জ্বলদর্চি

পুনশ্চ /পুলক কান্তি কর

চিত্র- চন্দ্রিমা ঘোষ 
পুনশ্চ 
পুলক কান্তি কর


শ্রাবণী’র বাঁ হাতটা আলগোছে নিজের হাতে তুলে পল্টন বলল, ‘এই কনুইটার কাছে কি হয়েছে বৌদি?
-ও কিছু না! 
-কিছু না মানে? এতখানি নীলা পড়ে গেল - এমনি এমনি?
-ওই তো কাল বাথরুমে পা স্লিপ করে দেওয়ালে গুঁতো খেয়ে ছিলাম। তাতেই লেগে গিয়ে থাকবে বোধ হয়! 
পল্টন কিছু না বলে চুপ করে রইল। আজ পঁচিশে বৈশাখ বলেই বোধ হয় শ্রাবণী গতকালই ওয়াক্সিং করিয়েছে হাতে। এমনিতেই ধবেধবে ফর্সা গায়ের রং। তার উপর খুব হালকা মৃদু রোমের রেখা। এমনিতেই ভালো লাগে পল্টনের। কেন যে মিছিমিছি বৌদি এসব করায় –  ওর পছন্দ হয় না। অবশ্য এমন একটা বিষয় নিয়ে কোনও মতামত দেওয়াও ভালো দেখায় না। তবে মেয়েদের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে পল্টনের একদম টনটনে জ্ঞান। তিন তিনটে দিদির পরে ওর জন্ম। ফলে দিদিদের পুতুল খেলায় কুশীলব সেজে সেজে ওর এইসব মেকাপ টেকাপের জ্ঞান একদম পাক্কা। আলতো করে চোখ মেলে দেখলে, বৌদি ভ্রূ জোড়াও প্লাক করেছে। ভাগ্যিস, আবার লিপ এ কিছু করেনি কিছু! ওর তো আবার এসব করালে দিন দুয়েকের আগে ঠিক হয় না।  ঠোঁট টোঁট ফুলে কেমন একটা নর্থ ইষ্টের মেয়েদের মতো দেখতে হয়ে যায়। আজ পাড়ায় বড় করে রবীন্দ্র জন্মোৎসব পালন হবে। শ্রাবণী’র নাচ, গান, আলেখ্য - তিনটে বিষয়েই অংশ নেবার কথা! বিকেল সাড়ে চারটে বেজে গেল, তবু যেন ওর তেমন কোনও হেলদোল নেই। পল্টনকে আগে থেকেই বলে রেখেছিল জুঁই ফুলের মালা আনার জন্য। বেচারা এ-পাড়ায় পায়নি। আজকাল পঁচিশে বৈশাখে ফুলের চাহিদা থাকে আকাশছোঁয়া। ও সেই পাঁচ সাত কিলোমিটার বাসে চড়ে সদর থেকে নিয়ে এসেছে। পল্টন এবার তাড়া মারল জোরে, কী হল বৌদি, যাও,সাজগোজ কর এবার! শেষ মুহূর্তে কিছু লাগলে কিন্তু আমাকে পাবে না। লালন’দা এবার আমার উপরই সাজের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে। পাঁচটা সওয়া পাঁচটা বাজলেই আমি বেরিয়ে যাবো।

🍂

-পল্টন, একটু বেলের পানা বানিয়ে রেখেছি। ফ্রীজের মধ্যে রাখা আছে। নিয়ে খেয়ে নে। শ্রাবণী একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল।
-যা গরম পড়েছে বৌদি! ফ্রীজ থেকে বার করে খাবো? গলা বসে যায় যদি?
-তুই কোন গান ভাষ্য পাঠ করতে যাবি? মাইকও ফুঁকবি না! সুতরাং শান্তি মনে খা না! এটা বাড়ীরই বেল!
-কোন গাছটার গো? সামনের না কলতলার?
-কলতলাটার। সামনের গাছটায় কেন কে জানে এবার একটাও বেল হল না। একটা বড় শ্বাস নিয়ে শ্রাবণী আবার বলল, কে জানে বেলা বোধ হয় ফুরোল।
-এই তোমার শুরু হল। কপট ধমকে দিল পল্টন। যাও মুখ হাত ধুয়ে সুন্দর করে শাড়ীটা পরো দেখি! মালাটা না হয় খোঁপায় আমিই পরিয়ে দেব। বৌদি আজ চুলটা একটু,অন্যরকম করে বাঁধো না?
-অন্যরকম বলতে?
-এই কানের উপর দিয়ে একটা লক্সের উপর আরেকটা লক্স তুলে উপরের দিকে নিয়ে ক্লিপ করে দাও।
-সেই ভিক্টোরিয়া যুগের মতো? বিনুনি করে কানের উপর দিয়ে?
-না, না। অতখানি নয়। একটা কি দুটো লক্স তোল। তুমি চাইলে আমি করে দিতে পারি। 
-না, তুই বোস চুপ করে। মেয়েদের চুলে ছেলেদের হাত দিতে নেই।
-তাহলে আজকালকার পার্লার আর সেলুন উঠে যাবে যে গো বৌদি? সবাই তো তোমার ওই অনীতা আর্টিস্টকে দিয়ে ঘরে করায় না! তারা বাইরে যায় - সবখানেই পুরুষ নাপিত!
-ভালোই বললি পল্টন। বহুদিন পরে নাপিত শব্দটা শুনলাম। আজকাল সবাই ‘এক্সপার্ট’ উপাধি নিয়ে নেয়। নাপিত শব্দটা আর শোনাই যায় না। 
-ঠিক আছে বৌদি, আমি এখন যাই, তুমি বরং দরকার পড়লে আমায় ফোন করো।
-দাঁড়া, চুলটা অন্তত দেখে যা।
-বিষ্ণুদা কোথায় গো?
-অফিস গেছে তো!
-কিন্তু আজতো সরকার ছুটি ঘোষনা করেছে!
-ছুটির কথা আমায় কিছু বলেনি। রোজকার মতো সকালে উঠে বেরিয়ে গেছে।
-তোমার অনুষ্ঠান দেখবে না?
-বউদের পাড়ায় নাচাটা নাকি অপসংস্কৃতি রে পল্টন! উনি তাই না দেখে প্রতিবাদ করবেন।
-গতবছর তো গেছিল!
-গেছিল, কিন্তু পছন্দ করে না এসব।
-শুধু এইটুকু নাকি.... 
-সবই। আমার গান, আবৃত্তি কিছুই পছন্দ নয় তার! আজকাল যেন রবিঠাকুরের নামেই জ্বলে ওঠে সে! ছাড় ওর কথা। দেখ দেখি, -  এরকমটা?
-ওই লক্সটার উপর দিয়ে চালাও নীচেরটা।
-এইবার? 
-হ্যাঁ। এইবার ঠিক হয়েছে।
-কী টিপ পরবো রে? লাল, নাকি কালো?
-আগে বলো, শাড়ীটা কী রঙের?
-কচি হলুদের উপর লাল বুটি।
-তবে লাল টিপই পরো। একটু বড় সাইজের।
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পল্টন বলল, বৌদি তোমার কি কিছু হয়েছে?
-কী আবার হবে?
-না, কখন থেকেই দেখছি বড় অন্যমনস্ক লাগছে তোমায়! অন্যান্য বার তোমার রবিঠাকুরকে সুন্দর করে সাজাঅ, মালা পরাও। এবার তো তাও করো নি!
-কী আর হবে তাতে? ‘ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁওয়ার পেছন হতে পাইনে সুযোগ চরণ ছোঁয়ার!’
-এমন ভাবলে তো সবই ফুরিয়ে যাবে বৌদি! তাহলে তো পাড়ায় ফাংশান করারও মানে হয় না।
-ওটা বাধ্যতা রে! আমি না করলে, লোকে আড়ালে দু-কথা বলবে, নানান রকম ভাববে। বলতে পারিস ওটা আমার আপোষ!
-তোমাকে আজকাল আর বুঝতে পারিনা বৌদি! কেমন যেন বদলে যাচ্ছ তুমি!
-বদল তো কালেরই নিয়ম, পল্টন!
-কিন্তু সময়ের তালে পা মিলিয়ে বদলালে চোখ সয়ে যায়। পা না মিললেই সমস্যা! তোমার তাল-লয়টা বড় দ্রুত যাচ্ছে।
-বলছিস?
-হ্যাঁ বৌদি। তুমি নিজেই দ্যাখো, আজকাল তুমি আগের মতো বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখো না। আগে একটা শালিক দেখলে কতখানি ব্যাকুল হতে তোর জোড়া খুঁজতে ...
-তুইতো বলতিস, ‘যত্ত সব কুসংস্কার!’
-সে তো এখনও বলি! কিন্তু তাই বলে তো তোমাকে ওটা ত্যাগ করতে বলিনি কোনওদিন!
-বাঃ রে! এটা কেমনধারা লজিক হল? মানুষ খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করলে তাকে তো উৎসাহই দেওয়া উচিৎ!
-তুমি তো ত্যাগ করতে চাও বলে করেছো, এমনটা তো নয় বৌদি! তুমি এখন করো না তোমার মন চায় না বলে!
চুপ করে রইল শ্রাবণী ।কথাটা ঠিকই বলেছে পল্টন। ও আজকাল কোনও কিছু করার পেছনে আর কোনও কারণ খোজে না। এখন সে শুধু অভ্যাসের দাস! সকাল ছটায় অ্যালার্ম বাজিয়ে ঘুম থেকে ওঠে সে, বরের অফিস যাবার রান্না আর টিফিন বানাতে।  চা খায়। ওর বর বেরিয়ে গেলে চুপচাপ বসে থাকে, এটা ওটা গোছায়। সাড়ে এগারোটা বারোটা নাগাদ ইদানীং পল্টন আসে। দেড়টা দুটো পর্যন্ত তার সাথে গল্প করে। তারপর খাওয়া-দাওয়া, একটু ঘুম – রোজ একই দিনলিপি। আগে ভোর পাঁচটায় উঠে একটু গান নিয়ে বসতো। আজকাল তাও ইচ্ছে করে না। এমন সময় পল্টন বলে উঠলো, ‘আজকাল তোমাকে একটু গুনগুন করে গাইতেও শুনি না কখনও!’
-গাই তো!
-কই গাও! আগে সবসময় গাইতে। কোনও একটা শব্দ বললেই ওই শব্দ নিয়ে একটা গান গেয়ে দিতে। তুমিই বলতে, তোমার নাকি গান পায়! এখন আর পায় না তোমার?
চুপ করে রইল শ্রাবণী। আস্তে আস্তে উঠে গেল ড্রেসিং টেবিলের সামনে। পল্টনকে বলল, ‘তুই যা এবার। তোর ওদিকে দেরী হয়ে যাবে নইলে!’   
                                (২)
  রাতে অনুষ্ঠান শেষ করে শ্রাবণী যখন বাড়ী এল, দেখল অনুপ সোফায় বসে টিভি দেখছে। মুখটা থমথমে। স্বাভাবিক। অফিস থেকে এসে চা জোটেনি। সামান্য এইটুকু কাজ কি নিজে করে নেওয়া যায়না? অথচ ও মুখে এই নিয়ে কোনও অভিযোগ করে না। মাথার খোঁপা থেকে জুঁই ফুলের মালাটা খুলতে খুলতে শ্রাবণী জিজ্ঞাসা করল, ‘কখন এলে?’
অনুপ গলাটা মোটামুটি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন? অন্যান্য দিন যেসময়ে ফিরি, সেই সময়ে ফেরাটাই স্বাভাবিক।’
-না, আসলে ছুটির দিনে ফেরার সময়টা অন্যান্য দিনের মতো থাকে কিনা, কৌতুহলটা ওটা নিয়েই। ছোট্ট করে ফোড়ণ কাটল শ্রাবণী। 
-আমাদের অফিসে আজ ছুটি ছিল, তোমায় কে বলেছে?
-কাউকে বলতে হবে কেন? পেপারে দিয়েছে, টিভিতে শুনেছি।
-সব চাকরী সমান নয়! আর তাছাড়া বাড়ীতে থেকে কী করতাম?
-রোববার বা অন্যান্য ছুটির দিনে কী করো?
-আমি থাকলে কি তুমি খুশী হও টুকু?
-আমার খুশী অখুশী ভেবে তুমি তোমার ঘরে থাকো নাকি?
-আসলে ভাবলাম আমি বাড়ী না থাকলেই তোমার সুবিধা। সারা দুপুর কথাবন্ধ, শ্বাসবন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস করবে!
-মানে? চিৎকার করে উঠল শ্রাবণী।
অনুপ ততোধিক শান্ত গলায় বলল, আজ কী কী গানে নাচলে?
-ওই তো – ‘মোর বীনা ওঠে’, ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে!’
- হাঁটু অবধি শাড়ী তুলে নাকি?
-কী সিনিকের মতো কথা বলছ তুমি? হাঁটু অবধি শাড়ী তুলতে যাবো কেন?
-ডালা ভরা পাকা ফসল কি অ্যাংকেল লেন্থ শাড়ী পরে মাঠ থেকে তুলে আনা যায়? লোক তো ড্যান্স ডাইরেক্টরের ক্লোদিং সেন্স নিয়ে প্রশ্ন তুলবে!
-এ পাড়ায় লোকেদের অত ফিল্ম ক্রিটিকদের মতো বিচার করার মন নয়! তোমার দেখতে ইচ্ছে হলে বলো, পল্টন বোধ হয় ভিডিও করে রেখেছে।
-স্বতঃ প্রনোদিত হয়ে, নাকি তোমার কথায়?
-লোকে নিজের লোকেদের অনুষ্ঠান ভিডিও করে রাখে, এতে এত প্রশ্ন উঠছে কেন?
-পাড়ার অন্য লোকেরা বুঝি পল্টনের নিজের লোক নয়? বলেই অনুপ লুঙ্গির গিঁটটা খুলে আবার লাগাতে লাগাতে চলে গেল শোওয়ার ঘরে।
শ্রাবণী পেছন পেছন বলল, ‘শোবার ঘরে যাচ্ছ কেন? পাঁচ মিনিট বসো। আমি ড্রেসটা চেঞ্জ করেই খাবারটা গরম  করে দিচ্ছি।‘
-আমি বাইরের থেকে খেয়ে এসেছি টুকু! রাতে খাবো না।
-এটা তুমি আগে জানাতে পারো নি?
-কখন কীভাবে জানাবো? তোমার মোবাইল কি খোলা ছিল? নাকি নৃত্যরতা বউকে ফোন করা সমীচিন হত?
-সকালেও তো জানাতে পারতে!
-প্রথম কথা সকালে এমন প্রোগ্রাম ছিল না। আর দ্বিতীয় কথা, আমার স্ট্যান্ডিং ইনস্‌ট্রাকশন দেওয়াই রইল, তোমার এধরনের প্রোগ্রাম থাকলে আমার রাতের রান্না করবে না। প্রোগ্রাম করতে গেলে সংসারের বেশী ধকল না নেওয়াই তো ভালো! 
ঝগড়া করতে চাইলে অনেক কথাই বলা যেত। কিন্তু শ্রাবণীর আর সেসব প্রবৃত্তি হল না। শুধু বলল, আমাকে নিজেকে তো খেতে হবে! সুতরাং বাড়তি ধকল আর হবে কোত্থেকে?
-সে কী? এত বড় স্টার পারফর্মার! তার জন্য কোনও প্যাকেটের ব্যবস্থা থাকে না? সেরকম হলে আমি এক প্যাকেট খাবার পার্সেল করে আনতাম! পরের বার থেকে বলে দিও, নিয়ে আসবো।
অনুপের গলার স্বর এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত, কথার শ্লেষটুকু ধরা গেল না। বরং কোথাও একটা আন্তরিকতার সুরও বাজলো। শ্রাবণী কিছু না বলে একটা হাল্কা নাইটি পরে শুতে চলে এল।
-কী হল, খাওয়া হয়ে গেল এত তাড়াতাড়ি? অনুপের গলায় জিজ্ঞাসা।
-হ্যাঁ।
-কী খেলে?
-জল।
-ব্যাস? কেন?
-খিদে নেই।
-লোকের হাততালিতে পেট ভরে গেল? মাইরি, তোমার পেট ভরানো কত সোজা! সকাল বিকেল দু-চারটে তালি বাজিয়ে দেব এর পর থেকে।
-কেন, তুমি কি আমার খাওয়ার খরচে বাহুল্য বোধ করছ? 
-না,না মজা করছি। এসিটা ছেড়ে শুয়ে যাও।
  একটুক্ষণ চুপ থেকে শ্রাবণী বলল, একটু আগে তুমি একটা কিছু আমাকে ইঙ্গিত করতে চাইছিলে আমি বুঝতেও পারছি। তা তুমি ঝেড়ে কাশবে নাকি আমাকেই খোলাখুলি প্রশ্ন করতে হবে?
-আমি যা বলি, সোজা সাপটাই বলি। আমি কোনও ইঙ্গিত টিঙ্গিত করিনি।
-কিছুক্ষন আগে দুপুরে মুখবন্ধ-হাঁসফাঁস এসব কিছু বলছিলে, তুমি কি পল্টনকে নিয়ে কিছু বলতে চাইছো?
-টুকু, কাল সকালে অফিস যাওয়া আছে; মাঝরাত্তিরে আমার ঘুমটার শ্রাদ্ধ করে দিও না,প্লীজ! 
-সেটা তোমার আগে ভাবা উচিৎ ছিল। অন্যের ঘুমটা ভাঙানোর কি তোমার রাইট আছে?
-আমি তেমন কিছু বলিনি, টুকু!
-আলবাৎ বলেছো। তুমি বলেছো, তুমি না থাকলেই আমার সুবিধা! কথাটার মানে বোঝ?
-দিব্যি বুঝি! আমি না থাকলে স্বাধীনভাবে থাকবে, কথা বলবে - এটাই মিন করতে চাইছিলাম। অন্য কিছু না।
-তোমার মনে হল কেন যে তুমি থাকলে আমি স্বাধীনভাবে থাকি না?
-সেটা নিজের অন্তরকে জিজ্ঞাসা করো, টের পাবে।
-আমার জিজ্ঞাসা করা আছে। আমি জানি ওটা ঠিক কথা নয়।
-এত খুশীর কথা টুকু। যে স্বামীর সাথে তোমার মনের কিছুমাত্র মিল নেই, যার রুচি তোমার সাথে মেলে না, যার কথাবার্তা চিন্তাভাবনা - একেবারেই তোমার বিপরীত - তার উপস্থিতিতে তুমি ময়ূরের মত পেখম তুলে নেচে ওঠো খুশীতে - এটা খুবই আনন্দের! আমি নিজের প্রতি গর্ব অনুভব করছি, টুকু!
-আর তোমাকে যেটা জিজ্ঞাসা করলাম?
-কোনটা?
-না বোঝার ভান করনা অনু! পল্টনের ব্যাপার নিয়ে তোমার কোনও খিঁচ থাকলে আমায় নির্দ্বিধায় বলো, আমি শুধরে নেবো।
-আমার কোন কিছু নিয়ে বা কাউকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই টুকু। রোজ খাচ্ছ-দাচ্ছ-ঘুমোচ্ছ এভাবেই জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দাও না! দয়া করে তুমিও চিমটিও না।
-এই খাচ্ছি-দাচ্ছি-ঘুমোচ্ছি, এটা কি জীবন? 
-দ্যাখো টুকু, এটা আমার এক্তিয়ারের বাইরে। গান শিখতে চাইলে, কোলকাতার নামী সংগীত শিল্পির কাছে যাচ্ছো নিয়ম করে - আমি টাকা পয়সা দিয়েছি। কোনও বাধাও দিইনি। নাচ শিখতে চাইলে - তাও যোগাযোগ করিয়ে দিলাম। যদি বলো কবিতা শিখবে  - সে ব্যবস্থাও করে দিতে পারি। এখন তুমি সব শিখেও কেন স্বাগতালক্ষী হতে পারলে না বা কেন অলকানন্দা হতে পারলে না সেই আফসোস আমি মেটাতে পারবো না।
-আমি কি তাই বলতে চাইছি?
-তবে কী বলতে চাইছো?
-দিব্যি বোঝ, আমি কি বলতে চাইছি। না বোঝার ভান করছো শুধু।
-প্লীজ টুকু, এইসব ন্যাকামি রাত দুপুরে আমার একদম ভালো লাগছে না।
-তুমি বললে আমাকে কোনও কিছুতে তুমি বাধা দাও না। সত্যিই কি তাই? তুমি মনে মনে সাপোর্ট কর আমি যা করি এ সব কিছুতে?
-হ্যাঁ।
-কেন নিজেকে চোখ ঠারছো অনু? তাই যদি হত তুমি কি আজ এই প্রোগ্রামটায় থাকতে পারতে না? সাপোর্ট করা মানে শুধু ফিনানসিয়াল সাপোর্ট নয়! অন্যকে এই অনুভবটা দিতে হয়, তুমি পাশে আছো।
-সেটা কিভাবে সম্ভব টুকু? আমি এইসব প্যানপ্যানানি ভালোবাসি না। রবীন্দ্র সঙ্গীত আমার রীতিমত ন্যাকামোও মনে হয়। রবীন্দ্র নৃত্য তো আরও ট্যাঁশ....
-প্লীজ আজকের দিনে আর এসব বলো না! এমন করে রবিঠাকুরকে – ছিঃ ছিঃ! যে এ’রকম ভাবে, সেই মানুষের সাথে আমাকে একসাথে থাকতে হয়...?
হ্যা হ্যা করে হেসে উঠল অনুপ। ‘আমি ত এই কথাই বলতে চাইছিলাম সোনা-মোনা।‘ বলেই হালকা করে শ্রাবণী’র দুটো গাল টিপে দিল সে। আমি জানি, তোমার রুচির সাথে আমার রুচি মেলে না। সত্যটা স্বীকার করে নাও না! তুমি তোমার মতোই থাকো! মিছিমিছি দুটো ভিন্ন মেরুকে জুড়তে চাইছো বলেই এত সমস্যা!
                                (৩)
-কী গো বৌদি, কাল বিষ্ণুদাকে জিজ্ঞেস করেছিলে, ও কোথায় ছিল? 
-না। আমি ওসব জিজ্ঞেস করি না। ও ওর নিজের মতো করেই থাকুক।
-‘থাক থাক নিজ মনে দূরেতে?’ তবে তো বৌদি তোমায় সুরে সুরে স্পর্শ করাতে হবে ওর প্রাণ মন! সেই সুরেও তো আর তেল দাও না দেখি বহুদিন! 
-আমার সুর ওর প্রাণ স্পর্শ করে না রে! 
-ওটা সুরের দোষ নাকি প্রাণের? নাকি কোনওটারই নয়? 
-হয়তো হাওয়ার! কিন্ত হাওয়াকে তো আর লাগাম দেওয়া যায় না। ও তার নিজের বেগেই চলে।
-সমস্যাটা কোথায় বৌদি? তুমি এত ভালো! বিষ্ণুদাকেও সবাই ভালো মানুষেরই মর্যাদা দেয়। 
-আমার মনে হয় ওর কোথাও একটা অভাব বোধ আছে ! 
-কিন্তু এটা তাসের দেশের রাজপুত্রের অভাবের মতো নয়তো? ওই অভাবটা আসলে অভাবেরই অভাব! ওখানে তো নতুন রাজ্য জয় এর ব্যাপার ছিল। এখানে কার কোন নতুন সমুদ্র বাওয়াটা হচ্ছে? বাই দা বাই, তাসের দেশ নিয়ে কথা উঠল যখন - একটা কথা বলি। কাল ওই ‘তাসের দেশ’ নৃত্যনাট্যটা দেখতে গিয়ে মনে হল কথাটা।  তাসের দেশের রাজা যখন রানীবিবি এবং মন্ত্রী অমাত্যদের নিয়ে শিক্ষা বিষয়ক এবং আরও অনেক কথা বলছিলেন - কোথায় যেন হীরক রাজার দেশের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল! 
-গ্রেট মেন থিংক অ্যালাইক!  
-ওখানে আরও একটা বিষয় খুব স্ট্রাইকিং বৌদি। এই যে হাওয়ার কথা বললে না, - এই হাওয়া কিন্তু আগে মেয়েদেরই গায়ে লাগে! মেয়েরা বদলাতে চাইল বলেই বদলটা হল। পুরুষরা এবিষয়ে একটু বেশী গোঁড়া, কুঁড়ে টাইপের!
-এটা খুব ভালো অবজার্ভেশন! মানে অবজার্ভেশনটা রবীন্দ্রনাথেরই। তুই যে ব্যাপারটা খেয়াল করেছিস সেটা সাধুবাদের যোগ্য!
-এই জন্য দ্যাখো এখনও স্টাইল বা ট্রেন্ডের চেঞ্জটা কিন্তু আমরা মেয়েদের দেখেই ধরতে পারি। পুরুষদের দেখে নয়। পোষাক-আষাক, ব্যবহার, এমন কি কথাবার্তার তফাৎটাও -
-তুই হঠাৎ এই প্রসঙ্গ তুললি কেন পল্টন? তোর কি মনে হয়, এই বাড়ীতেও হাওয়াটা আমার গায়েই লেগেছে আগে? 
-এমন করে কনক্লুশান টেনো না বৌদি! প্রসঙ্গ ক্রমেই কথাটা এসেছে। 
-আচ্ছা পল্টন, অনেকদিন ধরে তুই ইচ্ছে করে একটা ব্যাপার আমার কাছ থেকে লুকিয়ে যাচ্ছিস!
-কী কথা?
-এতগুলো যে ইন্টারভিউ দিলি, তার কী হল?
-সবই তো দূরে দূরে পোষ্টিং বৌদি! হয় দিল্লি, গুরগাঁও নইলে ব্যাঙ্গালোর।এ তদূরে গিয়ে থাকতে পারবো না।
-এত লোক পারছে, তোর না পারার কী আছে?
-এই তো লোকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছেলেপুলেদের গালি দেয়। বাবা-মা আর নিজের গ্রাম-শহর ছেড়ে কেরিয়ারের টানে সব বিদেশে চলে যাচ্ছে! আমি যেতে চাইছিনা বলে কোথায় উৎসাহ দেবে তা নয়, উল্টে গালি দিচ্ছ।
-দেবোই তো। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এভাবে কদিন বাপের হোটেলে খাবি পল্টন? এতে সম্মান থাকে না। আর আমি দিব্যি জানি বাবা-মা’র প্রতি তোর মনে মনে যাইই থাকুক না কেন দেখনদারি পীরিত একেবারেই নেই। তোর দুটো দিদিরই তো পাড়াতেই বিয়ে হয়েছে। আপদ-বিপদ হলে তারাই দেখবে। তুই কোনও একটাকে কনফার্ম কর।
-আমি যাবো না বৌদি। তুমি যা বলবে বল, যা গালি দেবে দাও - আমি এই গুসকরা ছেড়ে কোথাও যাবো না।
-কোনও স্পেশাল অ্যাট্রাকশান আছে কি?
-থাকলে কি তুমি জানতে না?
-তাহলে সমস্যাটা কোথায়? 
-ও তুমি বুঝবে না বৌদি! কলকাতায় চাকরী হলে একমাত্র নেব, নইলে নয়।
-এটা কিন্তু গোঁয়ার্তুমি হচ্ছে।
-হয়তো হচ্ছে। কিন্তু আমি নিজের কাছে পরিষ্কার!
-তোর ইচ্ছে করে না নিজের পায়ে দাঁড়াতে?
-ইচ্ছে করে বৌদি, তবে ইঞ্জিনীয়ার হতে ইচ্ছে করে না। আমার ইচ্ছে করে একটা ফিল্ম বানাই। তোমাকে তো বোধ হয় বলেওছি আগে।
-ইচ্ছা অপূর্ণ রাখছিস কেন? তোদের তো তেমন টাকা পয়সার অভাব নেই। সেরকম হলে টেকনিক্যাল বিষয়টা শিখে নে। সত্যজিৎ ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে কোর্সটা করে নেওয়াই তো যায়!
-তা তো যায়! কিন্তু ফিল্ম করার টাকা পাবো কোথায়? কে আমাকে ছবি করার জন্য ভরসা করবে? অথচ জানো আমার চিত্রনাট্য লেখা হয়ে গেছে, গান লেখা হয়ে গেছে, মনে মনে কাস্টিংটাও করে নিয়েছি।
-সে কী রে? কী নিয়ে ফিল্ম করবি?
-আগে অন্য কিছু ভাবছিলাম - রিসেন্টলি মনে হচ্ছে কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে ফিল্ম করবো।
-তা এই চরিত্রটায় কাকে ভাবলি?
-তোমাকে!
-তুই তো প্রথম থেকেই ফ্লপ করার দিকে এগোচ্ছিস রে পল্টন! বুঝে গেছি তোর এলেম! পাগলামি ছাড় আর - চাকরীতে জয়েন কর!
-বৌদি তুমিও উড়িয়ে দিচ্ছ? আগে শোন না ভালো করে আমার কথা!
-তোর কাদম্বরী অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু তুই আমাকে দিয়ে সিনেমা করবি কী বলে? তুই কি রবিঠাকুরের চরিত্রটা নিজে করবি?
-আমার চেহারায় যদি ওই দীপ্তি থাকতো, তবে কি আর অন্য কাউকে ভাবতাম বৌদি! যীশুকে ওই রোলে ভেবেছি, কিন্তু যথেষ্ট জেলাস হয়ে!
-আমার কথাটা কেন ভাবলি শুনি?
-দুটো কারণ। কালকে তুমি যেভাবে আলেখ্য পাঠ করলে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তুমি অভিনয়টা ভালোই পারবে। তবে আসল কারণটা অন্য। 
-কী সেটা?
-তোমাদের বাড়ীর পেছনের পুকুরের ঘাটটায় তুমি যখন মাঝ মাঝে বিকেলে এসে বসো, তখন আমার কেমন যেন মনে হয়। মনে হয়, সেই প্রাচীনকালের কোনও মস্ত জমিদার বাড়ীর কোনও মানসিক ভাবে নির্যাতিতা অল্প বয়সী বউ এসে জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে বসে আছে...
-সেই সাহেব বিবি গোলামের পুটু বৌঠান? 
-অনেকটা। কাদম্বরীও ভাবতে পারো। গল্পটা তো একরকমই! তোমার ফর্সা পা দুটো গোছ অব্দি ডুবিয়ে আনমনে বসে থাকো - হঠাৎ করে জলে তরঙ্গ আসে আর তোমার রূপোর মলগুলো তখন কেমন যেন বেঁকে চুরে উপরে নীচে করতে থাকে... 
-তুই বুঝি এসব দেখিস? ও হ্যাঁ, তুই একবার বলেছিলি - মেয়েদের পায়ের পাতা দেখাটা তোর একটা ফ্যাসিনেশন! 
পল্টন এই কথার জবাবে গেল না। সে একটা ঘোরের মধ্যে থেকে কাদম্বরী ছায়াছবির অনেক কাল্পনিক দৃশ্যপট পরপর বলে যেতে লাগলো। ‘জানো তো বৌদি, যেদিন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জাহাজের উদ্‌বোধন হওয়ার কথা, কাদম্বরী নতুন শাড়ী পরে সেজেগুজে বসে আছেন - তোমাকে ওই সিনে একটা গাউন পরাব। ঠিক ভিক্টোরিয়ার যুগের মতো। তোমার চুলগুলো বাঁধবো খেজুর পাতা দিয়ে বোনা শীতলপাটির মতো। তখন তো নেলপালিশ ছিল না। ভাবছি কুঁচ ফলের উপরটা কেটে নিয়ে তোমার নখের উপর বসিয়ে নেল আর্ট করে দেব। ঠাকুরবাড়ীতে নানান রূপচর্চা তো হতই, কেউ আতিশয্য বলে গালি দিতে সাহস পাবে না। সেই সময়টায় রবিঠাকুরকে বসিয়ে দেব তোমার ওই পুকুর ঘাটটায়।
-শ্যুটিংটাও তুই এই পুকুরে করবি নাকি?
-ভাবছি ওটা। পুকুরটার উত্তর পাড়টা নিয়েই সমস্যা! আমার ছবির পুকুরটার তিনধারেই বড় বড় গাছ থাকবে। তাদের ছায়া প্রতি নিয়ত কাঁপবে পুকুরের জলে। বৌদি, আজ বিকেলে একটু পুকুরের ঘাটটায় গিয়ে বসবে?
-বসতেই পারি!
-মলটা পরে যাবে কিন্তু! আর প্লীজ নাইটি পরে যেও না। একটা ছাপা শাড়ী আটপৌরে ঢঙে পরে এসো। গিয়ে আমায় একটা কল করো, আমি চলে আসবো।
-ঠিক আছে।
-শোন না, তোমার একটা গরদের উপর কাঁথাস্টিচ আছে না? ওইটাই পরে এসো বরং। ছাপা-শাড়ীর থেকে ওটাই খুলবে ভালো!
-এই গরমে গরদ পরতে পারবো না। তাছাড়া লোকে দেখলে কী ভাববে?
-তোমার পুকুর পাড়টা আড়াল বেশ! তাছাড়া বিকেলে কোন গরমটা?
-ঠিক আছে। পরে আসবো।
  বিকেলে ঠিক চারটেয় শ্রাবণী একটা গরদের শাড়ী পরে এসে বসল পুকুরটার পাড়ে, বাঁধানো ঘাটে। চুলটা বেঁধেছে অনেকটা গতকালের মতোই, চাটাই বোনার ঢঙে। কপালে একটা বড় টিপ। মাটির গয়না গলায় আর কানে। ওকে দেখে পল্টন বলল, ‘একেবারে কাদম্বরী সেজে এসেছ গো!’ শুধু যেন জাহাজ ঘাটা থেকে ডাক আসার অপেক্ষা! শুধু এই বেলা তোমায় বৌঠান বলে ডাকি?
-তুই আমার অনুমতি নিচ্ছিস? আজ ঠাকুরপোর সব ইচ্ছেতেই আমার ‘হ্যাঁ’।
-বৌঠান, তোমার কী মনে হয়, কাদম্বরী কি সেদিন চেয়েছিলেন - জ্যোতি দাদা নিজে এসে ওঁকে নিয়ে যান? না কি মনের কোনও এক জায়গা থেকে অন্য কেউ বলছিল রবি ঠাকুরপো নিয়ে যাক? 
-মনে হয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথকেই চেয়েছিলেন। রবিঠাকুর তখন সদ্য বিবাহিত। ফলে একটা হারানো জায়গা খোঁজার বিষয় ছিল বলেই মনে হয়!
-বেশ বলেছ! মানুষের মন বড় জটিল বৌঠান! বড্ড জটিল! কী যে চায়, বোঝা বড় মুশকিল!
-অনেক সময় হয়তো বোঝা যায়, তবে সেই বোঝাটাই মস্ত বড় দায় হয়ে যায় সময় সময়! সেটা আরো বড় সমস্যা রে!
-ঠিক কথা! এবার পা টা একটু জলে ডুবিয়ে বসো।
-কতটা ডোবাবো?
-ঠিক দু-ধাপ। শাড়ীটা আর একটুখানি তোল। ঠিক পায়ের ডিমটা যেখানে ঢেউ এর মতো এসে গোছে মিশেছে সেই জায়গাটা পর্যন্ত তোল। 
একটু এপাশ-ওপাশ করে শ্রাবণী বলল, ‘এবার ঠিক আছে?’
-হ্যাঁ। বৌঠান মোবাইলে একটা ছবি তুলব, তোমার পায়ের?
-তোল!
পল্টন ওর হাতটা দিয়ে শ্রাবণী’র ডান পায়ের উপর হালকা করে জলের ঢেই দিতে দিতে বলল, একটুখানি পা টা ছঁতে দেবে?
-এখানে কেউ দেখলে অন্য মানে করবে পল্টন। ঘরে চল।
ঘরে এসে শ্রাবণী বলল, এবার কি জামা কাপড় বদলে আসবো?
-তুমি যে বললে পা দুটো ছুঁতে দেবে? এই শাড়ী পরা অবস্থাতেই  ছুঁতে চাই।
-কোথায় বসব? সোফায়?
-বসো। পল্টন শ্রাবণী’র ঠিক পায়ের কাছে বসে ওর পায়ের পাতাটা তুলে নিল নিজের কোলে। ‘কী সুন্দর তোমার পা দুটো বৌঠান! ঠিক যেন মাখনের মতো তুলতুলে! শাড়ীটা হাঁটু অবধি তুলি?
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো শ্রাবণী। জানলার কাছ দিয়ে একঝলক বাইরে তাকালো সে। এখনও গোধূলি শেষ হয়নি। এক ঝাঁক পাখী সারিবদ্ধ হয়ে ফিরে চলেছে ওদের সামনের সুপুরি গাছদুটোর ঠিক উপর দিয়ে। শ্রাবণী ওই সুপারি গাছের ফাঁক দিয়ে মাঝেমাঝে সন্ধেতারাটিকে দেখে। এখনও ওঠেনি সে।
                               (৪)
আজ দুপুরে পল্টন আসেনি। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শ্রাবণী ফোন করল। ‘কী রে, কী করছিস এখন?’
-তোমাকে ফোন করব ভাবছিলাম। সংকোচ হচ্ছিল.... 
-ওইজন্যই তো ফোনটা করলাম।
-বৌদি আমি গুরগাঁও এর চাকরীটা নেব বলেই স্থির করেছি। ওদের মাইনে এবং সুযোগ সুবিধাগুলো অনেকটাই বেশী।
-খুব ভালো খবর। কবে যাবি?
-ওটাই বলতে চাইছিলাম। পরশু সকাল দশটায় জয়েন করতে হবে। ফ্লাইটের চার্ট দেখছিলাম। আমাকে আগামীকালই বেরিয়ে যেতে হবে।
-খুবই আনন্দের কথা পল্টন। তোর জীবন  এবার একটা দিশা পাবে। আমি খুবই খুশী হয়েছি রে! 
-তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও বৌদি! কাল আমি ঠিক নিজের মধ্যে ছিলাম না। আমি ঠিক ওভাবে...
-ঠিক আছে। তুই মনে কোনও গ্লানি রাখিস না এই নিয়ে। আমি কিছুই মনে করিনি, মনে করবও না।
-বৌদি তুমি আমাকে মনে মনে একশো জুতোর বাড়ি মারো। আমি তারই যোগ্য!
-ফোনে এসব কথা আর বলিস না। তুই পৌঁছে আমাকে একটা ফোন করিস। আর তোর ওখানকার ঠিকানা পাঠাস।

 দিন পাঁচেক পরে স্পিডপোস্টে একটা চিঠি পেল পল্টন। ‘কল্যানীয়েষু, ভাবছিস মোবাইল থাকতে,হঠাৎ চিঠি কেন? আসলে কথার মাঝখানে তুই এত বকবক করিস, আমার সব কথা গুছিয়ে বলা হত না তাহলে।
  জানিস পল্টন, তুই আমার থেকে বছর ছয়েকের ছোট। সেই বিয়ের পর থেকে তুই ছিলিস আমার সত্যিকারের বন্ধু, সমস্যার সাথী। আমরা দুজনেই পরস্পরকে ভালোবাসতাম বা এখনও বাসি। আমি জানি তার মধ্যে আলাদা গন্ধ ছিল, আলাদা রঙ ছিল। সেটা ঠিক স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার মতো শরীরের গন্ধ মাখা নয়। তবু নিজেকে চোখ ঠারাস না, আমি প্রতিনিয়ত তোর চোখে আমার প্রতি তোর মুগ্ধতা দেখতাম। আমি জানতাম, শুধুমাত্র আমার মোহেই তুই দেশের মায়া ছাড়তে পারছিলি না। আমার দেহেই আটকে ছিল তোর স্বপ্ন, তোর উড়ান। সেই মোহ থেকে তোকে মুক্তি দিলাম।
  তুই হয়তো ভাবছিস আমি তোর বিষ্ণুদার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছি। হয়তো তোর মনে এজন্য অপরাধ বোধও হচ্ছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, এজন্য আমার কোনও খারাপ লাগা নেই। পাপ-পূণ্যের হিসেব আমি ওভাবে করিও না। সত্যি সত্যি বিশ্বাসের দাম দেওয়া উচিৎ ছিল কিনা - তার কৈফিয়ৎও রয়েছে আমার নিজের সত্তার  কাছে। সে জবাবদিহি আমি কাউকে করব না। 
  তোর কাদম্বরীর চিত্রনাট্যটা সত্যিই ভারী সুন্দর। এ জীবনে আফসোস রইল, আমি তোর কাদম্বরীর রোলটা করতে পারলাম না। তবে হাল ছাড়িস না। স্বপ্ন না দেখলে, জীবনের কী মানে বেঁচে থাকে! কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় ডাক্তারী পড়তে পড়তে কবে ভেবেছিলেন, একদিন চাঁদের পাহাড় বানাবেন! একদন তোরও স্বপ্ন পূর্ণ হবে। তবে দেখিস, সুন্দর ফর্সা পায়ের গোছ আছে এমন মেয়েকেই কাস্টিং করিস। কিন্তু ভারী সমস্যা হবে তোর! তোর মতো অনামা পরিচালক কি বলতে পারবে, ‘স্ক্রীন টেষ্ট করবো, হাঁটু আব্‌দি কাপড় তুলুন।’ যে সব ফিল্মস্টাররা অলরেডি স্কার্ট পরে পাবলিকের সামনে এসে গেছে - তারা নিশ্চই কাদম্বরীর এই রোলে নজর কাড়বে না! এটা তোর কাছে একটা সমস্যা হয়ে রইল। তবে কিছু না কিছু উপায় নিশ্চই বার করবি। ওই সিনটা কিন্তু মাস্ট!
  আর একটা কথা। চিঠিটা পড়ে কিন্তু ছিঁড়ে ফেলিস। বারবার এই চিঠিটা পড়তে থাকলে তোর বাংলা ছেড়ে বাইরে চলে যাওয়ার আর কোনও মানেই থাকবে না। কী রে! আর একবার পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে? বেশ, আর একবারই কিন্তু!
  ভালো থাকিস। ইচ্ছে হলে মাঝে মাঝে ফোন করবি। কষ্ট হলে নাও করতে পারিস।
                                                          ইতি,
                                                             বৌদি     
পুনশ্চঃ আর একটা কথা। ‘মোর লাগি করিও না শোক, আমার রয়েছে বিশ্বলোক।’ আমি ভালোই থাকবো। আমার জন্য চিন্তা করিস না, আমার কথা ভেবে সময় নষ্ট করিস না। অন্তত জ্ঞান থাকতে, কাদম্বরীর পরিণতি আমি ভাবতেও পারিনা। পোস্টমর্টেমের ঘরে মুদ্দাফরাসেরা আমার বিবস্ত্র দেহ নিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করবে, মনে হয় আমার মৃত  দেহও তা সইতে পারবে না। অতএব - মা ভৈ! ভালো থাকিস।

Post a Comment

0 Comments