জ্বলদর্চি

অনুপম পালধি (বিপর্যয় মোকাবিলা প্রশিক্ষক, কবি, খড়গপুর) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫০

অনুপম পালধি (বিপর্যয় মোকাবিলা প্রশিক্ষক, কবি, খড়গপুর) 

ভাস্করব্রত পতি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'অপরিচিতা' গল্পের প্রধান চরিত্র 'অনুপম' ছিলেন একজন  শিক্ষিত যুবক। যাঁর মধ্যে সামাজিক প্রথা ও সংস্কারের প্রতি দুর্বলতা ছিল। এই গল্পের আরও কিছু চরিত্র ছিল কল্যাণী, অনুপমের মা এবং মামা। গল্পের মূল বিষয় হলো সামাজিক প্রথা ও সংস্কারের বিরুদ্ধে এক নারীর আত্মমর্যাদার লড়াই। সেই লড়াইতে গল্পের অনুপম ছিলেন নিষ্কৃয় এক চরিত্র। 
 সমাজসেবার বিশেষ অবদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ড. সি ভি আনন্দ বোসের কাছ থেকে পুরষ্কৃত হচ্ছেন

কিন্তু মেদিনীপুরের কবি অনুপম সামাজিক অবক্ষয়, প্রথা, সমাজের দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেননি। যৌতুক, পণপ্রথাকে মননে স্থান দেননি। গল্পের অনুপমের মা ও মামা সমাজের প্রচলিত ধারণা ও সংস্কারের প্রতি অনুগত ও অনুরক্ত ছিল। গল্পের অনুপম কাহিনির নায়িকা কল্যাণীকে পছন্দ করত। কিন্তু তাঁর মামার প্ররোচনা ও সমাজের চাপ অনুভব করে কল্যাণীকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। কিন্তু কবি অনুপম তাঁর পছন্দের কাকলীকে বিয়ে করেছিল সম্পূর্ণ যৌতুকহীন ভাবে। কোনও সামাজিক সংস্কার, ধ্যানধারণা কে প্রশ্রয় দেননি। আর এ কাজে পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিলেন নিজের মায়ের কাছে। 
'মনে আছে 
তুই আর আমি ছুটছিলাম মরুভূমিতে
হাসতে হাসতে চক্কর কাটা দুজনের
পড়ে গিয়ে ব্যথায় কঁকিয়ে উঠেছিলাম আমি
হাত ধরে তুলেছিলি তুইই আমাকে.... '। 

তিনি কবি অনুপম পালধি। । তিনি লেখেন কবিতা। । গড়পড়তা শিক্ষিত বাঙালির মতো তাঁর মননে চিন্তনে সৃজনে প্রস্ফুটিত হয় প্রেম, বিরহ, অভিমান, ভালোবাসা, দ্বন্দ্ব, প্রতিবাদ, খুনসুটি, হাসিকান্না আর নির্মেদ সাহিত্যের লালিত্য... 
'হঠাৎ ভোকাট্টা আওয়াজে আলগা হয় লাটাই
কাটাকুটির খেলায় ধরাশায়ী বিজিত অভিমন্যু।
কাটা ঘুড়ি ধরতে গিয়ে দৌড়াই আমিও
গোত্তা খেয়ে আটকায় বদ্ধ আঙিনায়।
বাবা বলে, কাটা ঘুড়ি আকাঙ্খার উচ্চ প্রতীক।
উড়ন্ত ঘুড়ি ভেসে বেড়ায় সৃষ্টির আনন্দে।
কখনও পাখি নতুবা কালিদাসের দূত হয়ে
মুক্তির আনন্দের পাঠশালা চত্বরে'।
কবিতার পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেও ভালোবাসেন। এই দুই চর্চার প্রতি দুর্বলতার কারণে তিনি নিজেকে পরিশীলিত করলেন সাহিত্য জগতের অন্দরমহলে।
পাঁশকুড়ার বন্যায় দুর্গতদের পাশে

১৯৯৬ সালে খড়গপুর রেল প্লাটফর্মে বসে ঠিক করলেন একটি পত্রিকা প্রকাশ করবেন। সেখানে থাকবে কবিতার কারিকুরি আর সাংবাদিকতার বিবরণ। সেসময় সেখানে বসে নতুন সেই পত্রিকার নামকরণ করেছিলেন গল্পকার অনিল ঘড়াই ও কবি মানস কুমার চিনি। যাঁদের দুজনই আজ আর পৃথিবীতে নেই। কবির কথায়... 
'এখন
ভেঙে গেছে আড্ডার কথকতার আসর 
ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেশের এখানে ওখানে
রাত আর জাগিস না, নিশ্চিন্তে ঘুমা
আমি যে অস্ত্র হাতে সীমান্তের সৈনিক'।
সেদিন অনুপম পালধির সম্পাদনায় জন্ম নেয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা 'কবি ও সাংবাদিক'। যা আজও প্রকাশিত হয়ে চলেছে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। আর ঘটমান জীবনের প্রতিচ্ছবিগুলো উন্মুক্ত হয়ে ওড়ে কবিতার ডানায় ভর করে.. 
'আবার 
সাগরের নোনা জলে আমাদের সূর্যস্নান 
ঢেউয়ের ধাক্কায় নুড়ি পাথরে তোর অন্তরীণ
সাহস করে ডুব সাঁতরে উদ্ধারকর্তা নাবিক
আমার স্পর্শে তোর জীবনের পুনর্নির্মাণ।
তারপর
হোটেলের ব্যালকনিতে তারা ছোঁয়ার গল্প 
উপচে পড়া গ্লাসে সমূদ্রের সাদা ফেনা
মাঝ রাতের চাঁদ কামড়ায় সেঁকা পাঁপড়
নির্বাক বেলাভূমি ঢেউ গোনে বসন্ত বাহারে'। 

১৯৬০ সালের ১৫ ই অক্টোবর পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের বাড় উত্তর হিংলী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও তাঁর বেড়ে ওঠা রেলশহর খড়গপুরে। বাবা হারা তিন মেয়ে দুই ছেলেকে নিয়ে মায়ের কি লড়াই। খুব কাছ থেকে দেখেছেন সমাজের বাস্তব রূপ। তাই তার মানসিতায় স্থান পেয়েছিল পেলব রূপ। এহেন মায়ের সন্তান হিসেবে অনুপম পেয়েছিলেন অন্যরকম রসদ। 
বিপর্যয় মোকাবিলার প্রশিক্ষন দিচ্ছেন

খড়গপুরে রেলের বয়েস হাইস্কুলে পড়াশোনা। এরপর মেদিনীপুর কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন। তারপর সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা। অবশেষে চাকরি। আজ তিনি রেলের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক। কিন্তু অবসরকালীন জীবন হলেও তিনি নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন সামাজিক কাজে। যে কাজ তিনি করেন, তা মেদিনীপুরের বুকে এক অন্যধারার কাজ। 
অনুপম পালধির কবিতার বই

সাহিত্যের জন্য সেরকম কোনও পুরস্কার জোটেনি তাঁর। তবে অনেক ছোট পত্রিকা থেকে পেয়েছেন পুরস্কার। তবে তিনি তো এখন জেলা তথা রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা ও ফার্স্ট এইড বিষয়ক প্রশিক্ষন দেওয়ার মাস্টার ট্রেনার। ইণ্ডিয়ান রেড ক্রসের অধীনে দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করার জন্য গত ২১ শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ড. সি ভি আনন্দ বোস তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন বিশেষ সম্মাননা। ভারতীয় রেড ক্রস সোসাইটির হয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানব সেবার কাজের জন্য এই পুরস্কার তাঁর। 

রাজভবনে এক অনুষ্ঠানে তাঁর হাতে উত্তরীয় ও ফলক তুলে দেন রাজ্যপাল। ওড়িশার সুপার সাইক্লোন, জ্ঞানেশ্বরী ট্রেন দুর্ঘটনা, আয়লা ঝড়, পশ্চিমবঙ্গের বন্যা সহ সর্বত্র তিনি ছুটে বেড়ান বিপন্ন মানুষের সেবায়। বন্যা, ঝড় সহ যাবতীয় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলেই হাজির বিপর্যয় মোকাবিলা ভল্যান্টিয়ার হিসেবে। কখনও উদ্ধারকার্যে সাহায্য, আবার কখনো প্রাথমিক চিকিৎসা, বন্যা কবলিত মানুষদের ত্রাণ বিতরণে তিনি থাকেন সম্মুখ সমরে। 
ছাত্র ছাত্রীদের শেখাচ্ছেন

বিপর্যয় মোকাবিলার পাঠ শেখাতে মেদিনীপুর জুড়ে তাঁর অবাধ যাতায়াত। ঘাটাল কলেজ, পিংলা কলেজ, বাজকুল কলেজ থেকে তমলুক, মহিষাদল, হলদিয়া, খড়গপুর, পাঁশকুড়ার নানা স্কুলে ২০০৪ সাল থেকে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন নিরলসভাবে। গঙ্গাসাগর মেলায় কচুবেড়িয়ার জেটিঘাটে স্ট্রেচার নিয়ে ছুটে গিয়েছেন আর্তদের উদ্ধার করতে। সাম্প্রতিক পাঁশকুড়ার বন্যায় ত্রাণ নিয়ে পাড়ি দিয়েছেন অকুস্থলে। ভারতীয় রেলের এই অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক অনুপম পালধি নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বিভিন্ন রেল কর্মীদের। প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের পাশে থেকেছেন আশু বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার পাঠ শেখাতে। বিপর্যয়কে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে হাতেনাতে শিখিয়ে চলেছেন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে। 

আজকাল অনেকেই কম বেশি মানসিক সমস্যায় ভোগেন। ইয়ং জেনারেশন, বয়স্করা আরও বেশি। কিভাবে আনন্দে বেঁচে থাকা যায়, তার পাঠ দেন তিনি। রাজ্য জুড়ে কাজ করেন মেন্টাল হেলথ ও সাইকোসোশিয়াল সাপোর্টের মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে। তাঁর সেই কাজের নিরিখেই এবার রাজ্যপাল পুরষ্কৃত করলেন তাঁকে। তাঁর এই পুরস্কার প্রাপ্তিতে খুশি ইণ্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তথা তাম্রলিপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান ড. দীপেন্দ্রনারায়ণ রায়। 

এর পাশাপাশি কবিতা, গল্প, ছোট গল্প, প্রবন্ধ, রম্য রচনার লেখা নিয়েই তিনি মেতে থাকেন জীবনভর। মূলতঃ ছোট কাগজেই লেখেন। লিটল ম্যাগাজিন তাঁর প্রথম এবং একমাত্র পছন্দ। এখানেই লেখেন --
'আকাশ সেজেছে নিজের মেকআপে 
নানা বিচিত্র প্রজাতির প্রজন্মে।
তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেঁকে ধনুকের ছিলায় 
বাতাসের প্রবাহ ভারসাম্য মাপে।
তেপান্তর পেরিয়ে টপকায় মেঘ পাহাড়,
সবাইকে পেছনে ফেলে রামধনুর দেশে।
সাত রঙিন নারীর স্বয়ম্বর সভায়
আমাদের ঘুড়িটাই একমাত্র প্রতিযোগী'।

কবিতাকে ভালোবেসে কাঁধে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়মিত কবি সম্মেলনে যাওয়া ছিল নিত্যদিনের ছবি। কবি বিধায়ক তমালিকা পণ্ডাশেঠের আহ্বানে হলদিয়ার আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও কবিতা উৎসব, ঘাটালের অধ্যাপক লক্ষণ কর্মকারের বীরসিংহ মেলা, কে টি পি পি মেলা, বালুঘাটার ভূতনাথ পানিগ্রাহির আহ্বানে কবিতা উৎসবে, কলকাতার নন্দন চত্বরে লিটল ম্যাগাজিন মেলায় পৌঁছে যান কবিতার ডালি নিয়ে। পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের আমন্ত্রণে দিঘা,শান্তিনিকেতন, কলকাতায় কবিতাপাঠ করেছেন কবি হিসেবে। পাশে পেয়েছেন অনিল ঘড়াই, মানস কুমার চিনি, আশিষ মিশ্র, অর্ণব পন্ডা, ঋত্বিক ত্রিপাঠী, দেবাশীষ প্রধান, এস মহিউদ্দিন, প্রশান্ত দাস, কমলেশ নন্দদের। 
কলকাতায় রাজভবনে ইণ্ডিয়ান রেড ক্রস সোসাইটির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত অনুপম পালধি

লিখেছেন দুটি কবিতার বই -- 'ভালবাসা তোমার সাথে আড়ি' এবং 'নিঝুম রাতে শব্দের ঘোড়সওয়ার'। আকাশবানী মৈত্রী চ্যানেলে গল্প পাঠ এবং গীতাঞ্জলি চ্যানেলে অণু গল্পের পাঠ করেন নিয়মিত। একদিকে কবিতা যাপন অন্যদিকে অফিসের দায়িত্ব। এর সাথে চাকরির প্রয়োজনে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বদলির খাঁড়া। তবুও সযতনে বজায় রেখেছেন কবিতার নির্যাস পান করার অমোঘ আকর্ষণ।
'খোলা মাঠে সিমেন্টের বেঞ্চিতে বসে আমি
দুটো গোলপোস্ট যেন যৌবন বার্ধক্যের রক্ষী
বৃষ্টি ভেজা কচি ঘাস আনন্দে ভরপুর
বেলা শেষে পাশের পুকুরে জমায়েত হাঁসেরা 
কৈশোরের উন্মাদনায় খালি পায়ে ছেলের দল
ঘোলা জলে মাছ নয়, বলে লাথি 
তার চেয়েও বেশি মজা কাদার শরীর 
জড়িয়ে, লতিয়ে ছুঁতে চায় মাঠের শিকড়। 
আমারও দেহ নিত ভিজে মাটির স্পর্শ 
গনগনে রোদ, শ্রাবণের ধারা, শীতের বিকেলে
সামনে দাঁড়ান দেবদারু গাছের ভগ্ন চেহারা
ঝরে যাওয়া পাতাগুলো এখন ধুঁকছে কাদায়'। 
  -- কাদা মাটি, অনুপম পালধি

🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. ভাস্কর সেনMarch 27, 2025

    অনুপম পালধির টুকরো কবিতার কতিপয় পড়ে মনে হলো এক একটি হীরের টুকরো পেলাম। এত অনুভূতি ও আবেগপ্রবণ ভাষার ব্যবহারে শ্রী পালধি কবিতার মান যে ভাবে বাড়িয়েছেন তা পাঠকের মন স্পর্শ করে যায়। কবি ও তাঁর কবিতার সাথে পরিচয় করানোর জন্য এই লেখাটির লেখক শ্রী ভাস্করব্রত পতি ও সম্পাদক শ্রী ত্রিপাঠীকে অনেক ধন্যবাদ।

    ReplyDelete