দূর দেশের লোকগল্প— ২২৬
চিত্র- অর্ণব মিত্র
ডেনমার্ক (ইউরোপ)
বোকার বেহদ্দ থেকে রাজার জামাই
চিন্ময় দাশ।
এক গ্রামে থাকত এক বুড়ি আর তার যুবক ছেলে। বয়সে যুবক হলে কী হবে? বুদ্ধিশুদ্ধি বলে কিছু নাই তার মাথায়। যাকে বলে, একেবারে বোকার বেহদ্দ! আর সেজন্যই বুড়ি ঘরের বাইরে বেরোতেই দেয়নি ছেলেকে।
একদিন মাকে ধরে পড়ল ছেলে—মা, খানিকটা মাখন দাও আমাকে।
মা বলল—কেন, বাছা? মাখন নিয়ে কী করবি তুই?
--বাজারে যাব। কিছু পয়সা হবে, মাখন বিক্রি করলে।
বুড়ি তো পড়ল আকাশ থেকে। এ ছেলে যাবে বাজারে? কোন দিন গাঁয়ের বাইরে যায়নি জীবনে। হাট-বাজার কাকে বলে, সেখানে লোকজন কেমন, কীভাবে দোকানি সেজে বসতে হবে—কিছুই তো জানে না এ। আর, আজ সে কি না একেবারে বাজারে যাবে মাখন বেচতে?
বুড়ি কিছুতেই রাজি নয়। কিন্তু ছেলে ঝোলাঝুলি করেই চলেছে। নাছোড়বান্দাকে নিয়ে কতক্ষণ আর পারা যায়? এক সময় রাজি হতেই হোল। খানিকটা মাখন পাতায় মুড়ে নিয়ে, রওণা হয়ে গেল ছেলেটা।
বাজারে যাবে বলে তো বেরিয়েছে। কিন্তু বাজারটা যে ঠিক কী জিনিষ, সেটাই জানা নাই ছেলের। কতক্ষণ হাঁটবার পর, রাস্তার ধারে একটা পাথর চোখে পড়ল। ছেলে ভাবল, এটাই নিশ্চয় বাজার।
মাখন কিনবে কি না, পাথরকে জানতে চাইল সে। পাথর কি আর উত্তর দেবে? একটু থেমে ছেলে বলল—সত্যি বলছি তোমাকে। আমার মাখন খুব ভালো। ঠকবে না তুমি। চাইলে, তুমি পরখ করে দেখতে পারো।
জবাবের অপেক্ষা করল না। এক খাবলা মাখন রেখে দিল পাথরের উপর। রোদ লেগে তেতেই ছিল পাথর। মাখন গলে গেল দেখতে না দেখতে। ছেলেটা ভাবল, নির্ঘাত মাখন পছন্দ হয়েছে খদ্দেরের। সে বলল—বুঝতে পেরেছি, মাখন পছন্দ হয়েছে তোমার। এক কাজ করো, পুরোটাই রেখে দাও তুমি। আমি নাহয় কাল এসে দামটা নিয়ে যাব।
পুরো মাখন পাথরে রেখে দিয়ে বাড়ি ফিরে এল ছেলে।
মা দেখে বলল—খালি হাতে ফিরেছিস দেখছি। কে কিনল তোর মাখন? কত টাকা পেয়েছিস?
ছেলে বলল—বাজারকে বিক্রি করেছি, মা। তবে, ধারে। কাল দাম পেয়ে যাব।
--সে কী কথা, ধারে? কিন্তু বাজারকে বিক্রি করেছিস, মানে কী এ কথার? খদ্দেরটা কে?
--কে আবার? তুমি যেমনটা বলেছিলে, বাজারকেই বিক্রি করেছি আমি।
-- হয়েছে, হয়েছে। আর কিছু বলতে হবে না তোকে। যা বুঝবার বুঝে গেছি আমি। যাকগে, মাখনটা জলে গেছে, কী আর করা যাবে? আসলে, তোকে মাখন দেওয়াটাই ভুল হয়েছে আমার।
পরদিন ছেলে বলল—আমি বাজার যাব। কালকের দামটা আদায় করে আনতে হবে।
মা বলল—যাওয়া আসাটাই সার হবে। ঐ দাম আর পাওয়া যাবে না।
🍂
--পাওয়া যাবে না, মানে? মাখন নিয়েছে, দাম তাকে দিতেই হবে। গটগট করে বাজার চলে গেল ছেলে।
হাঁটতে হাঁটতে সেই পাথরের সামনে গিয়ে হাজির—আমি এসে গেছি। কাল মাখন নিয়েছিলে। দাম দাও আমার।
পাথর কি আর এ কথা শুনল, না উত্তর দেবে? জবাব না পেয়ে, মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে ছেলের। বলল—আচ্ছা ধূর্ত লোকতো তুমি। মাখন নিয়েছ, দাম তো দিচ্ছই না। এমনকি রাটিও কাড়ছ না মুখে। এই কথাটা শুনে রাখো। আমার সাথে চালাকি করে পার পাবে না তুমি। একটা হেস্তনেস্ত করে, তবেই বাড়ি ফিরব। দাম না পেলে, তোমাকেও উলটে ফেলে দিয়ে যাব আমি।
বলেই পাথরটা ধরে টানতে শুরু করল ছেলে। কিন্তু পাথর ওঠানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু ছেলেও হার মানবার লোক নয়। অনেক ক্ষণ টান-হেঁচড়া করে, এক সময় তুলে উলটে ফেলে দিল পাথরটাকে।
অবাক হয়ে দেখে, একটা ঢাকনা দেওয়া কলসি ছিল পাথরটার তলায়। কলসিটা মোহরে ভরা। আর তাকে পায় কে? বাড়ি ফিরে চলল পা চালিয়ে।
মা তো দেখে অবাক। এত টাকা পেল কী করে? বলল—কোথায় পেলি তুই এতো টাকা? ঐটুকু মাখনের এত দাম কে দিল তোকে? খুলে বল তুই আমাকে। ব্যাপারটা কী?
--ব্যাপার আবার কী? কাল মাখন দিয়ে এসেছি। আজ গিয়ে দাম চাইলাম। ছেলেটা বলছে মাকে—টাকা ছিল তার। কিন্তু ভারি বজ্জাত। দাম দেওয়া তো দূরের কথা। একটা কথাও বলছে না মুখে! কিন্তু আমি ছাড়ব কেন? দিলাম উলটে। তবেই না দামটা পেলাম।
মা তো আকাশ থেকে পড়ল—উলটে দিলি মানে? বাজারকে উলটে দিলি, এ কথার মাথামুণ্ডু কিছুই তো আমার মাথায় ঢুকছে না। যাকগে, যাই করিস, দামটা খুব ভালোই আদায় করেছিস।
কিছুদিন কেটে গেছে তার পর। একদিন ভেড়া জবাই করা হয়েছে বাড়িতে। একটা ঝুড়িতে কিছু মাংস নিয়ে, আবার বাজারে চলল ছেলেটা।
সেদিন সত্যি সত্যি শহরে এসে হাজির হয়েছে ছেলে। মাথার ঝুড়িতে মাংস। তার গন্ধ পেয়ে, এক দল কুকুর পিছু নিয়েছে তার। কুকুরের যা স্বভাব। ঘেউ ঘেউ করতেও শুরু করেছে। ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল—কী গো বন্ধুরা! তোমরা কী মাংস কিনতে চাও?
কুকুর আর কী জবাব দেবে? একই রকম-- ঘেউ ঘেউ।
ছেলেটার মুখে হাসি—খুব ভালো কথা। তাহলে, আগে একবার চেখে দেখো। আমার মাংস সুস্বাদু কি না। বলেই, কয়েক টুকরো মাংস ছুঁড়ে দিল। ভারি মজা কুকুরদের। চেটেপুটে সাফ।
তা দেখে ছেলেটারও ভারি আনন্দ। নিশ্চয় মাংস পছন্দ হয়েছে কুকুরদের। বলল—তাহলে, বন্ধুরা! পুরো মাংসটাই তোমরা নিয়ে নাও। আমাকেও আর ঘোরাঘুরি করতে হয় না তাহলে। কিছু ভাবনা নাই, মাংসের দাম আজ দিতে হবে না। সে আমি কাল এসে নিয়ে যাব।
পুরো মাংসটা কুকুরদের সামনে ঢেলে দিয়ে, বাড়ি ফিরে গেল ছেলে।
পরদিন শহরে এসে হাজির হয়েছে সে। কুকুরগুলোও তাকে দেখে হাজির। তাদের লম্বা একটা কুর্ণিশ ঠুকে দিল ছেলে—ভালো আছো নিশ্চয় বন্ধুরা? আমার মাংসের দামটা দিয়ে দাও। বাড়ি যাই।
এদিকে আজ মাংস না পেয়ে, পুরো দলটা লেজ নেড়ে নেড়ে ঘুরছে পিছন পিছন। দাম দেওয়ার নাম নাই দেখে, ছেলেটার মাথা গরম—তবেরে, হতভাগার দল! চেটেপুটে পুরো মাংসটা খেলি আমার সামনে। আর দাম দেওয়ার বেলায় মুখে রা-টি নাই। ঠিক আছে। আমার সাথে চালাকি? উচিত শিক্ষা দেব আজ তোদের।
কুকুরের পালটার ভিতরে একটা বাচ্চাও ছিল। গলায় সুন্দর একটা বেল্ট বাঁধা। দেখতে বেশ নাদুস-নুদুস। আর গায়ের কী রঙ তার! ধবধবে সাদা। শিমুলের তুলোর মত। আকাশের সাদা মেঘের মত।
গলায় বেল্ট থাকলেও, এতটুকু বাচ্চা নিশ্চয় দলের মুরুব্বি নয়। তবে এর বাপ নিশ্চয় মুরুব্বিই হবে। টুক করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল ছেলেটা-- চললাম আমি রাজার বাড়ি। রাজাই বিচার করবে তোমাদের এই ধূর্তামির। বলে, রাজবাড়ির দিকে চলল ছেলেটা।
সে দেশের রাজার একটি মাত্র মেয়ে। দেখতেও ভারি সুন্দরী। কিন্তু কী যে তার হয়েছে? সব সময় মুখময় বিষাদ। হাসি নাই মুখে। কথাও বলে না কারও সাথে। সারাটা সময় মন মরা হয়ে থাকে।
বিয়ের বয়সও হয়েছে মেয়ের। কিন্তুএমন বিষন্ন মেয়েকে কোন রাজকুমার আসবে বিয়ে করতে? রাজামশাই বলে রেখেছেন—কেউ যদি আমার মেয়েকে সারিয়ে তুলতে পারে, হাসি ফোটাতে পারে রাজকুমারির মুখে, তার সাথেই বিয়ে দেব মেয়ের। বলতে কী, অর্ধেকটা রাজ্যও দিয়ে দেব তাকে।
সেদিন কুকুরছানা কোলে নিয়ে, ছেলেটা রাজবাড়িতে এসে হাজির। দেউড়িতে সেপাইর পাহারা। সে বলল—কী চাই তোমার?
--ধুর্তামি হয়েছে আমার সাথে। ছেলেটা বলল—বিচার জানাব রাজার কাছে।
--কী ধূর্তামি? কে ধুর্তামি করেছে তোমার সাথে? আগে আমাকে বলো।
ছেলেটা বলল—আমার এক ঝুড়ি মাংস খেয়েছে। আর, দাম দেবার বেলায় মুখে কুলুপ। রা-টিও কাড়ে না। এটা ধুর্তামি নয়?
সেপাই বলল-- শোন বাপু, অত কথায় আমার কাজ নাই। তোমাকে যেতে দিতে পারি ভিতরে। তবে, একটা শর্তে। মাংসের দাম , বা জরিমানা হিসাবে যা পাবে, ফেরার সময় তার অর্ধেক আমাকে দিয়ে যাবে।
ছেলেটা বলল—কোন অসুবিধা নাই। দেবো। আমি শুধু ন্যায্য বিচার চাই।
কয়েক পা গিয়েছে, এবার পড়ল দ্বিতীয় সেপাইর পাল্লায়। সেও সব শুনল মন দিয়ে। তারও একই শর্ত—দরবার থেকে যা পাবে, তার অর্ধেক দেবে আমাকে।
ছেলেটা এবারেও রাজি। দাম চুলোয় যাক। সে শুধু বিচার চায়।
এবার দরবারে পোঁছালো ছেলে। এক সময় তার নাম ডাকা হোল। রাজামশাই বললেন—বলো, কী জন্য এসেছ?
ছেলেটা এক-এক করে কুকুরদের মাংস চেখে দেখা, কুকুরদের মাংস বিক্রি করা, দাম চাইতে গিয়ে না পাওয়া, শেষমেশ তাদের মাতব্বরের বাচ্চাকে কোলে তুলে আনা-- সব বলে গেল, একটু কম বলল না। একটু বেশিও বলল না।
রাজার মুখ গম্ভীর—এমন অভিযোগ তার সাত পুরুষেও শোনেনি কেউ। রাজা বলল-- কুকুরকে মাংস বেচেছ তুমি? রাজার দরবারে এসেছ মাংসের দাম আদায় করে দিতে? তুমি তো দেখছি, আমার গোটা রাজ্যের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রজা হে!
হয়েছে কী, রাজকুমারি বসে ছিল রাজার পাশের কেদারায়। সব দেখছিল। সব শুনছিল। খিলখিল করে হেসে উঠেছে মেয়েটি।
সে হাসি শুনে রাজা অবাক। মন্ত্রী-সান্ত্রী অবাক। সেপাই-লোকলস্কর সবাই অবাক। খবর পেয়ে, রানিমা ছুটে এসেছে অন্দর মহল থেকে। আনন্দের ঢেউ উঠল গোটা রাজবাড়ি জুড়ে।
হাসি থামলে, রাজকুমারি ছেলেটাকে বলল—তোমার ঐ কুকুরছানাটা দেবে আমাকে? দাও না গো। কী ফুটফুটে বাচ্চা!
চোখ দিয়ে জল গড়াতে লেগেছে রাজামশাইর। হাসি ফুটেছে তার আদরের মেয়ের মুখে! কথা বলছে কেমন স্বাভাবিক গলায়! আজ কত বছর হা-পিত্যেস করে বসে আছে গোটা রাজবাড়ি এটা দেখার জন্য!
বিচার আর কী হবে? রাজা বলল—তোমার মত মানুষ দেখিনি আমি। আমার সাত পুরুষেও না। তোমার সাথে বিয়ে দেওয়া হবে রাজকুমারির।
ছেলেটা বলল—ওসব রাজকুমারি-টুমারি আমার চাই না। আমার মাংসের দামটা শুধু আদায় করে দেওয়া হোক।
খাজাঞ্চিকে ডেকে, রাজা বলল—এক ঘড়া সোনার মোহর দিয়ে দাও একে।
ছেলেটা বলল—মোহরও চাই না আমার।
রাজা তো অবাক। ঘড়া ভর্তি মোহর নেবে না, এ কেমন ছেলে! বলল— বলো, কত দাম তোমার মাংসের?
--পঞ্চাশ ঘা চাবুক। সেটা পেলেই আমি ঘরে ফিরে যাই।
রাজা আরও অবাক। রাজার মেয়ে বিয়ে করবে না! এক ঘড়া মোহর নেবে না! অথচ, গুণে গুণে পঞ্চাশ ঘা চাবুক? রাজা বলল—ব্যাপার কীহে? রাজকন্যা নয়। মোহর নয়। পঞ্চাশ ঘা চাবুক নেবে! কেন হে?
ছেলেটা বলল—পিছনে যে পাওনাদাররা অপেক্ষা করে আছে আমার?
--তোমার আবার পাওনাদার কীসের? কারা তারা?
ছেলেটা খুলে বলল ঘটনা—মাংসের যা দাম পাবো, তার অর্ধেক এক একজনকে দেব, এই কড়ারে রাজার সেপাইরা ভিতরে ঢুকতে দিয়েছে আমাকে। আমিও কথা দিয়েছি তাদের। আমার পাওনা অর্ধেক অর্ধেক হিসাবে পেয়ে যাবে তারা।
গোটা দরবার বোবা। কথা নাই কারও মুখে। রাজকুমারি হেসেছে শুনে, সবাই দৌড়ে এসেছিল। সেপাই দুজনও ছিল ভীড়ের ভিতর।
রাজা কটমট করে চেয়ে দেখল দুজনকে। তাদের তো বুক ঢিপঢিপ। রাজা বলল—তোমার কথাই রইল। পঁচিশ ঘা করে চাবুক পড়বে হতভাগা দুটোর পিঠে। তারপরও যদি জ্যান্ত থাকে, ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে রাজবাড়ি থেকে। রাস্তার কুকুররা ছিঁড়ে ছিঁড়ে মাংস খাবে ওদের।
ছেলেটা ভারি খুশি। কোলের কুকুরছানা রাজকুমারির হাতে তুলে দিয়ে বলল—এবার আমি ঘরে যাই। আমার মা পথ চেয়ে বসে আছে।
মন্ত্রী হাঁ-হাঁ করে উঠল—খবরদার, খবরদার। একে যেতে দেওয়া চলবে না, রাজামশাই। এমন ছেলে সারা দুনিয়ায় আর একটি পাওয়া যাবে না। এর সাথেই বিয়ে হবে রাজার মেয়ের।
রাজাও মাথা নেড়ে দিল—বোকা তো নয়ই। যেমন সরল, বুদ্ধিমানও তেমনি। কেমন মগজ খাটিয়ে, সাজার ব্যবস্থা করল সেপাই দুটোর। শুধু মেয়ে নয় হে, মন্ত্রী। সময় এলে, রাজার সিংহাসনটাও তুলে দেওয়া যাবে একে।
0 Comments