জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত—বংশীবাবুর খবর এলো শেষ পর্ব

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
বংশীবাবুর খবর এলো শেষ পর্ব

সকালে ওটসেদ্ধ খাওয়ার কথা। দেড় টেবিলস্পুন বা ২০ গ্রাম। সুদামের করে দেওয়া মেনু। ওসব মেনু টেনু করে আর কি হবে? দুশশা-  বংশী দুটো ডিম বার করেন ফ্রিজ খুলে। অনেকদিন পোচ খাওয়া হয় নি। পোচ না, ফ্রায়েড এগ। তাতে সদ্য গুঁড়ো করা গোলমরিচের বিপ্লবী গন্ধ। তার সঙ্গে মুচমুচে টোস্টের ওপর মোটা করে কো অপারাটিভ কম্পানীর ভোরাভ মাখন। আহা। কতদিন খাইনি। টোস্টে কামড় দিতে দিতে মেসেজ করে সুদামকে। ওকেই তো করা উচিত ছিল। উৎসাহের মাথায় করা হয়নি। রিপোর্টটা ফরোয়ার্ড করে দেয়। সুদাম এখন অফ লাইন। সব নোটিফিকেশান বন্ধ । বংশী বারান্দায় যায়। কাকা ও কাকী বসে আছে। রোজ একটা থিন বরাদ্দ। আজ একটু টোস্ট আর ডিম সাজিয়ে দেয় প্লাস্টিকের প্লেটে। দুটো ভাগ করে দেয়। দুজন রেলিঙ্গে বসে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে থাকে, পছন্দ কি না বোঝা যায় না ওদের চোখ দেখে। বংশী সরে আসে। দূরে নকল বিগ বেনের টাওয়ারে সময় দেখে, পৌনে নটা। আজ ঘড়িটা চলছে, সব দিন চলে না, বোধহয় ভোট আসছে। ভোট এলে দেশটা কেমন জেগে ওঠে, সব কিছু চলমান হয়ে যায়। সারা বছর ভোট হলে বেশ হয়। বংশী এই চিন্তায় মগ্ন হয়ে টাওয়ারের কাঁটাগুলোকে লক্ষ্য করে একমনে। পিছনে কাকদম্পতি কখন নিঃশব্দে শূন্য করে গেছে  প্লেট। ওদের সময় কম। 

নাহ তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে, অভিমান করে কবি লিখেছিলেন, কিন্তু এখনো দিব্যি তাঁর হ্যাপী বাড্ডে পালন হচ্ছে, গেঁয়ো ইস্কুল মাস্টারের ঘরের দেওয়ালে ঠাকুরের গলায় একদিন মালা পড়ছে। অন্য দেব দেবীর জন্য রোজ বাতাসা, ফুলের কুচি আর রবি ঠাকুরের জন্য একদিন ফিনফিনে মালা, সামনে রাখা সঞ্চয়িতা। 
উনি বড় মানুষ। বংশী ছোট, এটা মেনে নেওয়াই যায় কেউ মনে রাখবে না এক বছর পরে। কিন্তু দু দুজনকে এই খবরটা জানালেও কোন পাত্তাই দিচ্ছে না। আশ্চর্য। রাস্তায় একটা ভিখিরী মরলেও কিছু লোক তো আহা উহু করে। এবার বংশীর একটু রাগ হতে লাগল, দুঃখ করা কোনদিন তার আসে না। রাগ হয় মাঝে মাঝে। কারো ওপরে নয়, এই পৃথিবীটার ওপরে। কি রকম বন্ধু এরা সব? প্রতিবেশী বলে তো অনেক দিনই কিছু নেই। এক এক করে ফ্ল্যাট বাড়ি থেকে এক এক জন খাটে নেমে স্বরগযানে সওয়ার হন, শুধু জানলা দিয়ে চোখে পড়ে। কেউ জানে না কি হচ্ছে। কে বাঁচল কে মরল কার হারট এটাক, কার ক্যান্সার। শুধু করোনার সময় সবাই ভীষণ সচেতন হয়ে গিয়েছিল। রোজ সকালে ফোনে এপ চালিয়ে দেখা হত, ১০০ মিটারের মধ্যে কজন, ১ কিমিটারের মধ্যে কজন, সব পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য। 

একবার তা হলে গ্রুপে পোষ্ট করেই দেখা যাক। একজনও পাত্তা দেয় কিনা ওর অসুখের। হাত নিশপিশ করে ওঠে বংশীবাবুর। 

🍂

ফোনটা তাকিয়ে আছে ওঁর দিকে। কত মানুষের মত, ওঁরো একমাত্র সঙ্গী, ভৃত্য, পরামর্শদাতা। পি জি ওড হাউসের বাটলার জিভস মনে হয় কখনো, আবার এখন পোষা গোল্ডেন রিট্রিভারের মত ওনার দিকে তাকিয়ে চুপ করে তাকিয়ে বসে আছে। গায়ে ছুঁয়ে দিলেই খুশীতে জ্বলে উঠবে দুটি চোখ। ফোনে সার সার কন্ট্যাক্ট লিস্ট, এসেছে গেছে, অনেকে বেঁচে নেই, তবু আমরা সেগুলো মুছি না। যেন কল আসে যদি। সত্যি কল এলে কি হবে সেটা ভেবে হো হো করে হেসে উঠলেন বংশী। 

বংশী না থাকলেও তিনি থেকে যাবেন এমন সব কন্ট্যাক্ট লিস্টে। মাঝে মাঝে কল করে ভয় দেখাবেন। চাচারিয়াকেও মেসেজ পাঠাবেন মাঝ রাতে। নল মে পানী নেহি আ রহা হ্যায়, কি করব? 

সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরী। দু দিন কেটে গেছে কোন উত্তর নেই। বাধ্য হয়ে ফোন লাগালো মহারাজকে। সে আবার ইনফ্লুএন্সার, ঘুরে বেড়ায়, ইউটিউব করে। তবে সব খবর ওর কাছে থাকে, আর ফোন করলে উত্তর দেয়, যতই ব্যস্ত হোক।

- আরে কি খবর বংশীদা, এতদিন পরে হঠাত? কি নাতির অন্নপ্রাশন নাকি? 
- না রে ভাই নাতি তো আমেরিকা, অন্নপ্রাশন অনেক দিন হয়েছে। তুমি কেমন? চালিয়ে যাচ্ছ? এখন কি সাব্জেক্ট?
- চলছে দাদা, ধীরে ধীরে বাড়ছে, আমার চ্যানেল্টা সাবস্ক্রাইব করলেই দেখতে পাবেন । বলুন কি খবর?
- এই চ্যাটারজীর খবর জানো কিছু? দু দিন আগে মেসেজ পাঠিয়েছি, দেখো না, কালো টিক হয়ে আছে। ফোন টোন চুরি হয়ে গেল নাকি? তাহলেও দুদিন?
- ও আপনি জানেন না? চ্যাটারজী তো মিডল ইস্ট গিয়েছিল, নিউজ কভার করতে। ঐ যে ফায়ার হয়েছে না একটা, অনেক লোক মারা গেছে, সেখানে। গোলমাল হয়েছে, কিছু রিপোরটারকে এরেস্ট করেছে, ওও সে দলে আছে। মনে হয় তাই ফোন কাজ করছে না। ছেড়ে দেবে কয়েকদিন পরে। তা আপনার জরুরী কোন খবর আছে নাকি>

বংশী কথা ঘোরান। 

- না ঐ আর কি? অনেক দিন খবর নেই। একলা থাকি, একটু যোগাযোগ করা আর কি?
- আমার ভিডিও দেখবেন, সময় কেটে যাবে, আচ্ছা এখন ছাড়ছি, এই ঘাটালে গাছ পোঁতা হবে, সেটা নিয়ে একটা ভিডিও করতে যাচ্ছি। দেখবেন রেডি হলে, বাই। 

বাই বলার আগেই মহারাজ ছেড়ে দেয়। 

ললিতাকে কখনো ফোন করেন নি বংশী, যাই হোক মহিলা, বংশী ভয় পান। হঠাত ফোন করলে কে কি ভাব্বে। অনেক ভেবে চিনতে হোয়াটসাপে ফোন কল লাগালেন। অনেক ক্ষণ ফোন বাজার পর এক যুবকের গলা শোনা গেল, মালয়ালমে। 
বংশী ইংরাজীতে কোনমতে ব্যাখ্যা করে জানালেন ফোনের কারণ। কিন্তু উত্তর শুনে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় রইল না 
- শী ইস ডেড্ড। শী ওয়েন্ট ফর পিল্গ্রিমেজ, ল্যন্ডা স্লাইড, কার ড্রপ ২০০ ফিট। 

কতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন বংশী ঠিক নেই। সব বেখাপ্পা, এবসারড লাগছে। এই ক্যান্সারের রিপোর্ট, হয়ত দুয়ারে মৃত্যু, কিন্তু সেটা যাকেই জানাতে যান, তার আরো সাংঘাতিক উত্তেজক কিছু হয়ে বসে আছে। একটা টিভি চ্যানেলের কল্পনা করেন যেখানে সাধারণ মানুষের খবর থাকবে, তারা কোন খবরটা আজ দেবে? বংশীর তো নিশ্চয়ই নয়। জীবনে নয় মরণেও নয়, বংশী কোনদিন উল্লেখযোগ্য হতে পারবেন না। 

এত বিষণ্ণ হয়ে বসে ছিলেন যে ফোনটা অনেক খন ধরে বেজে চলেছে, খেয়াল হয় নি, হঠাত চমকে উঠে ফোনটা ধরেন। সুদামের ফোন।

-কি আজে বাজে জায়গায় টেস্ট করিয়েছিল বংশী? তোর এত বয়স হল বুদ্ধি হল না টেস্ট করতে দিয়েছিলাম লোয়ার এবডোমেন ওরা পাঠিয়েছি লাংস এক্স রের রিপোর্ট। তাও নামটা দেখেছিস? ভিনোদ চাচারিয়া, ঠিকানা ব্লক এ আর তোর ব্লক বি, ঠিকানাটা এক। তোর সব ঠিক আছে। ওটা মেন্টাল প্রব্লেম। হাসি খুশি থাকিস, পেট ব্যথা আর হবে না। 

বংশী ফোনটা ধরে বসে থাকেন। সুদামের কথা গুলো যেন অন্য কোন গ্রহ থেকে আসছে, অন্য কোন ভাষা, কিচ্ছু মাথায় ঢোকে না।

-শেষ

Post a Comment

0 Comments