পর্ব -৩৬
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
|| মুখরতা ছুঁয়ে থাকে বনমর্মর...||
আচ্চা,ছোদ্দি,শুনতিছ চারশো বছর ধরি সেখেনে হিঁদুরা পুজো দেচ্ছে আবার ধরো মোছলমানেরাও সেখেনে গে নামাজ পড়তিছ? গোলাপের গোড়ায় ঘাস নিড়োতে নিড়োতে করিমভাই বলল।
মরিছ তালি। কমনেগার কতা বলতুছ বলো দিন। হ্যাঁদে,মাতার ঠিক আছ তো তোমার? কাগজ ফুলের লতানো ডাল কঞ্চির সাথে বেঁধে তুলতে তুলতে বিশুকা বলল। লাউ আর কুমড়ো কোনোদ্দিন এক গাছে হয় নাই?
একই জাগায় পুজো আর নামাজ একইসাত হচছে সগ্গো ছাড়া সের'ম জাগা আবার আছ নাই?মাতা ফাটাফাটি করি মরব্যান তো!
বাজে বকপিনে একেবার।পেটের খোলে ঘা দিলিউ তো 'ক' বেরুবে না তোর। লাউ আর কুমড়ো ছাড়া মাতায় তোর ঢোকপেই বা কী।তা সেডাও তো ঠিক কোর শিকলি নে। চাল কুমড়ো বলি তরমুজির বীজ এনিছলি না গেল বচ্ছর?
করিম ভাই বিশুকাকে দাবড়ে দেয়।
ঠিকাছ। তুমি নয় লাউ নে বিএ পাশ দেছো।ফাতরামো মোটোও করবি নে বোল দিচ্চি বিশু তোর। আচ্চা ঘটনা কী সেডা তো বলবা।
ঘটনা বাবরি মজ্জিদ।
তোমাদ্দের ঈদগার কতা বলতুছ?হিঁদুরা আবার কবে সেখেনে পুজু দিয়িলো?মাতার ছিট একেবার খারাপ হইগেছ তোমার।হইনি একোনো।তোর সাত আর খানিক বকলি উন্মাদ পাগল হয়িই মরবান আমি।কতার মদ্দি তুই মুক একেবার খুলবিনে বিশে।
আমাদ্দের পাড়ায় ফজরের ছেলি আফসার রইছ না;ছোটত্থে বিরাট মাতা ভাল। চেংড়া অংকে নাই মেটেল পেইলো কলোজে। মাস্টার হয়ি ইস্কুলি পড়ায় একন।ছোদ্দি সেদিন আমাদ্দের বাড়ি গে বলতিল তাই তারির গে জিগিস করিলাম বাবরি মজ্জিদির কতাডা।
আর হয় না কে র'ম?এই যে ছোদ্দি চা রুটি নে এলু এক থালায় করি।দুজনায় খাচ্চি কত বচ্ছর?এক বিড়ির পাছায় ফুঁক দে টান দিচ্চি,এক বদনায় পানি খাচ্চি আর সনঝিবেলা বাড়ি গে উজু করি আমি নামাজ আদায় করতিছ আর তুই হরে রাম হরে কেষ্ট করি কেত্তন গাচ্চিস বলি ঝামালি কিছু হচ্চে? বয়স তোর বাতাসেই হই গেছ বিশু। গলায় তুলসীর মালা নে পরি সগগো আর বেহেস্ত বুজতি পারতুছ না ক্যামন?করিম ভাই ভয়ংকর চটে গেল বিশুদার ওপর।
আচ্চা ভুল হইগেছ।মাপ দ্যাও।আ্যকোন সেই বাবরি না কমনে কী নিয়ি ঝামেলা বেঁধিছ তাই বলো দিন।বিশুদাও হাত ঝেড়ে করিম ভাইয়ের ধারে থেবড়ে বসে ঘাসে।
ঠিক বলেছো করিম ভাই চারশো বছর ধরে ও জায়গায় দু ধর্মের মানুষই প্রার্থনা করছিল। তবে
মাঝে মধ্যেই ঝামেলা হত বলে বৃটিশ আমলে ইংরেজরা দেওয়াল তুলে দু'দলের জায়গা আলাদা করে দিয়েছিল।
আমি বলো মুক খুলতিচ এইবার। আমি বলিলাম না ত্যাকোন?ওদ্দের পাড়ার আফছার বলিছ! তা আমি নয় গোমুখ্যু।করিম ভাই তো কুমড়োয় এম এ পাশ। আমি বলিছ কিনা হিঁদু আর মোছলমান এক জায়গা পুজু কত্তি গেলি মরব্যান সব? তা সরকার জাগা য্যাকোন ভেন্ন কোর দেছ বখেড়া তো মিটিই গেছ তালি।করিম ভাইয়ের হাতের বিড়ি নিয়ে লম্বা টান দিয়ে বলল বিশুদা।
বিশে,কতা না শুনি ফাতরামি কললি থাবড়া দে কান চাবালি বলো ঘুরিই দোব্যান তোর।
ওইটাই তো কথা বিশুদা।ঝিনি বলল একসাথে থাকতে কোনো অসুবিধেই হয় না যতক্ষণ না কেউ এসে বারবার বলতে থাকে যে তুমি আলাদা বা তোমার ধর্ম আলাদা।আর মানুষের মাথায় যদি ঢুকিয়ে দেওয়া যায় যে অন্যের চেয়ে তার ধর্মই বেশি ভালো তালেই সিধে মারামারির রাস্তা তোয়ের!
অতচ মুকি সবাই বলে আল্লা যিশু ভগমান সব এক ঠিক কিনা বিশুদা মাথা নেড়ে বলে। আমাদ্দের সঙ্গে থেকি থেকি বিশেডার মাতায় বলো এট্টু কোর বুদ্ধি গজাচ্চে, করিম ভাই খিক খিক করে হাসল।হ্যাদে বুদ্দি কি তোমার দাড়ি না কুমড়োর বীজ যে গজাবে?করিম ভাইয়ের দাড়ি নেড়ে দিয়েই হাসতে হাসতে তফাত গেল বিশুদা। পানি কোকে নাতি দোব্যান তোর হারামজাদা কণেগার। তুমি বলো দিন ছোদ্দি।
প্রার্থনার জায়গা দেওয়াল তুলে ভাগাভাগির পর স্বাধীনতা অবধি ঝামেলা ছিল না কিন্তু তার বছর দুই পরে আবার শুরু হওয়ায় সরকার থেকে তালা ঝুলিয়ে দেয়। কিন্তু এখন আবার সমস্যা শুরু হয়েছে। তালা দেছ তা অন্য জাগায় পুজু কর, ভেন্ন ঈদগাহয় যেগি যা!মরণ যে!কিসির জন্যি আবার ঝামেলা?
ভোটের জন্যি।ঝিনিও ঘাসে পা ছড়িয়ে বসল।অয়! আফসারও ওই কতাডাই বলতিল।ছোদ্দির মাতাডাও পোস্কার খুব।বড় হলি দ্যাকপা ছোদ্দিও মেটেল পাবে। আমি তো বড় হয়েই গেছি।কেউ তাও মোটে আমায় মেডেল দিচ্ছে না!
🍂
শুনেই হাঁ হাঁ করে করিম ভাই বিশুদাকেই সাক্ষী মানে।বল দিন বিশু!আমাদ্দের ছোদ্দি নাই বড় হই গেছ।হ্যাদে পিঁমড়ে কামড়ালি কদিন আগেও কাঁদতি কাঁদতি এসি বলতো মন্তর বলি দ্যাও!ঝোপড়া গাছের ছায়ায় তিনজন গোল হয়ে বসে থাকে তারা। আবীর রঙের একটা দুটো কাগজ ফুল খসে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে তাদের গায়ে মাথায় এসে পড়ে।
বুধবারের সকালে মলয়বাবু স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাইকেলে উঠতে উঠতে স্যার বলল আজ তো রেজাল্ট তোদের।
ইলেভেনের রেজাল্ট বেরুনোর কথা শুনেই তাড়াতাড়ি সাইকেলে প্যাডেল দিল সবাই।বাড়ি ফিরে রেডি হয়ে ইস্কুলে যেতে বুক গুর গুর করছিল তার।
একেবারে সিনেমার নামে নাম্বার? অংক খাতায় সাড়ে চুয়াত্তর দেখে স্যার বললেন। বাকি অংকগুলো স্যারের ভাষায় সিলি মিসটেকে ভর্তি। কিস্যু হবে না তোমার। ফালতু গান কবিতাই তো গিজগিজ করছে মাথায়।যত উদ্ভট আইডিয়া নিয়ে দাদাদের লেজুড় হয়ে ঘুরলে এই র'ম রেজাল্টই হবে।বারো ক্লাসের এই কটা মাস তো হাতে আছে। আমি কিস্যু বলবো না। নিজের বিবেচনায় যা ভালো মনে হবে তাইই করবে এবার থেকে। পাশের ঘরে মার কানেও যাতে যায় চড়া গলা আরও চড়ায় তুলে তাই পরেশবাবু স্যার তাকে তুলোধোনা করছিলেন।ঝিনি আরও কাঁটা হয়েছিল কারণ সে নিশ্চিত মা সবটাই শুনছে এবং পরবর্তী দৃশ্যে তাকে মা'র মুখোমুখি হতে হবে।
আশ্চর্য! মা কিছু তেমন বলল না। স্যার চলে গেলে বরং বলল হাতে সময় আছে,ভাল করে পড়ো। দুটো কার্ড পেয়েছি। রোববার সকালে মছলন্দপুর সিনেক্লাব পথের পাঁচালি আনছে, অহনা বা বিনিকে বলে দেখো তোমায় নিয়ে যেতে পারে কিনা,আমারতো সময় হবে না।
চোখ গোল গোল করে সে স্ট্যাচু হয়ে রইল খানিক।তারপরেই লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরল।
মা,ওমা এক্ষুনি যাই তালে। অহনাদি এ সপ্তা হস্টেল থেকে ফেরেনি।বিনিদি যদি কাল ভোরে কলকাতা চলে যায়,তাইলে তো রোববারের কথাটা জানাতেই পাব না ওকে।ব্রততীদি সেই সন্ধে সাতটায় আসবে। আমি যাব আর আসব।
গেটের ধারে সাইকেল ঠেস দিয়ে হাল্কা হাওয়ার মত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে সে উঠছিল, হটাতই বিনিদির সাথে কার যেন চেনা গলার হাসি শুনে থেমে গেল,চিঠি পাওনি?আমিতো গোপালপুর থেকে তোমাকে আর ঝিনিকেও চিঠি দিলাম ।
ছোটদের এত ভাল লাগে বিশ্বাস করো ঝিনিকে দেখলেই আমার খুড়তুতো বোন বাবলির কথা মনে আসে। অমনই ছটফটে আর অপাপ নীলে ধোওয়া মুখ। বুঝলাম।কিশোরী মেয়েদেরই শুধু ভাল লাগে তোমার। আরে না,কিশোরীদের দিদিকেও!
এখানে না এলেতো জানাই হত না ইচ্ছামতীর এক ছায়া ঢাকা মফঃস্বলে কবিতার বই হাতে বসে আছে বিনতা সেন যার শুধু পাখির নীড়ের মত চোখই নেই,সে দাস ক্যাপিটাল নিয়ে গম্ভীর লেকচার দেয়,মেডিকেল ক্যাম্পের ছেলেদের রান্না করে খাওয়ায়, সুরেন্দ্রনাথ কলেজে বটানি পড়ে আবার বই ধার দিলে পাওনাদারের মত হামলাও করে।আমি তো চেখভের বইটা ফেরত দিইনি ইচ্ছে করেই,জানি বইয়ের টানে সে আসবেই।কি পাজি! আমি বুঝতেই পারিনি।
আরও অনেক কিছু বোঝা বাকি আছে আপনার।ওসব ক্রমশঃ প্রকাশ্য কিন্ত ম্যাডাম এখন অনুমতি দিন,আমি একটু মিতুদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। দুদিন হল আছি,আজ একবার না গেলে মাসিমা আর ঝিনি ভাববে কি?
তাড়াতাড়ি ফিরবে,খেয়েতো আবার ঘুমোতে যাবে সেই সজলদের বাড়ি।ও কে ম্যাডাম, আমরাতো ভোরের ট্রেনে একসাথে কলকাতা ফিরছি তখন তোমার সব কথা শুনবো।
যেমন এসেছিল, তেমনই নিঃশব্দে নেমে এলো সে। সাইকেলে সারাটা বিকেল সে ঘুরলো ভুতের মত। অজস্র ঝিঁঝিঁর ডাক আর খানিক জোনাকির ওড়াউড়ির মধ্যে ইচ্ছামতীর বাঁধে গিয়ে বসলো একলা।
ঝিনি এই ঝিনি,সন্ধে নেমে গেছে আর নদীর ধারে কি করছিস তুই?দেব কানের গোড়ায়? কাছে এসে চড় তুলেও থমকে যায় ছোট বুলাদা।আধো অন্ধকারেও কি যেন টের পায়।কী হয়েছে রে?
দোয়েলপাখি তুমি এখানে আর আমি তোমাদের বাড়িতে বসে থেকে থেকে ফিরে এলাম।মাসিমা চিন্তা করছেন। অন্ধকারের ভেতর মুকুলদা,বিনিদিও এগিয়ে আসে।
এই ঝিনি,কথা বলছিস না কেন? বিনিদি এসে হাত ধরে। কিছুই হয়নি ঘাড় গুঁজে সে বললো অংক খারাপ করেছিতো,মা বকবে তাই ভাবছিলাম।দেরি হয়ে গেল, ব্রততীদি বসে থাকবেন।যাই কেমন? আবছা আলোয় সবার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট হাসল সে আর সাইকেলে উঠে পড়ল।
ধীরে সুস্থে আয় তোরা আমি এগিয়ে দি ওকে। সে না করলেও ছোট বুলাদা চুপচাপ তার পাশে পাশে সাইকেলে এল।
ঝিনি তো আমাদের বাড়িতেই ছিল মাকে আশ্বস্ত করে ছোট বুলাদা।মৃদুল,বিনি গিয়ে বললো,আপনি চিন্তা করছেন তাই সঙ্গে করে নিয়ে এলাম।চা হবে না মাসি? ঝিনি যা হাতমুখ ধুয়ে নে,আমি ততক্ষণ ব্রততীদির সাথে দেখা করে আসি।
ঘরে এসে চিঠিদুটো ছিঁড়ে ফ্যালে সে।কুচি কাগজ আর ঝিনুকগুলো এত জোরে চেপে ধরে, তালুতে যেন ফুটে যায় ভাঙা ঝিনুকের টুকরো,সবসুদ্ধু দৌড়ে পেছনের পুকুরে ফেলে আসে সে।আঁজলা ভরে জল নিয়ে বারবার ধুয়ে ফ্যালে চোখ।রগড়ে রগড়ে মুছে তারপর পড়তে বসে।
রোজকার মত বাড়ি ফেরার আগে গেটের কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় ব্রততীদিকে।কি হয়েছে রে?মাথা নাড়ল সে। ঝিনুকরা আসলে উড়তে পারে না দিদি,ভেঙে যায়। ব্রততীদি চুপ করে রইল।
হোয়াংহো নদীকে কেউ বলে দুঃখ,কেউ বলে স্বর্গের নদী,তারাদের ছায়াপথ থেকে নাকি নেমে এসেছে.. আসলে যে যেভাবে দ্যাখে তাই না ঝিনি ?ভাঙা ঝিনুক গেঁথেই হয়ত কেউ কেউ বানিয়ে ফ্যালে ছোট্ট জাহাজ। বোতলবন্দী হয়ে পাড়ি দেয় তা আরও অচেনা কোন সমুদ্দুরে।
আমরা শুধু অপেক্ষাই করতে পারি বুঝলি। কিসের ? যে উত্তর আমরা খুঁজছি।
ভেবে দ্যাখ ঝিনি, ওই যে কালপুরুষের বেল্টের পাশে ছোট্ট তারা লুদ্ধক তার পাশে আরও ছোটো নাম না জানা ওই তারা হয়ত মারা গেছে বহুকাল,আমরা কি জানি তা?কোটি কোটি বছর আগে রওনা দিয়ে আজও যে তারার আলো পৌঁছোয়নি তাকেও জানি না।রাতের এই আকাশের কতটুকু জানি আমরা বল?সবকিছুই প্রায় ওরম'ই। আজ যদি কোনও প্রশ্নের জবাব ঠিকঠাক নাও পাওয়া যায় শান্ত হয়ে অপেক্ষাই করতে হয়।ঘরে যা ঝিনি,হিম পড়ছে,আমি এলাম।
অন্ধকারে কি একটা পাখি উড়ে গেল।তারাভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ঝিনুক ভাবল, তাহলে এরকম?
পরের ষ্টেপেই মিলে যাবে ভাবলেও সহজ অংক জটিল হয়ে নাগালের বাইরে চলে যায়?ভাঙা ঝিনুকের মত কি যেন ফুটে যায় আঙুলে আর রক্ত বেরোয়। কতদিন সব কিছু ভাসিয়ে দিতে হয় ছেঁড়া কাগজের সাথে।? জলের ভেতরে তারা জল হয়ে থেকে যায় আরও কতদিন?
তবু এরপর দেখা হলে সে হেসে উঠবে আগের মতই,গান শোনাবে।ভাল থাকুন মৃদুলদা,জানলার সিটে বসে বিনিদির সাথে চলে যান ভোরের ট্রেনে।হাওয়ার ভেতর সে শুধু উড়ে বেড়াবে সন্ধের ওই পাখিটার মত।
0 Comments