জ্বলদর্চি

মধুবাবুর মনকষ্ট /কমলিকা ভট্টাচার্য

মধুবাবুর মনকষ্ট
কমলিকা ভট্টাচার্য

ফোনের ওপার থেকে মিষ্টি গলায় কেউ বলল, "হানি, তোমার বাড়ি কোথায়?"

মধুবাবু ঘামতে ঘামতে বললেন, "কেন?"

"না, ভাবছিলাম একদিন আপনার বাড়ি যাব, সারাদিন সেখানেই কাটাবো, রান্না-বান্না করবো, খাওয়া-দাওয়া করবো আর অনেক অনেক গল্প।"

মধুবাবুর চোখে জল এসে যায়। তিনি বলেন, "সত্যি বলছেন?"

ওপার থেকে জবাব আসে, "মিথ্যা কেন বলবো? কেন, আপনার কোনো অসুবিধা আছে?"

মধুবাবু গলে জল হয়ে বলেন, "সত্যি আসবেন? আজ কতদিন হলো কেউ আমার বাড়ি আসেনি! এইভাবে তো কেউ বলেইনি। তাই নিজের ভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না।"

"নিশ্চয়ই আসবো।"

মধুবাবুর চোখের জল যেন বাঁধ ভাঙে।

কল্যাণীদেবী মধুবাবুকে নাড়া দিয়ে বলেন, "এই, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাঁদছো কেন? কী হয়েছে? স্বপ্ন দেখছ?"

মধুবাবু ধড়মড় করে উঠে বসেন। দেখেন, বালিশ জামা ভিজে গেছে। বুঝতে পারেন না—ঘামে নাকি তিনি সত্যি সত্যি কাঁদছিলেন।

কল্যাণীদেবী বলেন, "কী স্বপ্ন দেখছিলে? আমি মরে গেছি? তা দেখে তো তুমি খুশি হবে, কাঁদার তো কথা নয়।"

মধুবাবু কোনো উত্তর না দিয়ে টয়লেটে চলে যান। কল্যাণীদেবী বলেন, "টয়লেট থেকে ফিরে এসে হাত-পা না ধুয়ে বিছানায় এসো না। তাই উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখো! কতদিন বলেছি!"

মধুবাবু একবার ঘড়িতে দেখলেন—সাড়ে পাঁচটা। আবার শুয়ে পড়লেন, কিন্তু স্বপ্নটা ঘুরেফিরে মাথায় আসতে লাগল। তিনি তো কোনোদিন কোনো মহিলার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন না। তবে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নেবেন কিনা, পলিসি করাবেন কিনা এসব জানতে চেয়ে ফোন করে মেয়েরা, তিনি না বলতে পারেন না ,ফোনটা কাটতে পারেন না। কল্যাণী দেবী তো তাকে এজন্য সবসময় কথাও শোনান, "মেয়েদের গলা শুনলেই তুমি গলে যাও!"

অনেক ভেবেও স্বপ্নের কোনো কিনারা করতে পারলেন না। তবে ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয়, তাহলে…

ঠিক সেই সময় মাথায় এলো—স্বপ্নের ব্যাপারে এটাও বলা হয় স্বপ্নে নিজেকে দেখলে পরের হয়। পাশাপাশির কেউ না হলে তিনি এমন স্বপ্ন দেখবেন কেন? হঠাৎ তার মনে হলো—তাহলে কি কল্যাণী?

🍂

ইদানিং কল্যাণীর আচরণ কেমন যেন একটু অন্যরকম। সারাক্ষণ মোবাইলে যেন কী লিখে চলেছে। মাঝে মাঝে আপন মনে হাসছে। অনেক রাত পর্যন্ত ফোনে কী যেন করতে থাকে, কারো সঙ্গে কথা বলে। সেদিন তিনি দেখেছিলেন, ফোনে কেউ মেসেজ পাঠিয়েছে—"হাও আর ইউ?"

মধুবাবু পাশ ফিরে দেখেন, কল্যাণী দেবী তখনও ঘুমিয়ে। তিনি কল্যাণী দেবীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "কিগো, ছটা বাজে, উঠবে না?"

কল্যাণী দেবী বলেন, "রাতে ভালো ঘুম হয়নি। এখনো ছটা হয়নি, পাঁচ মিনিট বাদে উঠছি। কেন, তোমার কী হলো? এত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেল?"

"আচ্ছা কল্যাণী, তোমার পাড়ার ছেলেটা, যে তোমার স্কুলের বন্ধু ছিল… ওর নাম কি সুর না তাল? সেই যে সেবার তোমাদের বাড়িতে দেখা হল, তার সঙ্গে তোমার কথা হয়?"

কল্যাণীদেবী বললেন, "কেন? তুমি স্বপ্ন দেখেছো যে আমি তার সঙ্গে প্রেম করছি? দেখো, সকাল সকাল বাজে কথা বলে মেজাজ খারাপ করো না। হাজারো কাজ পড়ে আছে।"

"না, আমি সে কথা বলিনি। জানতে চাইলাম তো। বেশ ভালো ছেলে, পড়াশোনাতেও ভালো ছিল। তোমার সঙ্গে মানিয়েও যেতো। তাহলে তোমাদের বিয়েটা কেন হলো না? বাড়ি থেকে মানেনি বুঝি?"

কল্যাণী দেবী এবার উঠে বসে বললেন, "তোমার বেকার কথা শোনার আমার কাছে সময় নেই। আমি যাচ্ছি কাজে। আর আগে থেকেই তোমায় সাবধান করছি, সকালবেলায় এসব নিয়ে শুরু করবে না।"
কল্যাণী দেবী দুকাপ চা বানিয়ে খাবার টেবিলে এসে বসলেন। মধু বাবু খবরের কাগজ দেখছিলেন। কল্যাণী দেবীকে দেখেই বললেন,"কল্যাণী তোমরা তো সব বন্ধুরা মিলে একটা গ্রুপ বানিয়েছ সেই গ্রুপে ওই ছেলেটি আছে বুঝি থাকলে কোন অসুবিধা নেই আমি জাস্ট জানতে চাইছিলাম।
আমি বুঝি সারাদিন তুমি নানা কাজে ব্যস্ত থাকো, কাজের শেষে তাদের সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করে।"
কল্যাণী দেবী বললেন,"তা এতই যখন বোঝো, তাহলে তুমি তো একটু কথা বলতে পারো আমার সাথে, হাতে হাতে কাজে একটু হেল্প করতে পারো।"
"আচ্ছা একটা কথা সত্যি বলবে, ঐ ছেলেটা কি তোমার সঙ্গে  যোগাযোগ করে, ফোনে কথা বলে?"

কল্যাণী দেবী বিরক্ত হয়ে বললেন,"হ্যাঁ, কথা বলি প্রায়ই কথা বলি তোমার কোন অসুবিধা আছে?"
মধু বললেন,"আমার কিসের অসুবিধা তোমার যার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে কথা বলবে যতই হোক তোমার প্রাণের বন্ধু ছিল কিনা একদিন।"
কল্যাণী মধুবাবুর হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বললেন ,"বাজে কথা বসে বসে চিন্তা না করে বাজারটা সেরে এসো।"
আজ মধুবাবু কোনো কাজে মন বসাতে পারছেন না।মনে মনে ভাবছেন কল্যাণী তাহলে পর্যন্ত তাকে ভুলে তার পুরনো বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করছেন। 
কল্যাণীদেবী তাহলে তাকে আর ভালোবাসেন না।
কল্যাণী যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তাহলে তার কি হবে।

তবে মনে মনে একথাও ভাবেন,কাউকে বিনা প্রমাণে  কিছু বলাটা ঠিক নয় তাছাড়া এই বয়সে এসে কল্যাণী এইরকম কিছু করতে পারে না।
তবে সারাদিন মধুবাবু নানা বাহানায় কল্যাণীর উপর নজরদারি শুরু করেন।


কল্যাণী মোবাইলে হাত দিলেই মধুবাবু পাশে এসে দাঁড়ান, জিজ্ঞাসা করেন, "কি করছ?" উঁকি মেরে দেখেন, কী করছে।

কল্যাণী দেবী রাগ করে বলেন, "অনলাইনে তোমার খাবারের জন্য অর্ডার করছি।"
কল্যানীদেবীকে কাউকে ফোন করতে দেখলে পাশে এসে দাঁড়ান সেখানে আর শুনতে চান কার সঙ্গে কথা বলছেন।
কল্যাণী দেবী ব্যাপারটা আন্দাজ করে বলেন " কি ব্যাপার সমানে আমার পিছনে পিছনে কেন ঘুর ঘুর করছো?"
মধুবাবু বলেন ,"তোমার ফোনটা দাও কিছু অর্ডার করব।"

কল্যাণী দেবী রেগে ফোনটা ওনার হাতে দিয়ে বলেন," জিনিসপত্র কিনতে নিজের ফোনওতো  ব্যবহার করতে পারো।"

মধুবাবু ফোনটি হাতে নিয়ে দেখেন,তারপর কল্যাণী দেবীকে জিজ্ঞাসা করেন "কে তোমাকে হাউ আর ইউ পাঠিয়েছে?"
কল্যাণী দেবী এবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলেন," অনেকেই আছে পাঠাবার ,কেউ কেউ তো আই লাভ ইউ পাঠায়, সারা দিনে কত লাল পান পাতা আসে।"

রাতে মধুবাবু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার ভান করেন। ভাবেন, আজ রাতে দেখবেন কল্যাণী কার সাথে কথা বলে, কী কথা বলে।

রাত বাড়তেই কল্যাণী দেবী ফোন নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। মধুবাবু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলেন।

কল্যাণী দেবী ফোনে বললেন, "ডার্লিং, কী করবো বলো! বুড়োটা আজ সারাদিন আমার পেছনে! কী জানি কী সন্দেহ করেছে! সমানে আমাকে লক্ষ্য করছে! তাই সারাদিন লিখতে পারিনি। আদর সোনা, প্লিজ রাগ করো না। এই নাও, চুমু দিলাম!
সারাদিন এই বুড়োটার খিট খিট আর ভালো লাগেনা। আদর সোনা আমার..." 

মধুবাবু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না! কল্যাণী এসব কী বলছে!
অত্যন্ত মনে কষ্ট নিয়ে মধুবাবু বিছানায় গিয়ে শুলেন। মনে মনে ভাবতে লাগলেন তিনি কল্যাণীর থেকে প্রায় দশ বছরের বড় তাই বলে কল্যাণী এইভাবে বুড়ো বুড়ো বলছে। তারও তো বয়স কম হয়নি।
তার এই প্রচন্ড মনকষ্টের কথা তিনি কাকে বলবেন। এই বয়সে তার কপালে এই লেখা ছিল। কল্যাণী যে এইভাবে তাকে ঠকাবে তা তিনি ভাবেননি। তিনি কল্যাণীকে খুব ভালবাসেন মাঝে মাঝে রাগ করেন তাহলে কল্যাণী সে কথা বুঝল না। বাইরের কাউকে বললে লোকেরা হাসাহাসি করবে। 
মধু বাবু মনে মনে ভাবেন স্বপ্নে ভগবান তাকে ঠিক ইঙ্গিত দিয়েছেন। 
মধুবাবুর নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে।
মনে মনে ভাবেন কল্যাণী ঘরে আসলে তাকে আজ সরাসরি জিজ্ঞাসা করবেন সে কার সাথে কথা বলছিল। 
দেখবেন সে কি বলে। 

কল্যাণী দেবী শোয়ার ঘরে ঢুকে মধুবাবুকে জেগে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক হন। 

"কী হয়েছে? ঘুমোওনি?"

মধুবাবু ধরা গলায় বললেন, "কার সাথে কথা বলছিলে?"

কল্যাণী দেবী বললেন, "ছেলের সাথে।"

"মিথ্যে কথা বলছো!"

কল্যাণী দেবী হাসতে হাসতে বললেন, "তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের কথা শুনছিলে?"

হ্যাঁ, শুনছিলাম।"

"বিশ্বাস না হয় ছেলেকে ফোন করো।"

মধুবাবু ফোনটা হাতে নিতেই দেখলেন, ছেলে মেসেজ পাঠিয়েছে—

‘বাবা, এপ্রিল ফুল! মাম্মি আর আমি মিলে তোমায় এপ্রিল ফুল করেছি! লাভ ইউ, বাবা!’

মধুবাবু ফোনটা রেখে বললেন, "এসির টেম্পারেচার একটু কম করে দাও, গরম লাগছে।"

কল্যাণী দেবী অবাক হয়ে তাকালেন। প্রতিদিন ঠান্ডা লাগার অজুহাতে এসির তাপমাত্রা বাড়ানো কথা বলা মধুবাবু আজ উল্টো কথা বলছেন!

কল্যাণীদেবী এসি বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
আকাশ জুড়ে রয়েছে আলোর আভা,
বাতাসে আমফুলের গন্ধ।সব তার মন ছুঁয়ে যায়।

মন বলে—এপ্রিল ফুল!

Post a Comment

3 Comments

  1. দারুণ সুন্দর লেখা। শেষ পর্যন্ত কৌতূহল বজায় থাকে।

    সুদাস ভট্টাচার্য্য

    ReplyDelete
  2. আকাশ জুড়ে শুনিনু সে হাসে সে হাসে

    ReplyDelete
  3. কমলিকা ভট্টাচার্যApril 05, 2025

    হাসালে তুমি মোরে....
    ধন্যবাদ

    ReplyDelete