আটান্নতম পর্ব
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
‘ইদম নীরম ইদম ক্ষীরম স্নাত্বা পিত্বা সুখী ভব
ওঁ গয়া গঙ্গা গদাধর হরি’…
কূল পুরোহিতের সুরেলা কন্ঠে উপনিষদের ত্যাগ মন্ত্র ধূপ-ধূনো-গুগ্গুল গন্ধবাহিত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরবিহারী নভে,মুন্ডিতমস্তক ব্রতীর দক্ষিণ হস্তের দক্ষিণমুখী অর্ঘ্য নিবেদিত হচ্ছে পুরোহিতের নির্দেশ মতো।উত্তরাধিকারীর কুশাঙ্গুরীয়ের তিলাঞ্জলী দানে তৃপ্ত হবেন পূর্বজ আত্মা,শাস্ত্রের বিধান এই।
চক্রবর্তী বাড়ির উঠোনময় আঠারোখানি কলার ভেলা সহ পত্র-পুষ্প-ফলাদি নানাবিধ উপচারে সাজানো নৈবেদ্য।একপাশে খাট বিছানা,তৈজস-বাসন,সবৎসা গাভীও প্রস্তুত।
দুধসাদা গরদের জোড় পরে কম্বলাসনে আসীন মুন্ডিতমস্তক শ্রাদ্ধকর্তা, বাড়ির বড়ছেলে।
বাড়ি আজ লোকে লোকারণ্য।এ বাড়ীর কর্তামা শ্রীমত্যা বিরজাসুন্দরী দেবীর বৃষোৎসর্গ শ্রাদ্ধ উপলক্ষে গ্রাম শুদ্ধ সবার নিমন্ত্রণ।
যদিও তিনি এবংশের কেউ নন,বিবাহিতা কন্যা মাত্রই,তবু জীবনভ’র এবাড়ির সর্বাংশে জড়িয়ে থাকা মানুষটির পারলৌকিক ক্রিয়া কর্মাদির দায়িত্ব নিয়েছেন এবাড়ির ছেলেরা, যাদের মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছিলেন তিনি আজীবন।
অনেকদিনের সম্পর্ক ভুলে যাওয়া আত্মীয় পরিজনেরা এসেছেন,বন্ধু-স্বজন,পাড়া প্রতিবেশীরও মেলা বসেছে উঠোনে। আলোচনার মধ্যমনি সেই তিনি,সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা যাঁকে প্রতিপদে সমালোচিত হতে হয়েছে এঁদের কাছেই।
আসলে মৃত্যু তো একটি মহৎ উড়াল,মৃত মানুষের দোষ দেখতে নেই। মানুষ চলে গেলে,তার মানুষী দোষ ক্রটি ভুলে তাকে দেবত্বে উপনীত করা হয়,আমাদের দেশের এই লোকাচার। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
এই দ্বিচারিতা ভালো লাগছিল না অহনার।তাই এই ভীড়,স্মৃতিচারণ থেকে অনেকটাই দূরে,রান্নাশালের বাইরে ইট ঘেরে রান্না বসিয়েছে অহনা,একটু দূরে অপেক্ষায় অগ্রদানী ঠাকুর।
শাস্ত্রে বলে,প্রেতের প্রিয় খাদ্যগুলি শ্রাদ্ধের দিনে রান্না করে উৎসর্গকৃত খাদ্য অগ্রদানী গ্রহণ করলে মৃতের পাপভার ক্ষালন হয়।
অগ্রদানী!...পাপের ভার!...
অহনার মনের পটে ভেসে ওঠেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়,মুখ উজিয়ে বেরিয়ে আসা একদলা ভাত,চোখময় না বেরিয়ে আসা জল,আরও কতো কি;
আনমনে ভেসে ওঠে সেদিনের কথাও।
পুকুরপাড়ে বেশ রসিয়ে রসিয়ে কাঁচা তেঁতুল খাচ্ছিল অহনা,নুন আর লেবু পাতা জারিয়ে।হু হু করে বয়ে যাচ্ছিল এলোমেলো হাওয়া,শীত শেষের বিদায়ী উত্তুরে,মধ্যদুপুরের বাতাসে খানিক উষ্ণতার ছোঁয়া।মনে কোনো অজানা খুশির গুঞ্জন।
এমন সময়েই হঠাৎ কানে এসেছিল অস্ফুট গোঁঙানির শব্দ।কেমন যেন এক অজানা ভয়ে কেঁপে উঠেছিলো মন।দৌড়ে ঘরে গিয়ে দেখে,চারিদিক শুনশান,যে যার মতো বিশ্রামে।
যাক বাবা; কিছু হয়নি,ভেবে আবার পুকুরপাড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও পিছিয়ে এসেছিল ঘরে।পায়ে পায়ে এগিয়েছিল পিসিমার ঘরের দিকে।ছেলেটা ওখানেই ঘুমুচ্ছে তো…
কিন্তু ঘরে ঢুকতে যা দেখল, সারাজীবন ভুলতে পারবে কিনা সন্দেহ।
ঘরময় পুরনো কাগজ, একপাশে রাখা ট্রাঙ্কগুলির ঢাকনা খোলা,কেমন যেন এক পুরনো পুরনো স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ উড়ছে,বাইরের উজ্জ্বল রোদের একেবারে বিপ্রতীপ;
পিসিমা প্রণামের ভঙ্গিতে বসে আছেন তার পাশে, হাতদুটি জড়ো করা কোলের প’রে, চোখদুটি আধখোলা।খোকা বিছানায় দিব্যি ঘুমোচ্ছে।
কাছে গিয়ে পিসিমা, পিসিমা বলে ডাকতেও সাড়া নেই,অল্প অল্প কাঁপছে ঠোঁট।পাশে বসে একটু ঠেলা দিতেই উল্টে পড়লেন তার কোলের কাছে।
খুব ভয় পেয়ে চিৎকার করতে গিয়েও সামলে নিয়েছিল নিজেকে। কেমন যেন এক নির্বান্ধব বিবর্ণ জ্যোতি ঘিরেছিল তখন প্রিয় নারীর শুভ্র অবয়ব, পূর্ণ গ্রাসের আগে মৃত্যুরও হয়তো নিজস্ব কিছু নির্জনতা প্রয়োজন।
অনেক অনেক দিন আগে, ঠিক যেভাবে নিজের বাবার তারাপথে ফিরে যাওয়া দেখেছিল এক সদ্যকিশোরী, ঠিক একই ভাবে সে দেখলো,কি পরম নিশ্চিন্তে বুকের উথালপাথাল থেমে গেল,নিঃশ্বাস ছাড়লেন, কিন্তু আবার ঘুরে প্রশ্বাস নেওয়ার দায় ঐ জীর্ণ শরীর আর হয়তো নিতে চাইলো না। চোখের তলায় গালের পেশীতে খানিক কুঞ্চন,বলিরেখাময় ফর্সা চামড়ার তলায় নীল লাল আঁকিবুঁকি,তারপর ধীরে ধীরে সব স্হির হয়ে গেল।
ঘটনাক্রম এতোখানি সহজ ও সাবলীল ভাবে ঘটে চলেছিল যে,বিস্ময়াহত হওয়ার সময়টুকুও পায়নি অহনা।
বেশ খানিকক্ষণ পরে, দিদিভাই এসে আবিষ্কার করে, অহনা পিসিমার দেহ কোলে নিয়ে বসে আছে,ঘুম ভেঙে কাউকে দেখতে না পেয়ে খোকা কাঁদছে।
তারপর…তারপর,যা যা করতে হয়,সবই করা হয়েছে, ডাক্তার,ডেথ সার্টিফিকেট,আত্মীয় সমাগম,তাঁর সাবেকী শ্বশুরবাড়িতে খবর দেওয়া,দাহকার্য, অশৌচপালন, পারলৌকিক ক্রিয়া…সবই হচ্ছে যথাবিহিত। কিন্তু যে অপরিমেয় শূন্যতা ঘনিয়ে থাকার কথা ছিল শ্রাবণ মেঘের মতো,মনে বা হৃদয়ে, তার বিষন্নতা অনুভব হচ্ছে কই!
বড়ো লজ্জিত বোধ করল মনে!
যে অগ্রজা শত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার নারীজীবনের অভিষেক বেলায় তাকে ছায়া দিয়ে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিলেন, সম্পুর্ন বিপরীত মানসিকতার অনুজাকে সঠিক জীবনবোধ শিক্ষা দিয়ে সুগৃহিণীর পাঠে অভ্যস্ত করেছিলেন,তাঁর সদ্য প্রয়াণশোকের স্মৃতিচারণায় সে আরও বেশী বিহ্বল হচ্ছে না কেন? দিদিভাইয়ের মতো আকুল কান্নায় কেন ভেঙে পড়ছে না বারবার?
সে কি তাহলে তখনও এবাড়ির একজন হয়ে উঠতে পারেনি? ততটা ভালোবাসতে পারেনি পিসিমাকে,যতটা তিনি তাকে বেসেছেন!
🍂
ভাবতে ভাবতেই তেলের কড়ায় উদ্দিষ্ট ভাজাভুজির পরে হিং মাখানো পোস্তর বড়া ভাজতে শুরু করে অহনা, পিসিমা শিখিয়েছিলেন; বড়ো ভালোবাসতেন খেতে।আজও তাঁর জন্যই…
কেমন এক মনখারাপের ঢেউ পাঁক-পুকুরে ওঠা বুজকুড়ির মতো ফুটে উঠতে শুরু করেছিল মনে,চোখ জ্বলছিল হয়তো অনভ্যস্ত কাঠের ধোঁয়ায়, তার মধ্যেই হঠাৎ দেখে একখানি কলাখোলের ডোঙা নিয়ে ছুটে আসছে বাবু…
-’এমা!ওটা হাতে নিয়েছ কেন?পুজো হচ্ছে তো!’
-’ওরা বলছে, পিসি ঠাম্মাকে দেবে, কিন্তু দিচ্ছে না তো, শুধু মন্ত্র পড়ছে। তুমি যে বললে,ঠাম্মা তারা হয়ে গেছে তাই আমি নিজেই…’
বলতে বলতেই খোলাভরা ফলমূল-তিলতন্ডুল ছুঁড়ে দিল আকাশের দিকে।
ছোট্ট হাতের কতোটুকুই বা জোর, খানিক উঠেই আকাশ না ছোঁয়া পার্থিব খাদ্যকণিকা রেণু রেণু ঝরে পড়লো মাটিতে, খানিক তাদের মা ছেলের মাথাতেও…
অপার্থিব আশীর্বাদের মতো,ছোট্ট শিশুটির সরল অনাবিল আর্তির অমূল্য ভালোবাসার মতো।
এতোদিনের প্রতিক্ষিত অশ্রুভার এবার বুঝি বাঁধনহারা হলো,পল্লব উপচিয়ে ঝরে পড়লো গালে,গলায়,চোখে তীব্র জ্বালা!কাঠের ধোঁয়ায় না বিচ্ছেদ বেদনায়,তা কে জানে!
উঠোনময় তখন ছড়িছে পড়া মন্ত্রে মন্ত্রে শ্রদ্ধা নিবেদন, শ্রাদ্ধকর্তার উচ্চারণে,
অগ্নিদগ্ধাশ্চ যে জীবা যেহপ্যদগ্ধাঃ কুলে মম।
ভূমৌ দত্তেন তৃপ্যন্ত তৃপ্তা যাস্ত পরাং গতিম্ ॥
ওঁ যেযাং ন মাতা ন পিতা ন বন্ধু,
নৈবান্নসিদ্ধির্ন তথান্নমস্তি।
ততৃপ্তয়েহন্নং ভুবি দত্তমেতৎ,
প্রয়ান্ত লোকায় সুখায় তদ্বৎ।
ইতি মন্ত্রাভ্যাম্ আস্তীর্ণকুশোপরি বিকিরেৎ।
অগ্নি যাকে দগ্ধ করেছে অথবা করেনি,যার আত্মীয় আছে,অথবা যার কেউই নেই;মা,বাবা,আত্মীয়-বন্ধু… তাদের সবার আত্মার তৃপ্তির জন্যও শুভকামনা আছে আমাদের শাস্ত্রে!
0 Comments