জ্বলদর্চি

চলচ্চিত্র পর্ব (১)চলচ্চিত্র---মন্থন /তনুশ্রী ভট্টাচার্য

চলচ্চিত্র পর্ব (১)
চলচ্চিত্র---মন্থন 
তনুশ্রী ভট্টাচার্য 


পরিচালক-- শ্যাম বেনেগাল 
সাল--১৯৭৬

গণতন্ত্রের এই ক্ষয় ও বিপর্যয়ের সময়ে ফিরে দেখতে ইচ্ছে হয় আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের একটি শিল্পসৃষ্টিকে । কিভাবে  একটি শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির নীরস কচকচানির  বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়ে একটি উৎকৃষ্ট সিনেমার ধারক হওয়া যেতে পারে তা আমরা দেখেছি সদ্য প্রয়াত  চলচ্চিত্র পরিচালক  শ্রী শ্যাম বেনেগাল নির্মিত 'মন্থন' ছবিতে এবং তার নেপথ্য ঘটনায়।
ভারতীয় প্যারালাল সিনেমার একটি মাইলস্টোন এই মন্থন সিনেমাটি। গুজরাটের খেড়া অঞ্চলে গোপালন ও   দুধ উৎপাদনের  একটি বৃহৎ সম্ভাবনাময় বিষয়টি নিয়েই সিনেমাটি। ভারতের হোয়াইট রেভেলিউশন বা অপারেশন ফ্লাড  নামে খ্যাত এই দুধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত পদ্ধতির বাণিজ্যিকী করণের জন্য সমবায় প্রথা গড়ে তোলা (আমূল,) বাধা পাওয়া,উদ্দিষ্ট  মানুষদেরই অসহযোগিতা,ভুল বোঝাবুঝি  সরপঞ্চের দ্বারা  ব্যাঘাত সৃষ্টি করা  এবং এই গোপালক মানুষগুলির নিত্য দিনের জীবন চর্চা, নীরস জীবনে রসের ছিটে লাগানো, লাভ লোকসান, আশা ব্যর্থতা ঈর্ষা দ্বেষ, জিঘাংসা ,ওঠাপড়া,বিশ্বাস অবিশ্বাস সম্পর্কের জটিলতা , --সব একটি ফ্রেমে পরের পর বেঁধেছেন পরিচালক তাঁর নিজস্ব‌ সিনেম্যাটিক ফর্মে। 

🍂

ভার্গিস কুরিয়েন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এই দুধ উৎপাদনের ও সমবায়  প্রথার মাধ্যমে মানুষের লাভ পাওয়া এবং একটি সুষ্ঠু সমবায় প্রথার কার্যকারিতার  ব্যাপকতা এতটাই  নাড়া দিয়েছিল যে শ্যাম বেনেগাল এই 'মন্থন' চলচ্চিত্রে  সেটার  রূপ দিয়ে সেই লড়াই এবং  সেই লড়াকু মানুষটি এবং  গোয়ালাদের  সম্মান দিয়েছেন। গণতন্ত্রের কথা সেজন্যই শুরুতে বলা হলো যে  এই সিনেমাটি বানানো হয়েছিল ওখানকার পাঁচ লক্ষ গোয়ালার  বিশেষ সাহায্য নিয়ে যারা প্রত্যেকে দুটাকা করে   জমা দিয়েছিলেন এই সিনেমার ফান্ডিং এর জন্য --ক্রাউড ফান্ডিং বলা হচ্ছে যাকে । ভারতে এই জিনিস আর দ্বিতীয়টি হয় নি। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির  প্রতি কী অপরিসীম শ্রদ্ধা থাকলে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক এমন ভাবে মানুষকে সঙ্গে  নিয়ে মানুষের জন্য মানুষের কথা চলচ্চিত্রায়িত করতে পারেন তাও বাণিজ্যিক বিনোদন মূলক সিনেমার তুমুল জনপ্রিয়তার পাশাপাশি। আর এখানেই শ্যাম বেনেগাল তাঁর স্বাতন্ত্র্য নিয়ে ভারতীয় সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছেন। 
গল্পটি সংক্ষেপে এইরকম---পশুচিকিৎসক ড:রাও  তার একটি দল নিয়ে  একটি গ্রামে এসে সেখানকার গোয়ালাদের নিয়ে তাদের দুধের গুণগত মান পরীক্ষা করে তাদের আরো বেশী দাম দিয়ে সমবায় প্রথায় উৎসাহিত করলেন। এই প্রক্রিয়া চলাকালীন গ্রামের মোড়লদের থেকে তীব্র  বাধা আসতে লাগল।পারস্পরিক ঈর্ষা দ্বেষ শুরু হলো। সেই মানুষগুলোর  মধ্যেও ভাগাভাগি শুরু হলো। ড:রাও কেও অবিশ্বাস করতে লাগলো কেউ কেউ।  ড:রাও তাদের জীবনের ঘাত প্রতিঘাতের জড়িয়ে পড়তে লাগলেন কখনো তাদের আপনজন হয়ে উঠছেন কখনো আবার কেউ কেউ তাঁর বিরোধিতাও করছে। গ্রামের স্বামী পরিত্যক্তা মেয়েটির সঙ্গে সামান্য আবেগী দৌর্বল্য তৈরী হলেও কিছু পরেই তাঁর নিজের স্ত্রী এসে যাওয়ায় এবং মেয়েটির স্বামী ফিরে আসায় এই ইমোশনাল বন্ডিং লুপ্ত হয়ে যায়।‌ ভোলা নামের রাগী যুবকটি বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায়  দুলতে থাকলেও আসলে মনের দিক থেকে সে সমবায় প্রথায় বিশ্বাসী।  গ্রামের মোড়ল ঈর্ষা‌বশত গোয়ালা দের বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এইভাবে ঘটনা গড়িয়ে যায়।  সমবায় প্রথা সাফল্য পেলে  মানুষের মনের জোর তৈরী করে দিয়ে  ড:রাও গ্রাম থেকে বিদায় নেন।
গিরিশ কারনাড, নাসিরউদ্দিন শাহ,কুলভূষণ খারবান্দা,  স্মিতা পাতিল, ওমরেশ পুরী অভিনীত সিনেমাটি জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। 
বিজয় তেন্ডুলকর, কায়েফি আজমী ছিলেন শ্যামের সহযোগী চিত্রনাট্যকার ‌। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এটি  দেখানো হয়েছিল। ২০২৪এ ছবিটিকে পুনর্সংস্করণ‌ করে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আবার দেখানো হয়েছে। 
গণতন্ত্রের সঠিক প্রয়োগ ব্যর্থ হয় না বরং তা মানুষের দ্বারা আদৃত হবেই। পঞ্চাশ বছর বয়সী এ ছবি তার প্রমাণ।সিনেমা সমাজের দর্পণ। সেখানে অবক্ষয় দেখানোর সুযোগ ও থাকে আবার সৎভাবে গড়ে ওঠা সমাজ ও তার উন্নতির আপাত নীরস কাহিনীকে সৎভাবে পরিবেশন করলে পঞ্চাশ বছর পরেও তার আবেদন অক্ষুণ্ণ থাকে--- খাঁটি দুধ, ঘি, মাখনের মতোই।

Post a Comment

1 Comments

  1. তনুশ্রীর মন্থন সিনেমার উপর আলোচনা খুব পরিচ্ছন্ন হয়েছে।

    ReplyDelete