জ্বলদর্চি

নারী দিবসের গৌরচন্দ্রিকা /ঋত্বিক ত্রিপাঠী

নারী দিবসের গৌরচন্দ্রিকা 

ঋত্বিক ত্রিপাঠী 


নারীদের নামে এই যে একটা দিন পালন —তাতেই প্রমাণ হচ্ছে এর প্রাসঙ্গিকতা। এই প্রাসঙ্গিকতা দিনদিন যে বাড়ছে — তা নিশ্চয়ই উৎসব উৎযাপনের নিয়মে না। ঘটনাক্রমেই  জরুরি হয়ে উঠছে চর্চা।

এই চর্চার মূল কারণ— নারীদের ক্ষেত্রে সমানাধিকার না-থাকা। ফলস্বরূপ বাল্য বিবাহ, নারীপাচার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ-খুন, ডাইনি অপবাদ ইত্যাদি যেন নারীর অবশ্যম্ভাবী ভাগ্যলিখন।

পুরুষদের বীরত্বকে সম্মান জানাতে, বালকদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি, পুরুষদের আদর্শ চরিত্র গড়ে তোলা ইত্যাদির লক্ষ্যে পুরুষ দিবসও আছে। ১৯০৯ সালে নিউ ইয়র্কে পালিত হয় 'জাতীয় নারী দিবস'। ১৯৭৫ সালে রাষ্টসংঘ ৮ মার্চ দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে। মূল লক্ষ্য মহিলাদের মর্যাদা ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। বাল্যবিবাহ-সহ নানা অত্যাচার বন্ধ করা, শিক্ষার অধিকার, জমি ও অন্যান্য সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ছাড়াও সবরকম বৈষম্যমূলক আচরণ পৃথিবী থেকে বিলুপ্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘ উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের সুরে সুর মিলিয়ে আমাদের দেশেও প্রচার-সর্বস্ব আয়োজন দেখি। 

কিন্তু আয়োজনের মহত্ব আর বাস্তবতার মধ্যে যে চরম বৈপরীত্য — তা সংবাদপত্রের শিরোনামগুলো প্রমাণ দেয়।  সংবাদপত্রের সীমাবদ্ধতা ও বাণিজ্যিক-স্বভাবে কতটুকুই-বা আমরা জানতে পারি! অধিকাংশই থাকে গোপন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে দেশে প্রতি বছর গড়ে ৩১,০০০ ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়। তার মানে মূল সংখ্যা অন্তত  ১০ গুণ। এক বেসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় উঠে এসেছে প্রতি বছর ১০ লক্ষেরও বেশি নারী ও শিশু পাচার হয় এ দেশে।


🍂

মর্যাদা দূরে থাক। ভ্রূণ অবস্থা থেকে লড়াই শুরু। কন্যা ভ্রূণহত্যা আজ যেন স্বাভাবিক। শিশু থেকেই নির্বাচিত হয়ে যায় তার পোশাক। শিশু মেয়েটি কিশোরী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জেনে যায় সে 'মেয়ে'। তার পোশাক, তার চালচলন, তার জীবন, তার আকাঙ্ক্ষা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে সমাজ। মজার বিষয় এই সমাজ কিন্তু গড়ে উঠেছে নারী ও পুরুষ নিয়েই। বাবামা-কে দেখেই মেয়েটি কিশোরী থেকে যুবতী হচ্ছে। সে চেতনা পাচ্ছে বাবার কাছ থেকে। মায়ের কাছ থেকেও। তখন তার 'মা' নারী থাকছে না। সমাজের প্রতিনিধি হয়েও তিনি তাঁর কন্যাসন্তানকে দিতে পারছেন না মুক্তচিন্তা। অর্থাৎ বাবামা তখন পথপ্রদর্শক না হয়ে নিছক সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে দায়দায়িত্ব পালন করেন। স্বাভাবিক কারণেই ছোটোবেলা থেকে তাঁরা তাঁর মেয়েকে অজানা অচেনা মানুষের সঙ্গে মিশতে বারণ করেন কিন্তু কোষ্ঠীবিচার করে এক অজানা পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেন। পুরুষটিও দ্বিধাহীন ভাবেই তাই গ্রহণ করেন। পুরুষের বাবামা-র মনোবাসনাও পূর্ণ হয়। এ তো বাবামায়ের সৌজন্যে সমাজ-স্বীকৃত ধর্ষণ!

এভাবেই, আজও প্রতিষ্ঠা পায়নি মন ও হৃদয়ের মর্যাদা। অধিকাংশক্ষেত্রে পরিবারের মধ্যে, আত্মীয়স্বজনের কাছেই কিশোরীরা প্রথম যৌন হেনস্থার শিকার হয়। কিশোরও। এর চাইতে ট্রাজেডি আর কী হতে পারে! সন্তানকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ না করে আমরাই করেছি লিঙ্গ বৈষম্য। নিছক নারী সংরক্ষণ আইন এনে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। চাই সঠিক চেতনা। কিন্তু কে দেবে চেতনা! গণতন্ত্রের নামে আমরা যে ভোটতন্ত্রকে একমাত্র ভেবে বসে আছি। আর মেনে নিচ্ছি ভাগ্য, নিয়তি।

নারী যেন নিছক ভোগ্যা। তাকে তার সমাজ শেখায় সব কিছু মানিয়ে নিতে। মগজধোলাই-র শিকারে অধিকাংশ মহিলা মেনে নেয় পোশাকের রীতি, চালচলন, বারব্রত ইত্যাদি। সে জীবনের অনেকটা অংশ খরচ করে রূপচর্চায়। সে স্বনির্ভর হয়েও পরাধীন। তার কী প্রেম, কী প্রতিবাদ —সবই গোপন। সে অনিচ্ছা নিয়েও জন্ম দেয় সন্তান। দিনের বেলা স্বামীর কাছে অপমানিত হয়, সন্ধ্যায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে সেই স্বামীকে প্রণাম করে আত্মতুষ্টি পায়। স্বামীর ইচ্ছাতেই তার "হ্যাঁ"। মধুসূদন দত্ত-র 'বীরাঙ্গনা' কাব্যে পাই বীর নারীদের প্রেম ও প্রতিবাদ।

এই ইচ্ছা এই সাহস এই যে বাঁচার ব্যাকরণ তা কি শুধু সাহিত্যে থাকবে! বাস্তবে কবে দেখব নারীর নিরপেক্ষতা, আত্মমর্যাদা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা। কবে আসবে সেদিন— যেদিন স্ত্রী-র অমতে স্বামী তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। স্ত্রী-র "না"-ও যে "না"— কবে প্রতিষ্ঠা পাবে! আমরা কবে আমাদের সন্তানদের শেখাব —গুড টাচ ব্যাড টাচ! সেই দিনের অপেক্ষায় — যেদিন নারীদের অসহায় অবস্থার জন্য নারী দিবস পালন যেন না করতে হয়।

আজ যখন মহাকাশে মহাশূন্যের রহস্যময় জগৎ খুঁজে বেড়াচ্ছেন সুনীতা উইলিয়ামস, তখন আমরা আমাদের মেয়েদের 'সাজুগুজু'-র পাঠ দেব! বলব : নাও ভাতা, নাও চেতনাহীন আর্থিক সাহায্য! বলব: মেধা নয়, শারীরিক সৌন্দর্য তোমার অস্ত্র! মেধা না থাকলে কাকে বলে সৌন্দর্য — তারও তো চাই যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা। আমরা বাবামা আমাদের মেয়েদের বাইরের রূপ গড়ে তুলতে যতটা পরিশ্রম করি, বাস্তবের লড়াইয়ে ততটা কি আগ্রহী হই! আমরা আমাদের ছেলেদের শেখাই না জোর করে আয়ত্ব করার বস্তু নয় নারী। নারী কেন, পৃথিবীর সবকিছুকেই অর্জন করতে হয়। আর এই অর্জনের কথাতে নারী ও পুরুষের ভূমিকা বস্তুত এক। বাবা(পুরুষ) ও মা(নারী) নিয়েই তো বাবামা। তাহলে আজও কেন পরিবারের সম্পত্তির ওপর মেয়ের  অধিকার প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে না! অবহেলিত মেয়ে পরবর্তী সময়ে যখন নিজে মা হন, তখনই-বা কেন তিনি নীরব! এরই নাম সংস্কৃতি! পরম্পরা! 

আমার ব্যক্তিগত অভিমত : পিতৃতন্ত্র ভাঙতে নারী পুরুষ উভয়ের সমান ভূমিকা আছে। সে ভূমিকা যেন ছোটবেলার রচনা লেখার ভূমিকা বা গৌরচন্দ্রিকা হয়ে না থাকে। উৎসব আয়োজনে যেন না আটকে পড়ে। গৌরচন্দ্রিকা অনেক হল, বিচার বিশ্লেষণ নিয়ে হল বিস্তর গবেষণা। উপসংহারে তো পৌঁছাতেই হবে। আমরা আধুনিক থেকে অতি-আধুনিকে যেতে চাইছি যে।

Post a Comment

1 Comments

  1. Soumen RoyMarch 10, 2025

    যথার্থ বিশ্লেষণ।আমরাই সেই অর্থে অভিভাবক হয়ে উঠতে পারিনি।আজই শুনলাম ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।বড্ড হতাশ লাগে।

    ReplyDelete