সুদেব কুমার ঘোষ
ভূমিকা
আমাদের ছোটো বেলায় দেখেছি আমাদের বাড়িতে তাস খেলার আসর বসত। আমি যখন দশম শ্রেণীতে পড়ি তখনও পর্যন্ত এই আসর চালু ছিল। কাকা বাইরে তাস খেলতে যেতেন। বাবা ঘরের আসরেই বসতেন। পাড়ার আরও কয়েকজন সঙ্গী আসতেন। বাবার নিত্যদিনের সঙ্গী ছিলেন কিশোর মল্লিক। বাবা তাঁকে মল্লিক বলে ডাকতেন। আমরা তাঁকে পিসেমশাই বলে ডাকতাম। তিনি লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু বেশ কয়েকটি গুণের অধিকারী ছিলেন। কারো মুখ থেকে গল্প শুনলে এবং কেউ বই পড়লে শুনে শুনে সহজেই মনে রাখতে পারতেন। আগে কার্তিক মাসে ঘরে ঘরে রামায়ণ - মহাভারত পাঠ করা হত। পিসেমশাই তা সহজেই মনে রাখতে পারতেন। তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল খুব প্রখর। তিনি মাছ ধরতেও বেশ পটু ছিলেন। তিনি বেশ গল্প বলতে পারতেন। যেদিন কোনো কারণে তাস খেলা হতনা সেইদিন আমাদের গল্প বলতেন। সহজে বলতে চাইতেন না। কারণ পড়াশোনার ক্ষতির কথা মাথায় রাখতেন। আমরা জোরাজুরি করলে তখন বলতেন। রামায়ণ - মহাভারতের গল্প বলতেন। এছাড়াও এমন সব গল্প বলতেন যা বিশ্বাস যোগ্য নয়। যে গুলিকে বলা হয় আজগুবি গল্প। আমরা ছোটরা ওসব বিচার - বিবেচনা করতাম না। আমাদের কাছে বিচার্য বিষয় ছিল যা হোক গল্প হলেই হোল। এরকম অনেক গল্পই তিনি বলতেন। গল্পগুলি বেশ শুনতে ভালো লাগত। এখানে দুটি গল্প তুলে ধরা হল। বিশ্বাস - অবিশ্বাস পাঠককুলের বিচার্য বিষয়।
মাছ ধরার গল্প
হারিনারায়ানপুর গ্রামে নবীন কুন্ডু ছিপ দ্বারা মাছ ধরায় খুব ওস্তাদ। ইংরেজিতে যাকে বলে এক্সপার্ট। এ বিষয়ে চারিদিকে তার নাম - ডাক আছে। একবার দূরবর্তী এক গ্রামে মাছ ধরার প্রতিযোগিতার দিন ধার্য্য হল। টিকিট কেটে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। পুকুরের মালিক ঘোষালবাবু ঘোষণা করলেন যে সবচেয়ে বেশী ওজনের মাছ যিনি ধরবেন তাকে পুরস্কৃত করা হবে। পুরস্কারের মূল্য টিকিটের মূল্য অপেক্ষা বেশী। অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা সবাই মাছ ধরায় নিপুণ। বড় পুকুর। প্রায় ছোটো - খাটো দীঘির মতো। চারপাড়ে নারকেল গাছ , ছোটো ছোটো আমগাছ , লেবুগাছ , নানাধরনের ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে। পুকুরের পশ্চিম দিকে পুকুরের মালিক ঘোষাল বাবুর বাড়ি। শান বাঁধানো ঘাট। পুকুরের চারপাড় পরিষ্কার - পরিচ্ছন্ন। পুকুর এবং পুকুরের চারপাড় পরিচর্যা করার জন্য একজন মালি আছে। ঘোষাল বাবুর বাড়ির সামনেই পুকুর। একে একে মেছুনিরা এসে টিকিট কেটে নিজেদের পছন্দ মতো জায়গায় ছিপ নিয়ে টোপ ফেলে বসে পড়েছে। নবীন কুন্ডু টিকিট কেটে যুতসই একটি গাছের তলায় এসে বসল। কাঁটায় ও সুতোর উপর সুগন্ধী চারা লাগিয়ে পুকুরের মধ্যে ছুঁড়ে দিল। সবাই তার আদব - কায়দার দিকে একবার তাকাল। তারপর যে যার ছিপের ময়ূর পুচ্ছ ফাতনার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
ঘোষাল বাবু সদর বারান্দায় আরাম চেয়ারে বসে আছে। মাঝে - মধ্যে মালি এসে খবরা - খবর দিয়ে যাচ্ছে। সূর্য মধ্যাহ্ন গগনের থেকে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। আমরা পিসেমশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। গল্প শোনার সময় নাকি ' হ্যাঁ ' বা ' আচ্ছা ' বলতে হয়। আমরা ওসব কিছুই বললাম না। কেবল শুনেই যাচ্ছি। পিসেমশাই এক নাগাড়ে বলেই যাচ্ছে।
নবীন কুন্ডু জানে কোনটা ছোটো মাছ আর কোনটা বড় মাছ ছিপে লেগেছে। হটাৎ নবীন কুন্ডু ছিপ হাতে এক ঝটকা দিল। সবার দৃষ্টি তার দিকে। ঘোষাল বাবুও আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে এসেছে। নবীন বাবু চোয়াল শক্ত করে ছিপের সুতো কলের সাহায্যে গুটিয়ে নিচ্ছে। মাঝে - মধ্যে মাছ হ্যাঁচকা মেরে সুতো টেনে নিচ্ছে। নবীন বাবু একটু পিছিয়ে আসছে। মাছ যে পথে আসছে সে পথ দিয়ে বুদ - বুদ উঠছে। সবাই ভাবছে বড় মাছ গেঁথেছে। ছিপ - মেছুনীরা তো দেখছেই , তার সাথে আরো পাড়ার কয়েকজন এসে পুকুর পাড়ে ভীড় করেছে। নবীন বাবু সুতো গুটিয়ে ডাঙায় নিয়ে এসেছে। পিসেমশাই বলল " তারপর কীহল জান ? "
আমরা বললাম " কীহল ? "
পিসেমশাই চোখ বিস্ফারিত করে বলল " কাঁটায় উঠে এল মাছের বদলে এক টিন সরিষার তেল। "
আমরা বললাম " এটি কীকরে সম্ভব ? "
পিসেমশাই ঘাড় নেড়ে বলল " এই প্রশ্নই তো সবার মুখে। কিন্তু কে উত্তর দেবে ? নবীন বাবু তো হতবাক।" তিনি বললেন " আমার জীবনে এরকম ঘটনা ঘটেনি। জানিনা কীকরে এরকম ঘটনা ঘটল। "
তখন ঘোষাল মশাই পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি সামনের দিকে এগিয়ে এসে গম্ভীর মুখে বললেন " আমি পূর্বপুরুষদের মুখে শুনেছিলাম এই পুকুরের নাকি ঘানি গাছ আছে। রাত্রে যারা পুকুরে নামত তাদেরকে দু - একজনকে নাকি টেনেও নিয়েছে।"
চারিদিক নিস্তব্ধ । এর মধ্যে একজন দর্শক নীরবতা ভেঙে বললেন " আমি এক ঘটনা জানি যেখানে ছিপের কাঁটায় উঠে এসেছিল এক টিন তেল আর এক বস্তা ময়দা। " এবার নিস্তব্ধতার সাথে চাপা গুঞ্জন। " এও সম্ভব ? "
আমি বললাম " এটা হতে পারেনা। "
পিসেমশাই বললেন " জানিনা বাবা , আমিও গল্প শুনেছিলাম তাই তোমাদের বললাম । এবার বিশ্বাস - অবিশ্বাস তোমাদের উপর ছেড়ে দিলাম ।"
🍂
ময়াল সাপের গল্প
গ্রামের দক্ষিণ দিকে বহে গেছে ছোটো নদী তারাজুলি। সেই নদীর তীরে এক তাঁতির বাস। তাঁতি ঠিকই। কিন্তু তারা কেউ তাঁত বুনতে জানত না। বরং তাঁতি তারাজুলিতে মাছ ধরতেই অভ্যস্ত ছিল। মাছ ধরে বিক্রি করা তার জীবন ধারণের একটা দিক। অন্য সময় অন্যের জমিতে জন মজুর খাটত। তাঁতি বউ ঘরের কাজ - কর্ম সামলায়। তাদের পাঁচ - ছয় বছরের একটি ছেলে ছিল। সে খেলা - ধূলা নিয়ে সময় কাটাত। বাবার সাথে মাছ ধরা দেখত। বাবা মাছ ধরত আর ছেলে খালুই ধরত। তাঁতির ঘর থেকে নদীতে নামার জন্য অনেকগুলি কাঠের ধাপ ছিল। কোনটা তাল গাছের গুঁড়ি, কোনোটা বাবলা কাঠের । তবে কাঠগুলি বেশ মোটা। মাটির সাথে সেঁটে আছে। এমন কয়েকটি গুঁড়ি আছে সেগুলি যে কে দিয়েছিল তা তাঁতী বা তাঁতি বউ জানেই না। তাঁতি গুঁড়িগুলি মাঝে - মধ্যে পরিবর্তন করে। গুঁড়িগুলি এমনভাবে মাটির সাথে প্রোথিত থাকে এবং মাটির সাথে মিশে থাকে যেন মনে হয় মাটি এবং গুঁড়িগুলি একাকার হয়ে গেছে। প্রায় সব গুঁড়িগুলিকেই তাঁতি পরিবর্তন করেছে। কেবল একটির এখনও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়নি। তাঁতি ভাবে এই কাঠটি খুব শক্ত পোক্ত তাই এখনও এর ক্ষয় হয়নি। হটাৎ একদিন তাঁতির ছেলে তার বাবাকে বলল " দেখ বাবা , আমাদের ওই ধাপটি নড়ে উঠল। "
তাঁতি কৌতুহলী হয়ে শুধাল " কোন্ ধাপটি রে বাপ ? '
ছেলে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায় যে ধাপটির কখনো পরিবর্তন হয়নি সেটাকেই বোঝাচ্ছে।
তাঁতি অগ্রাহ্য করে বলল " বাপ , এটা তোর মনের ভুল। কাঠ কখনো নড়ে ? অবাক কথা বললি বেটা । " ছেলে আর কথা বাড়ায় নি। কিছুদিন পরে ছেলে আবার একই কথা বাবাকে শোনায়। তাঁতির এবার সন্দেহ হয়। সেও তক্কে তক্কে থাকে। একদিন বিষয়টি তারও নজরে আসে। সে খুব চিন্তায় পড়ে যায়। পাশের গ্রামের একজন গুনীনকে বিষয়টি জানায়। গুনীন সব শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে।
বলে " তাহলে তো দেখতে হয়। "
গুনীন দেরী না করে পরের দিনই দেখতে চলে আসে।
দেখার জন্য গ্রামের লোক ভেঙে পড়ে। মধু গুনীনের নাম সবাই জানে। সে যখন এসেছে কিছুনা কিছু ঘটনা ঘটবে। তাই সবাই উৎসুক হয়ে দেখতে আসে।
পিসেমশাই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল " বল দিকি বাবা , কী হতে পারে ? "
আমি বললাম " কাঠই হবে। "
দাদা বলল " কাঠ মনে হয় জীবন দান পেয়েছে। "
" তাহলে শোনো। মধু গুনিন কী বলল " এই বলে পিষেমশাই আবার পূর্বের মেজাজে বলতে লাগল। মধু গুনিন সব দেখে শুনে বলল " এ কাঠ নয়। "
সবাই নিস্তব্ধ। মধু গুনিন তাঁতির দিকে তাকিয়ে বলল " তোমরা এতদিন এই ধাপটিকে কাঠ ভাবছ। এটি তা নয়। এটি একটি ময়াল সাপের লেজের দিক।"
আমার এবং দাদার চক্ষু ছানাবড়া। পিসেমশাই আমাদের দিকে একবার তাকিয়ে লণ্ঠনের আলোয় বিড়ি ধরিয়ে টান দিয়ে আবার বলতে শুরু করল।
জনগণের মধ্যে চাপা গুঞ্জন। মধু গুনিন আবার বলতে শুরু করল " এর মুখ একদিকে , লেজ অন্যদিকে। মুখ নিশ্চয় কোথাও মাটির উপরে নির্জন জায়গায় আছে। সেখানে যা খাবার জুটে খায়। এখন নিশ্চয় তার খাবারের অভাব হচ্ছে। তাই ঘন ঘন লেজের দিকটি নাড়ছে।"
জনগণের মধ্যে একজন বয়স্ক লোক " জিজ্ঞেস করল " তাহলে এখন উপায় ? "
" উপায় আছে " মধু গুনিন বলল । " প্রথমে এর মুখটি খুঁজে বের করতে হবে। খুব সম্ভবত ও ক্ষুধার্ত। একবার বের হলে মাঠের গরু ছাগল যা পাবে সাবাড় করে দেবে। গ্রামের মধ্যেও ঢুকে পড়তে পারে। ওর মুখ খুঁজে মুখে খাবার ছুঁড়ে ফেলতে হবে। আকণ্ঠ পর্যন্ত খাবার দিতে হবে। তখনই ও শান্ত হয়ে শুয়ে পড়বে।"
আবার সবার মধ্যে চাপা গুঞ্জন। আমিও একটু ভয় পেয়ে গেলাম।
সকলে জিজ্ঞাসা করল " কী খাবার দিতে হবে ? "
মধু গুনিন চিন্তিত হয়ে বলল " সেটাই তো ভাববার বিষয়। ছোটো ছোটো ছাগল খাওয়া ওর কাছে কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এত ছাগল তো জোগাড় করা সহজ কাজ নয়। আর ছোটো ছোটো ছাগল দেবেই বা কে ? "
একটু থেমে সে আবার বলল " এক কাজ করা যেতে পারে। চিঁড়া ভিজিয়ে মাটির মাটিতে রেখে ওর মুখে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে হবে। কম করে দু মণ চিঁড়া তো লাগবেই। "
শুনে সবাই তাজ্জব ! কিন্তু উপায় নেই। তাই সবাই চিঁড়া জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে লাগল। বিকেলে গ্রাম বাসীরা দু মণ চিঁড়া জোগাড় করে তাকে খাওয়াতে লাগল। আকণ্ঠ খেয়ে সে নিস্তেজ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর গ্রামবাসীরা বন দপ্তরে খবর দিয়েছিল।
0 Comments