জ্বলদর্চি

মেমারি গেম-পর্ব ৩/বাসুদেব গুপ্ত

গল্প ধারাবাহিক। 
মেমারি গেম
পর্ব ৩
বাসুদেব গুপ্ত

কখন একসময় জ্ঞান ফিরে আসে দুজনের। ধীরে ধীরে চোখ খুলে মহিমা আর সুশান্ত দেখতে পান তাঁরা এক অজানা জায়গায় শুয়ে । জায়গাটা কি সেটা অনুমান করতে দুজনেরই সময় লাগে কয়েক মিনিট। কিন্তু কী ঘটেছিল এবং কীভাবে তাঁরা এখানে হাজির হলেন সে সম্পর্কে কিছুই মনে পড়ে না। নাম, ঠিকানা কিছুই না। কোন স্মৃতি নেই, অতীত বলে কিছু নেই, সবটাই অন্ধকার। যেন কোন এক দূর গ্রহ থেকে নেমে দুজনে সোজা এই গুহায় ঢুকে পড়েছেন। গুহার নাম আই সি ইউ। লাল অক্ষরে লেখা জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। 

আইসিইউতে তাদের শয্যা দুটি পাশাপাশি । আইসিউটি ফাঁকা ফাঁকা। আজ বড়দিন। ভিক্টোরিয়া এবং চিড়িয়াখানার লোভন কমলালেবুর মত রং লাগানো রোদে ক্রিসমাস উপভোগ করতে গেছে অনেকে। কর্মী খুব কম। সৌভাগ্যক্রমে মহামারীর সিজন অনেক আগেই চলে গেছে এবং নিউমোনিয়া মরশুম এবং ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব এখনও হতে বেশ দেরী। কুড়ি শয্যার আইসিইউতে রোগী মাত্র চারজন। আলোটা ঝিমিয়ে রাখা, সবকিছু কেমন সবুজ সবুজ। এটা কি হেল? সুশান্তের একবার মনে হল। না এটা কি কোন অতল সাগরের গভীরে এক নাগকন্যার পাতালরাজ্য? দূরে আবছা আলোয় বসে আছে একটি নারী। সে কে? নাগরাজ কন্যা ঊলুপী? দুজনেই নিজেদের পোশাকের রঙ দেখল অবাক হয়ে। গাঢ় সবুজ শেওলা রঙ ইউনিফর্ম। দুজনেরি হাতে বাঁধা অনেকগুলো নল, কয়েকটা তার চলে গেছে ইলেকট্রনিক নানারকম বাক্সের দিকে। সেই বাক্সতে লেখা আর সংখ্যা আর আলোর ছোট ছোট ঢেউ ফুটে ফুটে উঠছে। একজন ম্রিয়মাণ চেহারার নার্স একটি টেবিলে বসে তাদের উপর নজর রাখছিল। দুজনেই একই সঙ্গে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলেন, 'আমি কোথায়'।

🍂

দুজনকে একই সঙ্গে জ্ঞান ফিরতে দেখে নার্সটি খুব খুশি হলো। ভর্তির সময় বলা হয়েছিল, এই দম্পতি এসি বাসের সামনে একসঙ্গে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। একটা অ্যাম্বুলেন্সেই চড়ে দুজনে একসঙ্গে হাসপাতালে ঢোকে। সাথে একটাও জিনিসপত্র নেই। জনতা দক্ষতার সঙ্গে সবকিছু হাপিস করে নিয়েছিল। দুজনে নাকি অজ্ঞান অবস্থায় দুজনকে খুব শক্ত করে আলিঙ্গনে আবদ্ধ ছিলেন। তাদের আলাদা করা দুটি স্ট্রেচারে তুলতে নাকি অনেক কষ্ট করতে হয়েছে স্টাফদের। 

 নার্স নন্দিনী, দক্ষিণ থেকে আসা এক কালো মেয়ে। তার চোখ দুটি বড় বড় এবং গভীর কৃষ্ণবর্ণ। সে তার কাজ নিয়ে খুশি কিনা সেও ঠিক জানে না, কিন্তু তার বসে থাকা, চলায় কথা বলায় ফুটে ওঠে এক সন্তুষ্টি। একই সাথে অসুস্থদের সেবা করার এবং প্রভুর সেবা করার এমন পেশা কজন পায়। সে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে দুটো বিছানার মাঝখানে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
=ও স্যার আর ম্যাম দুজনেই দেখছি ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন, গুড মর্নিং। কেমন আছেন? শরীরে কোথাও কষ্ট, ব্যথা লাগছে?
মহিমা এবং সুশান্ত দুজনেরই ভুরু কুঁচকে গেল বিরক্তিতে। মেয়েটি তাদের এক গ্রুপে ফেলে দিচ্ছে, যেন দুজনে একই ফ্যামিলির লোক, অদ্ভুত! দুজনে দুজনার দিকে তাকিয়ে জীবনে কখনও একে অপরকে দেখেছে্ন বলে মনে করতে পারলেন না। খুব কষ্ট করে ধীরে ধীরে প্রায় ফিসফিস করে দুজনেই জবাব দিলেন,
=হ্যাঁ, খুব ব্যথা সারা গায়ে। আমি কোথায়? কী হয়েছে?
নন্দিনী মিষ্টি হেসে বলল,
=চিন্তা করবেন না স্যার আর ম্যাম, যা হয়েছে ভগবানের ইচ্ছায়। আপনারা দুজনেই খুব জোর বেঁচে গেছেন। এটা একটি হাসপাতাল। আপনাদের কয়েকদিন এখন অবসারভ করা হবে, তার সঙ্গে যেমন দরকার তেমন চিকিৎসা হবে। একদম চিন্তা করবেন না, একদম বেস্ট চিকিৎসা দেব আমরা। তারপর ভাল হয়ে আপনারা একসাথে বাড়ি ফিরে যাবেন। নিন, এখন বিশ্রাম নিন। আপনাদের ডায়েট ঠিক হলেই, আমরা আপনাদের কিছু নিউট্রিশনের ব্যবস্থা করব। 

মহিমা এবং সুশান্ত উভয়ই অত্যন্ত স্বাধীন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অহংকারী এবং নচ্ছার না হলেও সোচ্চার মানুষ। এরকম ভয়ঙ্কর এক জায়গায় অদ্ভুত এই মেয়েটি তাঁদের কী বলছে তা তাঁদের মাথায় কিচ্ছু ঢুকল না। চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুজনেরই খেয়াল হল ভোকাল কর্ড একদম সহযোগিতা করছে না। মাঝখান থেকে উত্তেজনার ফলে মনিটরগুলি যেন বিরক্ত হয়ে অদ্ভুত ঢেউ আঁকতে শুরু করল। নন্দিনী দৌড়ে এল তাই দেখে। এসে IV চ্যানেলে কি একটা ওষুধ ইনজেকশন দিলো আর দুজনেই কয়েক মিনিটেই চটজলদি গভীর ঘুমে ঢুলে পড়ল ।

হাসপাতালে একদিন কেটে গেল। মহিমা এবং সুশান্ত দুজনেই একে অপরের দিকে মাঝে মাঝে তাকান, কিন্তু তাঁরা কে এবং এই হাসপাতালে তাদের কেনই বা তাঁদের একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, এটা তাঁদের মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না। এটা নিঃসন্দেহ যে জীবনেও তাঁরা একে অপরের এই কদর্য মুখ দেখেনি। এদিকে অসহায়ের মত নন্দিনীর ভুলভাল কথা শুনতে হচ্ছে। দুজনেই ঠিক করেন, বের হতে পারলে এর একটা বিহিত করবেন। মহিমা ঠিক করে ফেললেন, এটা ডিফেমেশানের উপযুক্ত কেস, নার্সটির চাকরি কেমন থাকে তিনি দেখবেন। একবার বেরোলে এখান থেকে। 
 
আজ নাকি তাঁদের ভাইটাল রিডিং অনেক ভালো হয়েছে। নন্দিনী এসে হাসতে হাসতে বলে গেল । দুজনেরই নাকি মাথার চোটের জটিলতা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। সিটি স্ক্যানও ঠিকঠাক । কিন্তু স্মৃতি তখনও ধরা দিচ্ছে না, কি এক অজানার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। সকাল ৯টা। রিকশা যখন দুজনকে ঘষটে ঘষটে কয়েক ফুট টেনে নিয়ে যায় তখন অনেকগুলি কাটাকুটি ও ফোস্কা পড়েছে। তার যত্ন নেওয়ার জন্য আইভির মাধ্যমে অ্যান্টিবায়োটিকের একটি ডোজ পুশ করল নন্দিনী। তারপর তরল মুসুর ডালের স্যুপ দিয়ে তাঁদের প্রাতঃরাশ শেষ হল। এসব করতে করতে নন্দিনীর চোখে হঠাৎ দেখা গেল উদ্বেগের ছায়া। চটপট দুজন জুনিয়র মেডিক ঢুকে পড়ল। সমস্ত মনিটর, তাদের ড্রেসিং তাদের প্রত্যেকের কেস হিস্ট্রির ফাইল মন দিয়ে পরীক্ষা করল। আর তারপরই গটমট করে ঢুকে পড়লেন আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারীরা। একজন ব্যস্ত অফিসার লিটন পাল এবং দুজন সহকারী, দুজনের নামই যতীন। একজন দাস এখন পাল। এঁরা হাসপাতালের রেগুলার। নিয়মিত এইসব এক্সিডেন্ট কেস হতেই থাকে, এনারা দায়িত্ব পালন করে যান বিরস মুখে। 

কিন্তু আজ সেই তাঁদের মুখেই ফুটে উঠল একটা অদ্ভুত হাসি। মহিমা আর সুশান্তের বিছানার মাঝখানে দাঁড়িয়ে লিটন পাল শুরু করলেন প্রশ্নবাণ। 

=আপনার নাম কি?
মহিমা আর সুশান্ত দুজনেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর সুশান্ত যেন অকস্মাৎ মনে পড়ে গেছে বলে চোখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল, খুব উৎসাহ নিয়ে উত্তর দিলেন,
=সেলিম 
=আর আপনার?
মহিমা পিছিয়ে পড়ার পাত্র না। যদিও নামটি মনে করতে পারছিলেন না, তবুও ভেবেচিন্তে একটা ভাল নাম বলে দিলেন।
=দুর্গাবতী। 
এই উত্তরগুলো শুনে হাসির একটা চাপা হুল্লোড় বয়ে গেল, কিন্তু এটা আইসিইউ, হাসির জায়গা নয় ঠিক। লিটন পাল তাড়াতাড়ি গম্ভীর হয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
=বাসের নিচে আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন কেন? এটা কি একটা ভাল উপায় মরবার? জানেন না বাসের চাকায় চেপ্টে গেলে কত ভয়ানক কষ্ট হতে পারে? এছাড়াও, আর আমরা পুলিসের দিক থেকে বলতে পারি, এই যে ট্রাফিক আটকে আত্মহত্যার চেষ্টা, এটা তো রীতিমত একটা ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন। এতে এক হাজার টাকার জরিমানা হতে পারে জানেন?
যতীন পাল তাড়াতাড়ি ভুল ধরে দেয়,
=স্যার, নতুন আইন সংহিতায় দশ হাজার হয়ে গেছে। তারপর নিজেকে হত্যা করার চেষ্টা তো এটেম্পটেড হোমিসাইড। 
=৩০৭ যতীন দাস তাড়াতাড়ি জ্ঞান জাহির করতে যায় 
=না নতুন সংহিতায় বিএন এস ১০৯। লিটন পাল গম্ভীর ভাবে বুঝিয়ে দেন তিনিই অফিসার, এবং আইন তাঁর জানা। 
 
মহিমা ও সুশান্ত আরো বিমূঢ়, কিংকর্তব্য হয়ে পড়েন। মহিমা তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন,
=আমি জানি না ওই লোকটি কে। আমি আত্মহত্যা করতে যাবো কেন? হঠাৎ যেন একটা ভারী কিছু আমার উপর পড়ে গেল, তারপর দেখি আমি এখানে। 

সুশান্তও ঠিক একই কথা বলেন তাঁর ভাষায়, তবে গলায় অতটা আত্মবিশ্বাস নেই তাঁর। 
=ছেলে বা মেয়ের সাথে ঝগড়া ঝাঁটি হয়েছে? এমন তো হয়েই থাকে, তাতে আপনারা এমন একটা স্টেপ নিতে চলে গেলেন। দেখে তো মনে হচ্ছে আপনারা একে অপরকে এত ভালোবাসেন যে একসঙ্গে চলে যাব বলেও ঠিক করেছিলেন। কিন্তু আমি একজন পুলিশ নয়, হিউম্যান হিসেবে বলছি এভাবে মরে যাওয়া মোটেও ঠিক নয়। বেআইনি তো বটেই। 
মহিমা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
=আমার কোন ছেলে নেই। 
সুশান্ত আরও বলেন, 
=আমার কোন মেয়ে নেই। 
=আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, কিছু মনে করবেন না, এগুলো আমাদের জিজ্ঞেস করতেই হয়, আপনাদের ছেলে বা মেয়ে কি সমকামী? এজন্যই কি আপনারা গভীর আঘাত পেয়েছেন? দূর, আজকাল এটা কোন ব্যাপারই নয়। খুব স্বাভাবিক। এটা কিন্তু আত্মহত্যার ভালো কারণ নয়। যাই হোক প্লীজ আগে আপনার নাম মনে করার চেষ্টা করুন। এ আবার কি, সেলিমের স্ত্রীর নাম দুর্গাবতী? যাত্রা নাকি? কাল আবার আসব। 

লিটন পাল দুজন চিকিত্সকের সাথে ফিসফিস করে কিছু কথা বললেন। মহিমা এবং সুশান্তর ব্রেনের অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মস্তিষ্কে বড় ধরনের রক্তক্ষরণ বা ক্ষতি না হওয়ায় তাদের উন্নতি তাড়াতাড়িই হবে বলে আশা প্রকাশ করলেন চিকিৎসকরা। তবে এটি একটি শক এবং ঠিক হতে কিছুটা সময় তো নেবে। 
=একটু তাড়াতাড়ি করার চেষ্টা করুন, এরকম ফালতু কেস নিয়ে আমরা এত দিন নষ্ট করতে পারি না। 
মহিমা এবং সুশান্ত হাঁ করে এসব শুনছিলেন এবং এক একবার করে এ ওর দিকে তাকাচ্ছিলেন। কি হচ্ছে, বিন্দুবিসর্গ মাথায় ঢুকছে যাইহোক, সমকামী শব্দটি শুনে দুজনেরি নাক কুঁচকে উঠল, তা দেখে নন্দিনীর আশা হল, ওঁরা কিছু কিছু বুঝতে পারছেন, কথাটা যে অপ্রীতিকর সেটা তো বুঝতে পারলেন। লিটন পালরা বেরিয়ে যাবার পর, নন্দিনী ব্যাপারটা দুই মেডিকের নজরে আনলেন। কেস হিস্ট্রিতে নোট করে রাখল নন্দিনী।
-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments