শব্দে গাঁথা মণি-মালা : ৮১ / সালেহা খাতুন
এক্ষেত্রে শিক্ষা নিলাম কোনো সেমিনার ওয়ার্কশপ বা অনুষ্ঠানে বক্তারূপে এক এবং একমাত্র বক্তাকে আর ডাকবো না। একজন যদি না আসেন তাহলে এমন কোনো অসুবিধা হবে না। মাননীয় অধ্যক্ষ প্রবীরকুমার চক্রবর্তী আমাকে ডিপ্রেশন থেকে বের করে আনলেন। স্যারকে বলেছিলাম স্যার এন. এস. এস. করে স্লামের মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে দক্ষ হলেও হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের মনোভাব বোঝা সম্ভব হলো না আমার পক্ষে। “ঈর্ষা বৃহতের ধর্ম” ! এক গাড়ি, এক মঞ্চ অনেকেই শেয়ার করতে চান না। নিজের ঔদার্য দিয়ে সবাইকে একছাঁচে না ফেলার শিক্ষা পেলাম।
ভারতবর্ষ মানে ভালোবাসা। মানুষে মানুষে ভালোবাসা। তবুও কখনো কখনো আমরা একথা বিস্মৃত হই। অহংবোধ তীব্র হয়। বৈচিত্র্যপূর্ণ ভারতীয় সমাজের সব মানুষের কল্যাণ সাধিত না হলে ভালোবাসার ভিত মজবুত হয় না। সম্পূর্ণ হয় না মানব কল্যাণ। তাই সরকারি, বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক, ব্যক্তিগত বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে সমানাধিকার সমমর্যাদা সমান সুযোগ সুবিধা সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। ছাত্রাবস্থায় বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলাম একাজে। ভিলেজ মোবিলাইজারের মতো কাজ করতে করতে পাশাপাশি অবস্থিত কয়েকটি গ্রামের প্রত্যেকটি কোণের মানুষের কাছে পৌঁছে গেছি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সঞ্চয়-সাশ্রয়-
মানবতাবোধ বিভিন্ন ব্যাপারে তাদের সঙ্গে মতবিনিময় হতো। কিন্তু লক্ষ করেছি কী নিদারুণ বৈষম্য আছে সেখানে।কলকাতা থেকে মাত্র কুড়ি পঁচিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি বর্ধিষ্ণু এলাকা। অসংখ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী আর্থিক প্রতিপত্তি সম্পন্ন মানুষজনের বাস। আধুনিক সভ্যতার সমস্ত সুযোগ সুবিধা সেখানে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে প্রদীপের তলায় অন্ধকার। ডিসঅ্যাডভ্যান্টেজড গ্রুপস অধ্যুষিত অঞ্চলে জল-আলোর মতো গুরুত্বপূর্ণ দুটি জিনিসের সামান্য সুযোগটুকুও নেই। নেই-এর তালিকা আরো বিস্তৃত। কিন্তু চিরকাল এ অবহেলা চলবে না। সেজন্য নানাসময় সরকারি বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন সাধু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে।
ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টারের সেমিনারের নানা মুহূর্ত।
আপামর জনসাধারণ যদি মানসিক ভাবে প্রস্তুত না হয় তাহলে সবই বিফল। স্কুল কলেজে ডিসঅ্যাডভ্যান্টেজড গ্রুপের ছেলেমেয়েরা প্রচুর পরিমাণে স্কলারশিপ পাচ্ছে দেখে আভিজাত্যের চূড়ান্ত স্পর্শকারী অনেকেই দেখি বিরূপ মন্তব্য প্রকাশ করেন। আসলে ডিগ্রি নয়, মানব কল্যাণের জন্য, মানুষকে ভালোবাসার জন্য দরকার সফ্ট স্কিল। উদার মানবিকতার জাগরণের জন্য এবং সচেতনতার প্রসার ঘটানোর জন্য ইউ জি সিও উদ্যোগ নেয় কলেজে কলেজে ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কিন্তু এর দায়িত্ব আমার কলেজে তখন কেউ নিতে চান নি। অধ্যক্ষ প্রবীরকুমার চক্রবর্তী আমাকে দায়িত্ব দিলেন। মানবিকতার প্রতিমূর্তি বিবেকানন্দকে সামনে রেখেই নতুন করে পথচলা শুরু করলাম। প্রথমবারের ভুল থেকে শিক্ষা নিলাম। পাশে পেলাম শুভানুধ্যায়ীদের। বুঝলাম শিক্ষার্থীরা যাতে সরাসরি বিভিন্ন সরকারি সুযোগ সুবিধার সন্ধান পায় সে বিষয়ে সবিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আর কড়া দৃষ্টি রাখতাম অ্যাডমিশনের সময়,সরকারি নির্দেশিকা মেনে সংরক্ষিত আসনগুলিতে ভর্তি যথাযথভাবে নেওয়া হচ্ছে কিনা। আমার চিরকালীন শুভাকাঙ্ক্ষী অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগকে পেলাম পরামর্শদাতারূপে। তিনি বিভিন্ন লিফলেট এনে দিতেন যেগুলিতে শিক্ষার্থীরা কী কী সুবিধা পেতে পারে তা লিপিবদ্ধ থাকতো।
🍂
২০১২–এর সাতাশে মার্চ আয়োজন করলাম “প্রোটেকটিং দ্য রাইটস অব ডিসঅ্যাডভ্যান্টেজ গ্রুপস” শীর্ষক এক দিনের একটি সেমিনার। বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন প্রোজেক্ট অফিসার কাম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ডিস্ট্রিক্ট ওয়েলফেয়ার অফিসার শ্রী শান্তনু দাস, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট-ডেপুটি কালেক্টর-মাইনরিটি সেলের অফিসার ইনচার্জ শ্রী প্রশান্ত কুমার দাস এবং অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগ। শান্তনু বাবু বললেন এস, এসটি এবং ওবিসিদের জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রোগ্রাম আর পলিসির খুঁটিনাটি। প্রশান্তবাবু জানালেন মাইনরিটিদের জন্য সরকার নির্দিষ্ট বিভিন্ন প্রোগ্রাম পলিসির নাড়ি নক্ষত্র। তিনি আমাকে বাহবা দিলেন এমন একটি দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। কিন্তু মাইনরিটি হিসেবে আলাদা সুযোগ সুবিধা আমি কোনোদিন পাই নি এবং গ্রহণও করিনি। পড়াশোনা কর্মক্ষেত্র সর্বত্র জেনারেল ক্যাটিগরিতেই আমি লড়াই করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। ফলে সহানুভূতিশীল মানুষ রূপেই আমি আত্মস্বার্থে মগ্ন না থেকে সব মানুষের কল্যাণের জন্যই ভেবেছি, সুবিধা পেয়েছি বলে নয়।
এবার আর ভুল করিনি। সর্বোপরি বক্তাদের কাউকে গাড়ি পাঠাতে হয় নি। তাঁরা বলেছিলেন তাঁরা নিজেরাই চলে আসবেন। তবে তাঁদের অফিসে বারকয়েক যাবার পর ভিজিটর স্লিপ জমা দিয়ে অপেক্ষা করে তবে দেখা পেয়েছি। কর্মব্যস্ত মানুষ সব। শুধু আমাদেরই কোনো কাজ নেই!
২০১৩ তে জুনের কুড়ি তারিখ আর একটি সেমিনারের উদ্যোগ গ্রহণ করলাম। কিন্তু কলেজে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষা পরীক্ষা করে কোনো কাজই করা যায় না। যেমন শিক্ষার্থীরা যোগ দিতে পারেনা তেমনি আমরাও নাকাল হই। অধ্যক্ষ প্রবীরকুমার চক্রবর্তী তখন রিটায়ার করেছেন। সুধীনবাবু টিচার ইনচার্জ। স্যারকে বললাম এবারের সেমিনার ক্যাম্পাসের বাইরে কলেজের কাছাকাছি যে কোনো একটি স্কুলে আয়োজন করি। কেননা কদিন পরে স্কুলের শিক্ষার্থীরাই কলেজে আসবে। আর এটি একটি আউটরিচ প্রোগ্রামরূপেও গণ্য হবে। গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা স্বাতী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে চিঠি লিখে অনুমতি নিলাম। তাঁর তৎপরতায় মুগ্ধ হলাম। ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টারের অন্যতম সদস্য মমতা জানা রহমান ম্যাডাম ও কিছু শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্কুলে চলে গেলাম। প্রায় চারশো ছাত্রী এই সেমিনারে অংশ নেয়। স্কুলের শিক্ষিকাদের আন্তরিক সহযোগিতা পেলাম। সেবার বললেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বি সি ডাবলুর প্রোজেক্ট অফিসার কাম ডিস্ট্রিক্ট ওয়েলফেয়ার অফিসার শ্রী রাহুল নাথ এবং মাইনরিটি সেলের ফিল্ড সুপারভাইজার সেখ সাহেদ আলি। সেমিনারের শিরোনামা অধ্যাপক রাজেন্দ্রনাথ দত্তের পরামর্শে সেবার দিয়েছিলাম “সেফগার্ডিং দ্য রাইটস অফ সোশ্যালি এন্ড ইকনমিক্যালি ডিসঅ্যাডভ্যান্টেজড গ্রুপস”।
ঐ স্কুলে সেমিনার করার পেছনে আরো একটি জ্বলন্ত কারণ ছিল। বাইরে থেকে আমি দেখেছিলাম ক্লাস ফাইভের একটি বাচ্চা দিদিমণিদের কাছে নিজের কাস্ট এসসি/এসটি/ওবিসি কিনা জানাতে ইতস্তত করছে। কারণ বন্ধুরা এটা জেনে গেলে ওকে হেয় করবে। আর একটি ছোটো মেয়ে বাবাকে ‘আব্বু’ সম্বোধনে না ডেকে জামা ধরে টানছে, কেননা জানানো যাবে না ও মুসলমান। এই সেমিনার করে ওদের বোঝাতে চেয়েছিলাম,প্রত্যেকটা মানুষেরই মর্যাদা আছে। এসসি/এসটি/ওবিসি/মাইনরিটি হওয়া অপরাধ নয়, লজ্জারও নয়। আমরা যেন সবাই চেষ্টা করি সংকীর্ণ স্বার্থ ভুলে মহৎ মানবিকতার আদর্শে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে। সব থেকে বড়ো কথা মন যদি মালিন্য মুক্ত হয়, মনের প্রসার যদি ঘটে তাহলে ছোটো বড়ো ভেদ থাকবে না। শুধুমাত্র যারা পিছিয়ে পড়েছে বা পিছিয়ে রয়েছে তাদেরকে একটু এগিয়ে দিতে সাহায্য করতে হবে।
২০১৫ তে ২৮ জানুয়ারি “দলিত রাজনীতি ও মানবাধিকার” শীর্ষক আলোচনাচক্রের আয়োজন করলাম। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ দলিত জনগোষ্ঠীর মানুষ। দলিত শব্দটি এই গোষ্ঠীর নিপীড়িত অবস্থানকে সূচিত করে। দলিত একটি রাজনৈতিক আইডেনটিটি। যা মানসিক মর্যাদা,সাম্য এবং শ্রদ্ধা ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক দুর্বার শপথ। “দুর্বলতর শ্রেণির অধিকারের সমস্যা” প্রসঙ্গে বললেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক সুধীন্দ্রনাথ বাগ মহাশয়। বিপ্লব মাজি বললেন একুশ শতকের দলিত ভারত নিয়ে। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইয়াসিন খান দলিত রাজনীতি ও মানবাধিকার প্রসঙ্গে বললো। এন.এস.এস. এবং ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টারের দায়িত্ব সামলানোকালীন সব সময়েই আমার ছাত্র ইয়াসিনকে পেয়েছি। এবং এমনটা আমার ভাইয়ের ক্ষেত্রেও করেছি। লিগাল অ্যাওয়ারনেস প্রসঙ্গে ওকেও এই দুক্ষেত্রেই পেয়েছি। কাছের মানুষদের ডাকলে যেমন তাঁরা সহজে না করতে পারেন না তেমনি উল্টো দিক থেকে একটা প্রেস্টিজও জড়িত থাকে। ওঁদের কাছে নিজের কলেজকে ঠিকঠাক উপস্থাপন করতে পারবো তো? এ চিন্তা সর্বদা ভেতরে ভেতরে কেমন যেন অস্থির করে তোলে।
ওয়ার্ক অ্যালকোহলিক : মত্ত থাকার দিনগুলি
তবুও ২০১৬ - এর কুড়ি আগস্ট শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করলাম “অ্যাকসেস টু জাস্টিস ফর এসসি/এসটি/ওবিসি অ্যাণ্ড মার্জিনালাইজড গ্রুপস” আলোচনাচক্র। কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট এস.এম.ওবায়দুল্লাহ এবং যোগেশচন্দ্র চৌধুরী ল’কলেজের অধ্যাপক ড. সোমনাথ রায়কে পেলাম বক্তারূপে।
অপর্ণীতাকেও অনেকবার বিভিন্ন সেমিনারে বক্তারূপে ডেকেছি, সহায়তা পেয়েছি। ইক্যুয়াল অপরচুনিটি সেন্টারে আমার তত্ত্বাবধানের শেষ সেমিনারটিতে বাঁকুড়া বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপক ড. তনুকা রায় সিনহার সঙ্গে সমস্ত প্রকার যোগাযোগের দায়িত্ব ওরই ছিল। আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.মেরুনা মুর্মূর সঙ্গে যোগাযোগ করে ইংরেজির অধ্যাপক সাগির আলি। ২০২২ এর ২৪ মে আয়োজিত এই সেমিনারের নাম দিই “মেজার্স ফর এলিমিনেশন অফ সোশ্যাল ইনইক্যুয়ালিটিজ”। ২০২৩ - এ এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করি। বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে করতে কখন যে নিজেও আয়োজক হয়ে পড়েছি!! সত্যি সত্যিই শিক্ষা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। দেখে শেখা ঠেকে শেখা চলছে তো চলছেই। এর কোনো শেষ নেই।
(ক্রমশ)
0 Comments