জ্বলদর্চি

রাসবিহারী মিশ্র (স্বাধীনতা সংগ্রামী, তমলুক)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৪৮
রাসবিহারী মিশ্র (স্বাধীনতা সংগ্রামী, তমলুক) 

ভাস্করব্রত পতি

দিনটা ছিল ১৯৪২ এর ৭ ই সেপ্টেম্বর। বিকেলবেলা। দনিপুরের যুবক অমূল্য বেরা সহ কয়েকজন যুবক ঝাঁপ দিলেন রূপনারায়ণ নদীতে। আটকে দিলেন চালবোঝাই কয়েকটি চলমান নৌকোকে। সারারাত ধরে সেই নৌকাগুলো আটকে রেখে পাহারায় থাকলো অনেকে। চালকল মালিকরা তা জানতে পেরে মহিষাদল থানায় খবর দেয়। পরের দিন ৮ ই সেপ্টেম্বর। দনিপুরে এলেন মহিষাদল থানার পুলিশ সুধীর সরকার। সঙ্গে বেশকিছু সশস্ত্র পুলিশ। ইতিমধ্যে স্থানীয় মহিলারা শাঁখ বাজিয়ে পাশাপাশি গ্রামবাসীদের সেখানে ডেকে আনে। হাজির হয় হাজার হাজার মহিলা ও পুরুষ। শুরু হয় 'বন্দেমাতরম্' ধ্বনি দেওয়া। 
রাসবিহারী মিশ্র রচনা সমগ্র

এগিয়ে চলছে মিছিল। লক্ষ্য মিলগেট। আসলে ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কিছু আগেই মেদিনীপুরের কংগ্রেস নেতৃত্ব ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, জেলায় খাদ্যাভাবের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাই এমতবস্থায় জেলা থেকে ধান চাল যেন বাইরে কোথাও রপ্তানি না করা হয়। কিন্তু ব্রিটিশরা এ বিষয়ে উদাসীনতা দেখায়। বরং জেলা থেকে রূপনারায়ণ নদীর দুপাশের বেশিরভাগ চালকল থেকে এজেন্টের মাধ্যমে হাজার হাজার মন চাল অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছিল। ফলে জেলাতে একটা খাদ্য সমস্যা তৈরি হচ্ছিল। দায়িত্বে ছিল সৈন্যদের খাদ্য যোগানদার এজেন্ট ইস্পাহানী কোম্পানি। 
 
চালকল মালিকদের এই অন্যায় বরদাস্ত করেননি মেদিনীপুরের যুবকরা। এর প্রতিবাদে ১৯৪২ এর ৭ ই সেপ্টেম্বর মহিষাদলের দনিপুর এলাকার যুবকরা অগ্রনী ভূমিকা নেন। নেতৃত্বে ছিলেন রাসবিহারী মিশ্র, গুরুচরণ অধিকারী, গোবিন্দ মাইতি, বেণু মহাপাত্র, ধীরেন জানা, অমূল্য বেরা, ঈশ্বর মাইতি প্রমুখেরা। তাঁরা ঐ এলাকার চালকল মালিকদের কাছে মিলিটারী সরবরাহকারী এজেন্ট ইস্পাহানী কোম্পানীকে বেশী দামে চাল বিক্রির পরিবর্তে এলাকার সাধারণ মানুষদের কাছে প্রকৃত মূল্যে চাল বিক্রি করতে দাবিসনদ পেশ করে। কিন্তু চালকল মালিকরা তা মেনে নেয়নি। ফলে শুরু হয় তুমুল বিরোধিতা। দনিপুরের ঐ যুবকরা সিদ্ধান্ত নেয় কোনওভাবেই দনিপুর থেকে বাইরে চাল রপ্তানি করতে দেওয়া হবেনা। 

দনিপুরের বুকে মিছিল ক্রমশঃ দৃপ্ত হচ্ছে। সকলের দাবি, জেলার বাসিন্দাদের পেটের ভাত মেরে অন্যদের জন্য চাল দেওয়া চলবেনা। উন্মত্ত জনতাকে থামাতে না পেরে শঙ্কিত পুলিশ শুরু করে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তিনজনের। সেদিন মেদিনীপুর জেলার ভারত ছাড়ো আন্দোলনের প্রথম শহীদ এই তিন যুবক -- বাড় অমৃতবেড়িয়ার সুরেন্দ্রনাথ কর (৪৫), শশীভূষণ মান্না (১৮) এবং টিকারামপুরের ধীরেন্দ্র নাথ দীগার (৩০)। আহত হলেন আরও বেশ কয়েকজন। এই ঘটনার বিবরণে রাসবিহারী মিশ্র লিখেছিলেন, 'রাস্তার উপর তিনটি মৃতদেহ পড়ে থাকে, ছত্রভঙ্গ মিছিল বেশ কিছুটা দূরে অপেক্ষা করছে। এই ঘটনার পর মহিষাদল কংগ্রেস অফিসে সংবাদ যাওয়া মাত্র প্রায় চল্লিশজন কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক উপস্থিত হয়। ইতিমধ্যে তমলুকের তৃতীয় অফিসার অপূর্ব ঘোষ প্রায় চল্লিশজন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তিনটি মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুনরায় কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক সহ জনতা পুলিশ অফিসারের কাছে দাবী রাখে চাল রপ্তানী বন্ধ করতে হবে এবং মৃতদেহগুলি আমাদের হাতে দিতে হবে। তীব্র বাদানুবাদের পর স্থির হয় মৃতদেহগুলি ময়না তদন্তের পর মৃতের আত্মীয়দের হাতে দেওয়া হবে, কিন্তু পুলিশ সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নাই। ময়না তদন্তের পর পুলিশ রাতের অন্ধকারে নদীতে ফেলে দেয়। ....... এই অঞ্চলের মানুষদের উৎসাহ, উদ্দিপনা ও সাহস বৃদ্ধি পায়। মেদিনীপুর জেলায় আগষ্ট বিপ্লবের প্রথম রক্তস্নান এই দনিপুরে। শান্তিকামী মানুষের উপর পুলিশের নির্বিচারে গুলি চালনার নির্লজ্জ আক্রমণ সেদিন মেদিনীপুর জেলাবাসীদের মনে তিন শহীদের রক্তে প্রতিশোধের আগুন সারা জেলাকে পথ দেখানো-তার পরিণতি তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার'।

ঘটনার পরেই তমলুক থেকে পুলিশ অফিসার অপূর্ব ঘোষ এলেন ঘটনাস্থলে। সঙ্গে প্রায় ৪০ জন সশস্ত্র পুলিশ। কিন্তু মৃতদেহ তিনটি পরিবারের হাতে না দিয়ে পোস্টমর্টেম করতে তমলুকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু উত্তেজিত জনতার বাধায় অপূর্ব ঘোষ জানান, পোস্টমর্টেমের পর মৃতদেহগুলি তাঁদের আত্মীয়দের হাতে তুলে দেওয়া হবে। অথচ পরবর্তীতে তা হয়নি। রাতের অন্ধকারে সেই মৃতদেহগুলিকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় পুলিশ। বরং সেখানকার ৪০০ জন গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে এসে চালকলের মাঠে আটকে রাখে জেলাশাসক এম. এন. খান। গ্রেপ্তার করা হয় অমূল্য বেরা, হরিপদ ভৌমিক, রসিক পাল সহ মোট ১৩ জনকে। কিন্তু সেদিন পুলিশ ধরতে পারেনি রাসবিহারী মিশ্রকে। 
রাসবিহারী মিশ্রের সাথে আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক জয়দীপ পণ্ডা

১৯২২ এর ২রা সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন মহিষাদলের বাড় অমৃতবেড়িয়া গ্রামে। পিতা সতীপ্রসাদ মিশ্র ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। বাবা চেয়েছিলেন ছেলে উচ্চশিক্ষিত হয়ে শিক্ষক হয়ে উঠুক। বাড় অমৃতবেড়িয়া মাইনর স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর কল্যাণচক্ হাইস্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। এই বিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি নেমে পড়েন সমাজের কাজে। সেসময় অস্পৃশ্যতা, নিম্নশ্রেণীর প্রতি বৈষম্য ছিল সমাজের অভ্যন্তরে। সেসব দূর করতে গুরুচরণ অধিকারী, বেণু মহাপাত্র এবং রাসবিহারী মিশ্র মিলে গঠন করেন 'মিলনী' নামে একটি সমাজ সেবামূলক সংগঠন। জাতপাতের বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই সেসময় খুব প্রভাব ফেলেছিল সমাজে। 

১৯৪২ এর ১৬ ই অক্টোবর মেদিনীপুর জেলার কাঁথি এবং তমলুক মহকুমায় ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় সেসময়। তখন মেদিনীপুরবাসীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এই রাসবিহারী মিশ্র। তমলুকে গঠিত হয়েছিল 'মহেন্দ্র রিলিফ কমিটি'। সেই কমিটির মেডিকেল ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন রাসবিহারী মিশ্র। রাতের পর রাত জেগে দুর্গত মানুষদের সহায়তায় তিনি ছিলেন নির্লিপ্ত সৈনিক। 

১৯৪৫ সালে তিনি রেভলিউশনারী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন সৌমেন ঠাকুর, নেপাল মজুমদার, পান্নালাল দাসগুপ্তদের আহ্বানে। তবে ১৯৫০ সালে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে থাকাকালীন আরসিপিআই ছেড়ে সিপিআই দলে যোগদান করেন। ধীরে ধীরে তিনি বিশ্বনাথ মুখার্জী, গীতা মুখার্জী, বিমলা মাঝি, বংশী সামন্ত, ভূপাল পাণ্ডা, সরোজ রায়, সুকুমার সেনগুপ্ত, ববি মিত্র, পতিত জানা, অনন্ত মাজী, দেবেন দাস প্রমুখ বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সান্নিধ্যে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দিতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে বিয়ে করেন গোলাপরাণীকে। তিন পুত্র এবং তিন কন্যাকে নিয়ে সংসার।

স্বাধীনতার পর এ আই টি ইউ সি'র সম্পাদক হন রাসবিহারী মিশ্র। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ১৬ ই নভেম্বর হরিজনেরা তমলুক পৌরসভায় ধর্মঘট ডাকে নিজেদের নানা দাবী পূরণের জন্য। কিন্তু এই ধর্মঘট বেআইনি ঘোষিত হয়। এরফলে রাসবিহারী মিশ্রের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয়। কিন্তু কয়েকদিন পর পৌরসভা কতৃপক্ষ অবশ্য আন্দোলনকারীদের যাবতীয় দাবী মেনে নিতে বাধ্য হয়। এই বছরের শেষদিকে তাঁর প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে মার্কসবাদী সাহিত্য বিক্রয় কেন্দ্র 'প্রগতি পাঠাগার'। কিন্তু ১৯৪৯ এর জানুয়ারি মাসে পুলিশ ঐ পাঠাগারে চাবিতালা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়। 

১৯৭৮ এ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে অমৃতবেড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েতে সিপিআই দলের হয়ে পঞ্চায়েত সমিতির আসনে জয়লাভ করেন। মহিষাদল পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ পদে আসীন হন। অমৃতবেড়িয়া ইউথ লাইব্রেরি তাঁর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। এই অমৃতবেড়িয়া অঞ্চলে প্রথম জনতা কো অপারেটিভ এগ্রিকালচারাল সোসাইটি লিমিটেড গঠনের পুরোধা পুরুষ ছিলেন তিনি। ১৯৬৫ সাল থেকে সাক্ষরতা আন্দোলনের সাথেও যুক্ত ছিলেন রাসবিহারী মিশ্র। আশি নব্বই দশকে মেদিনীপুর জেলার সাক্ষরতা আন্দোলনের একজন অনন্য যোদ্ধা হিসেবে ছিলেন এই মানুষটি। পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতির উদ্যোগে ১৯৬৯ এর ৮ ই সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে কলকাতার এক মিছিলে নিজের পরিবারের লোকজন সহ পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন সেসময়। আসলে তিনি নিজে যেটা বিশ্বাস করতেন এবং চাইতেন, তা অন্যদের মধ্যেও সঞ্চারিত করতে উৎসুক ছিলেন। 

আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক জয়দীপ পণ্ডা পরিচিত ছিলেন এই মানুষটির সাথে। জীবনের অনেকটা সময় সান্নিধ্য পেয়েছিলেন 'মুক্তি পথের অগ্রদূত' এই স্বাধীনতা সংগ্রামী রাসবিহারী মিশ্রের সাথে। তিনি তাঁর উপলব্ধিতে লিখেছেন, 'রাসবিহারীবাবু চল্লিশের দশকেই জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতায় মোহভঙ্গ হয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পথ ধরলেন এবং সেই থেকে আজও তিনি আপোসহীনভাবে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে চলেছেন। শুধু তাই নয় তিনি লড়াই চালিয়ে ছিলেন ধর্মীয় মৌলবাদ, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এইভাবে জাতীয় আন্দোলন থেকে বামপন্থী আন্দোলন, কৃষক শ্রমিক আন্দোলনের পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচী রূপায়ণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর ছিল সহজ ও সাবলীল বিচরণ'।

২০০৭ এর ৯ ই জুলাই বিকেল ৪:৩০ মিনিটে তমলুক জেলা হাসপাতালে মৃত্যু হয় এই মহান মানুষটির। কিন্তু তিনি বিজ্ঞানের গবেষণার কাজে মরণোত্তর দেহদানে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। ফলে কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের হাসপাতালের এ্যানাটমী বিভাগে মরদেহ দান করে দেওয়া হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। 
বিশেষ কৃতজ্ঞতা -- জয়দীপ পণ্ডা, ইতিহাস গবেষক, তমলুক

🍂

Post a Comment

0 Comments