স্মৃতির পটে
তৃতীয় পর্ব
সুদেব কুমার ঘোষ
আমাদের গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তারাজুলি খাল। ক্ষীরপাই – আরামবাগ সড়কের উপর রামজীবন পুর শহর পার হলে যে খাল পার হতে হয় তার নামই তারাজুলি। আবার কামারপুকুর প্রবেশের আগে মান্দারনের নিকট যে খাল পার হতে হয় তার নাম আমোদর। এই খাল আমাদের গ্রামের উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়েছে। ভূগোল - ইতিহাস থেকে জানা যায় আমাদের দেশ নদী – মাতৃক। আমাদের গ্রামটিও তাই। এই খাল দুটি যেমন আমাদের কৃষিজ ফসল ধংস করে , তেমনি আমাদের কৃষি জমিকে উর্বরও করে তোলে। তখন জমি সুজলা – সুফলা হয়ে ওঠে। এই দুটি স্রোতস্বিনী খাল হলেও আমরা এই দুটিকে নদী নামেই অভিহিত করে থাকি। তারাজুলি আমাদের গ্রামের অতি নিকট দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলেই এই নদীর সাথে আমার বাল্যকাল থেকেই সখ্য। এই নদীর তীরে তালগাছ বেষ্টিত এক পাকুড় গাছ আছে। সেখানে স্নান করার ঘাট আছে। সেইখানে আমরা স্নান করতাম। মকর সংক্রান্তিতে এই নদীতেই আমরা সবাই পূণ্য স্নান করতাম। দুদিকের দুই নদী আমাদের দলকার জলা ভূমিকে সুজলা - সুফলা করে তুলেছে। আমাদের গ্রামের পূর্ব দিকে আছে বিশাল জলাভূমি। এই জলার নামই দলকার জলা। এর আয়তন প্রায় চব্বিশ বর্গ কিলোমিটার। পাঁচ থেকে ছয়টি গ্রামের জমি আছে এই জলাতে। তার মধ্যে আমাদের গ্রামের লোকের জমির পরিমাণ সবথেকে বেশী। আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি এই দুই নদীর জলে গ্রীষ্মকালে বোরো চাষ সহ আরো কত ফসল চাষ হয়েছে। কিন্তু এখন নদী শরতের পরেই শুকিয়ে যায়। এই দুই নদী কেবল শস্য নয় --- প্রচুর মাছ উৎপাদন করে। এতে অন্তত দু থেকে তিন মাস বেশ কয়েকটি পরিবারের সংসার চলে যায়।
আমাদের গ্রাম থেকে আরামবাগ এবং ঘাটাল কাছাকাছি। আরামবাগ শহরের পাশ দিয়ে বহে গেছে দ্বারকেশ্বর নদ এবং ঘাটাল শহর ভেদ করে বহে গেছে শিলাবতী নদী। দুই নদীর মিলিত রূপ হল রূপনারায়ণ নদ। ফলে আরামবাগ এবং ঘাটাল এই দুই মহকুমার বেশ কিছু অঞ্চল প্লাবন ভূমি। ফলে বর্ষায় বৃষ্টি হলেই বন্যার সৃষ্টি হয়। ফসল নস্ট থেকে ঘর – বাড়ি সবই ধংস হয়। যেমন উনিশশ আটাত্তর সালের বন্যায় আমাদের গ্রামের প্রায় সব বাড়ি – ঘর ধংস হয়ে গিয়েছিল। সেই বছর আমি মাধ্যমিক পাশ করে ইলেভেন ক্লাসে বীরসিংহ স্কুলে ভর্তি হয়েছি। দুর্গাপুজোর আগে দুদিন ধরে প্রবল বৃষ্টি। আমরা রেডিও থেকে চতুর্দিকের বন্যার খবর শুনছি। তখন আমরা বুঝতে পারছি আমাদের গ্রামের অবস্থা মোটেই ভালো নয়। বীরসিংহ স্কুলে আমরা প্রায় পাঁচ থেকে ছয় জন পড়তাম। আমাদের পাশের গ্রাম নাকুন্দর একজন স্যার ছিলেন। তিনি বীরসিংহ স্কুলের ভূগোলের শিক্ষক। বীরসিংহ গ্রাম থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় আট কিলোমিটার। পদব্রজে ছাড়া অন্য উপায়ে যাবার ব্যবস্থা নেই। দুদিন টানা বৃষ্টির পর স্যার বললেন “ চল, হেঁটে হেঁটে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে গ্রামে যেতে হবে। আমিও যাব। “ যে সোজা পথে আমরা যাতায়াত করতাম সেটি বন্যার কবলে। অগত্যা তিরিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেই যেতে হল। সকাল দশটার সময় খেয়েদেয়ে বের হলাম। বীরসিংহ গ্রাম থেকে এলাম ক্ষীরপাই। এরপর পাকা সড়ক ধরে জাড়া শ্রীনগর হয়ে রামজীবনপুর। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে রামজীবনপুরের পরেই তারাজুলি খাল বহে গেছে। সেখানে যখন পৌঁছালাম তখন সূর্য ডোবে ডোবে। নদীর ব্রীজ বন্যায় উড়িয়ে দিয়েছে। প্রবল স্রোত। অনেকটা পাশ দিয়ে কেউ কেউ পার হচ্ছে। আমাদের চোখের সামনে একজনকে পার হতে গিয়ে আমরা ডুবে মরতে দেখলাম। তবে ওই ব্যক্তি সাঁতার জানলে মারা যেত না আমরা সকলে সাঁতার জানতাম। আমাদের আস্থা ছিল যে আমরা পার হয়ে যাব। কিন্তু স্যার ওই রকম মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে আমাদের প্রস্তাবে রাজী হলেন না। অনন্যোপায় দেখে রামজীবনপুর স্কুলের হোস্টেল কতৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে হোস্টেলে রাত কাটালাম। পরদিন সকালে উঠেই আবার হাঁটা দিলাম গ্রামের উদ্দেশে। সকাল আটটার সময় বাড়ি পোঁছে দেখি বাড়ি ধুলিস্যাৎ।
ঘরের যাবতীয় আসবাবপত্র , খাবার – দাবার সব চাপা। লোকজন ঘরের চালে দিন কাটাচ্ছে। যে রাত্রে লোকজন বুঝে নিয়েছে ঘর পড়বেই , সেই রাত্রেই তারা গোবাদি পশু নিয়ে বন্যা পেরিয়ে উঁচুর দিকের গ্রামে এবং আত্মীয় – স্বজনদের বাড়ি চলে গিয়েছিল। পরের দিন বাড়ির টানে যখন ফিরে এল তখন সবার চোখে জল।
আমি যখন বাড়ি পৌঁছালাম তখন মাও চলে এসেছে তাঁর সাজানো সংসার কিভাবে ধংসস্তুপে পরিণত হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখার জন্য। আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। ঠাকুমা , কাকা , কাকিমা , বাবা , মা আরও ভাই বোন।মা ছিল বাড়ির বড় বউ। সাত বছর বয়সে মা এ বাড়িতে বাবার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে এসেছিল। তারপর ধীরে ধীরে সংসার তরনিতে পা রেখে যাত্রা আরম্ভ। ঠাকুমার হাতে সংসারের হাল ধরা থাকলেও মা দাঁড় বেয়ে চালাত। রান্না ঘরের পুর কতৃত্ব মায়ের হাতে। মা তার সব সন্তানকেই সমান চোখে দেখত। আমি প্রায় দু সপ্তাহ পরে বাড়ি যাবার পর মা এই প্রথম অনুভব করল আমি ছেলেকে কিছুই খেতে দিতে পারলাম না। আমি উল্টে মাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলাম। কিন্তু চোখের জল যেন বন্যার জলকেও ছাপিয়ে গেল। সরকারী সাহায্য এবং রামকৃষ্ণ মিশনের খিচুড়ি খেয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছিল। পড়াশুনা করতে পারব কি – না এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল মনে। ক্ষীরপাই ধ্রুবানন্দ আশ্রমে থেকে পড়াশুনা করার সুযোগ পাই। এই আশ্রমের শাখা আছে আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছেই। বিকেলে খেলাধুলা করে হাত – পা ধুয়ে সন্ধার নাম গানের সাথে যোগ দিতাম। সেই আশ্রমেই হল আমার থাকা – খাওয়ার আশ্রয়স্থল। ভগবানের কি অপার করুণা!
0 Comments