বাংলার ব্রত উৎসব ক্রমেই লুপ্ত হতে বসেছে
পি.শাশ্বতী
পর্ব--১
আর কদিন বাদেই আসছে মকরসংক্রান্তি,পৌষ মাসের শেষ।
'বারো মাসের তেরো পার্বণের' দেশ বাংলা। সংক্রান্তি ও নানা তিথি কে কেন্দ্র করে ব্রত- পালা পার্বণী লেগেই থাকে। পৌষ সংক্রান্তি হল সৌদ পুজো ও পিঠেপার্বণের উৎসব। বড় শহর গুলিতে সময় ও আধুনিক যাপন ছন্দের কারণে নানা ব্রত পালনের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলেও গ্রাম বাংলায় এখনও চল আছে। এই সকল পার্বণী গুলি গ্রামের মেহনতী মানুষদের বিনোদনের উপকরণ তো ছিলই এছাড়াও বেঁধে বেঁধে রাখত একে অপরকে। যে-কোনো দেশেরই লোকাচারে কোনো-না কোনো উৎসব আছেই। কোথাও কোথাও এ ধরনের উৎসবের সংখ্যাধিক্যও থাকে। কিন্তু বাঙালির ‘বারোমাসে তেরো পার্বণ’-এর রীতিতো একটি প্রবাদ হয়ে আছে এই দেশ ব্যাপী। আবার বাংলার এই তেরো পার্বণের আধিক্য ছাড়াও আছে অনেক আঞ্চলিক উৎসব। যার সবগুলোর সন্ধান আমরা অনেকেই জানি না। জানা সম্ভবও নয়। আঞ্চলিক উৎসবগুলি মূলত কোনো গ্রাম্য দেব বা দেবীকে কেন্দ্র করেই হয়ে থাকে। তবে এইসব ব্রতগুলির সিংহভাগই হয় কোন দেবীকে কেন্দ্র করে, এবং সেগুলি মূলত মহিলারাই পালন করে থাকে। কোথাও কোথাও আবার এই ব্রত পালনকে কেন্দ্র করে রীতিমত উৎসবের আয়োজনে মেতে ওঠে। আর এইসব মেয়েলি ব্রতগুলি স্বামী, সন্তান ও সংসারের মঙ্গল কামনায় করা হয়ে থাকে। এধরনের ব্রত শুধু যে এই বাঙলাতেই পালিত হয়, তাই নয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশেও এধরনের মেয়েলি ব্রত পালন করা হয়ে থাকে।
🍂
মধ্যযুগে ধর্মপূজায় মদ্যমাংসের সঙ্গে পিঠে নিবেদিত হত। তবে দেবতার পূজায় নিবেদনের জন্য বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার পিঠে প্রস্তুত করার রীতি ছিল । পরবর্তীতে গ্রীষ্মকালে পিঠেপুলি রুচিকর নয় বলে, বর্ষা বা শীতকালেই এই জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত পিঠেপর্বের মধ্যে পৌষ সংক্রান্তির পৌষপার্বণই সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। এই দিনটি হিন্দু পঞ্জিকায় ‘মকর সংক্রান্তি’ বা ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত। প্রাচীন হিন্দুরা এই দিনটিতে পিতৃপুরুষ অথবা বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে তিল এবং খেজুড় গুড় দিয়ে তৈরি তিলুয়া আর নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চাল থেকে তৈরি পিঠের অর্ঘ্য প্রদান করতেন। এই কারণে পৌষ সংক্রান্তির অপর নাম তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠে সংক্রান্তি। এই প্রাচীন উৎসবের একটি রূপ অদ্যাবধি পিঠেপার্বণের আকারে বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রচলিত। অগ্রহায়ণ এ আমন ধান ও নতুন ওঠা গুড় দিয়ে নবান্ন উৎসবের পর এটাই বড় উৎসব। পিঠে অনেক প্রকার হয়ে থাকে। তারমধ্যে ভাপা পিঠে বা সিদ্ধ পিঠে ও পাটিসাপটা বহুল প্রচলিত। চালগুঁড়ি দিয়ে তৈরি মণ্ড ও নারকেলের পুর দিয়ে এই পিঠে হয়। এছাড়াও নানা উপকরণের পুর ব্যবহার করে পিঠে হয়ে থাকে। ভাজা পিঠে ও পিঠে পুলি খুব জনপ্রিয়। এছাড়াও আস্কে পিঠে, সরুচাকলি প্রভৃতিও প্রস্তুত হত। কয়েক দশক আগেও একান্নবর্তী পরিবারগুলিতে মহা সমারোহে এই সব উৎসব পালিত হত জাঁকজমক করে। গ্রাম বাংলায় কয়েকটি পরিবারের বৌ রা মিলিত ভাবে এই উৎসব করত। প্রথম দিনে সদর ও ঘরের দরজায় খড় বেঁধে 'বাউনি' বাঁধা হত। পৌষমাসে নতুন ধান দিয়ে লক্ষীপুজো ও তার সাথে কলার পেটো দিয়ে তৈরি 'সৌদ' বা 'বাণিজ্য ডিঙা' পুজো করে সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালিয়ে স্থানীয় নদী বা পুকুরে ভাসান দেওয়া হত। সভ্যতার অগ্রগতিতে নানা প্রযুক্তিগত বিনোদন ঘরে ঘরে। এসেছে বহির্জগতের কাজের হাতছানি। অর্থের প্রয়োজনে সবাই শশব্যস্ত। তাই এইসব ব্রত পালন অনুষ্ঠানের সময় এখন অনেকের ই নেই। ক্রমে লুপ্ত হচ্ছে ব্রত গুলি। শুধু ভালোলাগার খাবারগুলি এখন সবই বিক্রি হচ্ছে নানা খাবারের দোকান ও মেলায়।
0 Comments