জ্বলদর্চি

জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ১৭৯


জ্বলদর্চি ছোটোবেলা ১৭৯
চিত্রগ্রাহক - ঋপণ আর্য

সম্পাদকীয়,
শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন, আমলকির ঐ ডালে ডালে। ডালে বসে ঐ যে তোমাদের বন্ধুরা শীতের হাওয়ার সঙ্গে গল্প করছে। কিসের গল্প?  ভূতের। কার গল্প? তোমাদের বন্ধু আরিয়ার। সেই ছবি তুলে পাঠিয়েছে ঋপণ আঙ্কেল। আর ছোট্ট বিলের কীর্তি কাহিনি শুনিয়েছে তানিয়া আন্টি। ছোট্ট বন্ধুরা, শীতের বন্ধু কে বলতো? রোদ্দুর্ররর। তাই আরণ্যক জ্যেঠু লিখেছেন, আয় রোদ্দুর মিষ্টিকুটুম,  মুখ দেখে যা এসে। শতদ্রু জ্যেঠু কাঁদনের গল্প নিয়ে হাজির। শীত বুড়িটা জাঁকিয়ে বসেছে। বসে বসে কী করছে? কুসুম ফুলের মালা গাঁথছে গো।  তাকে নিয়ে ছড়া লিখেছেন রাজর্ষি আঙ্কেল। ছোটোবেলার খেলা নিয়ে ছড়া লিখেছে চন্দ্রনাথ জ্যেঠু। আর বড়ো রা অনেক সময় তোমাদের কথা,ভুলে যায়। এই যেমন আমি ভুলে যাচ্ছিলাম অভিরূপের আর সৌমীর আঁকার কথা বলতে। ঠিক তেমন পলাশ বাবু ভুলে গেলেন মিতুল অটোগ্রাফ আনতে বলেছিলেন। এটা কিন্তু খুব অন্যায়। কে পলাশবাবু, মিতুলই বা কে? জানতে হলে নয়ন আঙ্কেলের গল্পটা পড়ে নিও। আজ এই পর্যন্ত। পিঠে খেয়ে পেটে সইয়ে নিয়ে আবার হাজির হবো ছোটোবেলা নিয়ে পরের মাসের প্রথম রবিবার। বন্ধুরা চিঠি লিখো কেমন লাগল ছোটোবেলা।  - মৌসুমী ঘোষ

তোমার কাছে ফেরা
   আরণ্যক বসু 

মন ভাসালাম, গান ভাসালাম,
কালচে নদীর পার;
ফুলকি হয়ে হারিয়ে গেলাম, 
কুল পাইনি আর।
কোথাও গিয়ে সুখ মেলেনি, 
তাই তো এলাম ফিরে, 
তারার আলোয় মায়ের বাড়ির 
শিউলিতলা ঘিরে।
 
শিউলিতলা, বরণডালা, 
ছোট্ট বকুল ফুল; 
সব রয়েছে, মা শুধু নেই, 
চিরুনিতে মা'র চুল। 
ভাঙা দুয়োর,  হু হু বাতাস,
দিয়ে যাচ্ছে হানা ;
শুকিয়ে গেছে তুলসীমঞ্চ,
লুটোয় আর্শিখানা।

টুকরোগুলো জুড়ে দিতেই, 
আয়না বলল হেসে-- 
আয় রোদ্দুর মিষ্টিকুটুম,
মুখ দেখে যা এসে। 
তোর ছায়াতেই মায়ের ছায়া, 
তার হাসি তোর ঠোঁটে; 
কদমবনে বৃষ্টিবাদল, 
লাল দোপাটি ফোটে।

🍂


শঙ্করী সেলুনে মামা
শতদ্রু মজুমদার 

মামা আজ চুল কাটবে।  আমি সঙ্গ দিচ্ছি।  মা অবিশ্যি আমাকেও কাটতে বলেছে। তার জন্যে পঞ্চাশটা টাকাও দিয়েছে। কিন্তু  গেল মাসে পুজোর ছাট দিয়েছি।  ফের চুল কাটলে ন্যাড়া লাগবে। সে যাই হোক গিয়ে।

 আমরা এখন রথ তলায়। নতুন একটা সেলুন হয়েছে। কাঁচের দরজা দেওয়া। আমি বললাম, এই তো। মামা বলল, অনেক টাকা লাগবে !                
----কী করে বুঝলে ?                
----তোর ঘটে কিছু থাকলে তুই ও বুঝতে পারতিস। আমি আর কী বলবো।                    অন্য একটা সেলুনের সামনে মামা দাঁড়িয়ে গেল। সেলুনের  নাম শংকরী সেলুন !                ----এখানে নয়, এখানে নয়। আমি হাত ধরে হেঁচকা টান দিলাম !                                ----কেন? এখানে নয় কেন? --আরে এটা কাঁদন পরামানিকের সেলুন। 
---তুমি কাঁদনকে  চেনো না?             
----খুব চিনি।                          ----তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?      কাঁদন নাপিতকে আমি দেখিনি l নাম শুনেছি l                       বললাম, ভয় নয়, সাবধানতা! 
---আরে  কিচ্ছু হবে না !   
 সেলুনে ঢুকতেই চোখে পড়লো একটা লেখা :
আমরা কি আপনার সঙ্গে এমন কোন ব্যবহার করেছি, যাতে আপনি দুঃখ পেতে পারেন।                    

বাবা বলেছিল, চুল কাটতে কাটতে খরিদ্দারের পকেট সাফ করে দেয়। সেই লোক জ্ঞানের কথা বাঁধিয়ে রেখেছে।  বুড়ো  মতো একটা লোক বেঞ্চে বসে বিড়ি টানছিল। এই কি কাঁদন? জানিনা। একটা অল্প বয়সী ছেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, চুল কাটবেন তো?     
মামা বলল , হ্যাঁ ! চুল-দাড়ি কত?                                       ---৫০ টাকা 
---মেসেজ করলে ১০ টাকা বেশি লাগবে।    
---দরকার নেই।
চেয়ারে বসলো মামা। বুড়ো লোকটা আমাকে বেঞ্চে বসতে বলল। একটু দোনোমনো করে  বসলাম। আমার পকেটে টাকা। পাশে একজন পকেট মার। বুকের ভেতরটা ভার ভার।
----ডাক্তারবাবুর ছেলে তো।
আমি ঘাড় নাড়লাম। কী ব্যাপার?বাবার পকেটে কোনোদিন হামলা করেছিল নাকি?
---এখন ফিস কত?
---পঞ্চাশ টাকা।
---সর্বনাশ। পঞ্চাশ টাকায় সাবু দানা?
---কে যেতে বলেছে আপনাকে?
এটা আমার পেটের কথা। মুখে বললাম, সব কিছুরই তো দাম বেড়েছে।
----তা অবিশ্যি ঠিক। বেস্পতিবার ডাক্তারখানা খোলা?
---হ্যাঁ।
---টাইমটা?
---সকাল দশটা থেকে বারোটা ---সন্ধ্যা ছটা থেকে রাত ন টা।
মামার ঘাড়ে পাউডার বোলাচ্ছে। ভালোই ছাট দিয়েছে। পেছন থেকে চেনার উপায় নেই।
বেমক্কা পকেটে হাত দিয়ে মামা বলে উঠল. টাকাটা?
বললাম, তুমি তো বুক পকেটে রাখলে।
---কোথাও নেই।
কাঁদন পরামানিক বলল, বাজারে ঢুকেছিলেন?
---কেন বলুন তো?
---আজকাল সবজি বাজারে পকেটমারের আমদানি হয়েছে।
মামা বলল, বাজারে পকেটমার তো সেলুনে জ্ঞানের কথা কেন?
কাঁদন বলল, ব্যাপার আছে। টাকা না থাকে বিকালে দিয়ে যাবেন। ডাক্তারবাবু আমার চেনা লোক।
আমি বললাম, না না আমি দিচ্ছি।
দিয়ে দিলাম।
সেলুন থেকে বেরিয়ে মামা বলল,কিছু বুঝলি?
---না।
---আসল লোক তোর সাথে গপ্পো ফেঁদে তোকে অন্যমনস্ক করে দিল। আর ছেলে কাজটা সারলো।
আমি ভাবছি অন্য।
মামা বলল, ফ্রেমবন্দি বাণী হলো টোপ। বাপ্ ব্যাটা দু জনেই ছিপ ফেলেছে। যার টোপ খায় আরকি। 
মামার একটা কথা তাকেই ফিরিয়ে দিলাম, সব পাখি মাছ খায় দোষ হয় মাছরাঙার।
একটা বিড়ি ধরিয়ে মামা বলল, তোর টাকাটা বিকালেই পেয়ে যাবি। 
আমি চুপ। তার মানে আমার মা'র কাছ থেকেই  চাইবে।


শীত বুড়িটা 
রাজর্ষি মন্ডল 

শীত বুড়িটা নামল এসে 
নরম পশম গা'য়
সঙ্গে নিল হিমেল হাওয়া 
ছাতিম ফুলে ছায়।

শীত বুড়িটা গাঁথল বসে
কুসুম ফুলের মালা
হিম কুয়াশা বলল এবার 
হলুদ গাঁদার পালা।

স্নিগ্ধ হেসে শীত বুড়িটা 
সোনার ধানে চেয়ে
মিঠে রোদের আদর মাখে 
ভোরাই গান গেয়ে।


ভূতুড়ে মাছ 

আরিয়া মুখার্জি 
বেথুয়াডহরি কাঁঠালবেড়িয়া জি এস এফ পি স্কুল 
দ্বিতীয় শ্রেণি

একদিন রাত্রিবেলা আমি মাছ নিয়ে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কে আমার পেছন পেছন আসছে। আমি তখনও ব্যাপারটাকে অতটা গুরুত্ব দিইনি। হঠাৎ আওয়াজটা দ্রুত বাড়তে থাকলো। আমি কিছু না ভেবে ওখান থেকে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার পা’টা যেনো ওখান থেকে সরছিলো না। আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেলাম। তারপর যখন চোখ খুললাম দেখি আমি হাসপাতালে ভর্তি। বুঝলাম এইসব কাণ্ডগুলো সেই মাছটার কারণে ঘটেছিলো। মাছটা আসলে একটা ভূত ছিলো। 


আছেন তিনি আছেন

নয়ন বসু

এনটি ওয়ান স্টুডিওতে ঢোকার সময় পলাশবাবুর ঠিক এটাই মনে হচ্ছিল যে আজকের দিনটা ওনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিন হতে চলেছে। পরাশর চ্যাটার্জির ইন্টারভিউ নেওয়ার একটা উত্তেজনা তো আছেই, কিন্তু আজ পলাশবাবু বুঝতে পেরেছেন, সবার অলক্ষ্যে একজন ভগবান নিশ্চয়ই আছেন কোথাও না কোথাও। নইলে ঠিক কাল রাত থেকেই নিখিল রায়ের গায়ে অ্যালার্জির চাকা চাকা দাগ দেখা দিতে হলো! এবং সকালে উঠে চিঁচিঁ করে বলতে হলো, "পলাশ, আজকের দিনটা উৎরে দিন একটু! আমার তো এই অবস্থায়...."

অথচ পলাশবাবু যখন অনেক খেটেখুটে পরাশর চ্যাটার্জির সেক্রেটারির ফোননম্বর জোগাড় করে, দশদিন তার বিরক্তি সহ্য করে, দুদিন তার বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করে আধ ঘন্টার ইন্টারভিউয়ের স্লট জোগাড় করেছিল, এই নিখিল রায়ই বলেছিল, "বাঃ, ভালো কাজ করেছেন। তবে আপনার তো অভিজ্ঞতা নেই ঠিক, আর পরাশর চ্যাটার্জি, মানে বুঝতেই পারছেন, এটা কোনমতে মিস করা যাবে না...পার্সোনালি নেবেন না, কিন্তু এটা আমাকেই হ্যান্ডেল করতে দিন বরং!"

হাজার হোক চলতি হাওয়ার পন্থী নতুন কাগজ এবং বছর পঞ্চাশের নিখিল রায় পলাশবাবুর বস। মাথা নিচু করে পলাশবাবু বলেছিলেন, "আমার ছেলে, মিতুল, ক্লাস ফাইভে পড়ে, ওনার বড় ফ্যান...ছেলেটার জন্য একটা অটোগ্রাফ যদি অন্তত...."

"সেসব ইন্টারভিউ নেওয়ার পরে দেখা যাবে খন। ওনার মতো স্টার, দেখি মর্জি কেমন থাকে, ঠিকঠাক বুঝলে তখন একবার বলে দেখব নাহয়!" 

এই কথাটা বলার সময় নিখিলবাবু আবার ওনার স্বভাবসিদ্ধ চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার ভঙ্গিতে ফিরে গিয়েছিলেন। দাঁতে দাঁত চিপে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন পলাশবাবু। 

সেই দিন আর আজ। সকালে এনটি ওয়ান স্টুডিওতে ঢোকার সময় বুকপকেটে হাত দিয়ে পলাশবাবু দেখছেন মিতুলের অটোগ্রাফ খাতাটা এনেছেন কিনা। ছেলেটা এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না তার বাবা পরাশর চ্যাটার্জির কাছে যাচ্ছে। বলে দিয়েছে, "একটা সেলফি নিও কিন্তু!"

পলাশবাবু নিজেও অবশ্য বড় ভক্ত ওনার। বাংলা সিনেমার জগৎ এখন প্রায় একার হাতেই ধরে রেখেছেন পরাশর চ্যাটার্জি। অথচ বয়স সবে তিরিশের আশেপাশে। যেমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারা, টকটকে ফর্সা রং, বাবরি করা চুল! ভাবতে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ওনার। 

স্টুডিওর ভেতরটা একটা ভুলভুলাইয়া মতন। একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করে অবশেষে পলাশবাবু একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বুকটা দুরুদুরু করছিল। গভীর একটা শ্বাস নিয়ে তিনবার টক টক করতেই ভেতর থেকে গম্ভীর গলায় আওয়াজ এলো, "আসুন।"

নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভেতরে ঢুকলেন তিনি। দেখলেন একজন আধবুড়ো লোক, পরনে একটা স্যান্ডো গেঞ্জি আর পাজামা, চেয়ার টেবিলে বসে স্টিলের টিফিন বক্স বের করে রুটি তরকারি চিবোচ্ছেন। একঝলক দেখে মনে হলো কুমড়োর তরকারি। রুটিগুলোর জায়গায় জায়গায় পুড়ে গেছে। এবং ভদ্রলোকের বয়স এই মুহূর্তে পঞ্চাশের একটা দিন কম বলে মনে হচ্ছে না। গায়ের রঙটাও ময়লা ময়লা, ভাঙা চোয়াল, গালে কয়েকদিনের না কামান দাড়ি। সামনে বসা ভদ্রলোক রাস্তায় ওনার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে একবার ফিরেও তাকাবেন না পলাশবাবু। 

কয়েক সেকেন্ড ওনার অবস্থা দেখে পরাশর চ্যাটার্জি নিজেই বললেন, "চিনতে পারছেন না তো? চিন্তা করবেন না, অনেকেরই হয়। এই অধমের ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্যই সন্তোষকে হাড়ে জ্বালিয়েছেন আপনি!" 

গলার স্বরে একইসঙ্গে ব্যক্তিত্ব, ভদ্রতা এবং রসিকতার ছোঁয়া। লজ্জা পেলেন পলাশবাবু। 

ইন্টারভিউ নিয়ে যখন স্টুডিও থেকে রাস্তায় বেরোলেন, কেমন শান্ত লাগছিল নিজেকে। মোবাইল ফোনটা ভাইব্রেট হতে হাতে নিয়ে দেখলেন নিখিল রায় কলিং।

-"কেমন দেখলেন? কেমন দেখলেন?" 

গলার ব্যগ্র স্বরে পলাশবাবু বুঝতে পারলেন এই মুহূর্তে ফোনের ওপারে চলতি হাওয়ার পন্থী পত্রিকার কর্ণধার নিখিল রায় নয়, একজন ভক্ত কথা বলছেন। উল্টোদিকের দেওয়ালে পরাশর চ্যাটার্জি অভিনীত আসন্ন সিনেমার পোষ্টার। পোষ্টারের সিনেমার নাম আছেন তিনি আছেন। একমুহুর্ত অপেক্ষা করলেন পলাশবাবু। 

তারপর বললেন, "লোকটা সামনে থেকে আরো গ্ল্যামারাস!" 

এরপর বাড়িতে ফোন করলেন পলাশবাবু। অটোগ্রাফ পেয়েছে শুনে মিতুল অসম্ভব উত্তেজিত। ওদিক থেকে প্রায় চেঁচিয়ে বলছে, "বাবা সেলফিটা নিয়েছ তো?" 

পলাশবাবু জিভটা বের করে একটা বড় অ্যাল করে বললেন, "যাহ্! একদম ভুলে গেছি!”



উবুদশ

চন্দ্রনাথ শেঠ

একটা বাগান পিঁড়ি পেতে সাঁঝবেলাতে
ফুলের সঙ্গে, সঙ্গে কুঁড়ির -
খেলছে : উবুদশ; কিংবা রুমালচুরি
হিম-হিমানি শিশির রাতে।

এমন সময় সন্ধ্যাতারা তিনচুমুকে খাচ্ছে চা
চাঁদ খাচ্ছে, সঙ্গে মামা
চকরা-বকরা গায়ের জামা -
তারায় মোড়া। একাদশীর একফালি চাঁদ যাঃ।


মনিষীদের ছোটোবেলা
পর্ব ১
বালক বিবেকাকন্দের কীর্তি
কলমে : তানিয়া বব্দ্যোপাধ্যায়


ছোট্টো বন্ধুরা,তোমরা নিশ্চয়ই সব্বাই দুষ্টুমি করো,তাইনা? কেউ একটু বেশি বা কেউ কম কম। আমি তোমাদের তেমনই এক দুষ্টু ছেলের গল্প বলবো। তার নাম ছিলো"বিলে"। তোমাদের সবার ই ক্লাসে বন্ধুদের সাথে গল্প করতে, ভাই-বোন বা অন্য বন্ধুদের সাথে দৌড়ে, গাছে চড়ে বা জোরে জোরে দোলনা চড়ে খেলে বেড়াতে খুবই ভালো লাগে। বিলেও এমন সব দুষ্টুমি প্রায় ই করতো। বিলেরা ভাইবোন মিলিয়ে ছিলেন নয় জন। দুষ্টু বিলে তার দুই দিদি আর দুই বোনদের সাথে খুবই বদমাইশি করতো,আর তারা বিলের পেছনে তাড়া করতে গেলেই সে অমনি নর্দমায় নেমে পড়ে তাদের মুখ ভ্যাংচাতো। সে জানতো নিশ্চয়ই তার দিদি আর বোনেরা নর্দমায় নামলে আর তাকে ছোঁবেই না। এমনই ছিলো বিলের দুষ্টু বুদ্ধি। মাঝে মাঝে  খুব বদমাইশি করলে বিলের মা তাকে দোতলার ঘরে আটকে রাখতেন। একদিন বিলের বাড়িতে এক সাধু ভিক্ষা চাইতে এসেছেন। বিলে তখন দোতলার ঘরে বন্দী, খোলা জানলা দিয়ে ভিখারি সাধুটিকে বিলে দেখতে পায়। দুষ্টু বিলের মন ছিলো কিন্তু ভারি উদার ও নরম।সে তখনই সেই ঘরের আলনায় রাখা তার মায়ের শাড়ি জানলা দিয়ে নীচের সাধুকে দিয়ে দিলো। এমনভাবে সে প্রায়ই জানলা দিয়ে ভিখারিদের জামাকাপড় দিয়ে দিতো। দুষ্টু হলেও ছোটবেলা থেকেই অপরের দু:খে বিলের মন কেঁদে উঠতো। 
ছোট থেকেই সে ছিলো অসম্ভব প্রতিভাবান।
সাত বছর বয়সে সে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হলো।
বিলের স্কুলে তার ছিলো নরেন্দ্রনাথ দত্ত।স্কুলের বন্ধুরা তাকে ডাকতো নরেন বলে।  ক্লাসে সে ছিলো বন্ধুদের খুব প্রিয়, কারণ সে ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সবাইকে রামায়ণ -মহাভারতের গল্প শোনাতো। একদিন নরেন ও তার বন্ধুরা সবাই মিলে এমনই গল্পে এতটাই মেতে ছিলেন , যে ক্লাসে স্যার এসে পড়াতে শুরু করে দিয়েছেন, সেটা তারা খেয়াল ই করেনি। ক্লাসে গল্প করার অপরাধে স্যার সবাইকে দাঁড় করিয়ে ক্লাসে কি পড়ানো হচ্ছে..সে সম্পর্কে  প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে শুরু করলেন। কেউ-ই ঠিক উত্তর দিতে পারলোনা, কিন্তু নরেন সব প্রশ্নের একদম ঠিক উত্তর দিয়ে দিলো। তার মানে বন্ধুদের গল্প শোনাতে ব্যাস্ত নরেন কিন্তু মন দিয়ে ক্লাসের পড়াও শুনেছে। এমনই ছিলো তার মনসংযোগ বা consentration. এবার ক্লাসে পড়া না শোনার জন্য স্যার সবাইকে শাস্তি দিলেন কিন্তু নরেনকে দিলেন না।তখন নরেন কিন্তু উঠে দাঁড়িয়ে সবার সাথে নিজেও শাস্তি ভোগ করার আবেদন জানালেন কারণ তিনি স্যারের কাছে স্বীকার করলেন যে তিনিই বন্ধুদের গল্প শোনাচ্ছিলেন,তাই তিনিও ওদের অমনোযোগীতার জন্য দায়ী। ছোটো থেকেই অমনই সত্যনিষ্ঠ ছিলেন বালক নরেন্দ্রনাথ। নরেনের মনসংযোগের আরেকটা গল্প বলি। তার প্রিয় খেলার মধ্যে অন্যতম সেরা খেলা ছিলো ধ্যান ধ্যান খেলা। প্রায়ই তিনি বন্ধুদের সাথে নিয়ে মেতে উঠতেন এই খেলায়। অমন দুষ্টু বিলে কিন্তু ধ্যান করতে বসলে একটুও নড়তেন না। তার বন্ধুরা একটু পরেই নড়াচড়া করতে শুরু করে দিতো, কেউ চোখ বুজে বসতেই পারতোনা,কেউ একটু পরেই উঠে পালাতো।কিন্তু নরেন্দ্রনাথ একভাবে বসে চোখ বুজে ধ্যান করতেন। একবার একটা সাপ তাদের ধ্যান খেলা মাঝে এসে উপস্থিত হতে বন্ধুদের মধ্যে হইচই বেঁধে গেলো। তারা উচ্চস্বরে "সাপ, সাপ,সাপ এসেছে " বলে চিৎকার করতে লাগলো। এত হইচই কিন্তু নরেনের কানে একটুও পৌছলোনা। সে তখন ধ্যানে বিভোর। বন্ধুরা কিছুতেই চেঁচিয়ে তার ধ্যান ভাঙাতে পারলোনা। তারা তো ফনাতোলা সাপ দেখে ভয়ে পালিয়ে গেলো। আর সাপটিও কিছুক্ষণ পরে আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে গেলো,কিন্তু নরেনের ধ্যান তবুও ভাঙলো না।
পাড়ার বন্ধুদের মতো স্কুলের বন্ধুদেরও তিনি ছিলেন নেতা বা লিডার।স্কুলে তার প্রিয় খেলার মধ্যে একটি ছিলো রাজা রাজা খেলা। ক্লাসের সবচেয়ে উঁচু ধাপ হতো তার সিংহাসন। সেই ধাপে কেউ বসতে পারতোনা। সেখানে বসে সে তার বন্ধুদের মধ্যে থেকে মন্ত্রী,কোটাল,সেনাপতি বেছে নিয়ে নীচের ধাপগুলোতে বসাতো।তারপর সে তার দরবার চালাতো আর রাজার মতো বিচার চালাতো।আর তার কথা কেউ না শুনলেই সে তার দিকে কটমট করে তাকাতো। 
সে ছিলো রাজার মতোই নির্ভীক মনোভাবের। কোনোকিছুকেই পরীক্ষা না করে মেনে নেওয়া তার স্বভাবে ছিলো না।ছেলেবেলা থেকেই নরেনের মন ছিলো সংস্কারমুক্ত। তাদের পাড়ার একটা চাঁপাগাছ ছিলো নরেনের খুব প্রিয় খেলার জায়গা। চাঁপাগাছটির ডালে দোল খেতে নরেন খুব ভালোবাসতো।সেই চাঁপা গাছের মালিক ছিলেন এক বুড়োদাদু। তার এব্যাপারে প্রবল আপত্তি ছিলো। নরেন আর তার বন্ধুদের চাঁপাগাছতলায় খেলাধুলা সে মোটেই বরদাস্ত করতে পারতোনা। বারন করলেও তারা কথা শুনতোনা মোটেই। তখন সে করলো কি...ছেলেদের ডেকে বল্লো,ওই চাঁপা গাছে ভুত আছে। ওই চাঁপা গাছের ডালে চড়লেই ভুত ঘাড় মটকে দেবে। নরেন চুপচাপ সব শুনলো। কিন্তু বুড়ো ওসব বলে চলে যেতেই সে আবারও গাছের ডালে উঠে দোল খেতে লাগলো। বন্ধুরা তো ভয়ে কাঁপছে। তখন বন্ধুদের নরেন বললো
- ফু:, ওসব ভুত-ফুত কিস্যু নেই। থাকলে সে আগেই তো আমার ঘাড় মটকে দিতো। তোরা মিছেই ভয় পাচ্ছিস। 
বলে হো হো করে হাসতে হাসতে আবারও গাছের ডালে দোল খেতে লাগলো। 
ছেলেবেলা থেকেই অমন  নির্ভীক, উদারচিন্তার ও প্রতিভাবান ছিলেন বলেই তো তিনি বড় হয়ে তাঁর চেতনার দ্বারা  বিশ্ববিজয়ী হয়েছিলেন । 
এই গল্পের বিলে বা নরেন ই ছিলেন বিশ্ববিজয়ী সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। যাঁর নাম ছিলো নরেন্দ্রনাথ দত্ত। উত্তর কলকাতার সিমলে পাড়ার  দত্তবাড়িতে ১৮৬৩ সালে এমনই এক জানুয়ারি মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মায়ের নাম ছিলো ভুবনেশ্বরী ও বাবার নাম ছিলো বিশ্বনাথ দত্ত। 
স্বামীজীর  জীবনের আরও অনেক  অনেক 
মজাদার গল্প  রয়েছে। আছে তার বিশ্ববিজয়ের গল্প। সেসব তোমাদের পরে কখনো বলবো।


অভিরূপ আচার্য
তৃতীয় শ্রেণী, পদ্মপুর হাই স্কুল, ধর্মনগর, উত্তর ত্রিপুরা


সৌমী মণ্ডল 
একাদশ শ্রেণি, কেশপুর এল এন হাই স্কুল মেদিনীপুর

Post a Comment

4 Comments

  1. ভালো।

    ReplyDelete
  2. বাহ! বেশ ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর করে সেজে উঠেছে জলদর্চির পাতা।পড়ে মন ভরে গেল। চমৎকার লিখেছেন মৌসুমী, নজরকাড়া। প্রতিটি লেখাই ভারি চমৎকার।

    ReplyDelete