জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোক গল্প— ২৩২ মরক্কো (আফ্রিকা)এক রাজার তিন কন্যা /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 

দূর দেশের লোক গল্প— ২৩২
মরক্কো (আফ্রিকা)
এক রাজার তিন কন্যা
চিন্ময় দাশ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। সে দেশের রাজার (মরক্কোয় রাজাকে সুলতান বলা হয়) ছেলে নাই। তবে, ছেলে নাই, তো কী হয়েছে? মেয়ে আছে রাজার। তাও আবার একটি-দুটি নয়। তিন-তিনটে মেয়ে রাজার।
মেয়ে তিনটি। কিন্তু রাজামশাইর বেশি পছন্দ ছোট মেয়েটিকে। মুখের কথা খসতে পায় না সে মেয়ের। সব আবদার পূরণ হয়ে যায় তার। মূহুর্ত দেরি করেন না রাজা। 
তাতে বড় বোন দুটির ভারি হিংসে হয়। বাবা কেন ওকে বেশি ভালবাসবে? ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে মরে দুটিতে। আর, নানাভাবে জ্বালিয়ে মারে ছোট বোনটাকে। 
রাজামশাইও সব দেখতে পান, বুঝতে পারেন। কষ্টও হয় মনে। একদিন ছোট মেয়ে বলল—এভাবে আর পারি না আমি। আমাকে আলাদা একটা বাড়ি করে দাও, বাবা। একটু শান্তিতে থাকব সেখানে।
ছোট মেয়ের দাবি বলে কথা। দেরি হোল না। সাত তাড়াতাড়ি একটা প্রাসাদ গড়ে দেওয়া হোল। দাস-দাসী, লোক-লস্কর, বাবুর্চি-খানসামা—সবাইকে নিয়ে গমগম করে উঠল নতুন প্রাসাদ। নতুন বাড়িতে উঠে যাবার বেলায়, মেয়ে বাবাকে বলে গেল—দেখো বাবা। কেউ যেন আমাকে গিয়ে বিরক্ত না করে। একাই শান্তিতে থাকব আমি। 
দিন যায়। মেয়েটি সুন্দরী হয়ে ওঠে। আরও দিন যায়। আরও সুন্দরী হয়ে ওঠে সে মেয়ে। 
ছোট রাজকুমারী ভারি সুন্দরী হয়ে উঠেছে। সে খবর ছড়ায় কাকের মুখেও। রাজবাড়ির লোকেরা শোনে। রাজধানির লোকেরাও। তার পর শোনে গোটা রাজ্য। এমন ছড়াল সে খবর, উতলা হয়ে উঠল অন্য রাজ্যের রাজকুমারের দলও।
এক রাজকুমার করল কী, বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে চিঠি পাঠাল ছোট মেয়েটিকে। ছোট গা করল না তাতে। আবার চিঠি এলো। আবারও তাই। 
আবারও এলো চিঠি। মেয়ে ভাবল—না, ধৈর্য আছে এ ছেলের। ভেবে দেখতে হবে। 
তবে, এককথায় রাজি হোল না। আজ এই শর্ত, কাল আর এক শর্ত চাপাতে লাগল। সবই পূরণ করছে রাজকুমার। তবু প্রকাশ্যে একটি বার দেখা করতে রাজি হচ্ছে না মেয়ে। 
সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। ছোট মেয়ের বাড়িতে একটা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ফেলল রাজকুমার। একদিন রাতের বেলায় সোজা মেয়েটির সামনে এসে হাজির হয়ে গেল সে। নতুন বাড়িতে একা একা থাকে মেয়ে। এমন সুদর্শন এক যুবক দেখে, ভারি ভালো লেগে গেল তার। সে আর আপত্তি করল না।
নিয়মিত দেখা হয় দুজনের। গল্পগুজব, হাসিঠাট্টা চলে দুজনের। কিন্তু কথা কি আর চাপা থাকে? ক’দিন না যেতেই, খবর পৌঁছে গেল দুই বড়বোনের কানে। ঈর্ষায় জ্বলতে লাগল দুজনে। একদিন রাজাকে গিয়ে বলল—বাবা, আমরা একবার ও বাড়িতে যাব। কতোদিন দেখিনি আদরের বোনটিকে। 
রাজামশাই তাদের ছলনা ধরতে পারলেন না। তবে, অনুমতিও দিলেন না। দুজনে তখন একটা লম্বা চিঠি পাঠাল বোনকে। কতদিন দেখিনি তোকে। সেই থেকে মন ভারি খারাপ আমাদের। দু’-চার দিন গিয়ে একসাথে থাকার ইচ্ছে। 

দু’-চার দিনে কী আর এমন যাবে আসবে? ছোট রাজি হয়ে গেল। বোনেরাও এসে গেল নতুন বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়া, গান-গল্প-খুনসুটি তিনজনের। রঙ বদলে গেছে নতুন বাড়ির। 
কিন্তু বড়বোনেরা তো তক্কে তক্কে ছিল। সুড়ঙ্গের হদিশ তারা ঠিক জেনে ফেলেছে। সেদিন রাতের খাওয়া সারা হয়ে গেছে।  দিদিরা বলল—বাইরে চাঁদের কী ফিনফিনে আলো। চল, বোন। বাগানে বসে গল্প করি।
তিনজনে গিয়ে বাগানে বসেছে। গল্প করছে। এক সময় বড় বোন বলল—পেটটা কেমন যেন মোচড় দিচ্ছে। একটু গড়িয়ে আসি বিছানায়। 
যেতে যেতে বলল—তোরাও আবার চলে আসিস না যেন। আমি ফিরে আসব। কতদিন এভাবে বাগানে বসা হয়নি সবাই মিলে। 
বড়মেয়ে ফিরেই, সোজা সুড়ঙ্গের আড়ালে গিয়ে হাজির। একটা কোণে লুকিয়ে বসে রইল। সুড়ঙ্গটা ছিল কাঁচ দিয়ে মোড়া। ঠিক সময়ে রাজকুমার ঢুকেছে সুড়ঙ্গ ধরে। যখন কাছাকছি এসে পড়েছে, দুম করে একটা পাথর ছুঁড়ে দিয়েছে বড় মেয়েটা। 
আর যায় কোথায়। কাঁচ তো ভেঙে চৌচির। কয়েকটা টুকরো ছিটকে রাজকুমারের চোখে গেঁথে গিয়েছে। আর সামনের দিকে নয়। যন্ত্রনায় ককাতে ককাতে বেরিয়ে বাইরে পালিয়ে গেল বেচারা।
ছেলেটার আর্তনাদ শুনে, বড়বোনের তো আনন্দ ধরে না। সেও বাগানে গিয়ে বোনেদের সাথে বসে পড়ল। 
রাত বেড়ে যাচ্ছে। রাজকুমার নিশ্চয় এসে বসে আছে তার জন্য। ছোট বোন বলল—রাত হয়েছে। চলো, এবার ফিরে যাই। 
ঘরে ফিরে, কোথাও দেখা নাই রাজকুমারের। চোখে ঘুম আসছে না। কতক্ষণ জেগে বসে রইল মেয়েটা। ভোরের আলো ফুটে উঠছে তখন। মেয়ে ভাবল, একবার সুড়ঙ্গটা ঘুরে দেখে আসি।
বেশি এগোতে হোল না, দৃশ্য দেখে চোখ ছানাবড়া। ভাঙা কাঁচ ছড়িয়ে আছে চারদিকে। কয়েক ফোঁটা লাল রক্তও ফুটে আছে মেঝেতে। 
এ নিশ্চয় বড়দিদির কাজ। কিছু একটা ঘটিয়ে বসেছে। এজন্যই মিথ্যে অজুহাত দিয়ে, উঠে এসেছিল বাগান থেকে।
রাগে আগুন জ্বলে উঠল মাথায়। মোকাবিলা একটা করতেই হবে। এই ভেবে, দিদিদের মহলে গিয়ে হাজির হোল। কিন্তু সব ভোঁ-ভোঁ। পাখি উড়ে গিয়েছে আগেই। ভোর হবার আগেই বেরিয়ে গিয়েছে দু’জনে। ছোট বুঝতে পারল, সময় যতই গড়িয়ে যাক, কিংবা যত বড়ই হোক দূরত্ব, ঈর্ষা কখনও মরে না!
প্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল ছোট। রাজকুমারের কোন খোঁজ পাওয়া যায় কি না, দেখা দরকার। কিছু দূর গিয়ে এক ভিখারিনীর সাথে দেখা। তাকে বাড়িতে ডেকে আনল ছোট। একটা গোপন কুঠরি ছিল নিজের। সেখানে ভিখারিনীর সাথে পোষাক বদল করে ফেলল ছোট। ভিখারিনীটিকে ঘরে রেখে, বাইরে বেরোল নিজে। 
সারাদিন পথ চলবার পর, সন্ধ্যা নেমে এল। একটা গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়ল মেয়েটি। রাত্রি তখন অনেক। গাছের ডালে বাসা ছিল দুটো ঘুঘুপাখির। তাদের কথায় ঘুম ভেঙে গেল তার।
একটা ঘুঘু বলছে-- আহারে, রাজার মেয়ে হয়েও, কী দুর্দশা বেচারীর। 
অন্যজন বলল—দুর্দশা তো হবারই কথা গো। নিজের বোনেরা যার শত্তুর, তার কি আর সুখ আছে জীবনে? 
--বোনের সাথে শত্রুতা তোদের। তাহলে, অন্য দেশের ছেলের চোখটা গেলে দিলি কোন আক্কেলে? 
ছোট মেয়ে তো আঁতকে উঠেছে শুনে। তার অনুমানই সত্যি তাহলে। সুড়ঙ্গের রক্ত তাহলে রাজকুমারের চোখ থেকেই পড়েছে। হায়, হায়! আমার জন্য চোখ খোয়াতে হয়েছে একজনকে! কী উপায় হবে এখন? 
কাঁদতে কাঁদতে পাখিদুটোকে বলল—দোহাই তোমাদের। তোমরা তো সবই জানো, দেখছি। তাহলে কী করে তার চোখ সারিয়ে তোলা যায়, উপায় বলে দাও আমাকে। 
পাখিরা কী জবাব দেবে? চুপ করে আছে। মেয়ে বলল—তার চোখের জন্য, আমার নিজের দুটো চোখও আমি দিতে পারি। তোমরা কেবল উপায় বলে দাও আমার। 
মেয়েটার কথায় বেশ খুশি হল পাখিরা। নিজের চোখ তুলে দান করে দিতে পাবে। এ মেয়ে নিশ্চয় খুবই ভালো মনের। তারা বলল—উতলা হয়ো না গো, মেয়ে। কিছু একটা ব্যবস্থা আমরাই করে দেব। এখন অনেক রাত। ঘুমিয়ে পড়ো। সকাল হলে উপায় বলে দেব।
সকাল হলে, পাখিরা উড়ে যেতে পারে। জেগেই রইল রাজার মেয়ে। সকালে জিজ্ঞেস করল—দোহাই তোমাদের। উপায়টা বলে দাও। বলো, আমার চোখ দুটো দিলেও কি, ছেলেটার চোখ সেরে উঠবে? 
পাখিরা বলল-- নাগো মেয়ে, তোমার চোখ দিতে হবে না। অন্য একটা উপায় বাতলে দিচ্ছি তোমাকে। চোখ সেরে উঠবে রাজার ছেলের। 
--বলো, বলো। কী উপায় আছে আর?
--আমাদের ডানা থেকে দুটো পালক দিচ্ছি তোমাকে। পুড়িয়ে ফেলবে পালক দুটো। পাখিরা বুঝিয়ে দিল—সেই ছাই যদি রাজকুমারের চোখে বুলিয়ে দিতে পারো, তাহলেই সেরে উঠবে রাজকুমার।
ভিখারিনীর পোষাকই গায়ে তখনও। সেভাবেই চলতে চলতে একদিন পাশের রাজ্যে গিয়ে হাজির হয়েছে মেয়ে। সোজা বাজবাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছে সে। কিন্তু ভেতরে যাবে কী করে? দেউড়ির সেপাইরা তাকে আটকে দিয়েছে। একজন ভিখারিনীকে কি আর দরবারে ঢোকানো যায়? 
মেয়ে নিজের পরিচয় দিল না। বলল—চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে রাজামশাইর ছেলের। আমি সারিয়ে দেব সে চোখ। সেজন্যই এসেছি। 
সারা রাজবাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল সে খবর শুনে। রাজার সামনে হাজির হয়ে, মেয়েটি বলল—রাজামশাই, আমাকে একবার রাজকুমারের কাছে নিয়ে চলুন। কথা দিচ্ছি, রাজকুমার সেরে উঠবে। একেবারে সেরে উঠবে। 
রাজ্যের যত কবরেজ বদ্যি ঘিরে বস আছে বিছানার চার পাশে। হাজারো জড়িবুটি, রেকাবি ভরা হাজারো ওষুধপত্তর সাজানো। কিন্তু রাজকুমারের চোখ সারবার কোন উপায়ই হয়নি।
ভিড় ঠেলে একজন ভিখারিনী ঢুকে পড়েছে রাজকুমারের বিছানার পাশে। তাদের কারও পছন্দ নয় ব্যাপারটা, চোখ মুখ দেখে বোঝা গেল। মেয়েটা কোন দিকে তাকালো না। বিছানার কাছে গিয়ে পৌঁছে গেল।
আহারে, কদিনেই মলিন হয়ে গেছে রাজকুমারের শরীর। তার জন্যই এই দুরবস্থা, ভেবে খুব কষ্ট হতে লাগল মেয়ের। গরম জল আনা হয়েছে। ভালো করে চোখ দুটো ধুইয়ে দিল মেয়ে।
কৌটো করে পালক পোড়ানো ছাই এনেছিল রাজার মেয়ে। পুরু করে মাখিয়ে দিল রাজকুমারের দু’চোখে। বলল—রাজামশাই, আমি এখন থাকব এখানে। বিকেল পর্যন্ত। কেউ যাতে আমার ওষুধের প্রলেপ না তুলে দেয়।
রাজা বললেন—অবশ্যই থাকবে। আমিও থাকছি তোমার সাথে। 
দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে গেল। যত্ন করে ছাইমাখা চোখ সাফ করল মেয়ে। রাজকুমারকে বলল—এবার চোখ খোল তুমি।
চোখ খুলল রাজকুমার। আবার দেখতে পেল সব কিছু। আগের মতই পরিষ্কার। চোখে আর যাতনা নাই কোনও। 
ছেলের চোখ সেরে গিয়েছে। খুশির বন্যা বয়ে গেল রাজবাড়িতে। প্রচুর পুরষ্কার দিতে চাইলেন রাজা। ভিখারিনী ফিরিয়ে দিল—সবই তো খুদাতালার দোয়া, হুজুর। পুরষ্কার আমার চাই না। অনেক দূর যেতে হবে। বরং একটা গাড়ি দেওয়া হোক আমাকে। 
এক রাজার গাড়ি চড়ে, আর এক রাজকন্যা ফিরে এল নিজের বাড়িতে। এসেই বাবুর্চিকে ডেকে পাঠাল। বলল—একেবারে আমার মাপের, একেবারে আমার মতো দেখতে হবে—এমন একটা কেক বানিয়ে ফেলো তাড়াতাড়ি। দেরি কোর না। খুব জরুরী। 
দেখতে দেখতে রাত নেমে এলো। বাবুর্চি কেক বানিয়ে এনেছে। যত্ন করে বিছানায় রেখে দেওয়া হোল কেকটা। কাপড় ঢেকে দেওয়া হোল গলা পর্যন্ত। কেবল মুখখানাই খোলা। চোখ পড়লেই মনে হবে, ছোট রাজকুমারি শুয়ে আছে তার বিছানায়।
রাত গভীর হয়েছে। রাগে ফুঁসতে ফুসতে সুড়ঙ্গপথ ধরে, একেবারে শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে রাজকুমার। তার তো ধারণা, ছোট রাজকুমারীই তার উপর আক্রমণ করেছিল। আজ তার বদলা নিয়েই ছাড়বে।
দরজা খোলাই ছিল।রাজকুমার ঢুকে পড়েছে ভিতরে। বিছানায় শুয়ে আছে রাজকুমারি। মুখখানি ঘুমে নিথর। ভয়ানক ক্রোধে, তলোয়ারের এক কোপ বসিয়ে দিয়েছে গলায়। 
কিন্তু কোথায় রক্ত!  এক দলা ক্রিম ছিটকে এসে লেগেছে রাজকুমারের চোখে মুখে। রাজকুমারি নিজে লুকিয়ে ছিল দরজার আড়ালে। খিল-খিল হাসিতে ঘর ভরিয়ে, রাজকুমারের সামনে বেরিয়ে এসেছে মেয়েটি। তখন? তখন আর কী? থতমত খেয়ে গিয়েছে বেচারা। 
ঢাক ঢোল পিটিয়ে ঘোষণা করে দেওয়া হোল রাজ্য জুড়ে। সাত দিন বাদে, ছোট রাজকুমারির বিয়ে। 
একটা কাজ অবশ্য করেছিলেন রাজামশাই। বিয়েটা পর্যন্ত সাত দিন, নিজের কুচুটে বড় মেয়ে দুটোকে ঘরে শেকল তুলে, আটকে রেখে দিয়েছিলেন। নইলে, কখন আবার কী বাধিয়ে বসে, তার তো কিছু ঠিক নাই কি না!
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল দুজনের। সুখে শান্তিতেই জীবন কাটতে লাগল দুজনের। 
আর, বড় বোন দুটি? না গো, সে খবর জানা নাই। তাদের খবর নিতে ইচ্ছে করেনি আমাদের।

Post a Comment

0 Comments