জ্বলদর্চি

একটা মেসেজ /কমলিকা ভট্টাচার্য


একটা মেসেজ
কমলিকা ভট্টাচার্য 


বাসে উঠেই রুচিতা একটা বসার জায়গা পেয়ে গেল। আজ অনেক দিন পর বাসে চড়ছে। সাধারণত সে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে। তবে আজ গাড়ি সার্ভিসিংয়ে গেছে। বাসে খুব একটা ভিড় নেই, কিন্তু সব সিট ভর্তি।

বেলা বারোটার সময়। এই সময় রাস্তাঘাট বা বাস-ট্রেন কিছুটা খালি থাকে। রুচিতা একবার বাসের অন্যান্য যাত্রীদের দিকে চোখ বুলিয়ে বাইরের দিকে তাকায়। রোজ একই রাস্তায় যাতায়াত করলেও আজ কিছু জিনিস যেন নতুন লাগছে। হয়তো বাসের উচ্চতা থেকে অনেক কিছু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, যা সাধারণত গাড়ি ড্রাইভ করার সময় নজর এড়িয়ে যায়।

বাস জায়গায় জায়গায় থামছে। দু-একজন উঠছে, নামছে। মনে হচ্ছে বাসের ভেতরে থাকা কারোই যেন কোনো তাড়া নেই। রুচিতারও তেমন কোনো তাড়া নেই। ছেলে বিদেশ থেকে আসবে। তার জন্য নিউ মার্কেট থেকে কিছু জামাকাপড় কিনতে হবে। অভিক বলেছে, শপিং সেরে চাঁদনি মেট্রো স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করতে। অফিস ফেরার পথে অভিক ওকে পিকআপ করবে।

বাস ধীরে ধীরে চলেছে। ভেতরে বেশিরভাগ লোক মোবাইলে ব্যস্ত, কেউ আবার ঝিমোচ্ছে। রুচিতাও ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখে—ছেলেরা, অভিক ,ফ্ল্যাটের অ্যাসোসিয়েশন গ্রুপ—ছাড়া আর কেউ নেই যে তাকে।মেসেজ পাঠাবে। ছেলেদেরও লেখার টাইম এখন নয়। রুচিতার কোনো বন্ধু নেই। কেই বা তাকে কী লিখবে! ফোনটা বন্ধ করে সে ব্যাগে রেখে দেয়।


🍂

সামনের সিটে বসা এক তরুণের দিকে হঠাৎ তার চোখ পড়ে। চোখাচোখি হয়ে যায়। ছেলেটি অপলক তাকিয়ে আছে রুচিতার দিকে। রুচিতা অস্বস্তি বোধ করে। বুকের উপর ওড়নাটা ঠিক করে বাইরে তাকায়। কিন্তু ছেলেটির দৃষ্টিতে যেন এক অদ্ভুত মায়া। সেই মায়া তাকে টানে। সে আবার ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি একইভাবে তাকে দেখছে।

রুচিতা অন্যদিকে মুখ ঘোরায়। এর মধ্যে দশ মিনিট কেটে গেছে। ছেলেটির লক্ষ্য সরেনি, এটা সে না দেখেও বুঝতে পারে।

বাস নিউ মার্কেটের কাছে থামে। কন্ডাক্টর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাঁক দেয়, "নিউ মার্কেট! নিউ মার্কেট!"

রুচিতা উঠে দাঁড়ায়। ছেলেটিও তার পেছনে এসে নামার জন্য দাঁড়ায়।

বাস থামার সঙ্গে সঙ্গে কন্ডাক্টর বলে, "আস্তে লেডিস।"

রুচিতা নামে। ছেলেটিও নামে। নামার সময় তার কানে একটা ফিসফিস করে বলা কথা ভেসে আসে—"আপনি খুব সুন্দর।"

সে অবাক হয়ে তাকাতে চায়, কিন্তু তার আগেই ছেলেটি উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে।

ঠিক সেই সময় ছেলেটির পকেট থেকে একটা ব্যাগ পড়ে যায়। রুচিতা ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে চিৎকার করে, "আপনার ব্যাগ! আপনার ব্যাগ!"

ছেলেটি থামে না, পিছন ফিরে তাকায়ও না। নিউ মার্কেটের ভিড়ে সে হারিয়ে যায়।

রুচিতা কী করবে বুঝতে পারে না। সেই সময় অভিকের ফোন আসে। রুচিতা ব্যাগ পাওয়ার কথা তাকে জানায়। অভিক বলে, "ব্যাগটা খুলে দেখো। বেশি টাকাপয়সা বা দরকারি কিছু থাকলে সঙ্গে রেখে দিও। বিকেলে থানায় জমা দিয়ে দেব।"

রুচিতা ব্যাগ খুলে দেখে। ভেতরে কয়েকটা কাগজ আর দশ টাকার একটা নোট ছাড়া কিছুই নেই। একটা কাগজের পিছনে একটা ফোন নম্বর লেখা।

সে একবার ভাবে, ব্যাগটা যেখানে পেয়েছে সেখানেই রেখে দেবে। কিন্তু মন সায় দেয় না। ব্যাগটাকে নিজের ব্যাগে রেখে বাজারের ভিড়ে হারিয়ে যায়।



এরপর প্রায় এক মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে ছেলে বিদেশ থেকে এসে আবার ফিরে গেছে। নানা ব্যস্ততার মাঝে কুড়িয়ে পাওয়া ব্যাগটির কথা রুচিতার মাথা থেকে হারিয়ে গেছে।

সেদিন হঠাৎ হ্যান্ডব্যাগ খালি করতে গিয়ে সেই ব্যাগটি তার হাতে পড়ে। একবার তার মনে হয়, সে কি ওই নম্বরে ফোন করবে? মনের টানাপোড়েন কাটিয়ে শেষমেশ নম্বরটিতে ফোন লাগায়। ফোন বেজে যায়, কিন্তু কেউ ধরে না।

রুচিতা অকারণেই হতাশ হয়। সারাদিনের কাজ সেরে দুপুরে বিছানায় এসে শোয়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ খুলে দেখে। জানে, এই সময়ে কারও মেসেজ আসার কথা নয়।



কিন্তু সে অবাক হয়। একটা অজানা নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে। লেখা—"আপনি খুব সুন্দর।"

সঙ্গে একটা পিডিএফ ফাইল।

কথাটা তার খুব চেনা লাগে। রুচিতার মনে পড়ে যায় সেদিন বাস থেকে নামার সময় ছেলেটি একই কথা বলেছিল।

সে তাড়াতাড়ি ফোন নম্বরটা মিলিয়ে দেখে। ঠিক তাই। সকালে যে নম্বরে ফোন করেছিল, এটাই সেই নম্বর।

রুচিতা পিডিএফটা খুলে দেখে। পায় সেদিন বাসে বসা নিজের একটি পোর্ট্রেট। অদ্ভুত সুন্দর, অবিকল ..

সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আয়নায় ধরা পড়া ছবির সঙ্গে পিডিএফের ছবিটা মেলাতে চায় .... দুজন কি  একই ...

মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে
মন হাসে ...
মোবাইলে টাইপ করে পাঠায়—"থ্যাঙ্ক ইউ, শিল্পী।"

তারপর মেসেজের পাশে দুটো ব্লু টিক।

এরপর আর কোনোদিন ওই নম্বর থেকে কোনো মেসেজ আসেনি। আর রুচিতাও ঐ নম্বরে কিছু লেখেনি।
তবে পোট্রেটটা যত্নে রেখেছে।

Post a Comment

0 Comments