জ্বলদর্চি

বংশীর খেলাধূলা-পর্ব ২/বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক
বংশীর খেলাধূলা পর্ব ২
বাসুদেব গুপ্ত


ক্যাং করে এলারম বেজে উঠল। কখন দু ঘণ্টা কেটে গেছে বোঝা যায় নি। লেখাটা মাথায় গজগজ করছে, সারাক্ষণ ইউটিউব দেখার ফল। একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না তো? সুস্মিতা আপত্তি করে। ও এসব দেখতে চায় না, শুনতে চায় না। কোথায় কি গোলমাল হচ্ছে, যুদ্ধ লাগছে, মানুষ মরছে, এ আর নতুন কি। ও বরং চায় বংশীবদন এন্ড্রয়েড টিভিতে নেটফ্লিক্সটা খুলুক। অনন্তকুমারের নতুন হাসির ছবি ফাটাফাটি ৩। ও চায় এরকম সব হাসির গল্প লিখুক বংশীকাকু। এইসব পড়ে পড়ে ওর মাথা ভারী হয়ে যায়। বংশী খবর চালিয়ে দেয় টিভিতে, ওকে বোঝাবার জন্য, কেন এসব লেখা, কেন এত জরুরী একজন লেখকের প্রতিক্রিয়া। ও চায় না এসব মাথায় ঢোকাতে। 
ঐসব খবর দেখলে ও গম্ভীর হয়ে যায়, অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর ফোনটা বার করে টুকটুক করতে শুরু করে, দুটো আঙ্গুল প্রবল বেগে চলতে থাকে। যেন খুব দরকারি মেসেজ। সবসময় সবার আজকাল দরকারি মেসেজ আসে, যেমন টেলিগ্রাম আসতো পঞ্চাশ বছর আগে, টরে টক্কা টক্কা টরে, মাদার এক্সপায়ারড, কাম শারপ। এখনো আসে, আপনার কি ধার চাই, আপনার জন্য ১০ লাখ টাকা রেডি করা আছে, ক্লিক করুন আর দশ মিনিটে পেয়ে যান। দিন পাল্টেছে। 
হ্যাঁ শহুরে পাঠকও এসব পড়তে চায়না, এসব নিয়ে ভাবতে চায় না। তাদের এমনিই নানা ঝামেলা। কিছু না থাক, মাঝে মাঝে কে ওয়াই সি করতে হয় ব্যাংকে গিয়ে। টাকার কথা বলা যায় না, এই আছে, এই নেই। তারা চায় একটু টুস টুসে মজা, একটু নরম করে শরীরের স্যালাড। যাতে বেশ গরম গরম ভাব হবে শরীরে।  
হাসির ছবি চালালে সুস্মিতার চোখে আলো আসে, মুখ আনন হয়ে ওঠে, সূর্যমুখী বা  ড্যাফোডিলের মত হলুদ নরম আলোয় ভরে যায়। সুস্মিতা ওর কেউ না। নেহাতই অস্থায়ী সহায়িকা বা এসিস্ট্যান্ট। বাচ্চা মেয়ে, বাংলা টাইপ করে দেয়, মেল করে এখানে ওখানে। ফোনে পোক্ত, ল্যাপটপে এক্সপারট। বংশীর তুলনায় তো বটেই। কিন্তু ওর নিজের অনেক সমস্যা। শরীর ভালো না। অম্বল, মাথা ঘোরা লেগেই আছে। দিন দিন মুখটাশুকনো লাগছে, চোখের তলায় হালকা কালো ছায়া। বংশী লেখক, ওর চোখে কিছু এড়ায় না। বাড়িতে হাজার ঝামেলা, ভাই নবীন ড্রাইভার, বাবা জুয়াড়ি, মা এক দিদিমণির বুটিকে সেলাই করে। সেই দিদিমণি আবার সিনেমাও করেন। কাগজ ওলার কাছে চকচকে পত্রিকায় তাঁর সাজুগুজু করা চিত্র থাকে।  সিনেমা না চললে মাইনে বন্ধ । সিনেমা হিট হলে একদিন তিনি চকলেট বিলোন। সেদিন সুস্মিতা নিয়ে আসে বংশীর জন্য। খুব যে খুশী দেখেই বোঝা যায়। 

সুস্মিতা ওকে জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার ভালো লাগে এই ঘরে ঘট হয়ে বসে থাকতে। একটু খেলা, ক্রিকেট ফুটবল দেখেন না কেন টিভিতে?’
বংশী হাসে, ‘অনেক বড় খেলা চলছে দুনিয়ায়, তুমি এখন ছোট, বুঝবে না। আমি সেই সব খেলা দেখি। আমি হলাম আসল ক্রীড়াসাংবাদিক, আসল খেলার খবর সব লিখে রাখি। 
সুস্মিতা কিছু বলে না, কিন্তু মার কাছে বসে গল্প করে। মা শুনে মাথা নাড়ে বিজ্ঞের মত। কি বলবে বুঝতে পারে না। বলে ‘দেখিস কাকু আবার গোলমালে না পড়ে এসব লিকে টিকে।‘
সুস্মিতা হাসতে চায়, হাসির ছবি দেখে খুব খুসি হয়। বংশী যখন লেখে, ও বসে থাকে, নেটফ্লিক্স দেখে। মাঝে মাঝে বংশী বোকার মত সেদিকে তাকায়, ওর মাথায় ঘুরতে থাকে কোথায় বোমা ফাটছে, শিশুদের মাথায়, সে সব দূরের খবর। সত্যিই মাথাটা বোধহয় যাচ্ছে। 

-জিভ বেরিয়ে গেছে? এখন ভালো আছে? বেঁচে যাবে? 
মালাই মেশানো কড়া চা খেতে খেতে নবীন ফোনে উত্তেজিত হয়ে কার সঙ্গে কথা বলে। নিশা শুনে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। 
নিশার সঙ্গে ওর ঠিক বনে কিনা ও বুঝতে পারে না। তরুণ নেতার বাড়ী। ব্যস্ত নেতা, সম্বিত কুশারী ভোটে দাঁড়িয়েছেন প্রথম বার। কুশারী ফ্যামিলির মৌরসি পাট্টা এই কেন্দ্রে। বাবা প্রীতিনাথ কুশারী দশ বছরের এম এল এ। তাঁদের হোটেল ব্যবসা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়ে উঠেছে লতার মত নিজেকেই জড়িয়ে জড়িয়ে। বাবা মারা যেতে কেন্দ্র খালি হয়ে উপনিরবাচন ছ মাসের মধ্যে। সম্বিত স্যার ছাড়া আর কে দাঁড়াবে এখানে? স্যার মানে শিক্ষক নয়, কিন্তু পছন্দ না হলে শিক্ষা দেবার সুনাম আছে। 
নবীন অনেক ভাগ্যে চাকরিটা পেয়েছে। দলের সবরকম কাজ করতে হয়েছে, সব কাজের কথা বাড়ির লোকে জানে না। জানলেই বা কি করত। বাবা মারা যেতে তাঁর পুরনো ড্রাইভারের ছুটি হয়ে গেল, সম্বিত নতুন জমানায় নতুন লোক এনে বসালো। নবীনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল। 
এটা বাড়ী না প্রাসাদ না হোটেল বোঝা দায়। কুশারীধামে ২৪ ঘণ্টা নানা লোকের যাওয়া আসা। নিশার কাজ গোছগাছ করে ঠিক করে রাখা। কাজের লোক, কিন্তু ও গর্ব করে নিজেকে বলে গভর্নেস। নবীনের সঙ্গে কথা হয়। মাঝে মাঝেই নবীন বসে থাকে, তখন কথা হয়। এলোমেলো, বায়োস্কোপ তোলার মত না। 
প্রেম ভালোবাসা সিনেমায় হয়। এখন যদিও ব্যাপারটা বেশ কমে এসেছে, বেশিরভাগ হিরোরা ভিলেন পেটাতেই ব্যস্ত। অতি আধুনিক নায়করা শুধু হাত ঘোরান, দশটা গুন্ডা দশ দিকে ছিটকে যায়, দেখতে খুব ভাল লাগে। গরীব মানুষেরা প্রেম করে না। ঘর বাঁধে, পায়রার মত। আবার ভেঙ্গেও যায় সেই ঘর। ডিম পড়ে থাকে, ভাঙ্গা বাসা ফেলে পুরুষ পালায়, নারীও কম যায় না। নবীনের ঘর নেই। নিশার বর নেই, পালিয়েছে সুস্মিতার মায়ের সেলাই কারখানার এক গোলগাল ফেসিয়াল করা এক ধিঙ্গির সঙ্গে। ফেশবুকে ছবি দিয়েছে, সেটা হোয়াটসাপে পাঠিয়েছে। আজকাল সবাই এসব পারে। বংশীবদন গুলিয়ে ফেলে, তাই তো সুস্মিতাকে আনা। সুস্মিতা আসলে ওর কেউ না। 

নবীন কাল হোল নাইট ড্রাইভ করেছে। ইলেকশান প্রচার ডিউটি। ভিড়ভাট্টা, হইচই, শ্লোগান, মিছিল, নেতারা পারেও বটে। ওর এখন চোখ টানছে। কড়া লিকার চা খেতে খেতে আবার বলে ওঠে,
-কি গুড লাক বল দেখি, গলার দড়িও ছিঁড়ে যায়। 
আজকাল ওটিটিতে থ্রিলার দেখে নিশা। সিরিয়াল কিলার, লেডি মস্তান সবই চলে।  ও পেতলের একটা বিরাট ফুলদানি পালিশ করছিল, হাত থামিয়ে জানতে চায়, 
“কি হল? গলায় দড়ি নাকি? কার?” 
নবীন ফোন রেখে ঝিমিয়ে যায়, ফিসফিস করে বলে, 
“আমাদের ঘরের পাশের টাওয়ারে।“ 
 চা পেটের পাইপে যেতেই নবীনের পেটটা খোঁচা দেয়। কিডনীতে পাথর। পাড়ার আধা হোমিও আধা এলো ডাক্তার বলেছে অপ্রেসান লাগবে। যদি কিডনীটাই কেটে নেয়? চিন্তায় চিন্তায় মনটা খারাপ হয়ে আসে নবীনের। তারপর ধীরে ধীরে বলতে থাকে। 
-আমাদের ঘরের পাশেই বাউন্ডারী ওয়াল আর তার পাঁচিলের ওপারেই ভিস্তা টাওয়ার সিক্স। বস্তির আদ্ধেক লোকই তো ওখানে যায় কাজ করতে। বকুল পিসী কাজ করে বারোর তিন নম্বরে। সেখানে থাকে দেবজিতবাবু। বয়স আঠাশ । লোকে বলে    ইঞ্জিনীয়ার নাকি । তার নাকি আবার খুব মন খারাপের অসুখ। যখন তখন কি যে খেয়াল হয়, খালি মরতে যায়। এই নিয়ে দুবার হল। লাস্ট মাসে কাফের তিনতলা থেকে লাফ দিলো, লাভ হলো না। পড়বি তো পড় নীচে বালির ওপর। আবার আজ সকালে চা কফি খেয়ে কি যে হল, আবার মন খারাপ। ফ্যান থেকে ঝুলে গেল। 

🍂

নিশা বাড়ীর নানা কাজের কান্ডারী। রান্নাতেও হাত লাগায়, বাসন মাজে আবার বুড়ি বিধবা গিন্নীমার টুপ্টুপে ফোলা পাও টেপে। ও বলে আমি ঝিও নই, রাঁধুনিও নই, আমি কি জানিস? হাউসমেড। ও এসব শুনে ফিঁচফিঁচ করে হেসে ওঠে। 
-ধুর, ওর মরার ইচ্ছেই নেই খালি নখরা, ঢং। কত জায়গা আছে। মেট্রোতে একবার ঝাঁপ দিয়ে দেখতে বল না। 
- নারে নিশা, বোধহয় কিছুই ঠিকঠাক পারে না লোকটা, ঠিকঠাক মরতেও পারল না। 
-ঠিক তোর মত। কিছুই পারিস না, 
এই কথার কি যে মানে কে জানে। নিশা কি চায় নবীন কিছু পারুক? নবীন কি ভালো মানুষ না ভীতু মানুষ? 
-অমন বলতে নেই রে, কার কখন কি হয়। এই আমিও হঠাৎ… 
-মরণ 
বলে নিশার মনে হয়, এটা ঠিক উত্তর হল না। চুপ করে যায়, দাঁড়িয়ে কি ভাবে।  ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। 
নিশার বাবার হয়ত আর সাত আটদিন। লোকাল হাসপাতালে বলেছে লিভার ফাটোফাটো। চেন্নাই বা ভেল্লোর যদি যেতে পারিস, কিছু একটা হতে পারে। বাবার দশ বছর কারখানা বন্ধ। চেন্নাই? এই তো বড়বাবু ঘুরে এলেন, ওনার হাঁটুর ব্যথাটা কমছিল না। কিন্তু ফিরে এসে হাটফেল। কি লাভ হল!
বাবা গেলে বাড়ীটা ফাঁকা হয়ে যাবে। মনটা খারাপ হয়ে যায় নিশার। 
-কি করত লোকটা? 
-কম্পুটার। কম্পুটারকে শেখাত কি করতে হবে, সব হিসাব কিতাব। 
- কম্পুটারকে আবার শেখায় কে? সেই তো শুনি সবজান্তা, যা জানতে চাইবে বলে দেবে। 
- তাই তো জানতাম, আমি কি অত জানি, গাড়ী চালাই, টায়ার বদলাই, পেট্রল ভরি ব্যাস। যাক শোন না কি হল। কম্পুটারের নাকি একটা বিদ্ঘুটে রোগ হয়েছে সবাই বলছে, ছটজিপিটি না কি ছাতার মাথা। আবার একজন বলল রোগ নয় জিনে ধরেছে, কম্পুটার আর কারুর কথা শুনবে না, সব কাজ ও নিজেই করে দেবে কাউকে কিছু করতে হবে না। তাইতো নাকি সব্বার কাজ যাবে। দেবজিতবাবুকেও নোটিস ধরিয়েছিল, 
-পয়সা আছে তো, গাড়ী বাড়ী সব। চিন্তা কি? 
-চিন্তা খুব আছে। নিজের নাকি, সব ঐ ইএম আই, ই এম আই মানে ধারে কেনা । 
-বুঝেছি, এবার ফেল হয়েছে, আবার টেরাই করবে। এবারে বোধহয় মেট্রো থেকে । 
বলে খিলখিল করে হেসে ওঠে নিশা। নবীন সেদিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
হাসি থামিয়ে নিশা ফুলদানিটা ঠিক করে মাঝখানে বসায়, তারপর খুব কাছে এসে বলে ওঠে,
-আচ্ছা, নবীন তোরও মাঝে মাঝে মন খারাপ করে? .
নবীন চমকে তাকায়। মাথা নাড়ে। বলে ‘তোর? ‘
-কি জানি? করে বোধহয়, তবে অত ভাববার সময় হয় না।
দুজনেই তাকায় জানলার বাইরে। পাশে একটা বাড়ী উঠছে তিরিশ তলা। তার ছাদ থেকে নীচের শহরটা যেন কুয়াশায় ডুবে থাকা জাহাজ। মানুষজন যেন পাঁজা পাঁজা ফেনা। নীল পানিতে নৌকো ভাসছে, অটো রিক্সা নয়। লাফ দিলেই হয় দরকার মত। 
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments