জ্বলদর্চি

সপত্ন /পুলক কান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

সপত্ন 

পুলক কান্তি কর

-  এই অপর্ণা দেখছিস্‌, ওই যে স্ট্রাইপ স্ট্রাইপ শাড়ীটা পরে একজন ভদ্রমহিলা ঢুকছে - ওইটা সমীরদার প্রথম বউ। নীলা বেশ আগ্রহভরে দেখালো তার বন্ধুকে।

- বাঃ খুব ডিগনিফায়েড দেখতে কিন্তু! সমীরদা শিল্পি মানুষ তো!  দু-দুটো বউই কিন্তু চোখে পড়ার মত। আমার তো লাবণ্য বউদিকেও দারুন লাগে। ঠিক যেন মানুষের শরীর নিয়ে একটা কবিতা দাঁড়িয়ে আছে। যেমন ফিগার, তেমনি রঙ, তেমনি চোখ-চুলও নজর কাড়ার মতো। অপর্ণা অকৃপন হল তার বর্ণনায়। 

- তোমরা মেয়েরা যখন এত রূপের প্রশংসা করছ, তাহলে তো মানতেই হবে ভদ্রমহিলা সুন্দরী। কই, ওই ভদ্রমহিলা কোথায়? অপর্ণার বর সৌরাশিস চোখ ঘোরালো চারদিকে অসীম কৌতুহল নিয়ে।

- ওই যে দ্যাখো, ওই একটা ছাপা মত সাদা শাড়ী পরে একজন এগিয়ে যাচ্ছে ওই অদিতি বউদি মানে ওই সাদা স্ট্রাইপ শাড়ী পরা ভদ্রমহিলার দিকে – ওটাই লাবণ্যবৌদি। নীলা উত্তর দিল।

- বাঃ দুই সতীনের ভারী ভাব যে গো! সৌরাশিস বলল অপর্ণার দিকে চেয়ে।

- ওরা নাকি ক্লাশমেট ছিল দুজনে। তেমনটাই শুনেছি আমি। নীলার উত্তর। সমীরদা ওদের সিনিয়র ছিল একবছরের।

- তুমি কি এদের সব খবর রাখো নাকি নীলা? সৌরাশিস বিস্ময় প্রকাশ করল। 

    অপর্ণা বলল, বা রে জানবে না? নীলা তো সমীরদার কীরকম একটা তুতো বোন হয় যেন!

- কীরকম কী রে! আপন মাসতুতো বোন। সমীরদা আমার চেয়ে বছর দেড় দুই এর বড়। ফলে ওর সাথে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল বরাবরই। ও যখন অদিতিবৌদিকে বিয়ে করল- তখন কিছুদিনের জন্য আমার সাথে ওর যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়- ওটা আমারই দোষ আমার তখন সুমির জন্মানো নিয়ে কিছু শারীরিক অসুবিধা ছিল- তারপর আমরা দুবাই চলে যাই। সেখান থেকে ফিরে যখন আমি- তখন সমীরদা লাবণ্যবৌদির সাথে থাকতে শুরু করেছে।

🍂

- কী তোমার মনে মনে লাড্ডু ফুটছে নাকি? সৌরাশিসকে কপট ধমক দিল অপর্ণা। 

- কি নিয়ে?

- এই তোমারও যদি এমন দুটো সুন্দরী বউ হত!

- সবার কি আর সেই সৌভাগ্য হয় অপু?

- এমন সৌভাগ্য আশাও করতে যেও না! আমি বাঁচতে তোমার মুক্তি নেই।

    তাহলে তো তোর মৃত্যু কামনা করবে যে রে মনে মনে! মাঝখান থেকে ফুট কাটলো নীলা।

- ও গুড়েও বালি নীলা। তুই কি ভেবেছিস মরে গেলে ওকে আমি মুক্তি দেব? ভূত হয়ে এসে চৌকিদারি করব। এসব গা ঢলাঢলি আমার সহ্য হবেনা বাপু!

- তোমারা এমন করছ, যেন আমি অলরেডি আরেকটা বউ রেডি করে রেখেছি! কপট রাগ দেখালো সৌরাশিস।

- ঠিক কথা অপর্ণা! তোর আবার বেশী বেশী! আমি তো গৌতমকে বলে দিয়েছি, যাও বাপু- তোমার যদি বেটার কাউকে মনে ধরে, আমাকে বলো। দু নৌকায় পা দিয়ে অশান্তি বাড়িও না। দুটো নৌকোই ডুববে। নীলা ফুট কাটলো।

    অপর্ণা বলল, দুটো ডুববে মানে? ডুবলে ওরটা ডুবুক। আমারটা ডুববে কেন?

- অন্যেরটা ডোবাও তো তোরই ডোবা রে! একটু চুপ থেকে নীলা আবার বলল, দেখনা - সমীরদার ফটোটা কি সুন্দর করে সাজিয়েছে! চারদিকে এত রকম অর্কিড, জানিস তো এই নীল রঙের অর্কিডটা সমীরদার খুব প্রিয় ছিল। লাবণ্য বৌদি সুন্দর করে সাজিয়েছে মানতেই হবে। ও যেমন রুচিশীল মানুষ ছিল, লাবণ্যবৌদি সেই রুচিকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করতে পেরেছে - এই অনেক।

- নীলা, পেছনের যে পেইন্টিংটা টাঙানো ওটা কি সমীরদা’র ই আঁকা? সৌরাশিস জিজ্ঞাস করল।

- হ্যাঁ। এই পেইন্টিংটার গল্প আছে একটা। সমীরদা মাঝে খুব আসুস্থ হয়েছিল একবার। ডাক্তার সবসময় ঘুম পাড়িয়ে রাখতো তখন। সমীরদা সেই সময় এঁকেছিল এই ছবিটা। খুবই জটিল আর দুর্বোধ্য নাকি? আমি তো বুঝি না এসব আর্টের। নীলামে ছবিটার দামও নাকি উঠেছিল অনেক। সমীরদা ছবিটা লাবণ্যবৌদিকে গিফ্‌ট করে দিয়েছিল বলে বিক্রি করেনি তখন।

    অপর্ণা নীলাকে জিজ্ঞেস করল, হ্যাঁ রে, তোর বেশী খাতির কার সাথে আছে, বড়জন না ছোটজন?

- বড় ছোট কি রে? বল প্রথম জন দ্বিতীয় জন। ওরা তো সমবয়সী। 

- সে যাই হোক, কোন জনের সাথে তোর রিলেশন ভালো?

- দুজনেরই সাথে। সমীরদা তো অদিতিবৌদির সাথে বিয়ের আগে অনেকদিন কোর্টশিপ করেছে। তখন লাবণ্য বৌদিকে দেখেছি দু-একবার ওদের সাথে। অদিতি বৌদির সাথে তখন আমার বেশ ভালো রিলেশনই ছিল। আমরা ফোনে গল্পও করতাম। বিয়ের পর তো বললামই- আমার সাথে কিছুটা দূরত্ব তৈরী হয়। যখন অদিতিবৌদি সমীরদাকে ছেড়ে চলে যায়, তখন আমি কলকাতায় ছিলাম না।

- আর লাবণ্যবৌদির সাথে যখন সমীরদা থাকতে শুরু করে তার বছর দেড়েক বাদে আমি কলকাতায় ফিরি। তখন থেকে ওর সাথেই আমার রিলেশন তৈরী হয়েছে, বরং সমীরদাই মাঝখানে গৌন হয়ে গেছে আমার কাছে।

- তোর সাথে এখন অদিতিবৌদির কথা হয় না? 

- না বললেই চলে। কখনও সখনও হয় হয়তো। বরই যদি সাথে না থাকে - তখন ওর বোন আর কে!

- তাও, অনেক সময় দুটো মানুষের মধ্যেও তো রিলেশন হয়।

- তা হয়! তবে এক্ষেত্রে অনেক কারণ হয়তো দায়ী। অদিতিবৌদি তাই বলে কিন্তু মানুষ খারাপ নয়। এসেছে যখন, দেখবি ঠিক কথা বলতে আসবে। 

    সৌরাশিস জিজ্ঞাস করল, আচ্ছা নীলা, সমীরদার এখন বয়স কত হত?

- একান্ন!

- এই এত রকম বয়সে এমন এক গুনী মানুষের চলে যাওয়া সত্যি খুব দুঃখের।

- সেটা ঠিক কথা। আসলে সবসময় ও খুব আনমনা থকতো। হয়তো এই অন্যমনস্কতারই দাম দিল সমীরদা।

- ঠিক কখন ঘটেছিল ঘটনাটা?

- ওই তো বিকেলের দিকে। লাবণ্যবৌদিকে চা বসাতে বলে সমীরদা বেরিয়েছিল টুকটাক কিছু কেনাকাটা করতে। ওই রঙ ফঙ টাইপের ওর নিজের জিনিসই। হয়তো কোনও ছবি-টবির কথা মনে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল। একটা চারচাকা, সম্ভবতঃ ভ্যান টাইপের কোন গাড়ী এসে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। সিভিয়ার সেরিব্রাল হেমারেজ। নার্সিং হোমে নিয়ে যেতে যেতেই মারা যায়। 

- শিল্পি মানুষেরা শুনি নেশাভাঙ করে। সেরকম কিছু ফ্যাক্টর ছিল নাকি?

- না না। সমীরদা চা ছাড়া আর কিছু নেশা করত না। দিনে অনেকবার চা খেতো। 

- এদের তো কোনও পক্ষেই কোনও ছেলেপুলে নেই। তাহলে শ্রাদ্ধশান্তির কাজ কে করবে?

- লাবণ্যবৌদি বলছিল অদিতিবৌদিকে করতে বলবে। 

- এখন অদিতিবৌদি রাজী হয়েছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। দ্যাখো, চোখ খুলে রাখলেই বোঝা যাবে কে আল্টিমেটলি করবে।

- দ্যাখ-দ্যাখ নীলা, ওরা দুই বৌ মিলেই কাজটা করবে মনে হচ্ছে রে। একসঙ্গে এসে পূজোর কাছে বসলো তো!

- হলেই ভালো। তবেই একটা জীবন পূর্ণ সমাপ্তি পাবে। এই দুজন সমীরদার জীবন জুড়ে এমনভাবে আছে, কেউ একটা না থাকলেই অসম্পূর্ণ হত।

- তবে নীলা, তোর লাবণ্যবৌদিকে উঁচু মনের মহিলা বলতেই হবে। যে নিজের অধিকার ছেড়ে দেয় এভাবে, তার চিন্তা রুচিকে সম্মান জানাতেই হয়। অপর্ণা বলল।

- ঠিক কথা অপর্ণা। তবে এটাও দ্যাখ - আমাকে কেউ সুযোগ দিয়েছে বলে আমি একেবারে লুফে নেব - এটাও ঠিক কথা নয়। অদিতিবৌদিও প্রতি-সম্মান দেখিয়েছে – এটা ও নিজে ভাল বলেই সম্ভব।


- হ্যাঁ রে বন্যা, লোকজন কত ডেকেছিলি আজ? লাবণ্যকে জিজ্ঞাসা করল অদিতি।

- শ তিনেক তো হবেই।

– সবার খাওয়া দাওয়া মিটেছে?

- হ্যাঁ। মিটে গেছে। চল তুই ও কিছু মুখে দে এবার।

- না রে বন্যা, এই অবেলায় আর কিছু খাব না। তুই খেয়ে নে।

- কী যে বলিস আদু, তোকে ছেড়ে আমি খেয়ে নেব? নে চল, যা হোক অল্প কিছু মুখে দিবি। তোর তো পুরোনো গ্যাসট্রিকের প্রবলেম আছে। বেড়ে যাবে।

- আচ্ছা চল। বন্যা, যতজনকে ডেকেছিলি সবাই এসেছে?

- মোটামুটি। যারা আসতে পারবেনা জানিয়েছিল আগে থেকে - তাদেরও কয়েকজন এসেছে দেখলাম।

- আসলে আজকাল শ্রাদ্ধবাড়ীতে অনেকে যেতে চায় না তো! তাই বলছিলাম। অদিতি বললো।

- সমীর তো শ্রাদ্ধবাড়ীর নেমন্তন্নতে বেশী করে যেতো। ও বরং যারা যেতে চাইতো না তাদের গালি দিয়ে বলতো - তুই যাচ্ছিস না তো, তুই মরলেও তোর শ্রাদ্ধে কেউ যাবে না। হয়তো এজন্যই ওর কাজের দিন ঈশ্বর সবাইকে আসার সুবুদ্ধি দিয়েছেন।

- ঠিক বলেছিস। সমীর এই প্রথাকে খুব সাপোর্ট করতো। অনেকেই বলে এমন কষ্ট বা দুঃখের দিনে এভাবে নানাবিধ খাবার গেলা উচিত নয়, এটা অমানবিক বা এধরনের আরও অনেক কিছু। সমীর কিন্তু বলতো - এ ধরনের অনুষ্ঠান মৃতের পরিবারকে দুঃখ ভুলে যেতে সাহায্য করে। এই অনুষ্ঠান ঘিরে বাজার হাট, কেটারিং, মেনু ঠিক করা - এসবেই এগারো-বারো দিন হুট করে কেটে যায়।

- সত্যি সত্যি, মানুষটাকে নিয়ে শোক করার অবসরও পেলাম না আদু।

    অদিতি কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটু এটা সেটা মুখে দিয়ে ওরা এসে বসল সমীরের ঘরে। সমীর এটাকে স্টুডিও না বলে কুলুঙ্গি বলত। আগেকার দিনের মাটির বাড়ীর দেওয়ালে ছোট ছোট ত্রিকোণা বা চারকোণা গর্তের মতো একটা স্ট্রাকচার বানানো হত - ওর নাম ছিল কুলুঙ্গি। ওখানে টুকটাক জিনিসপত্র রাখা হত। সমীর বলতো সারাদিন এদিক ওদিক থেকে মনের রসদ যা সে বয়ে আনতো - এই ঘরে এসে উজাড় করে রাখতো সে ক্যানভাসে। এই ঘরে সেই মানুষটার গন্ধ যেন চারদিকে। চারদিকে তারই ছোঁয়া, তারই সৃষ্টি নানান অবয়বে - কেউ ফ্রেমে বাঁধা, কেউ বা মূর্ত, কেউ বা লুকিয়ে বসে আছে কোনদিন মাত্রা পাবে বলে। অদিতি চারদিক ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল অনেকক্ষণ। বলল, ‘শেষদিকে ষ্কাল্‌পচারের কাজই কি বেশী করত সমীর?’ 

- না না। আসলে ছবিগুলো বেশী বিক্রি হয়ে গেছে বলে তোর এমনটা মনে হচ্ছে। তাছাড়া অ্যাকাডেমিতে প্রদর্শনীর জন্য অনেক ছবি গেছিল। সেগুলো এখনও বাড়ীতে ফেরৎ আনা হয়নি।

- আগে তো ষ্কাল্পচার বেশী করতেই চাইতো না। বলতো - আমি বাবা কুঁড়ে মানুষ। এত খাটুনি পোষায় না! 

- ও একটু আরামপ্রিয় ছিল - এটা ঠিক কথা। লাবণ্য উত্তর দিল।

 অদিতি কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, ‘জানিস বন্যা, বিষয়টা খুবই দুঃখের ছিল, তবু অ্যাকসিডেন্টের পরই যে তুই আমাকে ফোন করেছিলি, আমার খুবই ভালো লেগেছে রে! ফোনটা কেন করতিস না তুই?

    উত্তরে বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল লাবণ্য।

- কী রে? বললি না কিছু?

-কী বলব আদু? তোর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস আজ আমার জিম্মায়- তুই নিশ্চই আমায় দোষারোপ করতিস! সে সইতে পারতাম না রে! 

- দোষারোপ কেন করব বন্যা? আমি তো স্বেচ্ছায় ছেড়ে গেছি। কিন্তু একটা কথা বল, তোর তো সন্দীপের সাথে বিয়ে ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল! তা থেকে বেরোলি কি করে? তোদের সাত আট বছরের প্রেম - দু তিন মাস সমীরের সান্নিধ্যে এসে ফটাস হয়ে গেল?

- সবই ভবিতব্য রে! নইলে তোদের উথাল পাতাল প্রেমেই বা ভরাডুবি হল কেন?

     একথার কোনও উত্তর দিলনা অদিতি। মুখে বলল – ‘হ্যাঁ রে বন্যা, সন্দীপ এখন কি করে?’

- ও এখন ব্যাঙ্গালোরে সেটেল্ড।

- বিয়ে করেছে বলেই তো শুনেছি।

- হ্যাঁ হ্যাঁ, যেদিন আমি ওকে না বলেছি, তার মাস তিনেকের মধ্যেই ও বিয়ে করে নিয়েছে। 

- কী সব দিন ছিল রে! তুই বোধহয় তখন ইলেভেনে পড়িস। ও তোদের ছাদের চিলেকোঠায় তোকে প্রথম চুমু খেয়েছিল - তুই আমাকে সে কথা বলবি বলে কাকীমাকে ম্যানেজ করে চলে এসেছিলি আমার বাড়ী - সেদিন সব কথা বলতে গিয়ে তোর শিহরণ, এখনো পড়ে পড়ে বন্যা! 

- জীবনের প্রথম প্রেম। আমি সত্যি সত্যি সন্দীপকে ভালোই বাসতাম রে আদু। তোর তো সেসব কোনও কথাই অজানা নয়! 

- সেটাই তো আশ্চর্যের রে! সেখান থেকে তুই এখানে কি করে মজলি?

- মজিনি রে। তুই বিশ্বাস কর, তুই যখন সমীরকে ছেড়ে চলে যাস, তখনও আমার সন্দীপের সাথে রিলেশন আছে। 

- তাহলে তুই ইন করলি কি করে?

- তুই চলে যাওয়ার পর সমীর খুবই অসুস্থ হয়ে যায়। কেমন পাগল পাগল ভাব! অসংলগ্ন কথা বলে, মাকে চিনতে পারেনা। এমন করে দিন দশ বারো যাবার পর একদিন ওর মা আমাকে ফোন করে বললেন - সমীরের অবস্থা না কি ভালো নয়, সে শুধু আমার নাম করে। তখন তিনি সমীরের বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথা বলে বোধহয় আমার নম্বর যোগাড় করে ফোন করেছিলেন। আমি এসে দেখি - এই ঘরটা একেবারে লন্ডভন্ড। যেখানে সেখানে আমার ছবি আঁকা - কোনটা ছবি, কোনটা স্কেচ, কোথাও আবার ছবির বিশেষ কিছু অংশ অনাবৃত - আমি দেখে কী বলব কী করব- কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

- আর সমীর?

- আমি ঘরে ঢুকতেই কেমন শান্ত হয়ে গেল সে। একদৃষ্টে এমন গভীর চেয়ে রইল, কী বলব? জানিনা ওকেই অন্তর ভেদ করা দৃষ্টি বলে কিনা? সেই দৃষ্টি যে কী গভীর, কী দুঃসহ, বোঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছিল, ভেতরের কোনও কিছু যেন আর লুকোনো রইল না তার কাছে। কেমন যেন হিপনোটাইজড্‌ হয়ে যাচ্ছিলাম।

- ও মুখে কিছু বলে নি?

- না। খানিকক্ষণ বাদে বলল, আমাকে একটু ছুঁতে দিবি তোকে? 

- কী করলি তুই? 

- জানিস তো ভয় লাগছিল খুব। শুনে গেছি তো, ও পাগল হয়ে গেছে। তবু এমন ভাবে বলল- না করতে পারলাম না। ও উঠে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরল আমাকে। দ্যাখ আদু, হয়তো আমি তোকে ঠিক বোঝাতে পারবো না! একটু আগেই আমার আঁকা ছবিগুলো দেখে আমার রাগই হচ্ছিল, তবু ও যখন আমাকে জড়িয়ে ধরল - আমার যেন মনে হল শিল্প যেন সৃষ্টিকর্তার সাথে মিললো এখনই। এখনই যেন শিল্পে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল। 

- পাগলের আলিঙ্গনেই মজে গেলি তুই? হাল্কা শ্লেষের যেন ছোঁয়া ছিল অদিতির গলায়!

- না রে! প্রথম তো এমব্যারাসিং লাগছিল, আফটার অল তোর বিয়ে করা বর, আমিও একটা সম্পর্কে রয়েছি।

- তারপর?

- তারপর কিছুক্ষণ বাদে আমাকে ছেড়ে দিল সমীর। বলল, ‘দ্যাখ্‌ তো, তোকে আমি নিখুঁত গড়তে পেরেছি কিনা?’ বলেই একটা স্ট্যাচু বের করে আনল ওর চেয়ারের পেছন থেকে। বুঝলাম না - ওতে আমি কোথায়? মুখটা অনেকটা ঢাকা দুহাতের পাতায়, আর কিছুটা চুলে। চোখগুলো আর ভ্রূ-টাই প্রকাশ পাচ্ছে শুধু। চেহারায় কোনও মিল ছিল কিনা আমি বুঝিনি। হয়ত শিল্পির কল্পনা। পুরো ন্যুড একটা স্ট্যাচু। আমি বললাম, ‘এসব কী করেছ সমীরদা?’ ও বলল, ‘কেন, পছন্দ হয়নি বুঝি? দ্যাখ্‌ কী সুন্দর লজ্জাবনত চোখ!’ বলতে বলতে দেখি সমীরের চোখগুলো যেন দপদপ করে জ্বলছে। আমি তাড়াতাড়ি বাইরে এসে মাসিমাকে বললাম, ‘কোনও ডাক্তার টাক্তার দেখাচ্ছেন?’

- হ্যাঁ। ওর বন্ধুরা এসে নিয়ে গিয়েছিল কোনও সাইকিয়াট্রিষ্টের কাছে। ওষুধ টসুধ দিয়েছিল।

- সমীরদাকে নিয়ম করে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন তো?

- আমি একা কি পেরে উঠি? তবুও খাওয়াই। ওষুধ খেলে তো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোয়। জেগে থাকলে ছোঁড়াছুঁড়ি করে। আজ বরং তোমার সাথে দেখলাম শান্ত ব্যবহার করল। মা, মাঝে মাঝে একটু এসো না! খালি তোমার নাম নেয়। 

- অদিতি কে ফোন করুন না! 

- ও তো চলে গেছে মা। বলে গেছে আর ওকে ফোন না করতে। ও আর আসবে না।

   অদিতি চুপ করে রইল। খানিকক্ষণ বাদে বলল, ‘তখন মাথার ঠিক ছিল না রে বন্যা। ও যে এতটা অসুস্থ, তখন বুঝিনি। যাই হোক, তারপর কী হল?’

- আমার আসা যাওয়া বাড়ল। প্রথমে অন্য দু-তিনজন ডাক্তার দেখালাম, তেমন উন্নতি হল না কিছুতেই। পরে আমাদের এক রিলেটিভকে দেখালাম। বেসিক্যালি উনি একটা সরকারী অফিসের ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু তিনি জ্যোতিষ চর্চা করেন আর প্রয়োজন মত কিছু গাছের শেকড়বাকড় প্রেসক্রাইব করেন। এটা ওঁর পার্টটাইম একটা নেশা বলতে পারিস। উনি দেখে টেখে বললেন, সমীরের এরকম অবস্থা আরও নয় মাস সাতাশ দিন থাকবে। এর মধ্যে দু একটা পাতার নাম বললেন খাওয়াবার জন্য। আর বললেন - একে সঙ্গ দাও। ওর অবচেতনে এমন কিছু বিক্রিয়া হচ্ছে - সেখান থেকে বেরোতে পারলেই ও সুস্থ হয়ে যাবে। ব্যস আমিও ধীরে ধীরে ওকে সময় দিতে শুরু করলাম।

- তুই তো ‘হারানো সুর’ কেও হার মানালি বন্যা? মনে আছে ফিল্মটা? ঠেস মারল অদিতি।

- হ্যাঁ, ফিল্মটা দেখে তুই বলেছিলি - এমনি ভাবে বিয়ে করে পাগল সামলাতে হলে তো প্রতি পুরুষ পাগলের জন্য একটা করে অবিবাহিতা মহিলা সাইকিয়াট্রিস্ট লাগবে! দ্যাখ- ভাবলে হয়তো ঠিকই আজব লাগে, তবে পরিস্থিতি কখনও কখনও এমন হয় যে সেটা আর নিয়ন্ত্রনে থাকে না।

- কিন্তু তুই তো সন্দীপকে পাগলের মতো ভালোবাসতিস বন্যা? সেই টানেও কি এই পরিস্থিতি সামলানো গেল না? 

- সেটাই তো আরো বড় দুঃখের জায়গা রে আদু। যাকে এত ভালোবাসতাম তার কাছ থাকে আঘাতটাই বেশী বাজে রে!

- ও আবার কি আঘাত দিল তোকে?

- যখন আমি প্রথমদিন সমীরের ব্যবহারের সব কথা সন্দীপকে বললাম, ও কি বলল জানিস? বলল, ‘তুমি কি ওর ন্যুড স্টাডিতে মডেল হয়ে যেতে?’ সাধারণ মানুষ তো আর্টিস্ট মানে ওই বোঝে। ও তো আর আর্ট কলেজে পড়তো না - আঁকা ওর রক্তে। আর তাছাড়া এমন নোংরা ইঙ্গিত করার আগে ভাবলো না - আমি ওর ভাবী স্ত্রী? আমার সাথে ওর এতদিনের ঘনিষ্ঠতা? আসলে জানিস আদু, মানুষ কিছু পেয়ে গেলে না তার মূল্য কমে যায়!

- ঠিক বলেছিস বন্যা। কাউকে পুরোপুরি পেয়ে গেলে বোধহয় আর নতুন করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলল অদিতি। ওরা দুজনে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। অদিতি আবার বলল, ‘এই জন্য তুই সন্দীপকে ছেড়ে দিলি?’

- তুই হলে পারতিস এক সাথে থাকতে? তুইই তো আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিলি - আমার ভাবনা-চিন্তা সব তো তোর সাথেই মেলে আদু! তুই বল। তখন সন্দীপ যদি আমাকে সাপোর্ট করত, আমি হয়ত সমীরের সাথে জড়াতে পারতাম না। কোথাও একটা বাধা তো আসতোই- অ্যাটলিষ্ট  বিশ্বাস ভঙ্গের বাধাটাই সামনে এসে দাঁড়াতো। আমি ওকে ওর এই ব্যবহারের জন্য ক্ষমা করতে পারিনি আদু। আমি ও কে ‘না’ বললাম - ‘ও’ যেন সেই প্রতীক্ষাতেই ছিল রে! ও যেন দায় মুক্ত হল। 

- ওদিকে মুক্তি মিলল বলেই তুই এদিকে এন্ট্রি নিয়ে নিলি?

- আদু তোর ক্ষোভ হওয়া স্বাভাবিক জানি, তবু ব্যাপারটা ঠিক এতটা সহজ ছিল না। ওই সময় আমি না এলে ঘন ঘন মাসিমা ফোন করতেন – ‘মা একবার আসবে? মন্টুর পাগলামি তো বেড়েই যাচ্ছে।’‘মা একবার আসবে আজ একটু ডাক্তার দেখানোর ছিল!’আমি এলেই সমীর অদ্ভুত ভাবে শান্ত হয়ে যেত। তারপর তো তোকে বললামই - আমাদের এক আত্মীয়কে দেখালাম। বলতে নেই, উনি ন’মাস বলেছিলেন, মোটামুটি এক বছর দেড় বছরের মধ্যেই সমীর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। ও যখন অসুস্থ ছিল - চাকরিতে যেতো না। সুস্থ হওয়ার পর ওটা কন্টিনিউ করারও চেষ্টা করল না। পুরোপুরি ছবি আঁকাতেই মন দিয়ে দিল। এই ফাঁকে আমার বাবা-মাও গত হলেন। দাদা-বউদির সংসার। এদিকে সমীরও দেখি আস্তে আস্তে আমার উপর ডিপেন্ডেন্ট হয়ে যাচ্ছে। একদিন মুখ ফুটে বলল, আমিও মেনে নিলাম।

- তোর তখন আমার কথা মনে হল না বন্যা? ও তো সুস্থ হয়ে গেছিল তখন। ওই বা মনে করল না কেন?

- আমি তো তোকে ফোন করেছিলাম আদু। তুই মনে করে দ্যাখ্। তুই বরং তখন আমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করিস নি। তুই বলেছিলি - অন্যের বর যখন এত মিষ্টি লাগে, তখন তুই ভোগ কর। এ ধরনের ভাষা তোর রুচির নয়। আমি জানি আদু, তোর খারাপ লাগা খুবই স্বাভাবিক। আমি দুঃখ পেয়েছিলাম, তবে খারাপ পাইনি।

- কী করব বল। আমি তো জানি তুই সমীরের সাথে লিভটুগেদার করছিস। তোর সেদিনের ফোন তাই আমার কাছে আদিখ্যেতা বলেই মনে হয়েছিল। 

- আদু, সত্যি সত্যি তখনও পর্যন্ত সমীরের সাথে আমার কোনও প্রকার রিলেশন হয়নি। ওই একটু হাত ধরাধরি - তাও ‘ও’ যখন অসুস্থ ছিল – ওই পিরিয়ডে। ও সুস্থ হয়ে কখনও আমার সাথে ওরকম রিলেশনে যায়নি যতদিন না আমরা একটা সেট্‌লম্যান্টে পৌঁছেছি। 

- তাহলে ‘ও’ ই বা আমাকে ফোন করেনি কেন? 

- হয়তো অভিমান। ও সুস্থ হবার পর একদিন আমি বলেছিলাম, সমীরদা অদিতিকে ফোন কর। তুমি তো এখন সুস্থ। ও তখন কিছু বলেনি। একটু বাদে নিজের মনেই গুনগুন করে উঠেছিল ‘থাক থাক নিজ মনে দূরেতে, আমি শুধু বাঁশরীর সুরেতে/পরশ করিব ওর প্রাণ মন।

- কেন নিজমনে দূরে ছিলাম, তুই জানিস?

- কী করে জানবো বল? সমীরও সেই অধ্যায় বিশেষ কিছু জানতো না বলেই মনে হয়। জানতো না মানে, মনে করতে পারতো না। 

- তুইতো জানিস আমাদের কোর্টশিপের গল্প। তুই কি কখনও ভাবতে পেরেছিলি - এমন মনের মিল যাদের তাদের জীবনে এমন দূরত্ব তৈরী হবে? 

- ভাবিনি তো কখনওই রে। তাই তো আশ্চর্য হই - তুই চলে গেলি কেন?

- বিয়ের বছর দুই পরেই ওর একটা অসংলগ্নতা আমি অনুভব করতে পারি। ও আমার সাথে ঘনিষ্ঠতার চরম মুহূর্তেও কেমন অন্যমনষ্ক থাকতো। বললে মানতো না। শেষ দিকে তো ও ওই সময়ে তোর নাম নিত। মাঝে মাঝে আমাকে ‘লাবু’ বলে ডাকত। বল, সহ্য হয়?

- না হওয়ারই কথা।

-আচ্ছা বন্যা, ও কি কখনো তোকে লাবু বলে ডাকতো?

- কখনোই নয়। ও আমাকে বরাবর লাবণ্য বলেই ডাকতো। ওর সাথে যখন থেকে আমি থাকতে শুরু করি, তখন আমায় চৌ বলে ডাকতো।

- চৌ? সেটা আবার কেমন নাম? লাবণ্য থেকে কত মিষ্টি নাম ছোট করে ভাবা যায়!

- আসলে তা নয়। ও আমাকে বলতো, তুই আমার পড়ে পাওয়া চৌদ্দ আনা - প পা চৌ আ। ছোট করে শুধু চৌ। 

- বাঃ বাঃ।

- তাহলে কি লাবুটা অন্য কেউ আদু? বা অন্য কোনও ফর্মে হয়তো তোরই নাম, তুই বেকার অন্য কিছু ভাবতে গেলি!

- না রে বন্যা, তা যদি হত তাহলে তোর ছবি আঁকত কেন? তুই তো নিজেই বললি!

- আসলে এরা তো শিল্পি মানুষ। মনের কোন অতলে কোন ছবি একটা সাবজেক্ট হয়ে থাকে - বলা যায় না। হয়তো আমাকে ছবির সাবজেক্ট হিসেবেই মনে ধরেছিল তার।

- আমরা যখন কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন ও কখনও তোকে আঁকতে চেয়েছিল? 

- না রে। তখন ও টুকটাক ছবি আঁকত জানতাম। এটাকে তো আর পেশা হিসেবে নেয় নি!

- কখনও কি তোকে প্রেমের প্রস্তাব বা নরম টরম কথা বলেছিল সমীর? 

- হলে কি তুই জানতিস না আদু? তোকে তো সব কথাই আমি বলতাম। 

- তা ঠিক। তবে আমার স্টেডি প্রেমিক তোকে এই ধরনের কথা বলবে, তুই চেপে যেতেও পারতিস - আমি কী ভাববো ভেবে।

- সমীর কিন্তু ছেলে হিসাবে খুবই ভালো ছিল রে আদু। আজ ঘটনা ক্রমে যাই হোক না কেন, ও মানুষ হিসেবে খুবই উঁচু মনের ছিল। এই ধরনের ছিঁচকেপনা আমি ঠিক ওর সাথে কল্পনা করতে পারিনা।

- আচ্ছা বন্যা, তোকে সমীর পছন্দ করে কিছু করেছে বা তোকে প্রশংসা করেছে কোনও দিন - এমন কিছু কি মনে পড়ে?

- হ্যাঁ। একবার ভ্যালেন্টাইনস ডে তে আমরা সবাই সিনেমা গেলাম, তোর মনে আছে? সেদিন আমি একটা কচি কলাপাতা রঙের শাড়ী পরে এসেছিলাম, সঙ্গে একটা হলুদ ব্লাউজ। চুলটা উঁচু করে খোঁপা করেছিলাম। সমীর আমাকে দেখে বলল, ‘দ্যাখ - তোর মাঝে আজ বন্যার অনুষঙ্গ। চারদিকে সবুজ। শুধু  চুলটা খোঁপা থেকে মুক্ত করে দে। সঙ্গে কাজল পেন্সিল যদি ক্যারি করিস তবে বড় করে কাজল আঁক, চোখের তলাটায় বিশেষ করে। দেখবি - বন্যায় বাঁধ ভেঙ্গে যাবে।

- বন্যা তাহলে কি ভাববো শেষদিকে, আমার প্রতি ও আসক্তি হারিয়ে ফেলেছিল?

- এভাবে কেন ভাবছিস আদু?

- আমি সিম্পলি মেনে নিতে পারি না - ও অন্য নারীকে কল্পনা করছে, ওকে অন্য রূপে ফুটিয়ে তুলছে।

- আদু, ও একজন শিল্পি। নারী শরীর আঁকাটাই ওর চেতন অবচেতনের অংশ বিশেষ। এইভাবে ওর বিচার করা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না।

- দ্যাখ বন্যা, অন্যসময়ে সে আঁকছে অন্য নারীকে - আঁকুক না! তাকে তো আমি বাধা দিতে যাইনা। আমার সাথে একান্ত মুহূর্তে যদি সে অন্য নারীকে কল্পনা করে - তবে কি মাথার ঠিক থাকে?

- সমীর তখন অসুস্থ ছিল আদু। পাগল রাস্তায় যখন উলঙ্গ হয়ে ঘোরে, ও কি ভাবে তার আব্রু নষ্ট হচ্ছে? ও যখন অসংলগ্ন কথা বলে, গালি দেয় - তখন কোনও আগল এসে ওকে বাধা দেয় না। অথচ আমরা যারা স্বাভাবিক মানুষ, তাদের সংযম এসে পথ আটকায়; কোনটা কখন বলা উচিৎ, কোনটা নয় - এ কথা আমাদের মন সবসময় নিয়ন্ত্রন করে থাকে। সমীরের তখন সেটা ছিল না। তাই অবচেতনের কথা হয়তো বলে ফেলতো।

- তাহলে তুই তার অবচেতনে ছিলি এটা তো ঠিক?

- অবচেতনে থাকাও কি অপরাধ আদু? মনকে কি আমরা এভাবে বাঁধতে পারি? হয়তো তুই পারিস, কিন্তু সবাই এটা পারবে এমনটা দাবী করা ঠিক নয়। আর তুই এজন্যই ছেড়ে চলে গেলি?

- কী করব বন্যা! আমার তখন সবসময় মনে হত - ও লম্পট, দুশ্চরিত্র। ও নিশ্চই তলায় তলায় তোর সাথে সম্পর্ক রাখে। তারপর সন্দীপও বিয়ে করে নিল। আমিও দুয়ে দুয়ে চার করে নিলাম। সত্যি রে বন্যা, বড় ভুল করে ফেলেছি জীবনে।

- তখন যদি আজকের মতো আমার সাথে কথা বলে নিতিস! তাহলে আজকের দিন হয়তো দেখতে হত না।

- একথা বলছিস কেন?

- আমি যবে থেকে ওর সাথে থাকা শুরু করি - তখন সমীর ভীষণ অন্যমনষ্ক থাকতো। ও এমনিতে চুপচাপ, শান্ত-শিষ্ট টাইপ, কিন্তু তখন মনে হত ও যেন ভীষণ ভাবে ক্লান্ত, জীবনের বোঝায় ভীষণ রকম পর্যুদস্ত। ও বোধহয় তোর চলে যাওয়া মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। হয়তো তোকে মিস্‌ করতো!

- বন্যা, ও কখনও আমার কথা বলত না?

    লাবণ্য দেখল অসীম কৌতুহল নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে অদিতি। ও বানিয়ে কিছু বলতে পারলো না। সে জানে অদিতি কী শুনতে চায়। ও আস্তে করে ওর ডান হাতটা দিয়ে অদিতির বাঁ হাতটা চেপে ধরল। ও দেখল বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অদিতি। কিছু পরে বলল, ‘মিস করত না হাতি! আমার মতো দেখতে কোনও ছবি এঁকেছে কোনও দিন?’ লাবণ্য ভেবে পেল না, লাবণ্যের আজ কী হয়েছে? এইভাবে আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মতো ভাবছে কেন সে? লাবণ্য কি উত্তর দেবে এই কথার? বলল - শিল্পিদের কল্পনায় কি শুধু দেখার সাদৃশ্যটাই মিল? হয়তো তোর সব বিপরীত গুণ দিয়েই সে তোর অবয়ব সাজালো - যেমনটা তার শিল্পিসত্তা চায়!

- তাই যদি হতো, তবে তোর সাথে শোওয়ার সময় ওর মনে হল না আমার কথা?

- সবাই কি এক আদু? নাকি সবাই তোর মতো করে ভাববে? শরীরটা একটা অভ্যেস। 

- আমার কী শরীর নেই বন্যা? নাকি আমি মেয়ে বলে আমাদের ওসব থাকতে নেই?

- তুই তবে কেন বিয়ে করলি না আদু? 

- ঘেন্না ধরে গেছিল পুরুষ জাতটার প্রতি! যে পুরুষ এতদিনের সম্পর্কের পরেও অন্য নারীতে সুখ খোঁজে - সেরকম আর কারোর হাতে পড়ার ইচ্ছে ছিল না আমার।

- দ্যাখ আদু - সমীরের তো সে সমস্যা ছিল না। নারীর প্রতি তো তার ঘেন্না ধরেনি - বরং সে তার অসুস্থতার সময়ে তোর চলে যাওয়া নিয়ে অভিমান করেছে। সুতরাং শরীর বা এই সম্পর্ককে দোষ দেওয়ার দায় তার নেই। সবাইকে নিজের আঙ্গিকে বিচার করা ঠিক হচ্ছে না আদু। তোর সেই মুহূর্তে মানসিক অবস্থায় হয়তো তুই ঠিক - কিন্তু সময় তার বিচার অন্যভাবে করেছে।

- বন্যা, তুই আজকাল অনেক গুছিয়ে কথা বলিস ভাই। আগে অনেক চুপচাপ থাকতিস্‌।

- জীবনই শিখিয়েছে রে!

- সত্যি। তুইই ছিলি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। জীবনও দ্যাখ আমাদের কেমন মিলিয়ে দিল? দুজনের জীবনই একটি মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তন করল এতদিন।

- দ্যাখ আদু, তোর মনে পড়ে- একদিন তুই আর আমি বাবুঘাট গঙ্গার পাড়ে বসেছিলাম। তুই বলেছিলি আমাদের দুইজনের বর যদি এক হতো, তবে আমরা বেশ একসাথেই থাকতে পারতাম - ছাড়াছাড়ি হত না। নেহাৎ মজা করে বলা, অথচ ঘটনাটা একই ঘটল। শুধু একসাথে থাকা হল না। তোর প্রথম অর্ধ গেল, অমার মাঝের টা। শেষ অর্ধে শুন্যতা ছাড়া আর কিছুই রইল না।

- বন্যা - তোর আর সমীরের কি বিয়ে হয়েছে?

- না।

- সে কীরে? রেজিস্ট্রি ফেজিস্ট্রি কিছুই হয় নি?

- তোর সাথে কি সমীরের ডিভোর্স হয়েছে যে আমার সাথে রেজিস্ট্রি হবে?

- মন্দির ফন্দিরেও কিছু করিস নি?

- না।

- কেন? তুই তো সমীরের কিছুই পাবি না তাহলে?

- মানুষটা নেই, ওর জিনিস নিয়ে কি হবে? 

- দূর বোকা। তোর চলবে কি করে? তুই তো চাকরী বাকরীর চেষ্টাও করলি না কোনও দিন।

- কবে আর করব? জীবন শুরুর মুখেই তো বিপর্যয়। পরে সমীরকে নিয়েই কেটে গেল। 

- তা ঠিক। শোন না সমীর কি উইল টুইল কিছু করেছে?

- না।

- বন্যা, তবে তো কোনও ভয় নেই। ওর অবর্তমানে এই বাড়ী তো আমিই পাবো আইনত!। আমাদের কারোরই তো ছেলে পেলে নেই যে ভবিষ্যতে এই নিয়ে ঝামেলা করবে। আমি বরং এটা তোর নামে দানপত্র করে দেব। তোর অবর্তমানে কোনও মিশন টিশনকে ভালো কোনও কাজের জন্য দান করে দিলে হবে।

- কী দরকার আদু – এসবে? 

- বা রে! সমীরের বাড়ী – অথচ তোর মাথায় আচ্ছাদন থাকবে না? আচ্ছা ওর ছবি টবি তো শুনেছি ভালোই বিক্রি হত! তোর নামে টাকা পয়সা কিছু রেখে গেছে তো?

- জানিনা আদু। বাড়ীতে যা টাকা পয়সা ছিল- এই শ্রাদ্ধ-শান্তিতে পুরোটাই চলে গেছে। ব্যাঙ্কে কী আছে না আছে আমি জানি না।

- তুই কী রে বন্যা? কখনো ভাবিস নি তোর কী হবে? সমীরও তোর নামে কিছু রেখে যাবে, মনে তো হয় না। চল দেখি ব্যাঙ্কের বই টই বের কর।

- থাক না আদু। ও চলে যাবে ঠিক!

- কী করে যাবে? লোকের বাড়ী ঝিগিরি করবি? নাকি তোকে এ বয়সে কেউ চাকরি দেবে?

- ঠিক আছে। তুই আরেক দিন আয়- তখন দেখব না হয় খুঁজে। আজ আর ইচ্ছে করছে না।

- তুই চিন্তা করিস না বন্যা। যদি তোর নামে কিছু নাও করে গিয়ে থাকে - ওর টাকা পয়সা তো আমি তুলতে পারব। তোর নামে এম.আই.এস করে দেব। 

- না আদু। এগুলো তোরই প্রাপ্য। তুই আমাকে দিস না - আমি নিতে পারবো না।

- যে আমার প্রাপ্য ছিল - তাকেই যখন ধরতে পারিনি - তার সম্পদকে আমার প্রাপ্য বলে আর গ্লানি বাড়াস না বন্যা। আমার নিজেরই বা আর কত দরকার? চাকরী করি। নিজের ফ্ল্যাট আছে। সবচেয়ে বড় কথা - সমীর উপর থেকে কী ভাববে? তার টাকা পয়সা আমি নিয়ে নিয়েছি - আর অভাবে তোর অবস্থা দফারফা? বিষন্ন ভাবে হাসল অদিতি। একটু পরে বলল- সপত্নী মানে জানিস? সপত্নী মানে শত্রু। তুই আমার বন্ধু ছিলি, সতীন হলি। তাই বলে কি তুই আমার শত্রু হয়ে গেলি? আমরা তো দুই বোন রে। বলেই অদিতি এসে জড়িয়ে ধরল লাবণ্যকে। হঠাৎ ওর চোখ গেল লাবণ্যর ঠিক পেছনে একটা র‍্যাক এর দিকে। এতক্ষণ ওটা সে দেখতে পায় নি। র‍্যাক এর উপর একটা ফটো ফ্রেমে অদিতি আর সমীরের বিয়ের পরে পরে তোলা একটা সুখী দম্পতি মার্কা ছবি, আর তার ঠিক পাশের ফ্রেমে অদিতির অল্প বয়সের আর একটি শাড়ী পড়া ছবি সুন্দর করে সাজানো। ও লাবণ্যকে ছেড়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ফটো দুটোর দিকে। হাত দিয়ে দেখালো - এক ফোঁটাও ধুলো নেই। অতি যত্নের ছাপ আছে ওর চারপাশে। অথচ সারা তাক জুড়ে লাবণ্য নিজের একটা ছবিও রাখেনি কোথাও। হঠাৎ করে অদিতির তার বিয়ের দিনের কথা মনে পড়ে গেল। দুজন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ এসেছিলেন বিয়ের পৌরহিত্য করতে। তাঁদের গলায় যেন হঠাৎ করে বেজে উঠল- ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সৈন্ধব ওঁ মধু ওঁ মধু ওঁ মধু। সমীর যেন একগুচ্ছ অর্কিডের মধ্য থেকে নিজেই একটা অর্কিড হয়ে হাসছে ওর আর লাবণ্যর দিকে চেয়ে- সেই হাসিটাও বড় মধুময়।

Post a Comment

0 Comments