কমলিকা ভট্টাচার্য
প্রতিদিনের অভ্যাসমতো, মধুবাবু ঘুম থেকে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে এসে সোফায় বসলেন। বসেই দিনের প্রথম "অর্ডার"টি দিলেন—
"এই যে শুনছো, বাইরে থেকে নিউজ পেপারটা নিয়ে এসো!"
কল্যাণী দেবী প্রতিদিনের মতোই বিরক্ত হয়ে বললেন, "এইটুকু কাজও যদি নিজে করতে না পারো, তাহলে আর কী বলার আছে! বাইরে গিয়ে পেপার আনলে কি জাত যাবে?"
মধু বাবু অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, "আরে এখন তো আমি গরম জল খাব, লেবুর জল খাব।"
কল্যাণী দেবী মাথা নেড়ে বললেন, "সেগুলোও তো আমিই দেবো! এত বছর পর এগুলো কি আর অর্ডার করতে হয়! একেবারে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।"
বিরক্ত হলেও তিনি চুপচাপ গরম জলের বোতল আর লেবুর জল এনে টেবিলে রাখলেন। তারপর বাইরে গিয়ে দরজা খুলে পত্রিকা নিয়ে এলেন।
মধু বাবু কাগজ উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলে উঠলেন, "কল্যাণী, আজ ভারত-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ আছে। তুমি অনলাইনে বাজার করে নাও, না হলে খেলায় মন বসবে না।"
কল্যাণী দেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, "একটা কাজ বলতে বাজারে যাওয়া, সেটাও বন্ধ করেছ! প্রতিদিন কোনো না কোনো বাহানা করে বলছো, অনলাইনে আনিয়ে নাও।"
মধু বাবু আর কথা না বাড়িয়ে কাগজে মন দিলেন।
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর, তিনি আবার আরাম করে সোফায় বসলেন, হাতে রিমোট তুলে নিলেন, আর সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণী দেবীকে নতুন অর্ডার দিলেন,
"শুনছো, টিভিটা অন করে দাও তো!"
কল্যাণী দেবী মুখে চির-অবজ্ঞার ভাব এনে টিভি চালিয়ে দিলেন, আর মনে মনে ভাবলেন, "এই ষাটে এসেও মানুষটা আর বদলালো না।"
খেলা শুরু হলো। নিউজিল্যান্ড প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নিলো। মাঠে দাঁড়িয়ে এক সুন্দরী সঞ্চালিকা ভাষণ দিচ্ছিলেন,
তার সাজগোজ খেলা শুরুর আগেই খেলা দেখার উত্তেজনা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট।
মধু বাবু চোখ গোল গোল করে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
"আচ্ছা, কল্যাণী, একবার এই মহিলার দাঁড়ানোর স্টাইলটা দেখেছ?"
কল্যাণী দেবী বিরক্ত হয়ে বললেন, "আমি এসব দেখার সময় পাই না। তুমি দেখো, তোমার তো সময়ের অভাব নেই।"
মধু বাবু মজা করে বললেন, "তুমিও একবার ঐ ভাবে পা রেখে দাঁড়াও দেখি!"
কল্যাণী দেবী এবার হেসে ফেললেন ,তার কথা মতো ঐ মহিলার নকল করে দাঁড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন, হাঁটু চেয়ারের কোনায় লেগে গেল, আর ব্যথায় ‘উফ!’ করে উঠলেন।
মধু বাবু হো হো করে হেসে উঠলেন, "হা হা হা! সত্যি কাকে দিলাম রাজা না না রানীর পাঠ!"
কল্যাণী দেবী এবার রেগে বললেন, "বসে বসে মহিলার ঠ্যাং না দেখে তার চেয়ে বরং একটু বাগানে গিয়ে গাছে জল দাও। কিছু তো একটা কাজ করো সারাদিনে!"
মধু বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, "ঠিক আছে, যাচ্ছি, যাচ্ছি!"
বাগানে গিয়ে তিনি জল ঢালতে শুরু করলেন। কিন্তু তার জানা ছিল না যে এক গাছের ফাঁকে মৌমাছিরা বাসা বেঁধেছে। হঠাৎই, তাদের রাজ্যে অনধিকার প্রবেশকারীকে দেখে তারা ক্ষেপে উঠল! মুহূর্তের মধ্যেই কয়েক ডজন মৌমাছি বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল মধু বাবুর ওপর! মধুবাবুর মধু শুষে নিল।
"ওরে বাবারে! মারে! বাঁচাও!" মধু বাবু দৌড়াতে লাগলেন, কিন্তু ততক্ষণে হাত ফুলে ঢোল হয়ে গেছে!
কল্যাণী দেবী দৌড়ে এলেন, "এই মানুষটাকে কোনো কাজ বলাই ভুল! এক কাজ বলে আরেকটা কাজ বাড়ল!"
তিনি লোহা ঘষলেন, চেপে ধরলেন, সাবান জল দিলেন, অ্যালোভেরা লাগালেন, কিন্তু মধু বাবু তখনও কাতরাচ্ছেন।
রাতে হাতের ব্যথায় ঘুম আসছিল না, তাই মধু বাবু Google ডাক্তারি করে একটা প্যারাসিটামল খেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঘুমের মধ্যে মধু বাবু এক আশ্চর্য রাজ্যে পৌঁছে গেলেন— মৌমাছিদের রাজ্যে!
তিনি দেখলেন, একদল মৌমাছি তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাচ্ছে! কোথায়? রানী মৌমাছির সামনে!
রানীর কথা শুনতে মনে একটু খুশি হল , রানী সেই মাছি হোক বা মহিলা ,রানীতো সুন্দরী বেশ নরম মনের হবে।
ভাবের ঘোর কাটল রানী মৌমাছির হাঁকুনিতে, বললেন, "এ কে রে? মধুর জায়গায় এই মধুর কলসীটা কোথা থেকে নিয়ে এলি?"
এক মৌমাছি বলল, "রানী মা, এই লোকটা আমাদের রাজ্যে এসে গাছ নড়াচড়া করছিল!"
রানী গম্ভীর স্বরে বললেন, "ওহ! তাহলে শাস্তি পেতে হবে!"
মধু বাবু আতঙ্কিত হয়ে বললেন, "না না, আমি ভুল করেছি! আমি আর কখনো কারও রাজ্যে ঢুকবো না!"
কিন্তু সে কথা শোনার সময় নেই! এক ঝাঁক মৌমাছি এসে মধু বাবুকে হুল ফুটিয়ে দিল! হঠাৎ করেই মধু বাবু অনুভব করলেন, তার পুরুষ সত্তা কোথায় যেন উবে যাচ্ছে! তিনি হয়ে গেলেন এক শ্রমিক মৌমাছি!
রানী মৌমাছি নির্দেশ দিলেন, "এই নতুন কর্মীটাকে কাজে লাগাও!"
মধু বাবু হতভম্ব হয়ে দেখলেন, তার সামনে সারি সারি শ্রমিক মৌমাছি ব্যস্ত— কেউ ফুলের মধু সংগ্রহ করছে, কেউ মৌচাক পরিষ্কার করছে, কেউ ডিমগুলো দেখাশোনা করছে, কেউ রানীর শরীরের যত্ন নিচ্ছে!
রানী মৌমাছি একের পর এক আদেশ দিতে লাগলেন
"নতুন মৌমাছি, যাও, গিয়ে ফুল থেকে মধু নিয়ে এসো!"
মধু বাবু কাঁদো কাঁদো মুখে বললেন, "আমি কখনো ফুল তুলিনি, রানী মা!"
রানী বললেন, "ওহ! অকর্মনের ঢেঁকি,তবে যাও, চাক পরিষ্কার করো!"
মধু বাবু গিয়ে একটু চাক ঝাঁট দিতেই রানী চেঁচিয়ে উঠলেন, "না না! এত ঢিলে ঢালা কাজ চলবে না! ভালো করে করো!"
মধু বাবু কপালে হাত দিলেন, "এ আমি কোথায় এলাম!"
কিন্তু রানীর কোনো দয়া নেই!
"এবার আমাকে একটু বাতাস করে দাও!"
"এই, বাচ্চাদের জন্য খাবার বানিয়ে নিয়ে এসো!"
"আহ্! শরীরে একটু ব্যথা করছে, মালিশ করো!"
"এই নতুন কর্মীকে দেখে রেখো, যেন ফাঁকি না দেয়!"
এভাবে একের পর এক কাজের বোঝা এসে পড়ল মধু বাবুর ঘাড়ে!
হাঁপাতে হাঁপাতে তিনি ভাবলেন, "ওরে বাবা! রানী মৌমাছির আদেশ আর আমার দেওয়া আদেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই!"
এতদিন ধরে তিনি কল্যাণী দেবীকে একের পর এক কাজ করতে বলতেন, আর এখন তার নিজের সেই একই অবস্থায়!
মৌচাকের ভেতরে দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ তার চোখ পড়ল রানী মৌমাছির পায়ের দিকে!
"এই রানী মৌমাছির হাঁটার ভঙ্গি তো ঐ সঞ্চালিকার মতো! আহা, সেই লম্বা সুন্দর পা! না না এইসব কি ভাবছেন তিনি"
মনে মনে শপথ করলেন যখন ঐ মহিলা মাঠে আসবে চোখ বন্ধ করে রাখবেন না হয় খেলা দেখাই ছেড়ে দেবেন।এই অবস্থার জন্য দায়ী ঐ মহিলা।
এই সব ভাবতে ভাবতে সবে একটু ঝিমুনি এসেছে , রানী হাঁক ছাড়েন, "এই! বসে বসে ঘুমোনো হচ্ছে, আছো কেন? পা টেপো আমার!"
মধু বাবু ভয়ে ভয়ে রানীর পা টিপতে লাগলেন।
🍂
"উফ!" চমকে ঘুম ভেঙে গেল মধু বাবুর! ধড় পড়িয়ে উঠে বসলেন।
তিনি দেখলেন, কল্যাণী দেবী তার পাশে বসে পা টিপতে টিপতে ঘুমিয়ে পড়েছেন!
মধু বাবু ধীরে ধীরে বললেন, "ওগো, সারাদিন কত কাজ করো! যাও, এবার তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আজ তোমার পা আমি টিপে দিই।"
কল্যাণী দেবী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন।
পরের দিন সকালে, তিনি ঘুম থেকে উঠে দেখেন, মধু বাবু হাতে এক কাপ চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন!
"গুড মর্নিং!" হাসিমুখে বললেন মধু বাবু।
কল্যাণী দেবী চমকে বললেন, "এ আবার কী?"
মধু বাবু মুচকি হেসে বললেন, "বলছি,সব বলছি!"
বিকেলে গাছে জল দিতে গিয়ে কল্যাণী দেবী মৌচাকের দিকে তাকিয়ে বললেন, "আমি যা তিরিশ বছরে পারিনি, তা রানী একদিনেই করে দিলো! ধন্যবাদ, রানী!"
0 Comments