জ্বলদর্চি

পেয়ারা /ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৫৯
পেয়ারা

ভাস্করব্রত পতি

'কাঠবেড়ালি! কাঠবেড়ালি! পেয়ারা তুমি খাও? 
গুড় মুড়ি খাও? দুধ ভাত খাও? বাতাবি নেবু? লাউ?
বেড়াল বাচ্চা? কুকুর ছানা? তাও?
ডাইনি তুমি হোঁৎকা পেটুক, 
খাও একা পাও যেথায় যেটুক! 
বাতাবিনেবু সকল গুলো একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো! 
তবে যে ভারি ল্যাজ উঁচিয়ে পুটুস পাটুস চাও? 
ছোঁচা তুমি! তোমার সঙ্গে আড়ি আমার! যাও!
কাঠবেড়ালি! বাঁদরীমুখী! মারবো ছুঁড়ে কিল? 
দেখনি তবে? রাঙাদা'কে ডাকবো? দেবে ঢিল! 
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা! 
তাইতো তার নাকটি বোঁচা! 
হুতমো চোখী! গাপুস গুপুস! 
একলাই খাও হাপুস হুপুস! 
পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি কুষ্টি মুখে! 
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস। খেয়োনা মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও! 
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও! কাঠবেড়ালি! তুমি আমার ছোড়দি' হবে? বৌদি হবে? হুঁ,
রাঙা দিদি? তবে একটা পেয়ারা দাও না! উঁঃ!
এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো? 
ফ্রকটা নেবে? জামা দু'টো? 
আর খেয়ো না পেয়ারা তবে, 
বাতাবি নেবুও ছাড়ুতে হবে! 
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছ যে ছুট? অ মা দেখে যাও!
কাঠবিড়ালি! তুমি মর! কচু খাও'! 
---- খুকী ও কাঠবিড়ালি, কাজী নজরুল ইসলাম
বাংলা সাহিত্যে পেয়ারা নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা এটিই। ছোট বড় সবার কাছে সমাদৃত এই 'খুকী ও কাঠবিড়ালি'। পেয়ারাকে সংস্কৃতে পারেবত, হিন্দিতে সরিফা, অমরুৎ, তামিলে বিলয় গোয়াপঝাম, তেলুগুতে ইরাজাম পল্টু, অসমীয়াতে অমর, ইংরেজিতে guava বলে। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ায় আঁজির, মেদিনীপুরে প্যায়রা, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে গইয়ম, গোঁয়াছি, পেয়ালা, পঞ্চগড়ে বিলতি, সিলেটে সফরি, নোয়াখালীতে হেয়ারা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গইয়ম, বরিশালে গোইয়া, ময়মনসিংহে হবরি বলে লোকেরা। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে তাকালে স্প্যানিসে গুয়াবো, মালয়তে জাম্বুবাতু, পর্তুগিজে গোয়াবা, গোয়াইবেইরা, ফরাসিতে গোয়াভে, গোয়াভিয়ার, হল্যান্ডে গুয়াভেবুম বলা হয় পেয়ারাকে। 
পেয়ারা গাছের সুদৃশ্য কাণ্ড

খৃষ্টীয় প্রথম শতকের চরক সংহিতার সূত্রস্থানের ২৭ অধ্যায়ের ১০৬ নম্বর শ্লোকে পাই --
'গুরু পারাবতং জ্ঞেয়ং অর্চ্যত্যগ্নি নাশকম্। 
দ্বিবিধং শীতমুণ্ড মধুরঞ্চালমেব চ'।
অর্থাৎ পারাবত ফল দু'ই ধরনের। একটি অম্লরসযুক্ত, আর অন্যটি মধুররসযুক্ত। এ দু'টির মধ্যেই রয়েছে শৈত্য ও উষ্ণগুণ। এগুলি অত্যগ্নি রোগ এবং অরুচি রোগ নিরাময় করে। এই পারাবত ফল বা পারেতক ফল থেকেই লোকায়তিক নাম 'পেয়ারা' এসেছে। পেয়ারার বিজ্ঞানসম্মত নাম Psidium guajava Linn। এটি Myrtaceae পরিবারের অন্তর্গত। পেয়ারা গাছের অন্যান্য প্রজাতিগুলি হল --
Psidium cattleianum, 
Psidium molle, 
Psidium acutangulam, 
Psidium araca, 
Psidium chinensis, 
Psidium cujavillis, 
Psidium pumilum.
পেয়ারা পাতা

ভারতে এই ফল আমদানি করেছে পর্তুগীজরা। যতদূর জানা যায়, পেয়ারা প্রথমে মেক্সিকো থেকে এসেছে কলম্বিয়ায়, তারপর ব্রাজিল, পেরুতে রোপিত হয়েছে। এটি আমেরিকার গাছ বলেই কথিত। আমেরিকার নিরক্ষীয় অঞ্চলে পেয়ারার আদি বাসস্থান। কিন্তু প্রাচীন ভারতীয়রা একে জানতো 'পারাবত' ফল নামে। তথ্যসূত্র অনুযায়ী, পর্তুগীজদের ভারতে আসার অনেক আগেই এই পারাবত ফল প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল। খৃীষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কণিষ্কের সময়কালে চরক সংহিতায় এর উল্লেখ মেলে। তখন অবশ্য পর্তুগীজরা ভারতে আসেনি। ভারতের মধ্যে কাশী, পাটনা এবং প্রয়াগ অঞ্চলের পেয়ারা বেশ উৎকৃষ্ট। শীতের সময় পশ্চিমবঙ্গে যে পেয়ারা বাজারে মেলে তাকে কাশীর পেয়ারা বলা হয়ে থাকে। এ রাজ্যের মধ্যে বারুইপুরের পেয়ারার চাহিদা এবং বাজার খুব লক্ষ্য করা যায়। উত্তর ২৪ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলি জেলাতেও এরাজ্যের মধ্যে ভালোই পেয়ারা চাষ করা হয়। জনপ্রিয় বাংলা সিনেমা 'শত্রু'তে ছোট্টু তাঁর বাবার খোঁজ পেতে পুলিশকে পেয়ারা ঘুষ দেওয়ার দৃশ্য তো আজও জ্বলন্ত ছবি। 
কাঁচা পেয়ারা

উন্নত জাতের পেয়ারাগুলির মধ্যে লখনউ ৪৯, থাই পেয়ারা, ললিত পেয়ারা, শ্বেতা, সর্দার, অর্ক মৃদুলা, অর্ক কিরণ, এলাহাবাদ সফেদা, হিসার সফেদা, হিসার সুরখা, পান্ত প্রভাত উল্লেখযোগ্য। আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য উচ্চফলনশীল প্রজাতির পেয়ারা হল স্বরূপ কাঠি, বারি পেয়ারা-১, বারি পেয়ারা-২, বারি পেয়ারা-৩, বাউ পেয়ারা-১, বাউ পেয়ারা-২, বাউ পেয়ারা-৩, বাউ পেয়ারা-৪, বাউ পেয়ারা-৫, বাউ পেয়ারা-৬, বাউ পেয়ারা-৭, বাউ পেয়ারা-৮ ইত্যাদি। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা উৎপাদন হয় ভারতে। এখানে বাৎসরিক ১,৭৬,৫০,০০০ মেট্রিক টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়। আর ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম পেয়ারা উৎপাদনকারী রাজ্য হল উত্তরপ্রদেশ। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে মধ্যপ্রদেশ এবং বিহার। পাঞ্জাব ও হরিয়ানাতেও প্রচুর পেয়ারা চাষ হয়। ভারতের মোট ৫০১৬০০ একর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়। ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পেয়ারা রপ্তানি করা হয় কুয়েত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব এমিরেটস, সৌদি আরব, জর্ডন এবং নেদারল্যান্ডসে। 

বিশ্বের সর্বোচ্চ পেয়ারা (২০১১) উৎপাদনকারী ১০ টি দেশের নাম ---
১) ভারত ১৭,৬৫০,০০০ মেট্রিক টন
২) চিন ৪,৩৬৬,৩০০ মেট্রিক টন
৩) থাইল্যান্ড ২,৫৫০,৬০০ মেট্রিক টন
৪) পাকিস্তান ১,৭৮৪,৩০০ মেট্রিক টন
৫) মেক্সিকো ১,৬৩২,৬৫০ মেট্রিক টন
৬) ইন্দোনেশিয়া ১,৩১৩,৫৪০ মেট্রিক টন
৭) ব্রাজিল ১,১৮৮,৯১০ মেট্রিক টন
৮) বাংলাদেশ ১,০৪৭,৮৫০ মেট্রিক টন
৯) ফিলিপিন্স ৮২৫,৬৭৬ মেট্রিক টন
১০) নাইজেরিয়া ৭৯০,২০০ মেট্রিক টন

পাকা পেয়ারা

পেয়ারাতে রয়েছে ভিটামিন সি, ক্যারোটিনয়েডস, ফোলেট, পটাশিয়াম, আঁশ এবং ক্যালসিয়াম। খোসাতেই সবচেয়ে বেশি ভিটামিন সি থাকে। পেয়ারার বীজে থাকে ওমেগা ৩ এবং ওমেগা ৬ পলিঅ্যান স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড। এছাড়াও পেয়ারাতে রয়েছে ভিটামিন বি-১, বি-২, বি-৩, ম্যাঙ্গানিজ, সেলেনিয়াম ইত্যাদি। পেয়ারার পাতা, ছাল এবং ফল -- সবই খুব উপকারী। দাঁতের নানা ধরনের রোগের উপশমকারী হিসেবে পেয়ারার পাতা ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে পায়োরিয়া, দাঁতের ব্যথা, দাঁতে ঘা হলে পেয়ারা পাতা সেদ্ধ করে কুলকুচি করতে বলা হয়। এছাড়াও অজীর্ণ, আমাশয়, পাতলা পায়খানা, অগ্নিমান্দ্য, পোড়া ঘা, খাবারে অরুচির সমস্যার সমাধানে পেয়ারা খুব উপকারী। গ্রাম বাংলার মানুষ কচি পেয়ারা পাতা দিয়ে দাঁত মাজে।

🍂

Post a Comment

0 Comments