বাল্মীকিপ্রতিভার জন্ম হইল। ইহার সুরগুলি
অধিকাংশই দিশি, কিন্তু এই গীতিনাট্যে তাহাকে তাহার
বৈঠকি মর্যাদা হইতে অন্যক্ষেত্রে বাহির করিয়া আনা হইয়াছে; উড়িয়া চলা যাহার ব্যবসায় তাহাকে মাটিতে দৌড় করাইবার কাজে লাগানো গিয়াছে। যাঁহারা এই গীতিনাট্যের অভিনয় দেখিয়াছেন তাঁহারা আশা করি এ কথা সকলেই স্বীকার করিবেন যে, সংগীতকে এইরূপ নাট্যকার্যে নিযুক্ত করাটা অসংগত বা নিষ্ফল হয় নাই। বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্যের ইহাই বিশেষত্ব।"
আরো বলছেন,
"আমার বিলাত যাইবার আগে হইতে আমাদের বাড়িতে মাঝে মাঝে বিদ্বজ্জনসমাগম নামে
সাহিত্যিকদের সম্মিলন হইত। সেই সম্মিলনে গীতবাদ্য কবিতা আবৃত্তি ও আহারের আয়োজন থাকিত। আমি বিলাত হইতে ফিরিয়া আসার পর একবার এই সম্মিলনী আহূত হইয়াছিল—ইহাই শেষবার। এই
সম্মিলনী উপলক্ষ্যেই বাল্মীকি-প্রতিতা রচিত হয়।
আমি বাল্মীকি সাজিয়াছিলাম এবং আমার ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভা সরস্বতী সাজিয়াছিল-বাল্মীকি প্রতিভা নামের মধ্যে সেই ইতিহাসটুকু রহিয়া গিয়াছে।...
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যয়ের সূচনায় ইউরোপিয়ো অপেরা সংস্কৃতির যে বড়ো একটা ভূমিকা ছিল তা অনস্বীকার্য।
Wagner তাঁর সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় অপেরা বিভিন্ন পরীক্ষার সীমান্ত অতিক্রম করেছে। কখনো কথার সঙ্গে নামমাত্র সুর, কখনো যন্ত্রসঙ্গীতের প্রাধান্য, কোথাও গায়কের কন্ঠসঙ্গীতের প্রাধান্য, কোথ ও বা এরই সঙ্গে নৃত্যও স্থান পেয়েছে। হালকা রসের অপেরার পাশাপাশি রোমান্টিক অপেরার যেমন আবির্ভাব ঘটেছে, তেমনি বিষয়বস্তুর দিক থেকেও অপেরা ক্রমশ বাস্তবের দিকে ঝুঁকেছে। আবার, এই অপেরাকে কেন্দ্র করেই ইউরোপীয় কথাশিল্পের যুগান্তর এসেছে।
কাজেই, ইউরোপে অপেরার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইউরোপীয় অপেরার এই জনপ্রিয়তা এবং তার ঐশ্বর্যই নিঃসন্দেহে ঊনিশ শতকের বাংলা দেশের রঙ্গমঞ্চকে স্পর্শ করেছে। অর্থব্যয়ে তখন কয়েকটি ইতালীয় অপেরা অভিনীত হয়েছিল যা জানা যায়। অপেরার বাইরের জৌলুসই তৎকালিন দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিলো, সন্দেহ নেই।
রবীন্দ্রনাথের মনে এসব স্মৃতি কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিলো, তা বলা কঠিন। বোধ হয় ইউরোপ-প্রবাসেই তিনি এ সম্বন্ধে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহী হয়ে ওঠেন তাঁর নিজের লেখা থেকে এই কথাই ধারণা করা যায়। পরবর্তীকালে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে আর্থার সুলিভাসের গন্ডোলিয়ন সম্বন্ধে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে অপেরা সম্বন্ধে তাঁর কী মনোভাব ছিল তা অনুভব করা যায়। এই পর্বটি তখন ইংল্যান্ডে সঙ্গীতের দিক থেকে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ ।
এর কিছুকাল আগে ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে Wagner ইংল্যান্ডে উপস্থিত হন, তাঁর অপেরার অভিনয়ে লন্ডনে তখন থেকেই অপেরার বা সঙ্গীতের নবজাগরণ শুরু হলো। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রথম ইংল্যান্ডে যান, (২০ সেপ্টেম্বর ১৮৭৮-ফেব্রুয়ারি ১৮৮০)। অনুমান করা যায়, যে নব-কল্লোল সৃষ্টি হয়েছিলো তৎকালীন লন্ডনে সাঙ্গীতিক জগতে, তিনিও তার রসাস্বাদ থেকে বঞ্চিত হন নি।
অপেরাকে তার নিজস্ব পরিবেশে কাছে থেকে দেখার এই সুযোগকেই তিনি বাল্মীকি-প্রতিভার মধ্যে ব্যবহার করেছিলেন।
এই কথাগুলি স্মরণ করেই সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, বাংলা গীতিনাট্যের ধারাটি বাল্মীকি-প্রতিভর মধ্যে শেষ পর্যন্ত সংহতি লাভ করেছে। কবি নিজেও এই গীতিনাট্যটিকে বিশেষ অনুরাগের সঙ্গে দেখতেন এবং নানা উপলক্ষ্যে এটি বহুবার অভিনীত হয়েছে। বস্তুতঃ বাল্মীকি-প্রতিভা স্বতন্ত্র বা পারস্পর্যহীন বিচ্ছিন্ন সৃষ্টি নয়, বরং পূর্বাপরতাসূত্রে এর ঐতিহাসিক ভূমিকাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ । দেশে প্রত্যাগমনের পর ইউরোপীয় সঙ্গীতের সুরে গান রচনার চেষ্টা করাটাই তাঁর পক্ষে স্বাভাবিক। ইতিপূর্বে জ্যেতিরিন্দ্রনাথের ‘মানময়ী’ রচিত ও অভিনীত হয় বিদ্বজ্জনসমাগম উপলক্ষ্যে। এরই কিছু আগে ‘বসন্ত উৎসব’ গীতিনাট্যও অভিনীত হয়েছিলো। এই সময়েই এই দেশী ও বিলাতি সুরের চর্চার মধ্যে বাল্মীনি প্রতিভার জন্ম হল ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে। পরের বছর ‘কালমৃগয়া’।
এরও পরে মায়ার খেলা’র। প্রথম গীতিনাট্যের মধ্যে যে কী অপরিসীম আনন্দ রূপায়িত হয়ে উঠেছে তা বোঝা যায় সহজেই- “বাল্মীকিপ্রতিভা’ ও ‘কালমৃগয়া যে উৎসাহে লিখিয়াছিলাম সে উৎসাহে আর কিছু রচনা করি নাই। ”
এই দুটি গ্রন্থে সেই সময়কার একটা সঙ্গীতের উত্তেজনা প্রকাশ পায়। অবশ্য, এই গীতিনাট্যের পিছনে প্রত্যক্ষভাবে অন্য কোন গীতিনাট্যের এভাব আছে কিনা বলা কঠিন। তবে একটা কথা বলা চলে যে, তিনি নিঃসন্দেহে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও বিহারীলালের কাছে ঋণী। বিহারীলালের প্রভাব কবি নিজেই স্বীকার করেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে। সর্বোপরি, সবগুলি গান রবীন্দ্রনাথেরই সুরারোপ কিনা, তাও সঠিকভাবে বলা তর্কতিত নয়।
এ ক্ষেত্রেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের যে হাত ছিলো, তার প্রমাণ রয়েছে। এখানে শুধু একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, বাংলা গীতিনাট্য যা নীহারিকা রূপে প্রাচীন ও মধ্যযুগে নানাভাবে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়েছিলো, তা অবশেষে একটি প্রান্তভূমিতে আত্মপ্রকাশের সুযোগ দেয়েছে। উনিশ শতকে পাশ্চাত্য অপেরার সঙ্গে পরিচয় ঘটার ফলে পূর্ববর্তী নাট্যগীতের ধারাই অবশেষে নাগরিক পরিবেশে গীতিনাট্যে রূপান্তরিত হলো।
এর পিছনে নব্য নাটক বা থিয়েটারের প্রভাবও স্বীকার করা হয়েছে। ইউরোপে ‘অপেরার’ ভাগ্যে প্রশংসা ও নিন্দা দুইই জুটেছিল। ইংল্যান্ডে অনেক সঙ্গীতবিদদের অভিমত ছিল যে, অপেরা সঙ্গীতকে কোনোরকম প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অধিকাংশ অপেরা শিল্পী নাকি অনৈতিক জীবনযাপন করতেন।সর্বোপরি, অপেরা ছিলো মূলতঃ অভিজাতদের বিলাস ও উপভোগের বস্তু। Becthoven এবং Wagner এর সময় থেকে অবশ্য এ ধারণা বদলাতে থাকে যেদিন থেকে তাঁরা অপেরার ইউরোপীয় সঙ্গীতের একটি উচ্চ আদর্শ ও মান প্রতিষ্ঠা করলেন। অন্যদিকে, অপেরা ইউরোপে এত বেশী জনপ্রিয় যে, ইউরোপীয় সংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট নিদর্শন বললে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হয় না।
গীতিনাট্যের গায়ন পদ্ধতি
গীতিনাট্যের প্রধান উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নাটকটি আদ্যন্ত গানে রচিত এবং গেয়ে অভিনয় করা হয়। গানের ভিতর দিয়ে নাট্যবস্তুকে রূপ দেওয়াই হচ্ছে গীতিনাট্যের মূল কথা। নাটকের সংলাপ গদ্যে অথবা কখনো ছন্দোবদ্ধ পদ্যে (কবিতায়) রচিত হয়ে থাকে। দুইয়েরই সাধারণ ধর্ম অভিনয়। পার্থক্য হচ্ছে একটি সুরহীন বাণীর আশ্রয় নেয়, অপরটি সুরান্বিত বাণীকে আশ্রয় করে একটি সাধারণ ভাষা, অপরটি সুরসমন্বিত ভাষা।
নাটকের সংলাপ গদ্যে অথবা পদ্যে, যেভাবেই রচিত হোক না কেন, তার লক্ষ্য মনের ভাবকে প্রকাশ করা এবং সেইজন্যেই বলতে পারি, সংলাপের মূল্য উদ্দেশ্য হচ্ছে বাকরীতি বা কথাবলার ঢংটি ফুটিয়ে তোলা; এই অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাকে রূপদান করতে হয়। মানবমনের অন্তরীণ রহস্যকে রূপ দেওয়াই হচ্ছে অভিনয়ের লক্ষ্য। নানাভাবে আমরা নিজেদের প্রকাশ করে থাকি।
গীতিনাট্যে সংলাপের ভূমিকা নেয় সঙ্গীত। সাধারণ অভিনয়ের সব রীতিই তার মধ্যে বজায় রাখতে হয়, শুধু নাট্যবিষয়টি গানের (বা সুরের) মধ্যে দিয়ে অভিব্যক্ত হয়। গীতিনাট্য রচনা করতে গিয়ে সঙ্গীতকে কিভাবে গীতিনাট্যের কাজে লাগিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ তা নিজেই ব্যাখ্যা করেছেন।
হার্বার্ট স্পেনসরের মতবাদ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন ভাবিয়াছিলাম এই মত-অনুসারে আগাগোড়া সুর করিয়া নানা ভাবকে গানের ভিতর দিয়া প্রকাশ করিয়া অভিনয় করিয়া গেলে চলিবে না কেন।
অতঃপর তিনি কথকতার প্রসঙ্গ তুলেছেন এবং অনতিপরেই মূল কথাটি বললেন- ছন্দ হিসাবে অমিত্রাক্ষর ছন্দ যেমন, গান হিসাবে এও সেইরূপ- ইহাতে তালের কড়াক্কড় বাঁধন নাই, নাটকের সংলাপ একটা লয়ের মাত্রা আছে- ইহার একমাত্র উদ্দেশ্য কথার ভিতরকার ভাবাবেগকে পরিস্ফুট করিয়া তোলা, কোনো রাগিনী বা তালকে বিশুদ্ধ করিয়া প্রকাশ করা নহে।
ভাবাবেগকে পরিস্ফুট করে তুলতে সঙ্গীতের ক্ষমতা কতখানি বা গীতিনাট্যের অভিনয়ের লক্ষ্য কী, নানা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তা ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে যে, নাটকের সংলাপ আমরা যখন রোদন করি তখন দুটি পাশাপাশি সুরের মধ্যে অতি অল্প ব্যবধান থাকে এবং স্বরগুলি কোমল সুরের উপর দিয়ে গড়িয়ে যায়, সুর বিলম্বিত হয়ে ওঠে। তার বিপরীত হাসি।
হাসিতে কোমল সুর লাগে না তো বটেই, উপরন্তু তালে রীতিমতো ঝোঁক লাগে। দ্রুত তাল হচ্ছে সুখের ভাব প্রকাশের অঙ্গ। ভাবের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তালেও পরিবর্তন ঘটে। এরই সূত্র ধরে গীতিনাট্য সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যের সারমর্ম উল্লেখযোগ্য। তাঁর অভিমত এই যে, গীতিনাট্য আগাগোড়া সুরে অভিনয় করতে হয় বলে স্থানবিশেষ তাল থাকা দরকার। তা না হলে অভিনয়ের স্ফূর্তি বা পূর্ণ প্রকাশ সম্ভবপর নয়।
এদিক থেকেই গীতিনাট্যের গায়কী বা গায়ন-পদ্ধতির আলোচনা বিধেয়। বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যগুলি এই রীতিরই অনুসারী। ঊনিশ শতকের অন্যান্য পূর্ণাঙ্গ গীতিনাট্যগুলি কিভাবে পরিবেশন করা হতো, তার আলোকপাত অন্যত্র করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্যগুলি তার ব্যতিক্রম।
এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো, অভিনয়ের উৎকর্ষ অথবা অপকর্ষ শিল্পীর বা পরিচালকের দক্ষতার তারতম্যের উপর নির্ভরশীল; স্বভাবতই যা প্রত্যক্ষভাবে অভিনয়ের ব্যাপার। লিখিতরূপে তার সম্পূর্ণ প্ৰকাশ সম্ভব নয় । নিম্নে কতিপয় গীতিনাট্যের গায়ন পদ্ধতির পর্যালোচনা করা হলো।
*বাল্মীকিপ্রতিভা*
বাল্মীকিপ্রতিভা গীতিনাট্যের গায়কীর মূল কথা হচ্ছে গানগুলি যেহেতু অভিনয়ের ঢঙে গাইতে হয়, সেজন্যই সাধারণ গায়ন পদ্ধতির বাতিক্রম ঘটে অর্থাৎ গানগুলি বিনাতালে কিংবা ভাঙ্গা তালে গাওয়া যায়। গীতিনাট্যের গানগুলিও অনুরূপভাবে পরিবেশন করতে হয়। এই গীতিনাট্যের গানগুলি নিবলিখিতভাবে ভাগ করা যায়:
প্রথম দৃশ্য
১. সহে না সহে না কাঁদে পরাণ
২. আঃ বেচেছি এখন
৩. আজকে তবে মিলে সবে
৪. এখন করব কী বল
৫. শোন তোরা তবে শোন
৬. ওই মেঘ করে বুঝি গগনে
৭. এ কী ঘোর বন
৮. পথ ভুলেছিস সত্যি বটে
দ্বিতীয় দৃশ্য
১. রাঙ্গাপদ পদ্মযুগে প্রণমি
২. গো দেখো কো ঠাকুর
৩. নিয়ে আর কৃপাণ
৪. কী দোমে বাঁধিলে আমায়
৫. এ কেমন হলো আমার
৬. শোন্ তোরা শোন্ এ আদেশ
তৃতীয় দৃশ্য
১. ব্যাকুল হয়ে বনে বনে
২. ছাড়বা না ভাই, ছাড়ব না ভাই
৩. রাজা মহারাজা কে জানে
৪. আছে তোমার বিদ্যেসাধ্যি জানা
৫. আঃ কাজ কী গোলমালে
৬. হা, কী দশা হলো আমার
৭. অহো! আস্পর্ধা একি তোদের
৮. আয় মা আমার সাথে
চতুর্থ দৃশ্য
১. কোথায় জুড়াতে আছে ঠাঁই
২. কেন রাজা ডাকিস কেন
৩. চল্ চল্ ‘ভাই জ্বরা করে যাই
৪. প্রাণ নিয়ে তো সটকেছি রে
৫. বলব কী আর বলব খুড়ো
৬. সর্দার মগায় দেরি না সয়
৭. রাখ রাখ ফেল ধনু
৮. তোর দশা রাজা ভালো তো নয়
পঞ্চম দৃশ্য
১. জীবনের কিছু হলো না হায়
২. দেখ দেখ, দুটো পাখি
৩. কী বলিনু আমি
৪. এ কি এ, এ কি এ, , স্থিরচপলা
৫. নমি নমি ভারতী
৬. শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা
ষষ্ঠ দৃশ্য
১. কোথা লুকাইলে
২. কেন গো আপন মনে
৩. কোথায় সে ঊষাময়ী প্রতিমা
৪. বাণী বাণী পাণি
৫. এই যে হেরি গো দেবী
*মায়ার খেলা*
কালমৃগয়ার আলোচনার প্রারম্ভে পূর্বের উল্লেখ করা হয়েছে, মায়ার খেলা গীতিনাট্যের গানগুলির তাল-নির্দেশ দেওয়া আছে। গায়কীর দিক থেকে বলা যায়, এই গীতিনাট্যের অভিনয়ের সময় তালের শাসন মেনে চলা দরকার। তালের দিকে লক্ষ্য রেখে কতিপয় গান উল্লেখ করা হচ্ছে :
১. মোরা জলে স্থলে- একতালা
২. পথহারা তুমি- একতালা
৩. জীবনে আজ কি- কাওয়ালি
৪. কাছে কাছে খেমটা
৫. যেমন দক্ষিণে বায়ু- কাওয়ালি
৬. মনের মতো করে- খেমটা
৭. সখী, সে গেল- খেমটা
৮. প্রেমের ফাঁদ পাতা- ঝাঁপতাল
৯. যেয়ো না, যেয়ো না- ঝাঁপতাল
১০. কে ডাকে- কাওয়ালি
১১. এসেছি গো এসেছি খেমটা
১২. ওকে বলো সখী খেমটা
১৩. মিছে ঘুরি— ঢিমেতেতালা
১৪. তারে দেখাতে পারি নে ঝাঁপতাল
১৫. সখা, আপন মন- রূপক
১৬. আমি জেনে শুনে- রূপক
১৭. ভালোবেসে যদি সুখ- কাওয়ালি
১৮. দেখো চেয়ে ঝাঁপতাল
১৯. সুখে আছি, সুখে আছি- খেমটা
২০. ভালোবেসে দুখ সেও একতালা
২১. ওই কে গো হেসে- কাওয়ালি
২২. দূরে দাঁড়ায়ে- তালফেরতা
২৩. প্রেমপাশে ধরা খেমটা
২৪. ওগো, দেখি আঁখি- একতালা
২৫. ওকে বোঝা গেল না- কাওয়ালি
গীতিনাট্যে সমবেত গানগুলির (মায়াকুমারীগণের ও সখীগণের) গায়নপদ্ধতিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাল্মীকি-প্রতিভার সমবেত গানগুলি কোরাস পদ্ধতিতে গাওয়া। কাল- মৃগয়াতে ঝিম্ ঝম্ ঘন ঘন রে’ গানটির আলোচনা ইতিপূর্বে করা হয়েছে। এই গীতিনাট্যে ‘মোরা জলে স্থলে কত ছলে’ গানটির নির্দেশ মূল গ্রন্থে দেওয়া আছে।
‘সুখে আছি সুখে আছি’ কিভাবে প্রমদা ও সখীগণ পালা করে গেয়েছে, তাও লক্ষ্য করার মতো। এই গানটির ‘মধুর জীবন মধুর রজনী’ থেকে শেষের অংশটুকু বিলম্বিত লয়ে গাইতে হয়। প্রথমে প্রমদা একা গাইবার পর, সকলে পালা করে গেয়ে থাকে।
১. সুখে আছি সুখে আছি সখা, আপন-মনে – প্রমদা
২. সুখে আছি সুখে আছি সখা আপন মনে এবং কিছু চেয়োনা – সখীগণ
৩. দুরে যেয়ো না – প্রমদা
৪. শুধু চেয়ে দেখো – সখীগণ
৫. শুধু চেয়ে দেখো – প্রমদা
৬. শুধু ঘিরে থাকো – সখীগণ
৭. শুধু ঘিরে থাকো কাছাকাছি – প্রমদা
৮. আপনমনে – সখীগণ
এরই পাশাপাশি ‘এস’ ‘এস’ বসন্ত ধরাতলে সমবেত গানটি স্মরণযোগ্য। এ গানটিও পালাক্রমে স্ত্রীগণ, পুরুষগণ এবং স্ত্রীগণ ও পুরুগণ গেয়ে থাকে। সবশেষে উল্লেখযোগ্য নিবলিখিত গানগুলি বিনা তালে গাইলে ভালো হয়।
১. আজি আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে
২. কেন এলি রে, ভালোবাসিলি
৩. আর কেন, আর কেন
গীতিনাট্যের এই গায়ন-পদ্ধতি বা গায়কী অভিনয়কেন্দ্রিক এবং তা যে বাংলা গীতিনাট্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে অভিনব, তাও স্বীকার্য। এই গায়কীর মধ্যে সঙ্গীতের একটি নতুন রূপ দেখতে পাচ্ছি।
গীতিনাট্যের এই সাফল্য পরবর্তীকালে নৃত্যনাট্যের আঙ্গিককে প্রভাবিত করছে। গান যে নাটকীয়তাসূত্রে বিভিন্ন ভাব প্রকাশে এবং চরিত্রের রূপায়ণে সক্ষম, গীতিনাট্যের এই অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্যের মধ্যে আর একভাবে ব্যবহার করেছেন।
*গীতিনাট্যের প্রকৃতি*
পূর্ববর্তী আলোচনার ক্ষেত্রে গীতিনাট্যগুলির প্রকৃতি ও পরিসীমা, সেই সঙ্গে পূর্বভাষণে উল্লিখিত মূল সুরের যথার্থ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। নাটকের বা গীতিনাট্যের দুটি প্রধান উপাদানের কথা বলা হয়েছে- অভিনয় ও কথা বা গান। এই প্রসঙ্গেই নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি স্মরণীয়:
১. অভিনয়কে মূলতঃ দুভাগে ভাগ করা যায়- সাধারণ অভিনয় ও নৃত্য-অভিনয়।
২. সাধারণ অভিনয় গদ্যের মতো ছন্দ আছে কিন্তু তা প্রচ্ছন্ন বা ‘অনিয়মিত’; পক্ষান্তরে নৃত্য-অভিনয় কবিতার মতো, ছন্দ ব্যক্ত বা সুনিয়মিত।
৩. গীতিনাট্যের কথা অংশ কবিতা বলে ছন্দোময়; গানে পরিণত হওয়ার ফলে এই ছন্দোময়তার তীব্রতা গভীরতা ও বৈচিত্র্য বেড়ে যায় (কবিতা গানে পরিণত হয়, অর্থাৎ কথা-ছন্দও সুর-ছন্দে বা স্বরছন্দে পরিণত হয়।)
৪. গদ্যে লেখা সাধারণ নাটকেও ছন্দ স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয় না। অমিত্র বা মিত্র পয়ারে লিখিত নাটকে ছন্দ ঈষৎ ব্যক্ত। মাত্রাবৃত্ত বা স্বরবৃত্তে রচিত হলে তা আরো ব্যক্ত বিচিত্র ও মুখ্য হয়ে পড়ে। এবং যখন তা গানে পরিণত হয়- সেই মুহুর্তে ছন্দের বেগ, তীব্রতা, মাধুরী- সবই বহুগুণে বেড়ে যায়।
বস্তুতঃ গীতিনাট্যের একটি অঙ্গ ছন্দোময় হয়ে উঠেছে- তা হচ্ছে গানের দিক, যদিও তা অভিনয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এক কতায়, গানের ছন্দ অভিনয়ের ছন্দ দ্বারা বিধৃত। রবীন্দ্রনাথ আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন- ‘গীতিনাট্য যাহা আদ্যোপান্ত সুরে অভিনয় করিতে হয়, তাহাতে স্থানবিশেষ তাল না থাকা বিশেষ আবশ্যক। নহিলে অভিনয়ের স্ফূর্তি হয় না। এখানে স্পষ্টভাবেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, গীতিনাট্যের প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে একটা।
বাল্মীকি-প্রতিভা ও কালমৃগয়া সমজাতীয় রচনা। প্রতি ও প্রকরণের দিক থেকে বিশেষ পার্থক্য নেই। এই দুখানি গীতিনাট্যে, একই প্রেরণা থেকে কথা ও সুরের আবির্ভাব ঘটে নি। অর্থাৎ কাব্যচেতনা ও সঙ্গীতচেতনা ও দুখানি গীতিনাট্যে সাযুজ্যলাভ করেনি। মায়ার খেলা এ দিক থেকে স্বতন্ত্র।
এই গীতিনাট্যের প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- কথা ও সুর একই প্রেরণা সঞ্জাত সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হয় যে কবির ছন্দচেতনা শুধু যে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে তা নয়, তা পরিপূর্ণ মিলনের জন্যেও প্রতীক্ষা করেছে। এরই রূপান্তর ঘটেছে নৃত্যনাট্যে- যেখানে অভিনয় পর্যন্ত (অর্থাৎ নৃত্য, কবির কথায় ‘অঙ্গভঙ্গীর কবিতা’ ছন্দোময় হয়ে উঠেছে। অঙ্গভঙ্গীর ছন্দ যখন রসের ধারক বাহক ও প্রকাশক হয় তখনই তাকে বলি নৃত্য ।
*গীতিনাট্যের কাব্যরীতি*
কাব্যের মানদন্ডে গীতিনাট্যের বিচার যুক্তিযজ্ঞত নয়। কেননা এখানে গীতরসই মুখ্য, কাব্যরস নয় । রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে বলেছেন- ‘বাল্মীকিপ্রতিভা পাঠযোগ্য কাব্যগ্রন্থ নহে…।’ গীতিনাট্যগুলি সম্বন্ধে সামগ্রিকভাবে একথা প্রয়োজ্য। গান ও কবিতার মূল পার্থক্য হচ্ছে- গানে শব্দগত ধ্বনি ছাড়াও স্বরধ্বনির মিলন ঘটে এবং তারই ফলে প্রসঙ্গান্তরে আনন্দবর্ধন বা অভিনবগুপ্ত যাকে ‘রসধ্বনি’ বলেছেন তারও উদ্ভব হয়।
কথা ও সুরের এই যোগপতনের কারণে পুরোমাত্রায় কথা বা শব্দগত ধ্বনির মধ্যেই ছন্দ বা তাল আবদ্ধ রাখা প্রয়োজন হয় না। এই কারণেই গান ঠিক সুনিয়মিত ছন্দে রচিত পাঠযোগ্য কবিতা নয়। জীবনের প্রভাত-লগ্নে যা কিছু তিনি অনুভব করেছিলেন- যে অভিজ্ঞতা তিনি প্রথম জীবনে লাভ করেছিলেন- ব্যথা, বেদনা, শিল্পানুভূতি, সাহিত্যপাঠ, সুখদুঃখ- এসবই নবির সারাজীবনের সমস্ত সাহিত্যের সম্পদ ও উপাদানরূপে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছিল।
বাল্মীকিপ্রতিভা থেকে মায়ার খেলা পর্যন্ত এই পর্বটিকে সংকুচিত করে এর মধ্যে কবিমানসের সন্ধান করতে গেলে ঐ কথাগুলিই মনে পড়ে। দ্বিতীয় দৃশ্য থেকেই বাল্মীকির মধ্যে একটা ব্যাকুলতা জেগেছে:
এ কেমন হল মন আমার।
কী ভাব এ যে কিছুই বুঝিতে যে পারি নে।
পাষাণ হৃদয় গলিল নেরে।
কেন আজি আঁখিজল দেখা দিল নয়নে!
কী মায়া এ জানে গো
পাষাণের বাঁধ এ যে টুটিল,
সব ভেসে গেল গো, চরে ভেসে গেল গো-
মরুভূমি ডুবে গেল করুণার প্লাবনে।।
এবং-
কোথায় জুড়াতে আছে ঠাই, কেন প্রাণ কাঁদে রে!
বাল্মীকি-চরিত্রের অনুরূপ চরিত্র কিভাবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন নাটকে দেখা দিয়েছে, ‘রূপান্তরের’ আলোচনায় সে কথা উল্লেখ করেছি। সে কথা স্মরণ করে বলতে পারি, আসলে এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের এক সত্যরূপ উদ্ঘাটন করেছেন। পাপ সম্বন্ধে তাঁর অভিমত এই যে, আংশিকের প্রতি আসক্তিবশত: সমগ্রের প্রতি অন্যায়।
কালমৃগয়া এ দিক থেকে বাল্মীকি-প্রতিভার সঙ্গে তুলনীয় নয়। নাট্যরসের মতো ভাবের দিক থেকেও বিশেষ কোনো গভীরতা চোখে পড়ে না। সে দিক থেকে বরং মায়ার খেলা অনেক বেশী উল্লেখযোগ্য সামগ্রিকভাবে কবিকাহিনী, ভগ্নহৃদয়, নলিনীর ভাবগত স্বজাত্য ছাড়াও এই গীতিনাট্যের উপজীব্য প্রেম সম্বন্ধে কবির ধারণাটি উত্তরকালে নানা লেখায় রূপায়িত হয়ে উঠেছে।
এই কাহিনীর উপজীব্য- প্রেমের বিচিত্র রূপের স্বরূপ উদ্ঘাটন। অমর, শান্তা ও প্রমদাকে ভালোবেসেছে। প্রশ্ননাও অমরকে ভালোবাসে, তবে সে ভালোবাসা চপল; নিজেকে সখীদের কাছ থেকে লুকিয়ে র খতে চায়। স্বভাবতই প্রত্যাখ্যান ভেবে অমরকে ফিরতে হয় শাস্তার কাছে। শেষে প্রমদা যখন আবার দুজনের মাঝে গিয়ে উপস্থিত হল- অমর ও শান্তার কাছে তার ‘গোপন কথা’ প্রকাশিত হল। গভীর বেদনা বুকে নিয়ে ফিরতে হলো তাকে।
প্রমদা তাই মধ্যবর্তিনী, বিচিত্র প্রেমের মূর্তিমতী। শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশীও এই গীতিনাট্যের আলোচনা-প্রসঙ্গে অন্য দিক থেকে বলেছেন যে, এখানে প্রেম সম্বন্ধে পরিণত ধারণার পূর্বাভাস ফুটে উঠেছে। সে ধারণা হচ্ছে প্রথমতঃ প্রেমের পরিপূর্ণতার জন্যে বিরহ ও দুঃখের প্রয়োজন আছে। দ্বিতীয়ত প্রেমের মোহ বা রোমান্সের চেয়ে মানুষের পক্ষে আশ্রয়ের প্রয়োজন বেশী। এই মন্তব্য গভীরভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ।
বস্তুতঃ কবির প্রেমচেতনাই মায়ার খেলা গীতিনাট্যে ফুটে উঠেছে। প্রেম বিচিত্র বলেই বাইরে থেকে তার সবটুকু পরিচয় পাওয়া যায় না। কেননা মনের অন্তরালে সে তার আপন বাণী লিখে যায়। এই বিচিত্র প্রেমজালে নরনারী ধরা পড়ে; ধরা দিতে বাধ্য হয়।
অবশেষে একটু একটু করে সেই রহস্যের আবরণ সরে যেতে থাকে, তখন সেই প্রান্তভূমিতে দাঁড়িয়ে পুলক ও বেদনায় অভিভূত হয়ে পরস্পরকে চিনতে পারে। এই তো প্রেমের স্বরূপ, প্রেমের বিচিত্রতা! আর বিশ্ব জুড়ে এমনিই ফাঁদ পাতা রয়েছে প্রেমের-
প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে-
কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে!
*গীতিনাট্যের মঞ্চসজ্জা ও রূপসজ্জা*
রবীন্দ্রনাট্যকলার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চকলার বিবর্তনও নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য। এই ধারাবাহিক বিবর্তনের পথে মঞ্চকলা নিয়ে যে বিচিত্র সমীক্ষা ও পরীক্ষা করা হয়েছে, তার দিকে দৃষ্টিপাত করলেই চোখে পড়ে এর এক প্রান্তে রয়েছে গীতিনাট্যের যুগ, প্রান্তে নৃত্যনাট্যের পর্ব আর বাল্মীকি প্রতিভা তারই ভূমিকা রচনা করেছে।
অপর বাস্তবিকপক্ষে নাট্যকলার সঙ্গে মঞ্চকলার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। শুধুমাত্র জীবনচেতনা বা কাব্যচেতনা নয়, অভিনয় দোগ্যতা মঞ্চের উপযোগিতা দর্শকের উপস্থিতি ও রসবোধ- এসবের দিকে তাকিয়ে নাটক রচনা করতে হয়। এদিক থেকে নাট্যকারের স্বাধীনতা যেমন (রচনা দিক থেকে) সীমাবদ্ধ তেমনি নায়িত্ব অনেক বেশী।
শুধু তাই নয়, দেশকালের পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ বলেই বিশেষ বিশেষ যুগে প্রত্যেক দেশেই বিশিষ্ট মঞ্চকলার সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক পরিবর্তন ও বিজ্ঞানের প্রসারের সঙ্গে সমতা রেখেই মঞ্চ কলাকে অগ্রসর হতে হয়েছে। Amott এভাবে দু শ্রেণীর মঞ্চকলার কথা উল্লেখ করেছেন- that of convention and that of illusion.’ এই সঙ্গে তাঁর অভিমত হচ্ছে বর্তমান যুগ largely dominated by the theatre of illusion.
বাল্মীকি-প্রতিভার আগে যেসব নাট্যাভিনয় হয়েছিল, মঞ্চকলার দিক থেকে উনিশ শতকের মঞ্চকলারই পরিচয় পাই সেইসব অভিনয়ে। দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মরণীয়:
‘অভিনয় দর্শনের জন্য কলিকাতার সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ ও ভদ্রলোকেরা নিমন্ত্রিত হইয়াছিলেন। অভিনয়ও খুব নিপুণতার সহিত সম্পদিত হইয়ছিল। স্টেজও যতদুর সুদৃশ্য ও সুন্দর করিয়া সাজান হইয়াছিল।’
এই সঙ্গে ‘দৃশ্যগুলিকে বাস্তব করিতে যতদূর সম্ভব, চেষ্টার কোনও ত্রুটি করা হয় নাই। বনদৃশ্যের সীনখানিকে নানাবিধ তরুলতা এবং তাহাতে জীবন্ত জোনাকী পোকা আটা দিয়া জুড়িয়া অতি সুন্দর এবং সুশোভন করা হইয়াছিল। দেখিছে, সত্যিকারের বনের মতোই বোধ হইত। এই সব জোনাকি পোকা ধরিবার জন্য অনেকগুলি লোক নিযুক্ত করিয়া, তাহাদের পারিশ্রমিক স্বরূপ এক একটি পোকার দাম দুই আনা হিসাবে দেওয়া হইয়াছিল।
পুনশ্চ-
‘ঝড়বৃষ্টির একটি দৃশ্য ছিল- তাহাতে সত্য সত্যই ঝর ঝর করিয়া জলধারা পড়িয়াছিল, তখন অনেকেরই তাহা প্রকৃত বৃষ্টি ধারা বলিয়া এম উৎপাদন করিয়াছিল’।
অন্যত্র-
সীনও যেখানে যেমনটি দরকার, পুকুরঘাট রাস্তা; স্টেজ আর্ট যতটুকু রিয়ালিস্টিক হতে পারে হয়েছিল। একটা বনের দৃশ্য ছিল, অন্ধকার বনের পথ…. সেই বনের সীন এলেই রবি ঠাকুর অন্ধকার বনপথে জোনাকি পোকা মুঠো মুঠো করে ছেড়ে দিতেন।
রঙ্গমঞ্চের এই ঐতিহ্যের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের মঞ্চের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ। বাংলার লৌকিক মঞ্চকলার বা নাট্যকলার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে অনেক পরে।
হয়তো বা মঞ্চকালার ঐ কৃতিমতা প্রথম থেকেই তাঁর চোখে পড়েছিল। তাই বলা হয়েছে, সম্ভবত: এ কথা ভেবেই ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁহার বাল্যকালে নাটক ও অভিনয়ে যে দৃষ্টান্ত ও আদর্শ স্পষ্টবোধের অগোচরে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। তাহা বাংলাদেশের যাত্রাগান, কৃষ্ণলীলা, নিমাই সন্যাস নহে, তাহা সম্পূর্ণ ইউরোপীয় আদর্শে গড়া থিয়েটারের অনুসরণে রচিত নাটকের অভিনয়।
এইসব অভিনয়ের ক্ষীণ স্মৃতি-কণিকাগুলি বালকের অচেতন স্তরে সঞ্চিত ছিল এবং উত্তরকালে পূর্ণাঙ্গ আর্টরূপে কবির জীবনে প্রকাশ পায়। মঞ্চের এই বাস্তবানুকৃতির প্রবণতার সঙ্গে রূপসজ্জার মধ্যেও পাশ্চাত্য আদর্শের অনুকরণও লক্ষ্য করা যায়। মঞ্চসজ্জায় দামী ভেলভেট, সিল্কের কাপড় ইত্যাদি ব্যবহৃত হত। সেই সঙ্গে পোষাকের মধ্যেও রীতিমতো বনেদিয়ানা ফুটে ওঠে।
বাল্মীকির পোশাক তৈরি হয়েছিল ইউরোপীয় আদর্শে- পিঠের দিকে যে লম্বা জোব্বা মতো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাতে বিলিতী রাজরাজাদের mantle এর আভাস পাওয়া যায়। তার সঙ্গে রুদ্রাক্ষের মালা।
দস্যুদের সাজসজ্জাদের মধ্যে যে ‘বাস্তবতা’ দেখি, তা মনগড়া দুটি কারণে- এক, তরুণ প্রযোজকগণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাব বা অল্পতা, আর সেই বাস্তবের রূঢ়তা ও স্থূলতা একটু শোভন সহনীয় না করে নিয়ে উপায় ছিল না; তাই এদের কাবুলীওয়ালাদের মতো সাজ ‘ইয়া গোঁফ এবং ইয়া পাগড়ি’।
রীতিমতো ভীতিব্যঞ্জক সেই পোশাক! বাংলাদশের দস্যু বা ডাকাতদের যে স্বাভাবিক বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে খালি গায়ে কালিগুলি মাখা! অথচ মঞ্চে পুরোপুর এই সজ্জা শোভন নয়। এই জন্যেই বলছি, এ বাস্তবতা মনগড়া বা মনোকল্পিত।
মঞ্চকলার সঙ্গে চিত্রকলার একটা যোগ ছিল। তৎকালীন ভারতীয় চিত্রশিল্পে রবিবর্মা গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।
তাঁর রূপকল্পনার মধ্যে পশ্চিমী Illusion সৃষ্টির প্রবণতাই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। পরবর্তীকালে অবশ্য সাজসজ্জার কিছু কিছু পরিবর্তন ঘটে। দস্যুদের আগের রূপসজ্জার বদলে দেখা দিল ধুতি, ফতুয়া, পাগড়ির বদলে মাথায় ‘একটা ফেটি বাঁধা’। ইন্দিরা দেবীর অভিমত- এইসব অভিনয়ের আদ্য মধ্য আস্তরূপের রূপসজ্জা বিশেষভাবে আলোচনার যোগ্য। খুবই স্বাভাবিক যে অদিযুগে মঞ্চকলা বা সাজসজ্জার এই আদর্শ পরবর্তীযুগে অনুসৃত হয় নি।
বস্তুত: Amott রমঞ্চের কথা বলতে গিয়ে যে Illusion-এর কথা বলেছেন, এই পর্বের মঞ্চকলায় ঐ আদর্শই লক্ষ্য করা যায়। পোশাকে আগেকার জৌলুষ ছিল “সখাদের বেশ ছিল খুব টকটকে রঙ্গের সাটিনের পাঞ্জাবি ও ধুতি, তার সঙ্গে ঈষৎ গোঁফের রেখা। আর মায়াকুমারীদের হাতের দন্ডের মুন্ডে ইলেকট্রিক আলো জলছিল আর নির্ভছিল, বোধ হয় বিলিতি পরীর অনুকরণে। তখন সব বিষয়ে বিলিতী অনুকরণটাই প্রবল ছিল।এ থেকে সিদ্ধান্তে pআসতে পারি যে, ইউরোপীয় মঞ্চকলার গীতিনাট্যগুলি নাট্যকলার দিক থেকে উৎকর্ষ লাভ করলেও মঞ্চকলর দিক থেকে এই গীতিনাট্যগুলিতে কোনো উল্লেখযোগ্য মৌলিকতা দেখা যায় নি। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের কোনো মৌলিক নির্দেশের কথা জানা যায় না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্তনা যে, স্টেজসজ্জায় তখনো তাঁদের হাত পড়ে নি ।
মনে হয় প্রকারান্তরে তিনিও এই কথাই বলতে চেয়েছেন। ঘরোয়া পরিবেশের গণ্ডী অতিক্রম করে বাস্তবতার মোহ কাটিয়ে রবীন্দ্রমঞ্চকলা পরবর্তী কালে বিবর্তনের পথে এগিয়ে গেছে।
*নৃত্যনাট্যের আবির্ভাব ও আলোচনা*
কবি জীবনে প্রথম নাটক আরম্ভ করেছিলেন সম্পূর্ণভাবে গানকে অবলম্বন করেই। ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’, ‘কালমৃগয়া’, ‘মায়ার খেলা’ প্রভৃতি গীতিনাট্য আগাগোড়া গান গেয়েই অভিনয় করা হতো। এগুলি দস্তুরমতো নাটক, কোনো বিশেষ ঘটনাকে অবলম্বন করে এর নানা দৃশ্যে বিভক্ত। এতে পাত্রপাত্রীর সমস্ত সংলাপ ছিল গানে। কথাবার্তার ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে গানের সূরে তারা পরস্পরের মধ্যে কথোপকথন চালাতো। এগুলি ছিল সুরের নাটক, এর সঙ্গে কোনো নৃত্য ছিল না।
তারপর বিভিন্ন ধরনের অনেক নাটক কবি লিখেছেন, কিন্তু এই প্রকার সংগীত সর্বস্ব নাটক আর লিখেন নি। মধ্যজীবন হতে দেখা যায়, কবির নাটকে উত্তরোত্তর গানের সংখ্যা বেড়েই চলেছিলো। প্রকৃতি সম্পূর্ণযুক্ত নাটক “শরদোৎসব’ ও ‘ফাল্গুনী’ এর গান ‘আজ আমাদের ছুটি’, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ’ প্রভৃতিতে কবি গানের সঙ্গে একটু আকটু নাচ প্রবর্তন করেন। শারদোৎসবের গান
আজ আমাদের ছুটি
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
প্রভৃতি গানের সঙ্গে নাচের আমেজ আনবার প্রথম চেষ্টা করেন। ‘ফাল্গুনীতে কবি অন্ধ বাউল সেজে গানের সঙ্গে নিজেই নেচেছিলেন। তারপর নানা ঋতুনাট্যের মধ্যে কবি বিশেষভাবে নাচ প্রবর্তন করেন। এই ঋতুনাট্যগুলি গানের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে গঠিত। পালাগানের মণিপুরী নৃত্যের ভঙ্গিই বেশির ভাগ গ্রহণ করা হয়েছিল, অন্যান্য নৃত্যেও সামান্য কিছু ছিল।
এসব নৃত্য গানকে অনুসরণ করেই নানা ভঙ্গিতে প্রকাশ পেয়েছে, তালের ছন্দের সাথে পৃথকভাবে নৃত্যপ্রদর্শনের চেষ্টা এর মধ্যে করা হয়নি। এই সময় ‘নটীর পূজা’ নাটকে শ্রীমতীর শেষনৃত্য সকলকে যুদ্ধ করে। এটি শান্তি নিকেতনে নিযুক্ত মণিপুরী নৃত্য-শিক্ষকের শিক্ষার ফল, তখন হতেই শান্তিনিকেতনের মেয়েরা এই নৃত্যাভিনয়প্রথা শিক্ষা করতে আরম্ভ করে।
‘নটীর পূজা’ ও ঋতুনাট্যগুলির মধ্যে নাচের প্রবর্তনের ভাবের যে অপূর্ব সুন্দর রসমূর্তি রচিত হতে পারে, কবির উচ্চাঙ্গের আর্টিস্ট মন তা বুঝতে পেরে নাচের দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েন এবং নাচের নানা রূপ সম্ভাবনা ও পরিকল্পনা চিন্তা করতে থাকেন।
*নৃত্যনাট্য চিত্রাঙ্গদা*
১৯৩৬ সালে চিত্রাঙ্গদা কাব্যকে নৃত্য ও মূকাভিনয়ের মাধ্যমে ছাত্রীদের দিয়ে অভিনয় করার পরিকল্পনা করেন প্রতিমা দেবী। রবীন্দ্রনাথ যে কথা শুনে চিত্রাঙ্গদাকে অভিনয় উপযোগী করে গানের পরিবর্তন করে কাহিনী ও ভাবানুযায়ী সাজিয়ে দেন। পূর্বকৃত অনেকগুলো খন্ড নাচ যেগুলো প্রতিমা দেবী চিত্রাঙ্গদায় রাখতে চেয়েছিলেন সেগুলোর উপযোগী গানের কথা পরিবর্তন করে দেন। যেমন:
পূর্বের কথা
সখী বহে গেল বেলা
বাকি আমি রাখবো
ও বধু সুন্দরী
দূরের বন্দু সুরের দুতীরে
দেখা না দেখার মেলা
পরিবর্তিত কথা
রোদন ভরা এ বসন্ত
আমার এ রিক্ত ডালি
তৃষ্ণার শান্তি
কোন দেবতা সে
স্বপ্ন মদির নেশায়
নব কুমার সিংহ ‘বাকি আমি রাখব না’ গানটির সঙ্গে যে নৃত্য কম্পোজিশন করেছিলেন। তাতে গানের কলির ফাঁকে ফাঁকে ছন্দানুযায়ী মণীপুরী খোলের বোল ছিল। তাতে নৃত্যটি অত্যন্ত জমজমাট লাগতো। এই নাচটি শ্রাবণগাথা এবং শাপমোচনে ব্যবহৃত আরেকটি নাচ, ‘দেখা না দেখার মেশা’ সঙ্গে নৃত্বের কম্পোজিশনে অভি বত্ব ছিল। নানা প্রকার নৃত্যভঙ্গির প্রয়োগে গানের উদ্দম ভাবটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
চিত্রাঙ্গদায় যখন গানটি থাকবে বলে স্থির হয় তখন কবি কথা বদল করে, স্বপ্নমদির নেশায় মেশা করে দিলেন। শিলচরে মণিপুরী নৃত্যশিক্ষকের পঞ্চম তালে একটি নৃত্য কম্পোজিশন করেছিলেন। সেই ছন্দে দূরের বন্ধু সুরের দুতীরে গান তৈরী করেছিল। ছন্দ ও ভঙ্গিবৈচিত্র্যে নাচটি ছিল খুবই আকর্ষণীয়। চিত্রাঙ্গদায় এই নাচ ব্যবহারের জন্য কবি কথা বদল করে কোন দেবতা সে পরিহাসে’ করে দিলেন।
কোচিনের মহারাজার প্রেরিত কল্যাণের আম্মা শান্তিনিকেতনে লোকনৃত্যের ঢং-এ ‘ওগো বধু সুন্দরী’ গান এর সাথে তালের নাচ শিখিয়ে ছিলেন। এটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছিল কখনো শাপমোচনে কখনো শ্রাবণগাথায়। চিত্রাঙ্গদার জন্য কবি এই নাচটিকে ‘তৃষ্ণার শান্তি সুন্দর কান্তি’ গান দিয়ে গেঁথে দেন।
চিত্রাঙ্গদার নৃত্যনাট্যের ২য় দৃশ্যের মেয়েদের সাজটি প্রথম পরিয়ে তার উপরে প্রথম দৃশ্যের সাজ পরানো হোত অর্জুনের সহচরসহ নাচ ও বিরতীর সময়ে দ্রুত উপরের সাজটি খুলে ফেলা হোত।
১৯৩৬ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত চিত্রঙ্গদা প্রায় ৪০ বার অভিনীত হয়। প্রথম দুবছর চিত্রঙ্গদার নৃত্য আঙ্গিকে মণিপুরী নৃত্যধারা প্রয়োগ বেশি দেখি। কারণ সে সময় শান্তি নিকেতনে ব্যাপকভাবে মণিপুরী নৃত্যের চর্চা চলছিল। এ ছাড়া ছিল মালাবার ও বাংলার অন্যান্য প্রাদেশিক লোকনৃত্যের ভঙ্গি । ১৯৪০ সালের পরে নৃত্যাঙ্গিকে অন্যান্য অনেক ধারা যুক্ত। সেই সময়ে জাপানী ছাত্র মার্কী প্রাচীন জাপানী নৃত্য পদ্ধতি এবং ইউরোপীয় নৃত্যধারা মিশিয়ে মদনের ভূমিকায় নেচেছিলেন।
শান্তিদের ঘোষ জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, প্রতিমা দেবী থেকে শুরু করে শান্তি নিকেতন বাসী সকলেই এই নাচ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৩৭ সালে কেলু নায়ার শান্তি নিকেতনে অধ্যাপক যোগ দেওয়ার পর অর্জুন কথাকলি নৃত্যভঙ্গিতেই করা হত। তবে শাস্ত্রবদ্ধ মুদ্রাভঙ্গি রবীন্দ্রনৃত্যে খাপ খায় বলে হাত, মুখ ও চোখের ভাবভঙ্গি প্রকাশ করা হত সহজ ভাবে, গানের ভাবের সাথে মিলিয়ে, কথাকলির বাঁধা নিয়মে নয়।
গ্রামবাসী, বনচর প্রভৃতি সমবেত নৃত্য কিছুটা সিংহলের ক্যান্ডি বা দেশীয় লোকনৃত্যের আদলে তৈরী করা হয়। চিত্রাঙ্গদায় লক্ষনীয় চার/চার ছন্দের মণিপুরী কাওয়ালী তালের আধিক্য । তার সঙ্গে দাদরা, ঝাপতালও তেওরা গৌণভাবে স্থান পেয়েছে। দক্ষিণী তাল তেওরা ও দাদরা যদিও ব্যবহৃত হয়েছিল তবুও তা মণিপুরী খোলেতেই বাজানো হত।
কারণ মণিপুরী নাচের সঙ্গে খোলের বোল অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত এবং মণিপুরী খোলেই এইসব ভালবাদ্য অন্য এক আমেজ নিয়ে আসতো। পরবর্তীকালে অবশ্য কুরূপা চিত্রঙ্গদার মঞ্চে প্রবেশ এবং শিখার দৃশ্য এবং অর্জুনের প্রবেশের দৃশ্যে দক্ষিণ ভারতীয় তাল যন্ত্র চাড্ডা, মৃদঙ্গম প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়েছে।
নৃত্যকে মাঝে মাঝে স্বচ্ছন্দ্য বজায় রেখে স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য এবং তার স্বরূপ ও স্বভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য, কেবল মাত্র তাল যন্ত্রের সঙ্গে নৃত্যের প্রচলন আছে ভারতীয় সব নৃত্যপদ্ধতিতেই। রবীন্দ্রনাথ এই পদ্ধতি অনুমোদন করেছেন কখনো কখনো। চিত্রাঙ্গদায় দেখা যায় প্রথম গানটি নেপথ্য থেকে পাওয়া হয়, তার পরই তালবাদ্যের সঙ্গে চিত্রঙ্গদা ও সহচরিদের মঞ্চে প্রবেশ এবং শিকারের আয়োজন সূচক নৃত্য।
চিত্রাঙ্গদার স্নানে আগমনের দৃশ্য, গ্রামবাসীদের অস্ত্রদানের দৃশ্য ইত্যাদি। চিত্রাঙ্গদার নৃত্যের আর একটি উল্লেখ্যযোগ্য বৈশিষ্ট্য আবৃত্তির সঙ্গে নাচ। চিত্রাঙ্গদা রচিত হওয়ার পূর্বেই কবি এই দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। চিত্রাঙ্গদার ২২টি নৃত্য ছন্দে আবৃতি রয়েছে। প্রথম যুগে কবি নিজে সাধারণ ভাবে আবৃত্তিগুলো করতেন। পরবর্তী আবৃত্তির সঙ্গে নৃত্যছন্দে অভিনয়ের প্রচলন করলেন। তার পর থেকে এই রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে। নাটকের ঘটনাসূত্রের যোগ রাখা এবং দর্শকচিত্রকে বিশ্রাম দেওয়াই এর কাজ।
চিত্রাঙ্গদার পোষাক সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ জানাচ্ছেন -চিত্রাঙ্গদা ও তার সখীরা প্রথম দৃশ্য যে সাজটি পরত, দ্বিতীয় দৃশ্যের সময় তার পরিবর্তন করা হোত।
*নৃত্যনাট্য শ্যামা*
১৯৩৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে শান্তিনিকেতনে পরপর দুদিন পরিশোধ নৃত্যকাব্যের অভিনয় হয়। শান্তিদেব ঘোষ এর লেখায় জানা যায়। ‘এবারকার পরিশোধ অভিনয়ের নৃত্যে আমরা নতুন ভাবে একটি পরীক্ষায় হাত দিয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিলাম ভরতনাট্যম, মণিপুরী, করুক, কথাকলি ও সিংহলের ক্যান্ডি নাচকে নাটকের চরিত্রানুযায়ী ব্যবহার করতে।
যেমন: মৃণালিনী (সারাভাই) শান্তি নিকেতনে ছাত্রী হিসেবে যোগদানের পূর্বে ভারত নাট্যম শিখে এসেছিলেন তাঁকে বজ্রসেনের গানের সঙ্গে ভরতনাট্যমের নৃত্যভঙ্গিকে অভিনয় করার জন্য তৈরী করা হলো। নন্দিতা (কৃপালিনী) শ্যামার নাচ তৈরী করলেন মণিপুরীতে। আশা ওঝা জয়পুর ঘরানার কক্থক নৃত্যে ভালো করেই শিখে এসেছিলেন উত্তিয়ের ভূমিকায়। তার গান কটির নাচ তৈরী হয়েছিল খাটি কথক নাচের অভিনয় পদ্ধতিতে।
কথাকলি নৃত্যে প্রহরীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন কেলু নায়ার। সিংহলের ছাত্র অনঙ্গলাল কোটালের চরিত্রে অভিনয় করেন ক্যান্ডী নাচের আঙ্গিকে। সখীদের নাচে ছিল মণিপুরী নাচের প্রাধান্য।’ রবীন্দ্র নৃত্যে ধ্রুপদী নৃত্যধারায় আরেকটি দিক কথকযুক্ত হয় আশা ওঝা নামের শান্তি নিকেতনের তৎকালীন একটি অবাঙ্গালী ছাত্রীর মাধ্যমে। কবি আশার নাচ দেখে মুগ্ধ হন এবং তারই ইচ্ছা অনুসারে তাকে উত্তিয়ের ভূমিকায় অভিনয় করতে বলা হয়।আশার অবস্থাপন্ন পিতা সে খবর শুনে কথক নৃত্যের গুরুকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেন। আশা তার শুরুর সহযোগীতায় কথক এ শৈলীতে উত্তিয়ের ভূমিকায় অভিনয় করে সবাইকে মুগ্ধ করে। পরবর্তীতে শান্তিনিকেতনের কত্থকের ভাল শিল্পী আর আসেনি বিধায় রবীন্দ্রনৃত্যধারায় কথকনৃত্য সংযুক্ত হতে পারেনি।
প্রসঙ্গক্রমে এ কথা অনায়াসে বলা যেতে পারে যে কবি তার গানের সঙ্গে নাচের জন্য যখন যে পদ্ধতির নাচের ছেলেমেয়ে বা শিল্পী পেয়েছেন তাকেই ব্যবহার করেছেন। এবিষয়ে প্রচলিত ধ্যান ধারণার নৃত্যপদ্ধতির প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণ বা গোড়ামি কোনোটাই তার ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল খন্ড নাচের গানের বা নৃত্যেনাট্যের যে রসটি প্রকাশ করার কথা তা সঠিক ভাবে প্রকাশিত হলো কিনা।
যেমন কোটালের চরিত্রে ক্যান্ডী নৃত্যভঙ্গিতে যে অভিনয় করা হয়েছিল তাতে উত্তিয়দের হত্যার দৃশ্যে। শেষ দিকে তেহাই এর সাথে তলোয়ার হাতে অঙ্গলাল উত্তিয়ের ওপর ঝাপিয়ে পড়ার মূহুর্তেই বাতি নিভিয়ে অন্ধকার করে দেওয়া হয় নাটকীয়তা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে। এই নাচটি নাটকের প্রয়োজনে তৈরী করা হয়েছিল। ক্যান্ডী নৃত্যে তলোয়ার হাতে কোনো নাচ ছিল না।
মিশ্রনের চুড়ান্ত পরীক্ষার নিদর্শন শ্যামা নৃত্যনাট্যের মধ্যে রয়েছে। শ্যামার মূল নৃত্যাদর্শ গড়ে উঠেছে চরিত্রের উপযোগী করে।
শ্যামার নাচে প্রত্যেক নৃত্য পদ্ধতির নিজস্ব রীতিতে অভিনয়ের প্রয়োজনে বোলের নাচ ব্যবহার করা হয়েছিল।শুরুতে বজ্রসেন ও বন্ধুর প্রবেশের দৃশ্য, বন্ধুর পলায়ন, কোটালের প্রবেশ, বজ্রসেনের পলায়নের পর তালের নৃত্য : উত্তিয় বধের প্রস্তুতি নৃত্য ইত্যাদী, তারই সামান্য অংশ -
.... "কোটালের প্রবেশ
কোটাল।
থামো থামো,
কোথায় চলেছ পালায়ে
সে কোন্ গোপন দায়ে।
আমি নগর-কোটালের চর।
বজ্রসেন।
আমি বণিক, আমি চলেছি
আপন ব্যবসায়ে,
চলেছি দেশান্তর।
কোটাল।
কী আছে তোমার পেটিকায়।
বজ্রসেন।
আছে মোর প্রাণ আছে মোর শ্বাস।
কোটাল।
খোলো, খোলো, বৃথা কোরো না পরিহাস।
বজ্রসেন।
এই পেটিকা আমার বুকের পাঁজর যে রে--
সাবধান! সাবধান! তুমি ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না এরে।
তোমার মরণ, নয় তো আমার মরণ--
যমের দিব্য করো যদি এরে হরণ--
ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না।
[বজ্রসেনের পলায়ন
সেই দিকে তাকিয়ে
কোটাল।
ভালো ভালো তুমি দেখব পালাও কোথা।
মশানে তোমার শূল হয়েছে পোঁতা--
এ কথা মনে রেখে
তোমার ইষ্টদেবতারে স্মরিয়ো এখন থেকে॥
[প্রস্থান"
১৯৩৯ সালে অভিনয়ের সময় কবি পরিশোধ নাম পরিবর্তন করে শ্যামা নামকরণ করেন। সে নামই চলে আসছে।
*নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা*
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত চণ্ডালিকা নাটকের কাহিনী অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে চণ্ডালিকা নামে একটি নৃত্যনাট্য রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চণ্ডালিকা নাটকের প্রাণ বিষয়বস্তু হল, সামাজিক বৈষম্য, মুক্তি, প্রেম ও ক্ষমার শক্তি। নৃত্য নাটিকার কিয়দ অংশ তুলে ধরছি, যেখানে সুরের আঙিনায় বাক্য বিনিময় রয়েছে কিন্তু সুস্পষ্ট হয়েছে অস্পৃশ্যতার যন্ত্রনা।
...... "দইওয়ালা।
দই চাই গো, দই চাই, দই চাই গো?
শ্যামলী আমার গাই,
তুলনা তাহার নাই।
কঙ্কনানদীর ধারে
ভোরবেলা নিয়ে যাই তারে--
দূর্বাদলঘন মাঠে তারে
সারা বেলা চরাই, চরাই গো।
দেহখানি তার চিক্কণ কালো,
যত দেখি তত লাগে ভালো।
কাছে বসে যাই ব'কে,
উত্তর দেয় সে চোখে,
পিঠে মোর রাখে মাথা--
গায়ে তার হাত বুলাই, হাত বুলাই গো॥
চণ্ডালকন্যা প্রকৃতি দই কিনতে চাইল
একজন মেয়ে সাবধান করে দিল
মেয়ে।
ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,
ও যে চণ্ডালিনীর ঝি--
নষ্ট হবে যে দই
সে কথা জানো না কি।
[ দইওয়ালার প্রস্থান
চুড়িওয়ালার প্রবেশ
চুড়িওয়ালা।
ওগো তোমরা যত পাড়ার মেয়ে,
এসো এসো দেখো চেয়ে,
এনেছি কাঁকনজোড়া
সোনালি তারে মোড়া।
আমার কথা শোনো,
হাতে লহ প'রে,
যারে রাখিতে চাহ ধ'রে
কাঁকন দুটি বেড়ি হয়ে
বাঁধিবে মন তাহার--
আমি দিলাম কয়ে॥
প্রকৃতি চুড়ি নিতে হাত বাড়াতেই
মেয়েরা।
ওকে ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,
ও যে চণ্ডালিনীর ঝি।
[ চুড়িওয়ালা প্রভৃতির প্রস্থান
প্রকৃতি।
যে আমারে পাঠাল এই
অপমানের অন্ধকারে
পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।
কেন দিব ফুল, কেন দিব ফুল,
কেন দিব ফুল আমি তারে--
যে আমারে চিরজীবন
রেখে দিল এই ধিক্কারে।
জানি না হায় রে কী দুরাশায় রে
পূজাদীপ জ্বালি মন্দিরদ্বারে।
আলো তার নিল হরিয়া
দেবতা ছলনা করিয়া,
আঁধারে রাখিল আমারে॥
পথ বেয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ
ভিক্ষুগণ।
যো সন্নিসিন্নো
বরবোধিমূলে,
মারং সসেনং মহতিং বিজেত্বা
সম্বোধি মাগঞ্চি অনন্তঞ্ঞানে
লোকুত্তমা তং পণমামি বুদ্ধ।
[ প্রস্থান]"
বৌদ্ধ সাহিত্যের কাহিনী থেকে 'চণ্ডালিকা'র মূল ভাবটি গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এই নৃত্যনাট্যের ঘটনাস্থল শ্রাবস্তী নগরী। প্রভু বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য (বৌদ্ধ সন্ন্যাসী) আনন্দ এক গ্রীষ্মের প্রখর দুপুরে বিহারে ফিরে যাওয়ার সময় তৃষ্ণা বোধ করেন। তিনি দেখতে পেলেন একজন তরুণী কুয়ো থেকে জল তুলছে। সে এক চণ্ডালকন্যা, তার নাম প্রকৃতি। তার কাছে জল চাইলেন আনন্দ। কিন্তু তাকে তো সবাই চণ্ডালকন্যা বলে অস্পৃশ্য মনে করে। তাই সংকোচভরে প্রকৃতি আনন্দকে বলে যে, সে চণ্ডালকন্যা আর তার কুয়োর জল অশুচি। আনন্দ তাকে বলেন যে, তিনি যে মানুষ, প্রকৃতিও সেই মানুষ। সব জলই তীর্থজল, যা তৃষ্ণার্তকে তৃপ্ত করে, স্নিগ্ধ করে। আনন্দের এই ব্যবহারে, সেইসঙ্গে তাঁর রূপে মুগ্ধ হল প্রকৃতি। নিজের জীবন সম্পর্কে ভাবনা বদলে গেল তার। এ যেন তার নতুন জন্ম। তার হাতের এক গণ্ডূষ জল গ্রহণ করে আনন্দ তার জীবনের সমস্ত অপমান ধুয়ে দিয়ে গেছেন। আনন্দকে পেতে চাইল প্রকৃতি। কিন্তু তাঁকে পাবার কোনো উপায় না দেখে সে তার মায়ের সাহায্য চাইল। তার মা জাদুবিদ্যা জানত। মন্ত্র পড়ে এবং জাদুশক্তির জোরে তার মা শেষ পর্যন্ত আনন্দকে টেনে আনে। সে প্রকৃতিকে তার মায়াদর্পণে দেখতে বলে আনন্দকে। কিন্তু আনন্দের ক্লান্ত, ম্লান রূপ সহ্য করতে পারে না প্রকৃতি। কোথায় গেল তাঁর সেই দীপ্ত উজ্জ্বল, স্বর্গের আলোর মতো রূপ! সে পা দিয়ে ভেঙে ছড়িয়ে ফেলল তার মায়ের মন্ত্রের সমস্ত উপকরণ। তারপর প্রকৃতি ও তার মা দু'জনেই ক্ষমাপ্রার্থনা করে আনন্দের কাছে। তাদের এই নতুন উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই শেষ হয় রবীন্দ্রনাথের 'চণ্ডালিকা'র কাহিনী।
১৩৪৪ সালের ফাল্গুন মাসে 'চণ্ডালিকা নৃত্যনাট্য' নামে পুস্তিকা আকারে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। পরে ১৩৪৫ সালের চৈত্র মাসে 'নৃত্যনাট্য চণ্ডালিকা' নামে স্বরলিপিসহ এর নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই নৃত্যনাট্য সম্পর্কে প্রতিমা দেবীর লেখা একটি প্রবন্ধের কয়েকটি লাইন এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন: "একটি মানুষের মানসিক ক্রমবিকাশের উপর তার ('চণ্ডালিকা'র) রচনা। মানুষের মধ্যে যা আদিম আকর্ষণ তারই আবেগ দিয়ে শুরু হয়েছে চণ্ডালিকার নৃত্যকলা। দেহের যে আকর্ষণী মন্ত্র যা শিবের তপস্যাকেও টলাতে পেরেছিল প্রকৃতি-পুরুষের অন্তরের সেই চিরন্তন দ্বন্দ্ব পৌঁছল চণ্ডালিকার প্রাণে, তারই আঘাতে দোল-খাওয়া মন নৃত্যসংগীতের তালে আপনাকে বিচ্ছুরিত করে দিল অবসাদ বিষাদ করুণার আতিশয্যে।... এই যে প্রকৃতি-পুরুষের স্বভাবের মধ্যে মূলগত বিরুদ্ধতা, চণ্ডালিকার সাহিত্য ও নৃত্যনাট্য সেই মানসিক জটিলতাকে সুরে ও তালে প্রকাশ করতে চেয়েছে।"
*শাপমোচন নৃত্যনাট্য*
এই নামে ‘পুনশ্চ’ গ্রন্থের একটি সুদীর্ঘ গদা-কবিতা এই নাটকের মূল। এর মধ্যে সৌন্দের্যের মোহ ও প্রকৃত প্রেমের দ্বন্দ রূপায়িত। রাণী কমলিকা অরুনেশ্বরের কুৎসিত চেহারা দেখে ঘৃণায় তাকে ত্যাগ করে গেল, স্বামীর প্রেমের মূল্য বুঝিতে পারল না; তারপর বিরহের দুঃখ ও আত্মগ্লানির অগ্নিতে শুদ্ধ হইয়া সে প্রেমের মূল্য বুঝিল, বুঝিল কালের বুকেই বাস করে নয়ন- ভুলানো আলো। তখনই গদগদ কণ্ঠে, অপলক চোখে বলিল, প্রভূ আমার, প্রিয় আমার, এ কী সুন্দর রূপ তোমার ।
ইহার আখ্যানবস্তু ও ‘রাজা’ নাটকের আখ্যানবস্ত্র প্রায় এক। গদ্য-কবিতা হতে আবৃত্তি, সংগীত ও নৃত্যে ইহার রূপ দেওয়া হয়। প্রথম অভিনয়ে কবির স্বয়ং এটার গদ্য অংশ সমূহ পাঠ করেছিলেন।
শাপমোচন নৃত্যনাট্যর শুরুর কিয়দ অংশ-
ভূমিকার গান। ভাবটা এই, মনের নানা গম্ভীর আকাঙক্ষা কাহিনীতে রূপকে গানে রূপ নেয় ছন্দে বন্ধে, সঙ্গ রচনা করে কল্পনায়, সঙ্গ রচনা করে কল্পনায়, বস্তুজগৎ থেকে ক্ষণকালের ছুটি নিয়ে কল্পজগতে করে লীলা।
এ শুধু অলস মায়া-- এ শুধু মেঘের খেলা,
এ শুধু মনের সাধ বাতাসেতে বিসর্জন,
এ শুধু আপনমনে মালা গেঁথে ছিঁড়ে ফেলা,
নিমেষের হাসি কান্না গান গেয়ে সমাপন।
শ্যামল পল্লবপাতে রবিকরে সারা বেলা
আপনারি ছায়া লয়ে খেলা করে ফুলগুলি,
এও সেই ছায়া-খেলা বসন্তের সমীরণে।
কুহকের দেশে যেন সাধ ক'রে পথ ভুলি
হেথা হোথা ঘুরি ফিরি সারাদিন আনমনে।
কারে যেন দেব বলে কোথা যেন ফুল তুলি,
সন্ধ্যায় বনের ফুল উড়ে যায় বনে বনে।
এ খেলা খেলিবে হায়|, খেলার সাথী কে আছে।
ভুলে ভুলে গান গাই-- কে শোনে কে নাই শোনে--
যদি কিছু মনে পড়ে, যদি কেহ আসে কাছে॥
গন্ধর্ব সৌরসেন সুরসভায় গীতনায়কদের অগ্রণী। সেদিন তার প্রেয়সী মধুশ্রী গেছে সুমেরুশিখরে সূর্যপ্রদক্ষিণে। সৌরসেনের বিরহীচিত্ত ছিল উকণ্ঠিত। অনবধানে তার মৃদঙ্গের তাল গেল কেটে, নৃত্যে উর্বশীর শমে পড়ল বাধা, ইন্দ্রাণীর কপোল উঠল রাঙা হয়ে।
পাছে সুর ভুলি এই ভয় হয়,
পাছে ছিন্ন তারের জয় হয়।
পাছে উৎসবক্ষণ তন্দ্রালসে হয় নিমগন,
পুণ্য লগন
হেলায় খেলায় ক্ষয় হয়,
পাছে বিনা গানেই মিলনবেলা ক্ষয় হয়।
যখন তাণ্ডবে মোর ডাক পড়ে,
পাছে তার তালে মোর তাল না মেলে
সেই ঝড়ে।
যখন মরণ এসে ডাকবে শেষে বরণগানে
পাছে প্রাণে
মোর বাণী সব লয় হয়,
পাছে বিনা গানেই বিদায়বেলা লয় হয়॥
স্খলিতচ্ছন্দ সুরসভার অভিশাপে গন্ধর্বের দেহশ্রী হল বিকৃত, অরুণেশ্বর নামে তার জন্ম হল গান্ধাররাজগৃহে।
মধুশ্রী ইন্দ্রাণীর পাদপীঠে মাথা রেখে পড়ে রইল, বললে, "ঘটিয়ো না বিচ্ছেদ দেবী, গতি হোক আমাদের একই লোকে, একই দুঃখভোগে, একই অবমাননায়।"
শচী সকরুণ দৃষ্টিতে ইন্দ্রের পানে তাকালেন। ইন্দ্র বললেন, "তথাস্তু, যাও মর্তে, সেখানে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে। সেই দুঃখে ছন্দঃপাতন অপরাধের ক্ষয়।"
বিদায়গান
ভরা থাক্ স্মৃতিসুধায়
বিদায়ের পাত্রখানি,
মিলনের উৎসবে তায়
ফিরায়ে দিয়ো আনি।
বিষাদের অশ্রুজলে
নীরবের মর্মতলে
গোপনে উঠুক ফ'লে
হৃদয়ের নূতন বাণী।
যে পথে যেতে হবে
সে পথে তুমি একা,
নয়নে আঁধার রবে
ধেয়ানে আলোকরেখা।
সারাদিন সঙ্গোপনে
সুধারস ঢালবে মনে
পরানের পদ্মবনে
বিরহের বীণাপাণি॥
মধুশ্রী জন্ম নিল মদ্ররাজকুলে, নাম নিল কমলিকা। স্বর্গলোক থেকে যে আত্মবিস্মৃত বিরহবেদনা সঙ্গে এনেছে অরুণেশ্বর, যৌবনে তার তাপ উঠল প্রবল হয়ে।
জাগরণে যায় বিভাবরী,
আঁখি হতে ঘুম নিল হরি॥
যার লাগি ফিরি একা একা,
আঁখি পিপাসিত নাহি দেখা,
তারি বাঁশি ওগো তারি বাঁশি
তারি বাঁশি বাজে হিয়া ভরি।
বাণী নাহি তবু কানে কানে
কী যে শুনি তাহা কেবা জানে।
এই হিয়া-ভরা বেদনাতে
বারি-ছলছল আঁখিপাতে
ছায়া দোলে তারি ছায়া দোলে
ছায়া দোলে দিবানিশি ধরি॥"
*গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের বৈসাদৃশ্য আলোচনা*
যে কোন শিল্পেরই দুটি দিক। ১. বিশিষ্টতা ও ২. বহুর সঙ্গে মিলনের সম্ভাবনা। সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্য প্রত্যেকটি সুকুমার শিল্পেরই এমন একটি করে স্বতন্ত্র রয়েছে যে, তারা সবাই আলাদা ধারায় অনন্য। প্রত্যেকটি আশ্রয় রয়েছে এক একটি উপায় উপকরণকে। প্রত্যেকের একটাই উদ্দেশ্য- রূপায়ন। অর্থাৎ কোন একটি রূপকে প্রকাশ করা।
এই রূপ ও প্রকাশের পথে চলেছে গান, নৃত্য, নাটক, সাহিত্য। প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট ধারা নির্দিষ্ট গতিতে নির্দিষ্ট পথে চলতে চলতে এক সময় সবাই একটি প্রাপ্ত ভূমিতে এসে উপস্থিত হয়। আর সেই প্রান্তভূমির আদিতে আছে গীতিনাট্য ও শেষ প্রান্তে নৃত্যনাট্য। বাইরে থেকে এই সন্নিবেশ অর্থহীন ও তাৎপর্যহীন বলে মনে হলেও একথা স্পষ্ট যে, প্রথমে যদি গীতিনাট্যকে না পাওয়া যেত তাহলে হয়তো পরবর্তীতে নৃত্যনাট্যের বর্তমান রূপটি পাওয়া যেতো না।
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য এক অবিভাজ্য ছন্দময়তার প্রকাশ। দুই-ই আদ্যন্ত গানে রচিত। তবুও তাদের মধ্যে কতকতগুলি মূলগত পার্থক্য রয়েছে। যেমন :
*রচনার উদ্দেশ্য*
গীতিনাট্যের গানগুলি যেমন বিশেষ ভাবে অভিনয়ের জন্য রচিত নৃত্যনাট্যের গানগুলি তেমন নৃত্যাভিনয়ের জন্য। এখানেই নৃত্যনাট্যের গানের বৈশিষ্ট্য ।
*গায়কী*
গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যের মধ্যে গায়কীর পার্থক্য আছে। গীতিনাট্যের গান অভিনয় যোগ ও ভাবানুযায়ী গাইতে হয় বলে আগাগোড়া তালে গাওয়া চলে না। আর নৃত্যনাট্য ঠিক তার বিপরীত অর্থাৎ আগাগোড়া তালে গাইতে হয়। নৃত্যের জন্যই এই তাল বজায় রাখতে হয়। এই লয় ও ছন্দের মধ্যেই রয়েছে নাট্য স্বকীয়তা।
*রচনার সময়*
গীতিনাট্য শিক্ষানুবিশীর যুগে রচিত এবং নৃত্যনাট্য শিক্ষানুবিশীর যুগে রচিত এবং নৃত্যনাট্য রসানুভূতির যুগে রচিত তাই তাদের ভাব সম্পূর্ণ আলাদা ।
*পাশ্চাত্যের সাথে তুলনা*
গীতিনাট্য অপেরা ধর্মী ও নৃত্যনাট্য ব্যালেধর্মী ।
*উপাদান*
গীতিনাট্যের প্রধান উপাদান সংগীত ও অভিনয় এতে নৃত্যের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কিন্তু নৃত্যনাট্যের ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন নাচ। নাচ ছাড়া এর প্রকাশ কোন ভাবেই সম্ভব না।
*সুরের নাটিকা*
নৃত্যনাট্যগুলি পুরোপুরি গীতিনাট্য হলেও একে ‘সুরের নাটিকা’ বলা যায় না। কারণ সঙ্গীত ও নৃত্য পরস্পর পরিপূরক হলেও নৃত্যনাট্যে নৃত্য অপরিহার্য অঙ্গ। আর গীতিনাট্য সঙ্গীত ও অভিনয়ের নাটক প্রাধান্যতা গীতিনাট্যগুলো পয়ারের কাঠামোতে রচিত হয় আর নৃত্যনাট্যে মাত্রাবৃত্তের প্রাধান্য বেশী।
*অন্যগানের প্রভাব*
গীতিনাট্যতে পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এতে দেশীয় লৌকিক সুরের পভাব খুব কম। কিন্তু নৃত্য নাট্যে কীর্তন, বাউল ইত্যাদির প্রভাব আছে যথেষ্ট পরিমানে।
মিশ্র রাগ-রাগিনীর ব্যবহার
গীতিনাট্যের যুগেই মিশ্র রাগ-রাগিনীর ব্যবহার দেখা গেছে কিন্তু নৃত্যনাট্যে তা রয়েছে এক স্বতন্ত্র প্রকৃতির রূপায়ণে ও প্রকরণে।
কলা-কুশলীদের ভূমিকা
গীতিনাট্যে কলাকুশলীদের গানের সাথে সাথে অভিনয় (মঞ্চেই) করতে হয়। কিন্তু নৃতা নাট্যে সঙ্গীত শিল্পী ও যন্ত্রীগণ মঞ্চের পিছনে থাকে এবং নৃত্যশিল্পীরা নৃত্যের মাধ্যমে মঞ্চে অভিনয় করেন।
শিথিল বাক্যবন্ধের ব্যবহার
নৃত্যনাট্যে শিথিল বাক্যবন্ধের ব্যবহার আছে। গীতিনাট্যে ছিলো কিন্তু নৃত্যনাট্যে তা এত বেশী যে একে গদ্যছন্দ বা Fee verse বলা হয়। যেমন :
এ নতুন জন্ম, নতুন জন্ম
নতুন জন্ম আমার
সেদিন বাজলো দুপুরের ঘন্টা
ঝা ঝা করে রোদ্দুর। ইত্যাদি
তেহাই রীতি
নৃত্যনাট্যে কোন বিশেষ আবেগ প্রকাশের জন্য একটি শব্দ অনেক সময় তিনবার উচ্চারিত হয়। নৃত্যের তেহাই থেকে সম্ভবত এটি এসেছে। যেমন :
নৃত্য নাট্য ‘শ্যামা’ থেকে
ধিক্ ধিক্ ধিক্
যাও যাও ফিরে যাও ফিরে যাও বীর
কিন্তু গীতিনাট্যে এই রকম তিনবার উচ্চারণের কোন ব্যাপার নেই।
*সুর সমাবেশ*
সুর সমাবেশের দিক থেকে পার্থক্য নিরূপণ করতে গেলে দেখা যাবে- নৃত্যনাট্যের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবগুলি গানের মধ্যে একটা সুর প্রবাহই যেনো বিভিন্নভাবে উচ্ছলিত হয়েছে। একটি গানের রেশ ধরেই যেন আরেকটি বা পরের গানটি রচিত। অর্থাৎ গানের সুরে একটা অখন্ড ঐক্য আছে এর সংলাপের ক্ষেত্রেও তাই।
আবেগের উচ্চতা ও নিবতার মধ্যে দিয়ে কিভাবে নাটকীয়ভাব সৃষ্টি করতে হয় নৃত্যনাট্যের গানগুলি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গীতিনাট্যের সুর সমাবেশের মূল বিশেষত্ব গানগুলি রাগ-রাগীনির উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও নাটকের প্রয়োজনে নতুনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এখানে অনেক মিশ্র ও অপ্রচলিত রাগ ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন কুকুড় লুম, গারা, ললিত যোগিয়া, গৌড় সারং ইত্যাদি। গীতিনাট্যে বস্তুত গানের ভাবের দিকে লক্ষ্য রেখেই সুরারোপ করা হয়েছে এবং তাল তার সাহায্য করেছে।
নৃত্যের সূত্রে নাট্যের মালা
নৃত্যনাট্য গুলোকে নৃত্যসূত্রে নাট্যের মালা বলা যায়। নৃত্য ছাড়া এর রূপায়ণ কোনভাবেই সম্ভব নয়। গীতিনাট্য একমাত্র গানেরই প্রাধান্য।
*মঞ্চ সজ্জা ও অভিনয় মাত্রা*
নৃত্য নাট্যের মঞ্চকে মূলত দুইভাবে ভাগ করা হয়। সামনের অংশে নৃত্যশিল্পীরা। আর রঙ্গীন কাপড়ে ঘেরা পেছনের অংশে শিল্পী ও যন্ত্রীরা বসেন। কিন্তু গীতিনাট্যের মঞ্চের কোন বিভাগ নেই । তবে পশ্চাত্যের বাস্তবধর্মীতার দিকে দৃষ্টিপাত থাকে । গীতিনাট্যের রূপসজ্জার পাশ্চাত্যের প্রভাব যেমন, পোশাকে বনেদিপনা ও জৌলসের ছাপ। অন্যদিকে নৃত্যনাট্যের বিশেষ করে মণিপুরী ধরণ গৃহীত।
রবিঠাকুর এক মহাসাগরের নাম। তাঁর সৃষ্টির সবচেয়ে মনোগ্রাহী দিক - তাঁর সংগীত এবং গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য-এ সঙ্গীতের ব্যবহার এক জটিল মনস্তাত্বিক আলোচনার দাবী রাখে। রবিঠাকুর তৎকালীন নাট্যজগতে নতুন দিশার বাতায়ন খুলে দিলেন, বয়ে আনলেন বিদেশি বাতাস কিন্তু গল্পে, গানে, রচনায়, সুরে লেগে রইলো দেশের সংস্কৃতির ভাবধারা।
তথ্যসূত্র :
১)গীতবিতান - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২) গীতবিতান তথ্য ভান্ডার
- পূর্ণেন্দু বিকাশ সরকার
(সিগনেট প্রেস )
৩) রবীন্দ্রনাথের গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য - ডক্টর প্রণয় কুমার কুন্ডু
৪) রবীন্দ্রজীবনী- প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
৫) রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ
৭) আনন্দবাজার পত্রিকা, চিঠিপত্র ৫
৮) বাইশে শ্রাবণ- নির্মলকুমারী মহলানবিশ
৯) শনিবারের চিঠি, ১৩শ বর্ষ, একাদশ সংখ্যা, ভাদ্র ১৩৪৮।
১০) রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ- পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়।
১১) বাইশে শ্রাবণ- রানি চন্দ।
১২)গুরুদেব- রানি চন্দ।
১৩)ঠাকুরবাড়ির আপনকথা
- পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
১৪)ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য
0 Comments