জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /লাশটের বগী পর্ব ২

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
লাশটের বগী পর্ব ২

সামনে কোথাও একটা দুর্ঘটনা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, এখনো পুরো খবর আসে নি। এনকোয়ারীর সামনে বিরাট ভিড়, হই চই, কাউন্টারের লোকটিও বিব্রত কিন্তু কিছুই সে বলতে পারছে না। সে একটা ভিজে রুমাল মাথায় দিয়ে বসে আছে, আর চারদিকে লোক মাছির মত ঘিরে ধরেছে। এখনো কোন খবর নেই। হেল্পলাইন নাকি চালু হবে, তখন জানা যাবে।
সুকুমারের মাথায় হাত। দুর্ঘটনা হতে হল আজকেই! আর একটা লাইনে দুর্ঘটনা তো পাশের লাইনটাকে আটকানো কেন? ছেড়ে দে। সুকুমার আইপ্যাডটা নিয়ে বসে পড়লেন বেঞ্চিতে। এটাই তাঁর লেখার খাতা। শমিত দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে তার ঐ বাজারের ব্যাগ। 
-আরে বোসো। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। কখন যে গাড়ী ছাড়বে। আমাকে তো যেতেই হবে। আমি একটা পুরস্কার পাবো জানোতো? ওনারা বসে থাকবেন, সভায় সবাই অপেক্ষা করবে, ইস, না যেতে পারলে আমার নাম খারাপ হবে, অহংকারী অভদ্র বলে। 
বলতে বলতে খেয়াল হয়, শমিতকেও তো যেতেই হবে। ওর পরীক্ষা তো আজই হবে, ট্রেন আসে নি বলে তো কর্তৃপক্ষ আর একদিন ডেট ফেলবেন না। সুকুমার আড় চোখে ওর দিকে তাকান। ওর মুখে চোখে ঝাঁক বেঁধে আছে স্বপ্ন আর আশঙ্কা। 
তাকাতে গিয়ে চোখাচোখি হয়ে গেল। সে গুটিসুটি হয়ে পাশে বসে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে আইপ্যাডটার দিকে।
গরীব মানুষ, খুব ইচ্ছে ভালো জিনিষপত্র কেনার। আইপ্যাড দেখে নিশ্চয়ই লোভ হচ্ছে। সুকুমার লেখক, তিনি সব বোঝেন। মনে মনে মৃদু হাসলেন আর আশীর্বাদ করলেন, ভালো করে পড়াশোনা করো, তোমারও হবে। মুখে কিছু বললেন না।  একটা লেখা শুরু করেছিলেন, তার প্লটটা এই ফাঁকে গুছিয়ে নেওয়ায় মন দিলেন। ট্রেন আসতে অন্তত এক ঘণ্টা লাগবে, সবাই বলতে বলতে যাচ্ছে। 
-আপনি খাতায় লেখেন না? শমিতের হঠাৎ প্রশ্ন। ওর আবার আমার লেখার দিকে নজর কেন? প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বললেন,
‘অনেক লিখি তো, মুছতে হয়, এডিট করতে হয়, খাতায় ঠিক হয় না। তারপর আজকাল তো অনলাইনেই সাবমিট করতে হয়, হাতে লেখা পান্ডুলিপির দিন চলে গেছে।‘
ঘাড় নেড়ে মেনে নেয় শমিত, তার পর আবার বলে, 
‘এখন কি লিখছেন?’ 
এত বেশি কৌতূহল পছন্দ নয় সুকুমারের। এই একরত্তি ছোঁড়া, সে অংক কষতে পারে হয়ত, কিন্তু মানুষের জীবনের জটিল অঙ্ক সে বুঝবে? তাঁর কথায় হাল্কা বিরক্তি ফুটে ওঠে,
‘এখনো ঠিক করি নি, কখন যে কি মনে আসে বলা যায়। লেখাটা একটা অন্যরকম কাজ। তোমার স্টাডি করার মত না, যে ফর্মুলা ফেললাম, সমাধান হয়ে গেল। যাই হোক,  তুমি একটা কাজ করো তো একটু, ঐ যে টিকিট চেকার ঘুরছে, ওনার কাছে খোঁজ নিয়ে এস কি ব্যাপার। ব্যাগটা রেখে যাও, কে আবার সীট দখল করে নেবে‘ উৎসাহ পেয়ে শমিত দৌড়ল, খানিকক্ষণ বাদে খুব উত্তেজিত হয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে পুরো রিপোর্ট করে গেল। হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট। থিন এরারুট, রাস্তায় খিদে পেলে খাবে হয়ত। 
 
‘সাঙ্ঘাতিক কান্ড কাকু। এখান থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে রাঙাপুরে গিরিশৃন্গ এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ পিছন থেকে   একটা মালগাড়ি এসে ধাক্কা দিয়েছে। 
মালগাড়িটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। গিরিশৃঙ্গ ডিরেল্ড। একই লাইনে কি করে ট্রেন এসে যায়, আশ্চর্য। তবে ভাল খবর হচ্ছে, একটা লাইন ক্লিয়ার করে দিয়েছে, আমাদের চলে গাড়ী আসবে এক ঘণ্টার মধ্যে।’
রেল মন্ত্রীকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিলেন সুকুমার। ঘটে বুদ্ধি আছে। শিক্ষিত মানুষ, দেহাতী ভূত না। বোঝেন কোথায় কি সার্ভিস দরকার।  দরকারি ট্রেন কলকাতায় যাবে, সেটাকে আটকে রাখা ঠিক না, কত জরুরী কাজ থাকে লোকের।  দুর্ঘটনা না হলেই ভালো হতো, ঐ কিসব কবচকুন্ডল পরাবার কথা হয়েছিল সব রেলগাড়িকে, সেটা আজো হয় নি। যাই হোক, সুকুমারের ট্রেন চালু হয়ে গেছে, তাতেই উনি খুশি। পকেটে পারফিউমে ভেজানো রুমাল ছিল, রিয়ার দেওয়া, সেটা দিয়ে মুখটা মুছলেন, একটা বিদেশী সুগন্ধ ঘিরে নিলো তাকে। একটা তালমিছরি বারকরে মুখে দিয়ে শমিতকে আরো কিছু খবরের জন্য খোঁচালেন,
‘লোকটোক মারাটারা গেছে শুনলে ? কটা কামরা ড্যামেজ?’ 
‘তিন জন নাকি ডেড। আরো বাড়তে পারে। ঐ লাশটের  বগিটা যা হয়, ড্যামেজ হয়েছে, যেমন হয়। শিগগিরি নাকি টিভিতে দেখাবে, আপনার আইপ্যাডে ইউটিউব আছে? ‘ শমিত খুব উত্তেজিত। এরকম একটা ঘটনা প্রায় তার কাছাকাছি হয়েছে, ভাবলেই তার খুব অদ্ভুত লাগছে। 
সুকুমার হাসলেন। এই ছেলেটি অনেক খবর রাখে, আজকাল ইউটিউব গুগল এসব ঘরে ঘরে। ইস্ত্রি করা জেরক্স করার মত সবাই গুগল করে যখন তখন। এক্সিডেন্টের কথা শুনে অবশ্য তিনি সহজে বিচলিত হন না। প্রতিটি ঘটনা বা দুর্ঘটনা তাঁর সাহিত্যের রসদ, কাঁচামাল। অনেক লোক মারা যাবার কথা শুনে তাঁর একটা লাইন মনে এল, মৃদু স্বরে আবৃত্তি করলেন,
‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়’। ‘আমার’ কথাটাকে একটু জোর দিয়ে। 
শমিত বুঝতে পারল না, অবাক হয়ে তাকালো, কিছু বলল না। চশমাটা ওর একটু নেমে আসে মাঝে মাঝে, সেটাকে তুললো একটু, ঝাঁকড়া চুল গুলো হাত দিয়ে একটু সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমাদের ট্রেনে আবার না হলেই হল। হলেও আমি ঠিক বেঁচে যাবো। এই লকেটটা দেখছেন না, বাবা এনেছিল সাউথ ইন্ডিয়া থেকে। এটা গলায় থাকলে কিছু হবে না বলুন কাকু! ‘
শমিত একবার গলায় হাত দিয়ে চেক করে নিল লকেটটা আছে কিনা। বার করে একবার মাথায় ঠেকালো। সুকুমার মনে মনে বালকের অবিচলিত বিশ্বাস দেখে একটু হাসলেন। পদার্থবিজ্ঞান টিজ্ঞান যাই পড়ো বাপু, বিশ্বাসটি হচ্ছে আসল জিনিষ। নৌকোর মত, জীবন নদীতে ভেসে যাওয়ার  অবলম্বন। 
সুকুমার দুর্ঘটনা নিয়ে চটপট কিছু নোট নিয়ে নিল, আর শমিত ওর ব্যাগ থেকে বার করে কিছু নোটস মন দিয়ে দেখতে থাকল। চারদিকে হই চই গণ্ডগোল, কুলিরা আবার রেডি হয়ে ট্রিপ খাটতে যাচ্ছে, ট্রেন আসবে, এলেই ওদের রোজকার রোজগার। আটটা ট্রেনে আটবার। চাকফিওলা চা রেডি করতে শুরু করল, হযবরল লেখা একটা অদ্ভুত আলখাল্লা পরে একজন সাজিয়ে নিতে লাগল তার হাজার রকম শিশুদের খেলনা, নানারকম গ্যাজেট, ঝুমঝুমি। এখনো কেউ এসব কেনে? সুকুমার ভাবলেন, আর কবে? আর কবে আমরা ভদ্র দেশ হব?

🍂

ঝম ঝম শব্দ করে আধ ঘণ্টা পরে এসে গেল কলকাতা গামী ট্রেন। এসেই একটা জোরসে হুইসিল দিল। এ লাইনে এখন সবই ই এম ইউ, হুইসল পুরনো রেলের মত না, যেন একটা বিশাল টেরোডাক্টিল ট্যাঁ করে ডাক দিল, ওড়বার আগে।
তোর কামরা কোনটা? সুকুমার জিজ্ঞেস করাতে শমিত একগাল হেসে বলল, হ্যাঁ কাকু, ঐ তো লাশটের বগীটা আমার। 
তো যা যা দৌড়ো, আমি দেখে নিচ্ছি কোথায় উঠিস। 
শমিতের জেনারাল কামরা, একদম পিছনের বগিটা, ও হাতে ব্যাগটা প্রায় বুকের কাছে আঁকড়ে নিয়ে সেদিকে দৌড়ল। যে আগে যাবে সে জায়গা পাবে। দরজায় ঠেলাঠেলি বেশ, বেশ কিছু লোক পোঁটলা নিয়ে এক সঙ্গে ঢোকার চেষ্টা করছে। শমিত শান্ত হলেও লড়াই করা ওর রক্তে। হাত পা কনুইএর ব্যবহার ও জানে। যা হোক করে দিব্যি ও ঢুকে গিয়ে জানলা দিয়ে হাত নাড়ল, সুকুমারও হাত নাড়লেন। সুকুমারের রিজারভ করা সীট, তাড়া নেই অত। শমিতকে গাড়ীতে উঠতে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজের কম্পারটমেন্টের দিকে পা বাড়ালেন। এসি কামরা গাড়ির মাঝামাঝি, বাইরে প্রচন্ড গরম। এসিতে ঢুকে একটু জুড়োল শরীরটা। কামরাটা বেশ ফাঁকা। দুজন ব্যাবসায়ী নিজেদের মধ্যে হিন্দীতে আলোচনায় ব্যস্ত। বোধহয় চায়ের এক্সপোর্টের ব্যবসা, কয়েকবার অকশানের কথা শোনা গেল। সুকুমার ঝোলাটা একবার চেক করে নিয়ে হেলান দিলেন জানলায় একটা হাত দিয়ে। শমিত একবার কথায় কথায় বলেছিল যদি আমাদের গাড়ীতেও কিছু হয়? এরকম হয় না, একই লাইনে একই দিনে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা মিলিয়নে একবার। আর যদিও হয় তার রেশ ট্রেনের মাঝবরাবর এসে পৌঁছবেই না। যা হবে গাড়ীর পিছনে। লাশটের বগী। শমিত যেখানে বসে আছে। তার সঙ্গে আছে আরো অনেক গরীব চাষা ভূষোর দল। সুকুমারের একটা নিঃশ্বাস পড়ল, সমাজে এমনই হয়। অত ভাবলে চলে না। এক হ্যাঁচকা দিয়ে  গাড়ী চলতে শুরু করল, ঘুম এসে গেল কিছুক্ষণের মধ্যে।
 
ঘুম এলেই স্বপ্নরা আসে। স্বপ্ন দেখলেন বিশাল প্রান্তরের মাঝখানে কোথায় যেন দাঁড়িয়ে গেছে তাঁদের গাড়ি। সামনে সিগন্যাল লাল। চারদিকে মাঠে শুধু ধু ধু ধুলো উড়ছে, কোথাও কোন কৃষির চিহ্নমাত্র নেই। লাইনের পাশ দিয়ে চলে গেছে পরের পর নয়ান জুলি, শুকনো চোখের কোলের মত এক ফোঁটা জল কোথাও নেই। কি করে তিনি এই তেপান্তরের মাঠে এসে পড়লেন সেটা মাথায় ঢুকছে না। বাংলার কোন মাঠ তো এমন নয়, সব ঋতুতেই তা শ্যামল। দেখা যায় সবুজ দিগন্ত বিস্তৃত শস্যখেত, তার মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম। কোথায় তিনি?

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments