মলয় সরকার
(প্রথম পর্ব)
বাঙালী বই পড়ুয়ারা আজ আর কে না জানে সেই বিখ্যাত বই, ” নিঃসঙ্গতার একশ বছর” এর কথা। যা এনে দিয়েছিল ল্যাটিন আমেরিকার কলম্বিয়ার বিখ্যাত লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের হাতে নোবেল প্রাইজের অতুলনীয় সম্মান।
সেই মার্কেজ, যাঁর নামেই অনেক বাঙালী স্পেনীয় সাহিত্য পড়ায় আগ্রহী হয়েছেন।তাঁর নামেই, অনেক বাঙালীর মতই আমিও আগ্রহী হয়েছিলাম তাঁর সম্বন্ধে জানতে- বিশেষ করে তাঁর দেশ, যে দেশ জন্ম দিয়েছে শুধু মার্কেজকে নয় এরকম আরও বহু সাহিত্যিককে, যাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন শুধু স্পেনীয় সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যকে। ইদানীং তো মার্কেজ এবং স্পেনীয় সাহিত্য নিয়ে বাঙালীর ভিতর এক উন্মাদনা তৈরী হয়েছে।অনুবাদও হচ্ছে প্রচুর। ভালই হচ্ছে- বিদেশী সাহিত্যকে ঘরের আঙিনায় এনে ফেলা তো সুলক্ষণ। তবু এখনও আমরা বাঙালীরা অনেক পিছিয়ে আছি বিদেশী সাহিত্যকে জানার ব্যাপারে।তবে মিগুয়েল দ্য সার্ভেন্তেসের ‘ডন কিহোতে’ পড়েন নি এমন পাঠক পাওয়া মুস্কিল।
ইদানীং অবশ্য বাঙালী স্পেনীয় সাহিত্য নিয়ে মজেছে।তার কারণ হয়ত কলকাতা বই মেলায় কখনও পেরু, কখনও বলিভিয়া বা কখনও স্পেন থিম গ্যালারি হচ্ছে।আসলে স্পেন একসময় বিশ্বের বিশাল অংশের উপর আধিপত্য করায় অনেক দেশই তাদের নিজস্ব মাতৃভাষা ভুলে স্প্যানিশকেই আপন করে নিয়েছে, নিজের মাতৃভাষা বলে ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছে। তাই আজ স্প্যানিশে কথা বলে বিশ্বের একটা বড় অংশের মানুষ। এমন কি অনেক জায়গাতেই ইংরাজি ভাষা, যাকে আমরা মনে করি, এই ভাষা ভাল করে জানলেই জাতে ওঠা যায় বা বিশ্ব জয় করা যায়, তাকেও তারা চূড়ান্ত ভাবে ব্রাত্য করেছে। ঢুকতেই দেয় নি তাদের দেশে। সেখানে নিজের দেশের ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা তারা বলেই না। এই দলে অবশ্য অনেকেই আছে, যেমন, চীন, জাপান কোরিয়া, রাশিয়া, জার্মানী, হল্যাণ্ড ইত্যাদিরা।
সে যাই হোক,ফলে স্পেনীয় ভাষার সাহিত্যিকও অনেক।যেমন, কলম্বিয়ার মার্কেজ ও হুয়ান গাব্রিয়েল ভাস্কেজ, আর্জেন্টিনার জর্জ লুই বোর্হেস,পেরুর মারিও ভার্গিস লোসা, চিলির ইসাবেল আলেন্দে প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে ঊজ্বল জ্যোতিষ্ক।এর মধ্যে বাংলা ভাষায় নোবেলের ক্ষেত্রে যেখানে টিমটিম করে জ্বলছেন একমাত্র রবীন্দ্রনাথ, ওদিকে ল্যাটিন আমেরিকায় সাহিত্যে নোবেল প্রাপকের সংখ্যা অনেক, ছয় জন- গাব্রিয়েল মিস্ত্রাল (চিলি) মিগুয়েল এঞ্জেল এসচুরিউয়াস (গুয়াটেমালা,) পাবলো নেরুদা(চিলি) , গার্সিয়া মার্কেজ ( কলম্বিয়া) , অক্টাভিও পাজ (মেক্সিকো) ,মারিও ভার্গাস লোসা (পেরু)।
🍂
এছাড়াও স্প্যানিস ভাষায় স্পেনের ‘ডন কিহোতে’ খ্যাত মিগুয়েল দ্য সার্ভেন্তেস, ও ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ইত্যাদিরা তো আছেনই।
আমার এবারের খোঁজা মার্কেজের বেড়ে ওঠা, বিচরণভূমি বা সাহিত্যের পটভূমি, যা তাঁকে তার রচনাকে সমৃদ্ধ করেছে, জল হাওয়ার জোগান দিয়ে বিশ্বসেরা করেছে, সেই সমস্ত জায়গার আনাচে কানাচে।
আগেই গিয়েছি মেক্সিকোর গুয়াদালাহারা, মেক্সিকো সিটি, রোম, প্যারিস, নিউইয়র্ক, যেখানে যেখানে তাঁর চরণচিহ্ন পড়েছিল। আর এখন গন্তব্য কলম্বিয়ার কার্তাহেনা ও রাজধানী বোগোটাতে যেখানে কেটেছিল তাঁর জীবনের প্রধান অংশ, প্রথম, মধ্য ও শেষ অধ্যায়। খুঁজে বেড়িয়েছি, কোথায় তাঁর গল্পের শিকড়, কোথায় তাঁর উপন্যাসের চরিত্ররা জন্মেছে , বড় হয়েছে। খুঁজে বেড়িয়েছি “ দ্য স্টোরি অফ এ শিপরেকড সেলর”(বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প) এর বন্দরের কাছে ৷ এ ছাড়া সিয়েন আনিওস দ্য সোলেদাদ ( নিঃসঙ্গতার একশ বছর), বিবির পারা কোন্ত্রালা (বেঁচে আছি গল্পটা বলব বলে),মোমেইরা দি মিস পুতাস ত্রিস্তেস (আমার দুঃখ ভারাক্রান্ত বেশ্যাদের স্মৃতিকথা), লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা (প্রেম ও কলেরা ) এই সমস্ত অবিস্মরণীয় লেখার বিচরণভূমি।সেখানকার পরিবেশ, সেখানকার মানুষ, ইতিহাস ইত্যাদি নিজের চোখে দেখাই ছিল আমার লক্ষ্য।
গিয়েছি সেই কার্তাহেনায় , যেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন ; সেই কলম্বিয়া, যে দেশ তাঁকে ছাড়তে হয় ‘দ্য অটাম অফ দ্য প্যাট্রিয়ারক’ বইয়ের জন্য, সেখানেই ।
এর আগে এরকম আর একটা দেশে ঘুরে বেড়িয়েছি আনাচে কানাচে সেটি হল লেখক ওরহান পামুকের দেশ তুরস্ককে খুঁজতে ও জানতে, যার কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে আমার ‘তুর্কী নাচন’ বইটিতে।উৎসাহীরা ঘেঁটে দেখতে পারেন।
যদিও তাঁর জন্মস্থান আরাকাটাকা যাওয়া সম্ভব হয় নি, কেন না, সেখানের উপর ছিল তাঁর ক্ষোভ, যে, তারা ওঁকে ভালবাসে নি; সেখানের মানুষেরও রয়েছে ক্ষোভ যে, মার্কেজও তাঁদের জন্য নাকি কিছুই করেন নি।অবশ্য তিনি যখন সেই জন্মস্থান ত্যাগ করেন, তাঁর বয়স তখন মাত্র আট বছর পেরিয়েছে। সেটাও নিজের ইচ্ছায় নয়, বাবার ভাগ্য অন্বেষণের তাগিদে।তবু এই আরাকাটাকাই নাকি তাঁর গল্পের দেশ মাকোন্দোর পিছনের ছবি।মাকোন্দো, বুয়েন্দিয়া পরিবার সবাই উঠে এসেছে এখান থেকেই।সেই কলার ব্যবসায়ীরাও এখানকার মার্কিন কোম্পানীরই ছবি।এই শহরটি রাজধানী সান্টা মার্তা থেকে আশি কিমি দূরে,আরাকাটাকা নদীর ধারে।
যাই নি এখানে, তবু তাঁর বিচরণভূমিতে ঘোরার সৌভাগ্য যে পেয়েছি তাই তো অনেক লাভ। কলম্বিয়ার সাধারণ মানুষ তাঁকে শ্রেষ্ঠ সন্তানের স্বীকৃতি দিয়েছে, আমাদের প্রাণের মানুষ রবীন্দ্রনাথের মতই।তাঁর ইচ্ছা রইল, তাঁর সাহিত্যের জাদুবাস্তবতার যে ছোঁয়া, যার মূলে রয়েছেন ফ্রাঞ্জ কাফকা, তাঁর কর্মভূমি প্রাগে যাওয়ারও। দেখা যাক–
সেবার গিয়েছিলাম ছেলের কাছে। উদ্দেশ্য নতুন নাতনির সাথে মোলাকাৎ। যখন ধীরে ধীরে নাতনীর পরিচয় হচ্ছে নতুন পৃথিবীর সঙ্গে একটু একটু করে, যেমন করে ঠিক প্রথম প্রভাতে ফুলের কলি চোখ খোলে, ধীরে ধীরে পরিচয় হয় নতুন বিশ্বের সঙ্গে; আমরা আনন্দে ভাসছি তার আস্বাদন পেয়ে, ঠিক তখনই প্রস্তাবটা এল ছেলের কাছ থেকেই। বলল, কিছুদিনের জন্য ঘুরে এস লাটিন আমেরিকার কোন দেশ। তাতে একটু পরিবর্তনও হবে আর একটা ব্যাপারও আছে। তা হল আমেরিকার বাইরে বেরিয়ে ভিসার মেয়াদটা আর একটু বাড়িয়ে নেওয়া যাবে। আমেরিকা তো ছয় মাসের ভিসা দেয়। যদি এর বাইরে বেরিয়ে আবার ঢোকা যায় , তাহলে আরও ছয় মাস বেড়ে যাবে।বুঝলাম, তাহলে মা বাবা আর একটু বেশি থাকতে পারবে-এটাই তার ইচ্ছা।
সে যাই হোক, পড়ে গেলাম দোটানায়। নাতনীকে ছেড়ে এখন যাওয়াও মুস্কিল। যখন সে ভোরবেলাতেই চলে আসে দাদু- ঠাকুমার সাথে খেলতে, আর নানা খেলা খাওয়া দাওয়া আর হাসি দিয়ে ভরিয়ে রাখে সারা দিন, তখন তো মনে হয় তাকে ছেড়ে স্বর্গে যাওয়াও মুস্কিল।
তবে, ছেলে অনেক জোর করল, এরকম সুযোগ পাচ্ছ, তা ছাড়া এর পর বয়স আরও বেড়ে গেলে বাইরে যাওয়া মুস্কিল হবে ইত্যাদি নানা কথা। বলল, তুমিই তো আগে বলেছিলে কলম্বিয়া যাবে।তখন ভাবলাম, সত্যিই আমার বহুদিনের ইচ্ছা এই লাটিন আমেরিকার দেশগুলোকে একটু দেখে আসার , তা ছাড়া কলম্বিয়ার তো আলাদা বিশেষত্বই আছে, তাই নিমরাজী হয়েও সম্মতি দিলাম।ছেলে বলল, সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব, অসুবিধা হবে না।
দেখতে দেখতে দিন এসে গেল। ২৫ শে মে ২০২৪ যাওয়ার দিন স্থির হয়েছিল।
বেরোলাম কর্তা গিন্নী সব সুটকেশ গুছিয়ে। যাওয়া হবে এখান থেকে নেওয়ার্ক, সেখান থেকে পানামা সিটি এবং সেখান থেকে আবার ফ্লাইট পালটে তবে কলম্বিয়ার কার্তাহেনার Rafael Nunez বিমান বন্দরে। এখানে কার্তাহেনার নামের বানান স্প্যানিশে Cartagena । স্প্যানিশে ‘J’ অক্ষর আর ‘G’ অক্ষর দুটোই ‘হ’ এর কাছাকাছি হয় ,যদিও অল্প উচ্চারণের তফাত আছে। এরকম অনেক ব্যাপারেই আছে। X এর উচ্চারণও ‘হ’ এর কাছাকাছি । তাই Mexicoর উচ্চারণ হয়ে যায় ‘মেহিকো’ ।ঠিক এমনি করেই হয় Don Quixote ডন কিহোতে।
পথ চলা শুরু হল বেশ কিছুদিন পরেই।এবার আবার অন্য পথে, অন্য দিকে। যাঁরা ছিলেন আমার সঙ্গী অতীত দিনে, আজও তাঁদের চাইছি নতুন পথের সঙ্গী হিসাবে আর যাঁরা ছিলেন না, সঙ্গে থাকুন তাঁরাও।দেখতে থাকি অনুভব করতে থাকি নতুন পথের সঞ্চয়কে--
( প্রতি বুধবার জ্বলদর্চির পাতায়, আগের মতই সম্পাদক ঋত্বিক ত্রিপাঠীর হাত ধরে।)
0 Comments