দ্বাদশ পর্ব
প্রসূন কাঞ্জিলাল
ভানুমতী
ভানুমতী, কেবলমাত্র দুর্যোধনের স্ত্রী হিসাবে নয়, 'ভানুমতী' হিসাবেই মহাভারতে একটি জায়গা করে নেওয়া উচিত চরিত্র ছিলেন। মনে হতো দুর্যোধনের মতো খলনায়কের স্ত্রী হিসাবে তাঁর মানসিক প্রতিক্রিয়া কী ছিলো ? কৌতূহল নিয়েই খুঁজতে শুরু করলাম। যা পেলাম, তাতে ভানুমতীর জীবন নিয়ে গল্প লেখা যায় না। এতটাই উপেক্ষিতা যে ব্যাসদেব মহাভারতে ভানুমতী নামটাও উল্লেখ করেননি। তাহলে ভানুমতী নামটা এলো কোথা থেকে? নারায়ণ ভট্ট একাদশ শতাব্দীতে 'বেণী সংহার' বলে একটি সংস্কৃত নাটক রচনা করেন, সেই নাটকেই 'ভানুমতী' নামটা ব্যবহার করেন। তাই ব্যাসদেব মহাভারতে দুর্যোধনের স্ত্রীর ব্যাপারে কী বলে গেছেন, সেইখানে আসি। শল্য পর্বে ব্যাসদেব দুর্যোধনের মুখ থেকে একবার 'লক্ষনের মা' বলে উল্লেখ করিয়েছেন। স্ত্রী পর্বে (যে পর্বে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর গান্ধারী শোকাতুর হয়ে কৃষ্ণকে অভিশাপ দেন ) গান্ধারী কৃষ্ণের বরে দিব্যদৃষ্টি পেয়ে রণক্ষেত্রে শোকে পাগল হয়ে, গান্ধারীর মুখ দিয়ে ব্যাসদেব ভানুমতীর সমন্ধে যা বলিয়েছেন তা পড়তেও লজ্জা লাগে। কাশিরাম দাস ও আধুনিক কালে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তা এড়িয়ে গেছেন। খুঁজতে খুঁজতে ১৮৮৩ সালে কিশোরী মোহন গাঙ্গুলী ইংরেজি তে যে ব্যাসদেবের মহাভারত অনুবাদ করেছিলেন, তার অক্ষম বাংলা অনুবাদ তুলে ধরছি -----
"এ দৃশ্য কৃষ্ণ, মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর। কৃষ্ণ দেখো, ওই যে লক্ষনার মা, যার ভারী নিতম্ব, যার চুলের বেণী অবিন্যস্ত, ও যে দুর্যোধনের প্রিয়তমা পত্নী, মনে হচ্ছে বলির বেদীতে ওই স্বর্ণময়ীকে বলি দেওয়া হবে। কোনো সন্দেহ নেই, ওই বুদ্ধিমতী, সুন্দরী রমণী তাঁর সুদর্শন প্রিয়তমের বাহুলগ্না হয়ে বিহার করতোন। কেন আমার পুত্র ও নাতিদের মৃতদেহ দেখেও আমার হৃদয় শত টুকরো হচ্ছে না ? ওই ভ্রান্তিহীন মহিলটি মৃত পুত্রের বিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত মাথার ঘ্রান নিচ্ছে। ওই গৌরবর্ণা উরুর মহিলাটি নিজের গৌরবর্ণা হাতে দুর্যোধনের দেহ কোমলভাবে বুলিয়ে দিচ্ছে। একবার স্বামীর বুকে লুটিয়ে পড়ছে, পরক্ষনেই পুত্রের বুকে। হে মাধব, ওই নারী মাথায় খালি করাঘাত করে চলেছে।"
আপনারা ভাবুন যে ব্যাসদেব মহাভারতে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে 'গীতার সাতশো শ্লোক বলিয়েছেন, সেই ব্যাসদেবই সদ্য সন্তান হারা গান্ধারীর মুখ দিয়ে ভানুমতীর নিতম্ব, উরুর বর্ণনা করাচ্ছেন, অথচ দুর্যোধনের পত্নীর নাম নেওয়াচ্ছেন না।
🍂
কেন ? তাই হয়তো কাশিরাম দাস, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী এই অংশ এড়িয়ে গেছেন দৃষ্টিকটূ বলেই।
অনেক পরে মহাভারতে 'ভানুমতী' নামে যা প্রক্ষিপ্ত হয়েছিলো, শান্তি পর্বে নারদের মুখ থেকে শোনা যায় কলিঙ্গের রাজা চিত্রাঙ্গদ এর মেয়ে ( এখানেও ভানুমতীর নাম নেই ) স্বয়ংবর সভায় ভানুমতী দুর্যোধনকে প্রত্যাখ্যান করলে, স্বয়ংবর সভা থেকে কর্ণ হরণ করেন ভানুমতীকে, তারপরে দুর্যোধনকে প্রদান করেন। কোথাও বলা হয়েছে দুর্যোধনের দুই স্ত্রী - এক, কাশীর রাজকুমারী ও্ দুই, কলিঙ্গের রাজকুমারী। দুজনেই যে একই নারী সেটা বোঝাই যায়। কাশীর রাজার নাম ছিলো ভগদত্ত। না, সেখানেও ভানুমতী নামের উল্লেখ নেই। ভানুমতীর দুই সন্তান, মহাভারতে আছে পুত্র লক্ষনকুমার, কন্যা লক্ষনা। ভানুমতী কী একেবারেই গৃহে অন্তরীণ থাকতেন ? মনে হয় না। তামিল ভাষার মহাভারতে কর্ণ ও ভানুমতী পাশা খেলছেন একা একা, সেখানে কর্ণ ভানুমতীর আঁচল খেলাচ্ছলে ধরে টান দিয়েছেন, এটা উল্লেখ আছে। ইন্দোনেশিয়ার মহাভারতে ভানুমতী কে রাজা শল্য এর মেয়ে বলে উল্লেখ করা আছে যে অর্জুন কে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন ভানুমতী । স্কন্ধপুরাণে ভানুমতীকে বলরামের মেয়ে বলে উল্লেখ আছে। লোককথাতে দুর্যোধনের মৃত্যুর পর ভানুমতী কৃষ্ণের বুদ্ধিতে অর্জুনকে বিয়ে করেন, তাঁর সন্তানের জীবন রক্ষার স্বার্থে।
আমার মনে খালি আসছে, 'ভানুমতী' সেই ভারতীয় নারীদের এক প্রতিনিধি যার নাম নেই, সে কারো কন্যা, কারো স্ত্রী, কারো মা, কারো বন্ধুপত্নী। যার মন নেই, যার বর্ণনা করতে তাঁর দেহের সৌন্দর্য এর উল্লেখ করতে হয়। পুরুষ প্রধান সমাজে 'ভানুমতী' রা চিরকালের উপেক্ষিতাই , তাঁদের নিয়ে গল্প হয়না, জীবনীও হয় না ।।
0 Comments