জ্বলদর্চি

অতনুনন্দন মাইতি (পত্রিকা সম্পাদক, লোকগবেষক, দাঁতন) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৪৭
অতনুনন্দন মাইতি (পত্রিকা সম্পাদক, লোকগবেষক, দাঁতন) 

ভাস্করব্রত পতি

সুবর্ণরেখা তীরবর্তী অঞ্চল দাঁতন। সুবর্ণরৈখিক সংস্কৃতি এই এলাকার আশেপাশে। পাশেই ওড়িশা। আর এদিকে পশ্চিমবঙ্গ। দুই রাজ্যের মিলিত সংস্কার ও সংস্কৃতিতে একাকার পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন ১ ব্লকের এক বর্ধিষ্ণু জনপদ জামুয়াপতি। অন্যান্য আর কয়েকটা গ্রামের মতোই এর অন্দরেও মিশ্র সংস্কৃতির ছোঁয়া। এহেন এলাকার বাসিন্দা হিসেবে যেকোনো সংস্কৃতিপ্রিয় মানুষ তুলে ধরতে চাইবে তাঁর এলাকার কথা, দিনযাপনের কথা, ইতিহাসের কথা, সংস্কৃতির কথা, ভালোলাগার কথা, ভালোবাসার কথা। দাঁতনের অতনুনন্দন মাইতিও তাইই করেছেন। করে চলেছেন। 
অতনুনন্দন মাইতি সম্পাদিত 'বিবিধ' পত্রিকার ৪৬৯ তম সংখ্যা

একদিকে বাংলা ভাষা, অন্যদিকে ওড়িয়া ভাষা। জন্ম থেকেই দেখে আসছেন, শুনে আসছেন, বলে আসছেন দুই ভাষাভাষীর মানুষের কথপোকথন। দুই আলাদা এলাকার একাত্মীভূত জীবন যাপন। দুই আলাদা সংস্কৃতির মিশ্র রূপ। আর দিন বদলের সাথে সেসব যখন লুপ্তপ্রায় হতে চলেছে, তখন যে কয়জন মুষ্টিমেয় মানুষ জ্বালিয়ে রেখেছেন, টিকিয়ে রেখেছেন, ধরে রেখেছেন এখানকার চালচলন, চালচিত্র, তাঁদের মধ্যে একজন হলেন অতনুনন্দন মাইতি। যিনি নিজেকে 'পেশায় কৃষক, নেশায় পাঠক' - এই অভিধায় অভিহিত করতেই পছন্দ করেন। 

আঞ্চলিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির খোঁজে অবিরাম পথচলতে তিনি বদ্ধপরিকর। সীমিত ক্ষমতা কিন্তু অপরিসীম ইচ্ছাশক্তিকে পাথেয় করে প্রত্যন্ত মেদিনীপুরের সীমান্তবর্তী এলাকার ভূমিপুত্র হিসেবে নীরবে নিভৃতে নিরলসভাবে যে কাজ তিনি করে চলেছেন, তা আজ নয় কাল নয়, একসময় তা অমূল্য সম্পদ হয়ে উঠবে গবেষকদের কাছে। 
ভাষা শহীদ দিবস পালনের অনুষ্ঠানে বেলদায় অখিলবন্ধু মহাপাত্রের সঙ্গে

বাবা কেদারনাথ মাইতি ১৯৩৭ সালে এই জামুয়াপতি গ্রাম থেকেই স্কুল ফাইনাল পাশ করে রেঙ্গুন (এখনকার মায়ানমার) করাচি জলপথে জাহাজের কর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। মা ছিলেন হরপ্রিয়া সাইতি। কিন্তু এরপরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। নাফ নদী অতিক্রম করে পায়ে হেঁটে সুদূর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসেন জামুয়াপতি। পিতৃদত্ত সেই ভূমিতেই তিনি আজও আসীন নিজের কাজকে সঙ্গী করে। 

ষাটের দশকের শেষের দিকে গ্রামের বিশিষ্ট শিক্ষক হরিপদ শাসমলের উৎসাহে এবং সাহচর্যে স্কুলের বই পড়ার সাথে সাথে অন্য ধরনের বই পড়া, সাহিত্য চর্চা এবং লেখালেখিতে ব্যাপৃত রাখতে শুরু করেন। অবশেষে গ্রাম ছেড়ে মেদিনীপুর কলেজে গিয়ে ভর্তি হন। পাশ করলেন বি.কম এবং বি. এড। সাহিত্যের প্রতি অনুরক্ততা আরও বেড়ে যায় মেদিনীপুর গিয়ে। তবে  পারিবারিক কারণে কখনও চাকরির দরখাস্ত করা হয়নি তাঁর। 

বাবা যখন রেঙ্গুন থেকে ফেরেন তখন তিনি এনেছিলেন একটি রেডিও। সেই রেডিও হয়ে ওঠে ছোট্ট অতনুনন্দনের জীবন পাল্টানো উপকরণ। রেডিওতে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান শুনতে শুনতেই জন্মায় লেখালেখির প্রতি অনুরাগ। শুরু করেন চিঠি লেখা। হয়ে উঠলেন সু-পত্রলেখক। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নিয়মিত চিঠি পৌঁছাতো রেডিও দপ্তরে। পাঠ হত সেসব। অবশেষে আশির দশকে অতনুনন্দন মাইতি পেলেন বিবিসির শ্রেষ্ঠ পত্র লেখকের সম্মান। 
'আত্মানুসন্ধান' পত্রিকা

জামুয়াপতি গ্রাম একপ্রকার অজ পাড়া গাঁ'ই বলা চলে। তার ওপর শহর থেকে অনেক দূরে। শহরঘেঁসা নয়। ফলে উন্নয়নের আলো ক্ষীন। ২০০৪ সালে প্রথম আসে বিদ্যুৎ। বলতে গেলে আধুনিকতার ছোঁয়া ঠিক তখন থেকেই। কিন্তু তারও অনেক আগে থেকেই সাহিত্যচর্চা, লেখালেখি, সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে মেলামেশা তাঁর। তখন তো ফোন, মোবাইল, টিভি ছিল না। শুধুমাত্র চিঠিপত্রের মাধ্যমেই ছিল কষ্টকর যোগাযোগ। 
কোনও এক অনুষ্ঠানে অতনুনন্দন মাইতি

সেই চিঠি চালাচালির সৌজন্যে তিনি যে পরিচিতি পেয়েছিলেন তার জেরে তাঁর অখ্যাত জামুয়াপতি গ্রামে বহুবার এসেছেন গৌরকিশোর ঘোষ। ১৯৯২ সালের ২৯ মার্চ আরও দু'জনের সঙ্গে দাঁতনে এসেছিলেন তিনি। কথা বলেছেন, আলোচনা করেছেন, টানা তিন রাত কাটিয়েছেন নির্দিধায়। এই গৌরকিশোর ঘোষ নামকরণ করেছেন তাঁর মেয়ে আশাবরীর নাম। আর নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নামকরণ করেছেন ছেলে আলাপনের নাম। অতনুনন্দন মাইতির সাংস্কৃতিক মানসিকতায় ঋদ্ধ হয়ে এখানে এসেছেন মতী নন্দীর মতো দিকপালও। পৌঁছে গিয়েছেন উৎপল দত্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, নারায়ণ সান্যাল, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বরুণ সেনগুপ্তর বাড়িতেও। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহের লেখা সাতখানা চিঠি তাঁর কাছে গচ্ছিত। ১৯৯৮ সালে বুদ্ধদেব গুহ এক চিঠিতে অতনুনন্দনকে লিখেছেন, "আপনার মতো। মনোযোগী পাঠক যে কোনও লেখকের পক্ষেই সৌভাগ্যের বিষয়। নির্জলা প্রশংসা শুনে শুনে আমি শুধু ক্লান্ত নই, বিরক্তও। ভালো মন্দ সবই শুনতে ইচ্ছে করে। তাতে নিজের উন্নতি হয়"।
ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজে

সকলের সাথে নিবিড় যোগাযোগের দরুন পেতেন সা সাহচর্য, পেতেন পরামর্শ, পেতেন ভালোবাসা। নিয়মিত চিঠিপত্র আদানপ্রদান চলতো। সেসবকে পাথেয় করে তিনি চালিয়ে গিয়েছেন আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা। আসলে একটা সাহিত্য, সংস্কৃতি, লৌকিক ইতিহাস কথন ও যাপনের মাধ্যমে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে চেয়েছেন বহুদিন ধরে। এখনও করে চলেছেন সমানভাবে। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার গঠিত 'মেদিনীপুর আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র' এর তিনি এখন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। 
ভাঙ্গা মন্দিরের ইতিহাস অন্বেষণে

তাঁর হাত ধরেই নিয়মিত প্রকাশিত হয় লোকসংস্কৃতি ও আঞ্চলিক ইতিহাসসমৃদ্ধ পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যা 'আত্মানুসন্ধান'। খবরের কাগজ ও আঞ্চলিক সংবাদকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে একুশ বছর ধরে প্রকাশ করে চলেছেন 'বিবিধ' নামে একটি উজ্জ্বল পত্রিকা। গত পয়লা মার্চ ২০২৫ তে প্রকাশিত হয়েছে এই পত্রিকার ৪৬৯ তম সংখ্যা। গাঁটের কড়ি খরচ করে 'বনের মোষ তাড়ানোর কাজ' তিনি অবিচ্ছেদ্যভাবে করে চলেছেন  মেদিনীপুরের বুকে দাঁড়িয়ে। হয়তো এতে মেলেনা উপার্জন। পণ্ডশ্রম করে চলেছেন নিজের তাগিদে। কিন্তু আসলে দেশীয় ইতিহাসকে লেখ্যাগারে লিপিবদ্ধ করে রাখার নির্মল ব্রত তিনি পালন করে চলেছেন নিরলসভাবে। মোঘলমারি বৌদ্ধবিহার, শরশঙ্কা দিঘী, বালিযাত্রা, কাকরাজিৎ, সাতদেউলা, গগনেশ্বর মন্দির, কেশিয়াড়ির সর্বমঙ্গলা মন্দির, কিয়ারচাঁদ, মনোহরপুর রাজবাড়ি, ভেটিয়া, ভারত গান, বেলদার জৈন মন্দির, অগস্থ মূর্তি সহ দাঁতন ও তৎসংলগ্ন এলাকার অসংখ্য গর্বের বিষয়ের নানা তথ্য বারংবার ফুটে উঠেছে তাঁর পত্রিকায়।

🍂

Post a Comment

0 Comments