জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা/সুপ্রিয়া মুর্মু


গুচ্ছ কবিতা/সুপ্রিয়া মুর্মু


বৈশাখ
  
এসো হে বৈশাখ
বৎসরের যত মলিনতা,
তিক্ততা, আবর্জনা সব দূর 
হয়ে যাক তোমার আগমনে;
এসো নবরূপে। 
সকল বাধা, সকল গ্লানি,
অভিমানকে সরিয়ে এগিয়ে চলি
 নতুন প্রানের ছোঁয়ায়, 
মহুয়া, পলাশ, অশোক, শিমুল, 
কৃষ্ণচূড়ার ভুবন জুড়ানো সৌন্দর্যে
 রঙিন হোক চতুর্দিক, 
হৃদয়ের মণিকোঠায় থাকুক 
শান্তির বাণী;
কৃষকের দল মাতাল হোক 
নব অন্নের ঘ্রাণে
নববধূর আগমনে ভরে উঠুক 
সকল শান্তিনিবাস
অবসান হোক পরিশ্রান্ত,
 নিরানন্দ জীবনের, 
স্মৃতির পাতায়  তোলা থাকুক 
দুঃখ, হতাশা, ক্লেশ
খুশির বার্তা নিয়ে আসুক বৈশাখ
বেদনার কথা ভুলে ইতি 
টানুক চৈত্রের শেষদিন, 
পরিপূর্ণ হোক উচ্ছলতায়;
ঘরে ঘরে খুশির বার্তা নিয়ে আসুক
পয়লা বৈশাখ, হোক বর্ষবরণ;
বৈশাখের নব ছোঁয়াতে শুরু 
হোক নতুন জীবন
পূর্ণ হোক সকল আশা, 
বয়ে যাক শাশ্বত ঐতিহ্য।।


ব্যাধ

আমি ব্যাধ।
অসংখ্য পাখিকে হত্যা করে, 
মিটিয়েছি আমার আশ, 
আমার সাধ,আমার বাসনা।

কত শুক-শারীদের 
আলাদা করে তৃপ্তি মিটিয়েছি;
তারা যখন মনের 
সুখে গল্প করে, গান গায়, 
তখন আমি ঝোপের ভিতর 
আড়াল থেকে তাদের 
লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ে 
 তাদের একজনকে
শেষ করে বড় আনন্দ পাই। 

আমি ব্যাধ। 
কত মুক্ত বিহঙ্গকে 
আমি নিমেষের মধ্যে 
মাটিতে লুটিয়ে দিয়েছি। 

চখাচখি যখন আপনমনে 
খেলা করে ছোটো ছোটো 
ক্ষুদেদের উড়তে শেখায় , 
তখন আমি সুযোগ খুঁজি 
মুহূর্তের মধ্যে তাদের 
আলাদা করে দিয়ে 
ক্ষুদেদের অনাথ করে দিতেও 
আমার এতটুকু হাত  কাঁপে না। 

আমার পাষাণ হৃদয়, 
আমি পাষন্ড, আমি ব্যাধ।।


🍂


সমুদ্র

আজ অনেক দিন পর
      তোমায় দেখলাম সমুদ্র
    নতুন করে নতুন রূপে। 
তোমার বিস্তৃত সুনীল জলরাশি
             অনন্ত, সীমাহীন;
তোমার বুকে সূর্য ওঠার মুহূর্ত
         বড়ই অপরূপ । 


তুমি চাইলে ভয়াবহ রূপে
   ভাসিয়ে দিতে পারো
   সারা দেশ, সারা বিশ্ব;
সুনামি তুলে লন্ডভন্ড 
    করে দিতে পারো সব।


কত মানুষকে কত আনন্দ
       দিতে পারো তুমি, 
কত জনের কত স্মৃতি আকা
      আছে তোমার বুকে;
তোমার বুকে পাড়ি দেয়
      কতজন কত অজানা 
        দেশ আবিষ্কারে।


কত অগুনতি প্রানীকে
    আশ্রয় দিয়েছ তুমি 
         তোমার গর্ভে;
সমুদ্র তুমি সত্যিই অপূর্ব
      তুমি সীমাহীন।।


হৃদয়ান্তর

আমায় একটা চিঠি লিখে দিয়ো, 
যেখানে থাকবে তোমার হাতের স্পর্শ;
তোমার হৃদয়ের স্পন্দন।

তুমি যত দূরেই থাক না কেন
তোমার কথা 
আমার হৃদয়ের ভার হালকা করে;

তোমার চিঠিতে যেন থাকে
অনেকটা আবেগ মাখা প্রেম;
তোমার কথার সুর
প্রতিটা দিন আনে বসন্তের আমেজ। 

তোমাকে আলাদা করে ভালোবাসি
বলতে হয় না;
তোমার অনুভূতি আমায় আগলে রাখে। 

তোমার চোখের ভাষা আমায়
             উন্মত্ত করে;
যতবার স্মৃতিতে ভাসে তোমার চাহনি, 
তোমায় পাবো বলে  আমি
উন্মাদ হয়ে যাই। 

তোমার দেওয়া ফুলের মালা
আমার ইহজন্মের শ্রেষ্ঠ উপহার;
তোমার স্নেহের লালিত্য, 
প্রেমের মাধুর্য
জীবনে আনে নতুনত্ব, 
ওঠে নবকিরনে সূর্য।।



জন্মদাতা

হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়েছ
হাঁটতে হাঁটতে যখন হোঁচট খেয়েছি, 
আমার থেকে অনেক বেশি 
ব্যথা পেয়েছ তুমি,
কোলে তুলেছ আমায়;
কোনও দিন কিছু চাইতে 
হয়নি তোমার কাছে
না চাইতেই হাতে এনে দিয়েছ সব, 
মুখ ফুটে বলতে হয়নি কিছু;
অনেক আশা নিয়ে বড়ো করেছ
       স্বপ্ন দেখিয়েছ, 
জানি কিছুই দিতে পারিনি তোমায়, 
        বটবৃক্ষ তুমি;
আজ অনেক মানুষের ভরসার জায়গা তুমি
এখন তোমার বয়স হয়েছে অনেক
তুমি এখন শীর্ণ, জরাজীর্ণ
তাও তোমার অশেষ মনোবল
যেমন ছিলে সাদামাটা
আজও তেমনই আছো, 
তবে তোমার বাঁশীর সুর
আজও অজস্র মানুষের
মনকে হালকা করে, 
তোমার বাঁশীর সুর হয়ে উঠুক
প্রতিটা মানুষের দুঃখ আর
আনন্দের সাথী;
তুমি থাক সবার মনে
সবার হৃদয়ে, নিজগুনে, 
নিজ বাঁশীর সুরে।।



এসেছে বসন্ত

হিমের পরশ শেষ হতেই 
এসেছে বসন্ত, 
পলাশ বনে রঙের তুলিতে
 এঁকেছে সে, 
আজ তার রাঙিয়ে দেওয়ার দিন
অশোক, শিমুল, মহুয়া তাই 
সেজেছে নিজের মত করে
পলাশ বনে যেন আগুন 
লেগেছে খুশিতে;
আবির রঙে রঙিন চারিপাশ
শুধু অঙ্গে নয়, যে চিরদুঃখী 
তার মনকেও আবিরে
 রাঙিয়ে দিয়ো বসন্ত;
তোমার সাথেই সেজে
 উঠুক নবীন- প্রবীন
পাতাঝরা দিনের শেষে নতুন পত্র
 গাছে গাছে শাখায় শাখায়
সেজে উঠুক বসন্ত উৎসব
মুখরিত হোক পাখির কলরবে, 
বসন্ত যেও না চলে
আনন্দবার্তা দিয়ে যাও
থাকো জীবনভর;
দিকে দিকে আবিরের রঙে
 রাঙা হয়ে উঠুক প্রকৃতি
আবিরে তোমায় রাঙিয়ে 
দিলাম বসন্ত, 
বসন্ত থাকুক 
মনে প্রানে কথায় সুরে।।


 আদিবাসী

তোমরা আদিবাসী, 
তাই মহামারীর ভয়ানক অসুখে 
তোমরা অসুস্থ হও,
তবুও তোমাদের কথা
হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছায় না;
তোমাদের অসুস্থ বাচ্চাদের ওঝা দিয়ে
সাময়িক সুস্থ করা হয়, 
তারপর একদিন মায়ের কোলেই
 চিরবিদায় নেয় শিশু। 
 
তোমরা সারাদিন কষ্ট সয়ে 
পরিশ্রম করো, কিন্তু 
পরিশ্রমের দাম পাও না মোটেই। 

প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা 
তোমাদের সুমিষ্ট তনয়াদের 
উপর লোলুপ দৃষ্টি থাকে 
সাহেবরূপী হিংস্র পশুদের;
দিনের বেলায় ছায়া 
মাড়ানোও যাদের পাপ, 
তারাই রাতের অন্ধকারে 
বিছানা সুসজ্জিত করতে চায় 
তোমাদেরই অগ্নিকন্যাদের দিয়ে।

হঠাৎ কোন এক মধ্যরাতে
ঝুপড়ি কামিন বস্তি থেকে 
তুলে এনে সুরম্য বাগানবাড়িতে 
তোমায় নিয়ে পরিপূর্ণ হয় 
কোন এক অসুরের রজকীয় লাম্পট্য, 
ঝাড়বাতির চমৎকার আলোয় 
ফুটে ওঠে তোমার অনাবৃত শরীর। 

গোধূলির ম্লান আলোয় 
কোন এক অসভ্যবিলাসী সুপুরুষ
তোমায় নিয়ে কালক্ষেপণ করে
 এঁকে দিতে চায় ছোট স্বপ্নের কাজল, 
আর ফুরিয়ে যাওয়া সিগারেটের মত
ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ
হতে ছুটে যায় শহরের পথে। 

আদিবাসী তুমি বঞ্চিত নও,
নগন্য নও;
তুমিও হয়ে উঠতে পারো অসামান্যা, 
তুমি জানো না শিক্ষাক্ষেত্রে 
তোমার জন্য কত সুযোগ 
অপেক্ষা করে আছে, 
তোমারও আছে গনতন্ত্রের অধিকার, 
সুস্থভাবে বাঁচবার অধিকার।।

Post a Comment

0 Comments