অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
দু'মাস আগে বাগদাদ গেছিলাম। মনে পড়ল সৈয়দ মুজতবা আলীর সেই বিখ্যাত মজার গল্প। কাজী ডিনার টেবিলে মুরগির একটা ঠ্যাং দেখে বাবুর্চিকে জিগ্যেস করলেন, একটা ঠ্যাং কেন? বাবুর্চি বলে, মুরগির একটাই ঠ্যাং ছিল। কাজী বিস্ময় প্রকাশ করলে বাবুর্চি বলে, আপনাকে দেখিয়ে দেব। কদিন পর কাজীর সামনে একটা মুরগি একটা ঠ্যাং পালকের ভেতর গুঁজে এক পায়ে দাঁড়িয়ে। বাবুর্চি কাজীকে বলে, ওই দেখুন, একঠ্যাঙী মুরগি। কাজী আনন্দে হাততালি দিতেই মুরগি আরেকটা ঠ্যাং বের করে উড়ে গেল। কাজী বলেন, ওই তো দুটো ঠ্যাং। বাবুর্চি বলে, সেদিন টেবিলে এরকম হাততালি দিলে দুটো ঠ্যাংই বের করত। মানুষকে এভাবে মানুষই বোকা বানায়। বিশেষত মৌলানা পুরুত প্রিস্টের মতামত খুব সহজেই মানুষ বিশ্বাস করে।
কেন যে এই কথা এখন মনে এল তার হদিস পাচ্ছিনা। তবে গত বছর ইরানের পার্সিপোলিসে গিয়ে আকাদেমীয় রাজত্বকালে পার্সিদের নানা কীর্তি দেখেছি যার মধ্যে পৌরাণিক গল্পের সাথে ইতিহাস মিশে গেছে। প্রাচীন ইরানি ধর্মে দ্বৈতবাদ সবচেয়ে বিশিষ্ট এবং অনন্য। জরথ্রুস্ট ধর্মগ্রন্থ আবেস্তায় পরস্পর বিরোধী দুই দেবতার কথা বলা আছে। একজন আলোর প্রতীক আহুর-মজদা, আমরা ভগবান বলে যাকে মানি, আর অন্যজন অন্ধকারের প্রতীক আহিরমন বা শয়তান। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই ধর্মগ্রন্থ মতে আলো আর অন্ধকারের দ্বন্দ্ব সৃষ্টির প্রথম থেকেই। জরথ্রুস্টরা মনে করে আলোর জয় হবেই, আহুর-মজদা জিতবেই। কিন্তু আলো আর আঁধারের অবস্থান পাশাপাশি। আঁধার আছে বলেই আলোর প্রকাশ আমাদের কাছে এমন মহৎ। এই আলো এবং অন্ধকার সত্য ও মিথ্যা, সৎ ও অসতের প্রতীকও। বিজ্ঞান মানুষের মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ করে দেখেছে তার দুভাবে কাজ। ছটা রিপু দিয়ে তৈরি মন। এরাই মানুষের মন চালনা করে। প্রত্যেক রিপুর কাজ ঋণাত্মক যদি না তাকে সংযত ব্যবহার করা যায়। এটাই হল মনের অন্ধকারের প্রতিফলন। আবার অন্যদিকে এই মানুষের মস্তিষ্ক প্রেম ভালোবাসা দু:খ আনন্দ বেদনা এবং সৃষ্টিমূলক সব ভালো কাজের আবেগের উৎস। আলোর দিশা। স্বার্থের খাতিরে মানুষ মিথ্যাচার নিষ্ঠুর নির্মম হয়, হত্যা গণহত্যা করতে মন কাঁপে না। আবার এই মানুষই ভগবান মেনে মানত করে পুজো করে প্রসাদ বিতরণ করে গির্জায় মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করে মাজারে চাদর চড়ায়। আসলে এরা সেই ঋণাত্মক মনকেই জীবনদেবতারূপে বরণ করে নেয়। কারণ মন অন্ধকারে নিমগ্ন, আলোর হদিস জানে না। রবীন্দ্রনাথ বারবার বলেছেন, অন্তরের আলো জ্বেলে মনের অন্ধকার দূর করার কথা। সেই আলোর দেখা কবে পাওয়া যাবে তার ভরসায় না থেকে মিথ্যা ক্রূর দুর্নীতির আশ্রয় নিলে সাংসারিক ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সহজে উন্নতি করা যায়। আসলে জীবনযুদ্ধে সবাই জিততে চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তাহলে কি আহিরমন বা শয়তান শক্তিমান, শক্তিশালী হয়ে গেল! ধর্ম সাক্ষী রেখে রাজসভা বিচারালয় কর্মক্ষেত্রে যে শপথ তা মিথ্যা! শয়তানই শক্তিশালী! সারা বিশ্বে আজ শয়তানের প্রতিপত্তি। আহুর-মাজদা বা সততা মানবতার মূল্য দিয়ে যারা বেঁচে আছে এখনও তারা হয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে। যারা জাতি ধর্ম দেশ বিদেশ লিঙ্গ বৈষম্য ও পাসপোর্ট ভিসার বদলে শুধু একটা চমৎকার সীমাহীন আকাশের মত কাঁটাতার ছাড়া শৃঙ্খলহীন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখে তারাও তো এই নীল পৃথিবীর বাসিন্দা। তাদের কি বেঁচে থাকার হক নেই?
🍂
পৃথিবীতে একটা শৈত্যযুগের শেষে উষ্ণযুগের সূচনা হয়েছে বারো হাজার বছর আগে। পঁচিশ লক্ষ বছরের ক্রমবিবর্তনিক মস্তিষ্কের মানবের অভিজ্ঞতা, আর ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটার মস্তিষ্কের পূর্ণতাপ্রাপ্ত মানুষের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে গত বারো হাজার বছর ধরে সভ্যতার নানা দিকে বিকাশের ছাপ রেখে গেছে। তার মধ্যে অন্যতম লিপি আবিষ্কার। মেসোপোটেমিয়ার টাইগ্রিস -ইউফ্রেটস অববাহিকায় কিউনিফর্ম লিপি উদ্ভব এবং তার ব্যবহার মানুষের মনের কথা প্রকাশে সাহায্য করেছে। সেই লিপির বিবর্তন হয়ে আজকের অসংখ্য লিপিতে ভাষা-সাহিত্য এটাও ইতিহাস। এসব তো সেই সৎ আবেগের প্রকাশ। বর্তমান উষ্ণ যুগ শুধুই পৃথিবীকে ক্রমাগত গরম করছে তা নয়, মাঝেমধ্যে ছোট সময়ের জন্য শৈত্য প্রবাহ হয়। তবে সাত-আট হাজার বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা এমন বৃদ্ধি পেয়েছিল যা আজকের থেকেও বেশি। সেসময় পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক জলস্ফীতি হয়, মেরু অঞ্চলে বরফ গলে সমুদ্রের জল হুহু করে বেড়ে যায়। পাহাড়ের মাথায় গ্লেসিয়ারের বরফ গলে বিশ্বজুড়ে নদীগুলোতে বন্যা হয়। তারই বর্ণনা লেখা আছে বাইবেলে। প্রাচীন আসিরীয় ব্যবিলনীয় প্রস্তরগাত্রে সে ঘটনার কথা খোদিত আছে। ব্যবিলনের ঝুলন্ত বাগানের অস্তিত্ব দেখিনি, কিছু প্রশ্নাতীত নয় এমন খণ্ডহর দেখেছি। হিন্দু শাস্ত্রে আছে কেশব তখন মীন-শরীর ধরে বেদ বাঁচিয়েছিলেন। অর্থাৎ সেই বন্যা অনেক ক্ষতি করলেও তখনকার সভ্যতা সংস্কৃতি ভেসে যায় নি। এর পরও সভ্যতা এগিয়েছে। অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন পথে তার বিকাশ হয়েছে।
আর্কটিক সাগরে সর্বোচ্চ অক্ষরেখায় স্পিৎজবার্জেন দ্বীপপুঞ্জের লংইয়ারবেন দ্বীপে পৃথিবীর সব তৃণ লতা গাছের বীজ মাটির নিচে সযত্নে সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা আছে দেখে এসেছি। পৃথিবীর অমূল্য সম্পদ রক্ষা করা এর উদ্দেশ্য। মনে পড়ে সেই বন্যা আসার আগে জেহোভা সেসময়কার পয়গম্বর নূহকে নৌকা বানিয়ে পৃথিবীর সব গাছ ফুলের বীজ সব প্রাণী জোড়ায় জোড়ায় রেখে দিতে বলে যাতে বন্যার পর পৃথিবীতে আবার আবাদ সম্ভব করে তোলা যায়। এ-ও তো মানুষের সেই সদ্ভাবনা, আহুর-মজদা। আর্কটিক সাগরে ঝড় দেখেছি। ছুঁচের মত হাওয়া ছ-সাত স্তরীয় পোশাকের ভেতর দিয়ে ঢুকে চামড়ায় বিঁধছে। পালিয়ে যাইনি। অনুভব করতে চেয়েছি প্রকৃতির তীব্রতা, তার ভয়ংকর শক্তি। এমনই তীব্র প্রলয়ের অভিজ্ঞতা আছে আন্দামান সাগরেও। প্রলয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চ্যালেঞ্জ নয়, তীব্রতা সহ্য করার চেষ্টা করেছি। আহিরমন তখন ভগবান স্মরণ করেনি। শয়তান দূরে থেকে দেখেছে তার চেয়েও শক্তিমানকে। না, গর্ব নয়, সে যেন কখনও না হয়, এ আত্মশক্তির ক্ষমতা বোঝানোর চেষ্টা। মানুষের আত্মশক্তিকে শয়তান ভয় পায়।
প্রথম দিকে বলা দুটো কথা সংশোধন করা দরকার। বলেছি, আলো আর আঁধারের চিরকালীন দ্বন্দ্বের কথা। এটা ভুল। আঁধারের গায়ে গায়েই আলোর পরশ। প্রতিবেশি বললে ভুল হবেনা। কোনো প্রাণী অন্ধকারকে ভয় করে না, ভয় করতে জানেনা। যেটার জন্য সতর্ক থাকা তা আক্রমণ, শিকার হওয়া। সে ভয় নিশাচর প্রাণিদের দিনের আলোতেও আছে। মানব বা পরে মানুষেরও অন্ধকারে ভয় ছিল বলে জানা নেই। যা ছিল তা অন্য প্রাণির আক্রমণের যার জন্য তারা রাতে আগুন জ্বালিয়ে রাখত। তাহলে অন্ধকারকে ভয় করতে জানল কবে? যখন কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ আপামর জনগণকে বোঝাতে শুরু করল ধর্মের নীতি ও তার মেনে চলার রীতি। যখন আহুর-মজদা আর আহিরমনকে আলাদা করে চিনিয়ে দিল একটা আলো অন্যটা অন্ধকার। মানুষের মনে দ্বন্দ্বের বীজ বপন করল। সবই ছিল কিন্তু তাকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিল। যেমন কোনো শিশু জ্ঞানপ্রাপ্ত হওয়ার সাথে সাথে জানতে শেখে ভাল আর মন্দ। এই শিক্ষা সে পায় প্রথমে পরিবার ও পরে সমাজ থেকেই। তার রিপুগুলো সজাগ হয়, সক্রিয় হয়ে ওঠে বা বলা ভাল সক্রিয় করে তোলা হয়। অথচ তার মধ্যে ভালো গুণগুলোও আছে। এখন কোনো কাজ করতে গেলে একেবারে প্রথম দিকে ভালোমন্দের বিচার যুক্তি কাজ করে না কিন্তু কিছু পরেই সে নিজেই যুক্তি দিয়ে কাজটা করে ফেলে। যদি ভালো হয় বাহবা পায়, মন্দ হলেও "দেখ কী পাকা হয়েছে " বলে একরকম বাহবাই পেয়ে থাকে। একটা বয়সের পর যখন তার সেই কাজ আর ভালো বলে মনে হয়না তখন তাকে মন্দ বলে বোঝানোর সময় অনেক দেরি হয়ে গেছে। এভাবেই শয়তান আহুর-মজদার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সেই আলো ভালো আর অন্ধকার শয়তান বলে তাকে ভয় পাওয়ানোর অভ্যেস শুরু হয়ে যায়। অন্ধকার মানেই যত বিপদ, দুষ্কর্মের সময়। তার থেকে মুক্তি পেতে বিপদ তাড়ানোর পুজো কর। মানুষের মন ধীরে ধীরে গভীর আঁধারে নিমজ্জিত হতে থাকে। ধর্মের ব্যবসায়ীরা তাতে আরও বেশি ইন্ধন যুগিয়ে মানুষকে সংস্কারে জড়িয়ে ফেলে যা তাকে আর আত্মশক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করেনা।
দ্বন্দ্ব মানে যুদ্ধ। জীবনযুদ্ধ কথাটাও ব্যবহার করেছি আগে। কেন বলব যুদ্ধ? জীবন কার সাথে যুদ্ধ করছে? এটাও আমাদের শেখানো হয়েছে ধর্মের নামে। ঋণাত্মক ভাবনা। ভেবে দেখলে মানুষ জীবন সব কিছুর সাথে একটা সন্ধি করে, সহনশীল হয়ে, মানিয়ে নিয়ে চলছে। সেই প্রাচীন পশ্চিমী সাহিত্যে প্রকৃতির সাথে অবিরাম যুদ্ধের কথা বলা আছে। প্রকৃতির সাথে কেন যুদ্ধ, তা বলে না। প্রকৃতির যে প্রচণ্ড শক্তি তার সাথে যুদ্ধে পারবে মানুষ? কখনোই পারেনি। কিন্তু প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়া মানুষের অভ্যেস হয়ে গেছে। সবেতেই যুদ্ধ আর সেই যুদ্ধে জিততে হবে। তার জন্যে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করতে হবে। মানত করতে হবে। সেই আহিরমনকেই প্রাধান্য দেওয়া। তাকে স্বীকার করে অধর্ম করা। অধর্ম অন্যায়কে মানুষ ভন্ডামি বলে মনে করে না, এটাই সান্ত্বনা। আবার এদিকে ভন্ডামিকে ঘৃণা করে মানে আহুর-মজদাকে মান্যতা দেয়। ভন্ডামি আহিরমনের, সত্যনিষ্ঠা মজদার। এই দ্বন্দ্ব মানুষের মনে অবিরাম হয়েই চলেছে। এর অবসান নেই। আলো-আঁধারের দ্বন্দ্বের শেষ নেই। সেই হ্যামলেটের "টু বি অর নট টু বি" র সন্দেহ দোলায় অহরহ দুলছে মানুষ।
2 Comments
মনের ভিতরের দ্বন্দ্ব - যুদ্ধে
ReplyDeleteনিজের সাথে নিজেরই সন্ধি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গিয়েছেন, অন্তরের আলো জ্বেলে মনের অন্ধকার দূর করতে।
ReplyDelete