দূর দেশের লোকগল্প-- ২২২
মোরগ কর্তার সহমরণ
(নেপাল, এশিয়া)
চিন্ময় দাশ
ঘন বনের ভিতর এক মোরগের বাড়ি। মুরগি বউ আর সাতটা ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে সংসার তার। বাচাগুলো খুঁটে খেতে শেখেনি তখনও। সকাল হলেই দুজনকে বেরিয়ে পড়তে হয় দানার খোঁজে।
এরকমই একদিন বেরিয়েছে দুজনে। অনেকটা সময় পেরিয়েও গেল। তেমন কিছুই জুটছে না। ওদিকে বাচ্চাগুলো তো খিদেয় আছে। দুজনেরই মন খারাপ।
এমন সময় কী সৌভাগ্য! এক ছড়া সয়াবিন পেয়ে গেল দুজনে। আহা, বেশ বড়সড়ই ছড়াটা। মোরগ বলল—বউ, একটা কাজ করো। আপাতত এটা নিয়েই তুমি ঘরে চলে যাও। বাচ্চাগুলো হাঁ করে আছে। আমি দেখি, আর কিছু পাই কি না।
বউ বলল—ঠিক বলেছ। সেই ভালো।
অনেকখানা পথ চলে এসেছিল দুজনে। ফিরতি পথে ভারি তেষ্টা পেয়েছে মুরগির। ভাবল, গলাটা একটু ভিজিয়ে নিতে পারলে, ভালো হয়। তাহলে, একটু তাড়াতাড়ি পথ চলা যাবে।
আরও কিছুটা এগিয়ে, ছোট্ট মতন একটা ডোবা দেখতে পেয়ে গেল। আহ, বাঁচা গেল! চটপট জলের কাছে নেমে গেল। তেষ্টায় বুক যেন ফেটে যাচ্ছিল বেচারির।
ঠোঁট ডুবিয়েছে জলে, অমনি সর্বনাশ! সয়াবিন ধরা ছিল ঠোঁটে। মুখ খুলতেই, টুক করে জলে পড়ে গেল। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখল, পুরো ছড়াটা একটু একটু করে নীচে নেমে যাচ্ছে। অসহায়ের মতো চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া, কিছুই করবার রইল না মুরগির।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ঘরে বাচ্চাগুলো খালি পেটে আছে। সকাল থেকে কিছুই জোটেনি তাদের। তার চেয়েও বড় কথা তার স্বামী। ভয়ে সিঁটকে গেল বেচারি!
যা রগচটা আর নিষ্ঠুর। কোন যুক্তিই শুনবার পাত্র নয় সে। আজ অনেক দুর্গতি আছে কপালে। ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে চলল মুরগি।
বিকেল বেলা মোরগ ঘরে ফিরে এলো। এসেই জানতে চাইল—কীগো, সয়াবিন দিয়েছ বাচ্চাগুলোকে?
বুক কেঁপে উঠল শুনেই। কথা বলবে কী, তোতলাতে লাগল—নাগো। জল খেতে ডোবায় নেমেছিলাম। জলেই পড়ে গেছে সয়াবিনটা।
শুনে তো মাথায় রক্ত উঠে গেলে মোরগের। এমনিতেই মোরগের গলা ঝাঁঝালো। সেটা সপ্তমে চড়ে উঠেছে এখন—তবে রে, মিথ্যুক! আমাকে বোকা বানাবার চেষ্টা? ঐ ফন্দি আমার কাছে খাটবে না। আসলে সয়াবিনটা নিজের পেটে চালান করেছিস। এখন গল্প ফেঁদে, বোকা বানাতে এসেছিস?
--না গো, গল্প নয়। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করো।
--তোকে বিশ্বাস করবো? আমি? চিনি না আমি তোকে? মিথ্যুক লোভী একটা। দুনিয়ার যতো লোভ তোর পেটে। সয়াবিনটা নিজেই খেয়েছিস তুই। দূর হয়ে যা আমার সামনে থেকে।
বুক কাঁপছে মুরগির। কিছু একটা বলতে গিয়েছিল, মোরগ হাঁকড়ে উঠল—মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। আর একটা কথা বলেছিস কী, ঠুকরে ঠুকরে তোকেই খেয়ে ফেলব আজ আমি। বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।
মনের দুঃখের চেয়ে, ভয় বেশি। সরে না পড়লে, বিপদ আছে কপালে। বেরিয়ে গেল মুরগি। এখানে এক মূহুর্ত থাকাও আর নিরাপদ নয়। যা শয়তান একখানা! তোর পেটেই সয়াবিনটা আছে—বলে, হয়তো পেটটাই চিরে ফেলবে তার।
যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। মনে একটাই ভাবনা। মা হয়ে বাচ্চাদের খাবার খেয়ে নিতে পারি কখনো? কী করে এমন সন্দেহ করতে পারে কেউ!
ভাবছে আর এগিয়ে চলেছে। ভাবছে, আর আরও পথ চলেছে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে চলছে তো চলছেই।
দেখতে দেখতে দিন যায়। দিন যেতে যেতে হপ্তাও যায়। দেখতে দেখতে বড় হয়েছে সাতটা বাচ্চাও। নিজেরাই এখন খুঁটে খেতে শিখে গিয়েছে তারা। সক্কাল না হতেই, দানা খুঁজতে বেরিয়ে পড়বার ঝক্কি নাই আর মোরগের।
হয়েছে কী, রাগ নেমে যেতেই মাথা ঠাণ্ডা। তখন বুঝতে পেরেছে, নিশ্চয় মিথ্যে বলেনি আমাকে। জল খেতে নামলে, পড়ে যেতেই পারে মুখের সয়াবিন। অসম্ভব কিছু নয়।
🍂
ভারি অনুশোচনা হোল মোরগের। কাজটা ঠিক হয়নি। ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলাটা, খুব ভুল। ভারি অন্যায়ই হয়ে গিয়েছে। তাছাড়া, ঘরটাও বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে আজকাল।
কী করা যায়, কী করা যায়? একদিন মরিয়া হয়ে, বউকে খুঁজতে বের হোল মোরগ। যেখান থেকে হোক, ফিরিয়ে আনতে হবে।
তখন হেমন্তকাল। বনের ভিতর দিয়ে চলেছে মোরগ। চলতে চলতে তেষ্টা লেগেছে। খানিক এগিয়ে, সেই ডোবাটার কাছে এসে হাজির। তার বউ বলেছিল, এখানেই জল খেতে নেমেছিল।
ডোবায় নেমে তো অবাক। আরে, এগুলো কী? জলের একেবারে কিনারা ঘেঁষে, চার-পাঁচটা শালুক ফুটে আছে। ধবধবে সাদা রঙের ফুল। আগে তো কখনও দেখা যায়নি!
মাথার মধ্যে চিড়িক করে উঠল। হায়, ভগবান! বউ তো সত্যিই মিথ্যে বলেনি তাহলে! সয়াবিনটা এখানেই পড়ে গিয়েছিল তার।
জোরে জোরে আবার হাঁটতে লাগল মোরগ। যে করেই হোক, খুঁজে আনতে হবে তাকে। আবার একসাথে দিন কাটাবো আবার দুজনে। হাঁটতে হাঁটতে সেইখানে এসে হাজির হোল, যেখানে শেষবার সয়াবিন নিয়ে, ঘরে ফিরেছিল তার বউ।
হেঁড়ে গলা মোরগের। তাতেই গান গাইতে লাগল—
মিথ্যে বলোনি বউ, তুমি
যা গিয়েছ বলে
সত্যি ছিল সবই। দ্যাখো,
শালুক ফুটেছে জলে।
সবাই রয়েছি পথ চেয়ে
তোমার ফেরার আশায়
ফিরলে তুমি, ঘর
ভরবে ভালোবাসায়।।
চেয়ে চেয়ে দেখল জায়গাটা। আবার শুরু হোল তার পথ চলা। দিন কয় যাবার পর, এক জায়গায় দু’একটা পালক পড়ে থাকতে দেখতে পেল। কিন্তু সে জানতে পারবে কী করে? ক’দিন আগে, এখানে একবার থেমেছিল ক্লান্ত মুরগিটা।
আবার কদিন চলে, এক জায়গায় বেশ কিছু ঝরা পালক চোখে পড়ল তার। বউয়ের কথা খুব মনে পড়তে লাগল তার। কিন্তু তখনও সে জানতেও পারল না, ঠিক একদিন আগে, এখানেই থেমেছিল তার বউ। শরীর এক্কেবারে কাহিল। পালক ঝরে যাচ্ছিল তার গা থেকে।
পুরাণো দিনগুলোর কথা মনে পড়তে লাগল মোরগের। কী সুখেরই না ছিল সেসব দিন। বাচ্চাদের নিয়ে মনের আনন্দে সময় কেটে যেত দুজনের। মোরগ আবার গাইতে লাগল--
মিথ্যে বলোনি বউ, তুমি
যা গিয়েছ বলে
সত্যি ছিল সবই। দ্যাখো,
শালুক ফুটেছে জলে।
সবাই রয়েছি পথ চেয়ে
তোমার ফেরার আশায়
ফিরলে তুমি, ঘর
ভরবে ভালোবাসায়।।
কেউই জানে না। দুজনে এখন অনেকটাই কাছাকাছি হয়ে এসেছে। এক সময় মোরগের গলা কানে গেল মুরগির। আঁতকে উঠে ভাবল, নিশ্চয় এতো দিনেও রাগ নামেনি মাথা থেকে। পেট চিরে দেখবে বলে, খুঁজতে বেরিয়েছে!
ভয় পেয়ে দৌড়তে শুরু করে দিল। যত তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু শরীরে কুলোচ্ছে না। হাঁফ ধরে যাচ্ছে। কিন্তু থেমে গেলেও চলবে না । সাক্ষাৎ মৃত্যু তাড়া করে আসছে পিছনে।
দৌড়তে চেষ্টা করল শুধু। কিন্তু তার শরীর তাল মেলাতে পারল না। ধুপ করে পড়ে গেল মাটিতে। আর উঠল না।
পরের দিনই একেবারে সেখানেই এসে হাজির হয়েছে মোরগ। মুরগির নিথর শরীরটা চোখে পড়ে গিয়েছে। আঁতকে উঠেছে সে। হায়, হায়, এ কী দৃশ্য। আমার দোষেই হয়েছে এমনটা। অনুতাপে পুড়ে যেতে লাগল মোরগ।
কতো আশা নিয়ে এতটা পথ খোঁজাখুঁজি করে এসেছে সে। মনে আশা ছিল, সেই ডোবার পাড়ে নিয়ে যাবে বউকে তার। সুন্দর শালুক ফুলগুলো দেখাবে বউকে। মাফ চাইবে তার ভুলের জন্য। সে তো মাথা-গরম মেয়ে নয়। নিশ্চয় মাফ করে দেবে তাকে! আবার সুখের সংসার গড়ে উঠবে দুজনের।
বেশিক্ষণ ভাবতে হোল না বেচারাকে। মাথাটা কেমন পাক খেয়ে গেল। ধুপ করে সেই যে আছড়ে পড়ল, আর উঠল না। বউয়ের বুকে মাথা রেখে, মরেই গিয়েছে মোরগ।
0 Comments