শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮২
সালেহা খাতুন
প্রতিষ্ঠানের কাজে এই যে প্রাণ পণ রেখে নিজেকে নিয়োজিত রাখা, এর যেমন ভালো দিক আছে তেমনি প্রাণহানির আশঙ্কাও থেকে যায়। আমাকেও এর মাশুল দিতে হয়েছিল। প্রাণ হয়তো রক্ষা পেয়েছে। কিন্তু আয়ুর হয়েছে ক্ষয়। নিজের যত্ন ভুলে শুধু কাজ কাজ আর কাজ করে কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকতে গিয়ে নিজেকে অবহেলা করার খেসারত দিতে হলো। পর পর দুদিন দুটি অনুষ্ঠানের সার্থক রূপায়ণের পর রক্তচাপের হেরফেরে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেল বামহাত। বয়স তখন চল্লিশের দোরগড়ায়। উনচল্লিশ।
বিপদে পড়ে দিশাহারা হয়ে পড়লেও, মানুষ চেনা যায়। ২০১২-র সাতাশ আঠাশ মার্চ এন. এস. এস. আর ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টারের দুটি অনুষ্ঠান “থ্যালাসেমিয়া ডিটেকশন ক্যাম্প এণ্ড অ্যাওয়ারনেস প্রোগ্রাম” এবং “প্রোটেকটিং দ্য রাইটস অফ ডিসঅ্যাডভ্যান্টেজড গ্রুপস” আয়োজনে এতো সময় দিতে হয়েছিল যে, সে সময় প্রথম আধার কার্ড নির্মাণের যে প্রাথমিক উদ্যোগ চলছিল তাতে বাবা হাজার বার ডাকা সত্ত্বেও যেতে পারিনি। বিরক্ত হয়েছিলেন বাবা। সময় নেই সময় নেই অজুহাত দেখিয়ে লাভ হলো না। সময় থমকে গেল। চারশো ভলান্টিয়ারের ফোন আর চারশো রকম কাজে ব্যস্ত থেকে নিজের চুল আঁচড়ানোর সময়টুকুও যেখানে ছিল না, অন্য কাজ তো সেখানে দুরস্ত।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সব বিগড়োতে শুরু করলো। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝতে হবে, অর্থাৎ দাঁতের চিকিৎসায় যেতেই হবে এমন ভাবে প্রথমেই ক্ষেপে উঠলো দন্তরাজি। দাঁত বাবাজির খেল শেষ হতে না হতেই ভেলকি দেখালো হাত বাবাজি। সকালে দাঁতের চিকিৎসক যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়েছিলেন সেসব রিপোর্ট নিয়ে,পাণিগ্রহণ করেছেন যিনি তিনি সন্ধেতে ডাক্তারের কাছে গেছেন। দশ বছরের বালিকাটিকে নিয়ে ঘরে রয়েছি। ঘর মানে কোয়ার্টার। বন্ধ দরজার ভেতরে মাতা কন্যা ব্যস্ত আছি লেখাপড়ায়।
লেখার জন্য পেন খুলতেই দেখি কালি শেষ। রিফিল ভরার তোড়জোর শুরু হলো। মনে চলে এলো ছোটোবেলায় বাবার পাঞ্জাবির পকেটে থাকা পেন থেকে রিফিল খুলে নিয়ে নিজেদের পেন ভরে নিতাম আর স্কুলে গিয়ে বাবা সই করতে গিয়ে হতবাক হয়ে যেতেন। অপরাধের বিচার তো এক দিন না একদিন হবেই! এবার আমি একাধিক পেনে রিফিল ভরতে গিয়ে কিছুটা অস্থির হয়ে খাটের একেবারে কোণায় বসে উল্টে গেলাম। কী যে হয়েছিল তখন! বুঝতে পারছিলাম যেভাবে পড়ছি, তাতে দরজার পাল্লায় মাথা লাগলে মাথা দুভাগ হয়ে যাবে। মাথা বাঁচানোর জন্য আঁকড়ে ধরলাম কারলনের গদির একটি কোণ। হড়কে গেল হাত। হাতটা কেমন যেন ছোটো হয়ে এলো।
বাথরুমে ছুটে গিয়ে জল ভর্তি পঞ্চাশ লিটার রিজার্ভারে পুরো বামহাত ডুবিয়ে দিলাম। বাথরুমের মেঝেতে থেবড়ে বসে কাতর কণ্ঠে মেয়েকে ডেকে বললাম আমাকে একটু খাওয়ার জল দিতে পারবি? মা জল চেয়েছে! তাই দৈনন্দিন ব্যবহারের গ্লাস ছেড়ে অনেক যত্ন নিয়ে কাচের গ্লাসে করে জল এনে দিল। উঠতে পারছি না। ওকেই বললাম বাবু, স্বপন মামাকে একটু ডাক। কিন্তু কীভাবে? দরজায় তো ছিটকিনি আটকানো। বললো একটা চেয়ার এনে তাতে উঠে দরজাটা খুলি। বিপদে পড়লে ছোটোরাও কীভাবে বড়ো হয়ে যায়, অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকি। যাকে হাতের তালুতে রেখে বড়ো করছি, পরিস্থিতি কেমন তাকে বড়ো করে দিল!
🍂
ওর স্বপন মামা আমার কলিগ। পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক। কোয়ার্টারে আমার নেক্সট ডোর প্রতিবেশী। দরজা খুলে মিহিগলায় স্বপনদার দরজায় টোকা দিয়ে স্বপন মামা স্বপন মামা বলে দুবার ডাকতেই স্বপনদা দরজা খুলে অবাক হয়ে দ্রুত চলে এলেন আমার কোয়ার্টারে। সঙ্গে অপর্ণাদি, ঐন্দ্রিলা এবং সায়ন। পুরো পরিবার। অপর্ণাদি আমাকে ধরে তুললেন। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। স্বপনদা ফোন করলেন কলেজের তৎকালীন অ্যাকাউন্টেন্ট শুভাশীষদাকে। তিনি ফোন করলেন সুধীনবাবুকে। সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করে গাড়ি এনে ডাক্তার কুলদীপ মুখার্জিকে দেখানোর ব্যবস্থা করলেন। ইতোমধ্যে সালাউদ্দিন ফিরে হতবাক হয়ে গেলেন। ঘরের পোশাকে ভিজে গায়েই চলে গেলাম রায় নার্সিংহোমে। ওখানে সব ব্যবস্থা করে মণিবাবু অপেক্ষা করছেন। সালাউদ্দিনও ঘরে থাকতে পারলেন না। ওঁকে বলেছিলাম মেয়ের কাছে থাকতে। কিন্তু মেয়ে রইলো অপর্ণাদির কাছে। ঐন্দ্রিলার পাশে।
তীব্র যন্ত্রণাতেও আমার মুখে হাসি দেখে ডাক্তার অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, “আশ্চর্য,কী করে এমন চুপচাপ আছেন? হাত ভেঙেছে টি শেপে”। সুধীনবাবু, মণিবাবু নিয়ে গেলেন কেয়ারফুলে এক্সরে করাতে। এক্সরে রিপোর্টও ডাক্তারের অবজারভেশনকেই সমর্থন করলো। অপারেশান হবে পরের দিন। সাময়িক একটা ব্যান্ডেজ করে ওষুধপত্র দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। এবার অনুভূত হলো অসম্ভব ব্যথা। বাড়িতে সেদিন জানানো হয় নি। পরের দিন রাত্রে প্রায় রাত দুটোতে অপারেশান হলো। সুধীনবাবু তার পুরো টিম নিয়ে অপারেশান থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষা করছেন। অপারেশান করে স্টিলের পাত বসিয়ে দেওয়া হলো। মেয়ে রইলো অপর্ণাদির কাছে। সত্যিই এ জীবন কত মানুষের কাছে আমাকে ঋণী করেছে,সেই অসীমের পরিসংখ্যান আমি আজীবন নিয়েই যাচ্ছি।
নার্সিংহোমের বিছানায় বসে জয়শ্রীদিকে ফোন করলাম, পরীক্ষার ডিউটিতে যেতে পারবো না বলে। তিনি বললেন, “এদিকটা নিয়ে ভেবো না। তুমি আগে সুস্থ হয়ে ওঠো”। জয়শ্রীদি আমার কলেজের কেমিস্ট্রির অধ্যাপক। পরে তিনি রাজা এন এল খান মহিলা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন। অপারেশান টেবিলে উঠেও এই যে কাজের চিন্তা, আসলে আমাকে যে দায়িত্বই দেওয়া হোক, সেটা যথাযথভাবে পালনের আপ্রাণ চেষ্টা আমি চালিয়ে যাচ্ছি সারাজীবন ধরে। আমাকে যদি ঝাড়ুদারের কাজ দেওয়া হতো বা দারোয়ানের কাজ দেওয়া হতো ঠিক একই নিষ্ঠাভরে সে কাজ আমি করতাম। সর্বত্র নিজেকে কর্মী বলেই পরিচিতি দিই। শিক্ষার্থীরা জানে ক্লাসেও কোনো ফাঁকি থাকে না আমার। এজন্য সকাল দশটা কেন বিকেল পাঁচটার ক্লাসেও শিক্ষার্থীরা সবাই উপস্থিত থাকে। ক্যাম্পাসে থাকার কারণে কলেজ আমার চব্বিশ ঘন্টাই নিয়ে নিয়েছিল।
মা তো রোজই ফোন করেন। কী কারণে যে দুদিন ফোন করেননি আজ আর মনে নেই। তৃতীয়দিন ফোন করতেই মেয়ে সব বলে দেয়। মা তৎক্ষণাৎ ট্রেন ধরে বাউড়িয়া থেকে সোজা মেদিনীপুরের নার্সিংহোমে চলে আসেন। খবরটা জানাইনি বলে বকাবকি করতে থাকেন। খবর পেয়ে সেদিন আমার পিএইচ.ডির গাইড অধ্যাপক লায়েক আলি খানও আসেন। আর সুধীনবাবু যন্ত্রণাকাতর নার্সিংহোমের দিনগুলিতে ঈশ্বরের দূতের মতোই পাশে থেকেছেন। ঐ দিনগুলিরই এক ভোরে নার্সিংহোমে কেবিনের দরজার বাইরে থেকে কোমল কন্ঠে জিজ্ঞেস করছিলেন, “সালেহা কেমন আছো?” বললাম স্যার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। সহ্য করতে পারছি না। তিনি নার্সদের জাগিয়ে তুলে যন্ত্রণা নিরশনের জন্য ইনজেকশন দেওয়ানোর ব্যবস্থা করলেন। তখন হয়তো আমার বাড়ির লোকেরা ঘুমিয়েই আছেন।
বিপদে যাঁরা পাশে ছিলেন।
কলেজ আমার কাছে পরিবারের মতো। বাড়ি থেকে দূরে থাকি, কলেজের মানুষজনই আমার আপনার। সে প্রমাণ বার বার পেয়েছি। একহাতে অপারেশান আর এক হাতে সেলাইন চলছে, দুপুরে নার্সিংহোমে ভাত খেতে দিয়েছে। খাবো কীভাবে? আমার বাংলা বিভাগের কলিগ অমর কুমার সাহা এলেন। তিনি বয়সে আমার সিনিয়র। তাঁকে অমরদা বলে ডাকি। তিনি মেদিনীপুর কলেজে ২০০৬ সালে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কলেজেরই প্রাক্তন ছাত্র। একখানা চামচ কিনে আনলেন। দু’লিটার জলের বোতল সঙ্গে আনলেন। আর ছিল আমার ছাত্র শুভদীপ বসু। চামচ দিয়ে আমাকে ভাত খাইয়ে দিল ও। চোখের জল লুকিয়ে ফেলে অবাক হলাম, মায়ের আদরের দুলাল ম্যাডামকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে।
ক্লাসরুমের বাইরেও শিক্ষার্থীদের এই যে ভালোবাসা আমি পাই, জীবন আমার সার্থক হয়েছে এখানেই। ইউ জি সি যে মেন্টরশীপের কথা বলে সেটা আমার কাছে নতুন নয়। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আমার বন্ধন এক অদৃশ্য রজ্জুতে বাঁধা। যখন যেখানে যার সঙ্গেই দেখা হোক,সম্মান পাই এবং সম্মান দিইও। ওদের শুকনো মুখ, বেকারত্ব, সাংসারিক জীবনের লড়াই যেমন আলোড়িত করে তেমনি ওদের প্রতিষ্ঠিত হওয়া, আনন্দে থাকা আমাকে আনন্দিত করে। দেশ বিদেশে ছড়িয়ে আছে ওরা। সুদীপা আছে ক্যালিফর্নিয়ায়, জার্মানিতে আছে অনন্যা। সমাজ মাধ্যমে দেখি সন্তান সামলাতে কেমন দক্ষ হয়ে উঠেছে ওরা। অসুস্থ হলে সত্যি সত্যিই ঘরের এবং বাইরের সব মানুষকে ভেতর থেকে অনুভব করা যায়। ২০১৪ তে যখন দ্বিতীয়বার হাতের অপারেশান হলো, স্পন্দনে থমথমে মুখে দেখতে এলো সুদীপা। আমার মাথায় হাত রাখলো। সে মুখ ভুলিনি।
(ক্রমশ)
0 Comments