মেমারি গেম। পর্ব ১
আজ ছিল ক্রিসমাস। সুশান্ত মোটেই খ্রিস্টান নন। প্রকৃতপক্ষে তিনি মুসলিম বা বৌদ্ধও নন, তাও বা শিন্টোর অনুসারী নন, হিন্দুও নন। এই প্রবীণ বয়সে এসেও তিনি নিজের বিশ্বাস আজও খুঁজে পাননি, তাই অধার্মিক হয়েই রয়ে গেলেন চিরকাল। কিন্তু আজ ছিল ক্রিসমাস। একদা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর এই উদ্ভ্রান্ত, যানজটিল বিশৃঙ্খল কলকাতা শহরে সবাই কিন্তু বড়দিন খুব ভালোবাসে । এদিন বাজারের কোণায় কোণায় দোকানগুলো সেজে ওঠে শুকনো শুকনো ক্রিসমাস ফ্রুট এবং প্লামকেকের বাক্সে । কিন্তু দাম বড্ড বেশি। অন্তত সুশান্তের ধরাছোঁয়ার প্রায় বাইরে। প্রথমে তাই সস্তা মাছের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। মাছওলা ও উলিদের ঝুড়িগুলো আজ কতরকম মাছে যে ভর্তি তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু সুশান্তের সাধ্যের মত সস্তা কই? তবু আজ বড়দিন। কলকাতায় আজ শুধু ক্রিসমাস নয়, আজ হল বড়দিন। সুশান্তের কাকা প্রতি বড়দিনে একটি করে ক্রিসমাস কেক পাঠাতেন। কাকা কাজ করতেন গ্রেট ওয়েস্টার্ন হোটেল নামে এক বনেদী স্মৃতি বিজড়িত হোটেলে। এই হোটেলের খুব রমরমা বা বোল বোলাও ছিল এককালে। ব্রিটিশ রাজের সময়ে সাহেব মেমরা আসতেন কেক কিনতে, সেসব দিনের গল্প কাকা বলতেন। সুশান্তের কিন্তু কেকের ভিতরে লুকিয়ে রাখা নানা রকম রত্ন খুঁজে বার করতেই বেশি উৎসাহ, অত ইতিহাস চাখার বয়স ছিল না সেই ইস্কুলে পড়া বিচ্ছু ছেলেটির।
নাঃ সব মাছই নাগালের বাইরে। সুশান্ত আজ মাছ খাওয়ার আশাই ছেড়ে দিলেন। যারা মাছ খান না তাদের কাছে মাছের বাজার একটি পূতিগন্ধময় ছোটখাটো নরক। সুশান্ত কিন্তু শুধু মাছের স্বাদের পূজারীই নন, তাঁর কেমন ঘোর লাগে এই মাছের শরীরী সুবাসে। মাছ কিনুন বা নাই কিনুন ঘুরে ঘুরে বেড়ান মাছের বাজারে। বাংলার অসংখ্য নদীর মোহনা থেকে উঠে আসা এই জলের পরীরা তাদের রূপালী গয়না পরে ঝলমল করছে কালো সিমেন্টের চাতালে। তার ওপর নিয়ন বাতির আলো পড়ে কেমন এক মায়াময় জগত মনে হয় সুশান্তর। মনে পড়ে গত বছর ছোট্ট ক্রিসমাস ট্রির জন্য তাঁর কেনা রূপালী জিঙ্গল বেলগুলির কথা। কেমন ভাবে চাঁদের আলো নিম গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে জিংগল বেলের ওপর পড়ে ঝিকিমিকি করছিল। মরি যদি তাও ভালো গানটা একবার গেয়েও ফেলেছিলেন। চারদিক তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার, হঠাৎ কারেন্ট চলে গেল। আর অন্ধকারের মধ্যে তাঁর বারান্দাটা ঠিক যেন এক অন্ধকার স্রোতস্বিনী। ভেবে সুশান্ত আনমনা হয়ে যান এই রোদ্দুর ভরা সকাল বেলায়। ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে ঢুকে পড়েন কেকের দোকানে।
🍂
কেকও কিছু সস্তা নয়। সুশান্তের বৌ প্রিয়াঙ্কা প্রতি শীতে একটি করে কেক বেক করত। প্রিয়াঙ্কা কোনও দুর্দান্ত বেকার ছিল না, কিন্তু সুশান্তের আর কেই বা ছিল যে কেক বেক করে দেবে? কেকটি হত নরম এবং তুলতুলে স্পঞ্জ কেকের মতো। ক্রিসমাস কেকের ক্রিসমাস ট্রির মত এক রাজসিকতা থাকে। সে শক্ত পায়ে সটান দাঁড়িয়ে থাকে, সারা গায়ে নানা রত্নসম্ভার সাজিয়ে। প্রিয়াঙ্কার কেক সাদামাটা। প্রিয়াঙ্কা সহজাতভাবে জানত সুশান্তের খুব একটা পছন্দ হয়নি এই কেক, তাই অত খাটাখুটি করে কেক বানিয়েও সে যেন একটু রেগে রেগে থাকত। এখন ভাবলে মনে হয়, প্রিয়াঙ্কা যেন বেশিরভাগ সময়ই রেগে থাকত। কিন্তু কেকের কথা সে ভুলত না একবারও। এটা ছিল তার বাৎসরিক রুটিন। যখন ক্যান্সার এসে তাকে ধীরে ধীরে অজগরের মত গ্রাস করে ফেলছিল, সেবারেও শেষ হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে প্রিয়াঙ্কা কিন্তু কেক তৈরি করতে ভোলে নি। ২৪শে ডিসেম্বর সেই কেক খাবে বলে দুটো লাল সান্টার টুপি কিনে এনেছিল নিউ মার্কেট থেকে। এক সপ্তাহ পরে যখন সে সাদা কাপড়ে মুড়ে ঘরে ফিরে এলো, তখনো সেই কেক আর টুপি ডাইনিং টেবিলে। যেমনকে তেমন। সুশান্ত সাহস করে সেই কেক আর ছুঁতে পারেন নি।
কতদিন আগে, সুশান্তের একটি মেয়েও ছিল। রোগা কিন্তু ভীষণ উচ্ছল, গান গাইত যখন তখন। সেবক রোডের ভেজা দুপুরে সুমোতে বসেও সে গাইছিল - আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো। ভাঙ্গ খেয়ে উচ্চমার্গগামী ড্রাইভার যখন খাদ আর পাহাড় আলাদা করে চিনতে না পেরে পিছলে পড়ে যায় সিকিমের জঙ্গলে, তারপর থেকে তার গান কেউ শোনেনি আর। স্মিতা ছিল কেকের পোকা, হয়ত প্রিয়াঙ্কা ওর কথা ভেবেই কেক বানাতো প্রতি বছর। যখন ছিল তখন, যখন হারিয়ে গেল তখনো। প্রিয়াঙ্কা চলে গেলে কেক বেকিং থেমে যায়, আভেনটা মরচে ধরে শেষে আরশোলার শহর হয়ে গিয়েছিল। আকাশের ঠিকানায় চিঠি কি আর লেখা যায়? পিন কোডটাই তো জানা নেই।
=এইটার দাম কত? না না, এত বড় নয়। আমি একা মানুষ, এত খাব কি করে?
=১০০০ টাকা। পার পিস।
=এই একটু কেকের জন্য হাজার? হায় ভগবান! তুমি কি পাগল?
=আজ আর ভগমান নয় হায় খ্রিষ্ট খ্রিষ্ট বলো কাকু। তা কাকু, সব কিছুরই দাম বাড়ছে, কেকের বেলাতেই যত দোষ? জানো তো ডলারের দাম ৮৬ এরও বেশি। পেট্রোল তো ১০০-র মাথায় চড়ে বসে আছে কবে থেকে।
সুশান্ত মনে মনে প্রশংসা করেন মাছওলার অর্থনৈতিক জ্ঞান দেখে। তবু চেষ্টা করেন যদি কমে।
=হ্যাঁ ভাই জানি তো। সরকারও চান না, তোমরাও চাও না আমি আর বেঁচে থাকি।
=যা বলেছ কাকু। আমরাই বাঁচতে পারছি না, কে আর সিনিয়রদের নিয়ে মাথা ঘামায়।
সুশান্ত কিছুটা হতাশ বোধ করেন। একজন প্রবীণ বেঁচে থাকুক বা না থাকুক তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। যেন সবাই চিরকাল তরুণ থাকবে। দেখবো। বলেই খেয়াল হয় দেখার জন্য তিনি কি আর থাকবেন?
=তোমরা সিনিয়ররা কাকু সরকারের থেকে পচুর সুবিধা পাও আজকাল। সুদ বেশি, আয়কর কম, ভর্তুকি চিকিৎসা। তাও তোমাদের আপত্তি দাম নিয়ে। কাম অন কাকু কিপ্টেমি করবেন না, আজকে যাকে বলে বড়া দিন। এত ভালো ফ্রেশ কেক আর কোথাও পাবেন না। ঠিক আছে ৯৫০ টাকাই দিন না হয়। এটা শুধুমাত্র সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য এস্পেশাল ৫০ টাকা ছাড়।
তুমি থেকে আপনিতে সরে যায় দোকানদার, সুশান্ত লক্ষ্য করেন। কিন্তু সুশান্তের কাছে একটি মাত্র ৫০০ টাকার নোট। প্রযুক্তিগতভাবে তিনি হয়ত প্রতিবন্ধী না, কিন্তু মনে মনে একদম পুরানো টাইমার। গুগল পে ইত্যাদি ব্যবহার করতে ভয় লাগে। প্রতারণা সর্বত্র। কে কখন স্ক্যাম করে দেবে কে জানে। তাঁর সম্বল বলতে এই একটা ব্যাংক একাউন্ট। যদি এটা ফ্রড হয়ে যায় তাহলে তো খেল খতম।
=এই কেকগুলোর দাম অত বেশি মোটেও নয়। আমরা কি বাড়িতে কেক বানাইনি কখনো? তোমরা ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই আমাদের ঠকিয়ে দাও।
সুশান্ত বিড়বিড় করল।
=কাকু আজ একটা পবিত্র দিন। সাত সকালে বিলা করছেন কেন? কিনতে না পারলে চলে যান। আপনার চেঁচামেচিতে এবার আমার অন্য খদ্দের পালাবে ।
সুশান্ত দেখলেন কাঁচাপাকা গোঁফ, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি এবং চকচকে টাক এক হৃষ্টপুষ্ট খদ্দের কমলা রঙের সেলোফেনে মোড়ানো পাঁচটি বড় কেকের বাক্স তুলে নিচ্ছেন । হ্যাঁ, পাবলিকের সামর্থ্য আছে কেনার। দেশ এগিয়ে চলেছে। সুশান্ত আর সচল নয়। তিনি অচল পয়সার মত পুরনো, সিনিয়র। সুশান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। আজ আমি চিনি দিয়ে মাখন মাখানো টোস্ট খাব, মনে মনে ঘোষণা করলেন। এটাই হবে তাঁর বড়দিন উদযাপন। তাঁর দুর্বল অগ্ন্যাশয়ের জন্যও একটা লাত্থি বরাদ্দ হোক না।
বাড়ি ফেরার পথে পড়ে একটি ছয় লেনের রাস্তা। চলে গেছে সোজা আইটি সিটিতে। অবিরাম গাড়ি চলছে দুদিক দিয়ে। বাজারের কাছে ট্রাফিক সিগনাল নেই, শুধু জেব্রা ক্রসিঙের ভরসা। মাথার ওপরে ঝুলছে মেট্রোর কংক্রিটের বিশাল পিলার। হাল্কা পলকা দেখতে মেট্রোর ট্রেনগুলো এই পিলারের ওপর ভর করে যাচ্ছে আসছে হু হু করে। দেখে মনে পড়ে রোমের রাস্তার কথা, প্রাসাদ আর স্তম্ভ রাস্তার কোণে কোণে। ট্রেন দূর থেকে আসে, আস্তে আস্তে বাঁক নেয় এবং তারপর হঠাৎ হুস হুস করে চলে যায়। ট্রেনের লাইন ৮০ ফুট উঁচুতে, মনে হয় যেন টিভির মত অন্য এক জগৎ, কোচগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে একটা সুশৃঙ্খল আর্মি মাথার উপর দিয়ে মার্চ করছে। সুশান্ত মাথা উঁচু করে দেখলেন মাথার ওপর দিয়ে এইমাত্র একটা ট্রেন যাচ্ছে। আর অনেক নীচে গাড়ি, অটো, রিকশা, টোটো, অ্যাপ ট্যাক্সি, পুরনো জরাজীর্ণ বাস, নতুন বিশাল বড় এসি ভলভো বাস, আশি বছরের বৃদ্ধরা শিরা বের করা হাতে ব্যাগ ভর্তি পুঁই শাক নিয়ে পার হচ্ছেন, ব্যস্ত সাইকেল নিয়ে নিউজপেপারওয়ালারা হই হই করে কাটাকুটি খেলছে, আর সর্বোপরি ডেলিভারি মোটরবাইক ছুটে চলেছেন সাত মিনিটের সময়সীমা পূরণ করার জন্য। নইলে তাদের তারার সংখ্যা কমে যাবে পাঁচ থেকে, চাকরিও চলে যেতে পারে। বড্ড স্পীডে চলছে সবাই, কোথায় কে জানে? ভাবতে ভাবতে সুশান্ত পা বাড়ান রাস্তা পার করার জন্য।
0 Comments