জ্বলদর্চি

না লেখা গল্পটা /পুলককান্তি কর

চিত্র- শুভম দাস 

না লেখা গল্পটা

পুলককান্তি কর


সজল খানিকটা মজার সুরেই বলল, 'জানো নন্দিনী, একটা কথা তোমায় বলতে ভারি ইচ্ছে করছে, কিন্তু ভয়ে বলতে পারছিনা! তোমাকে আমি কত ভয় পাই ভাবো!' 
নন্দিনী খানিকটা তেরিয়া হয়েই যেন বলল, 'এমন কথা বলার ভাবনা মাথায় আসে কেন আপনার, যাকে ভয়ে ভয়ে বলতে হয়?' 

মঞ্জুষ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নন্দিনী মেয়েটিই এমন, দিল সব মাটি করে। চটজলদি সে এমন বাক্যবাণ হানে, তারপর আর কথা চলে না।বেশ রসিয়ে কষিয়ে আর পাঁচটা মেয়ের মতো বলতেই পারতো, 'কী এমন কথা সজলদা যে আপনি ভয়ে মরে যান?', বা নিদেনপক্ষে চুপ করে থাকলেও সজল একটু সময়-টময় নিয়ে পরের বাক‍্যে গিয়ে মনস্কামনাটা নিবেদন করতে পারতো... কিন্তু এখন সে গুড়ে বালি। বড় দৃঢ় আর গোঁয়ার মেয়েটা। একটু মেয়ে সুলভ কৌতুহলও কি থাকতে নেই ওর! জানতে কি তার ইচ্ছে করে না, কী এমন বলতে চাইছে সজল? নাকি সে সজলকে কোনও ভাবেই এগুতে দিতে চায় না?
--'কী হল? যাচ্ছি বলে তো আধঘণ্টা কাটিয়ে দিলে! বাজারটা না আনলে আমি রত্নাদিকে দিয়ে কীই বা ছাই জোগাড়-টোগাড় করে রাখব? বেলা দশটা বাজে! রান্নাবান্না কি হবে না আজকে?' একটানা গজগজ করতে করতে মঞ্জুষের লেখার ঘরে এসে ঢুকলো পর্ণা। 'বলি বাজার যাবে? নাকি খাবার অনলাইনে অর্ডার করে দেব?'

🍂
ad

মঞ্জুষ মনে মনে ভাবল বাজার না গেলে ভালোই হয়, তবে পর্ণার এরপর আরও দশটা বাক‍্যবাণ আসবে তার চেয়ে ধীরে ধীরে উঠে পড়াই ভালো। সে ওঠার উপক্রম করতেই পর্ণা ওর খাতার কাগজটার শেষ কটা লাইন পড়ে বলল, 'সজল কী এমন বলতে চাইছিল শুনি?'
-নন্দিনী আর বলতে দিল কোথায়?
-বলতে দিলে কী বলত, সেটা তো বল! প্রেমের প্রস্তাব দিত নাকি?
-না, না।
-তবে কী বলতে চাইছিলে ওই খেলুড়ে টাইপ মেয়েটাকে?
-প্রথম কথা আমি বলতে চাইবো কেন, আর দ্বিতীয় কথা... 
   কথার মাঝে কথা টেনে পর্ণা বলল, 'তুমি লিখছো যখন, সজলের কথা তো তোমার কথাই! মেয়ে পটানোর জন্য তুমি এমন কথাই তো বল।'
-তুমি আমাকে ক'টা মেয়ে পটাতে দেখেছ পর্ণা?
-তোমার কি আর পটানোর হিম্মত আছে? তবে ফ্লার্ট করার মৃদু চেষ্টা তো তুমি করেই থাকো সবসময়। থাক্ সেসব নিয়ে আমার বিশেষ চাপও নেই, মাথাব্যথাও নেই! কিন্তু মালটা কে? প্লে-ওম‍্যান?
-কার কথা বলছ পর্ণা? কিছুটা আশ্চর্য হয়ে মঞ্জুষ তাকিয়ে রইল পর্ণার দিকে। 
-কে আবার? ওই নন্দিন্... খানিকটা শম্ভু মিত্রের মতো গলার টোন নকল করে ব্যঙ্গ করে উঠলো  পর্ণা। 
-নন্দিনী একটা ক্যারেক্টার! সেটা না বোঝার মত তুমি ইম'ম্যাচিওর তো নও পর্ণা! 
-ক্যারেক্টার হোক বা যেই হোক, জীবনের কোন একটা চরিত্রের আবছায়ায় তো তাকে ভেবে লিখছ। সুতরাং সে পুরোপুরি ভার্চুয়াল কী করে হয়? 
-তোমার সঙ্গে এই নিয়ে বাক্য বাড়িয়ে কোনও লাভ হয় না পর্ণা। মিছিমিছি এসব নিয়ে কেন কথা বলতে আসো? আর তাছাড়া এই দু-চার লাইন পড়ে তুমি বুঝে গেলে নন্দিনী খেলুড়ে মেয়ে? একেবারে প্লে-ওম্যান? মঞ্জুষের গলায় স্পষ্ট বিরক্তি। 
পর্ণা খানিকটা চুপ করে থেকে বলল, এগুলো মেয়েদের স্ট্র‍্যাটেজি। ও যেভাবে সজলের কথার বাষ্পটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল, তাতে ওই কথার বাষ্প ফানুস হয়ে বাড়তে বাড়তে সজলকেই উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। 
-কথার বাষ্পটা তো বেলুন হয়েছিল পর্ণা। নন্দিনী ওটাকে পিন দিয়ে ফুটো করে দিল। ও আর ফানুস হবে কী করে? 
-এই তোমার লেখকের বুদ্ধি! ওটা স্ট্র্যাটেজি! খেলুড়ে মেয়েরা এমনই করে! 
  মঞ্জুষ এবার বিরক্ত হয়ে বলল, 'সবকিছুতেই একেবারে বিপরীতটা তোমার কী ভাবে মনে হয় পর্ণা? নন্দিনীর চরিত্রটা তো পুরোটাই তোমার ভাবনার উল্টো!
-তুমি এত যখন ওর চরিত্র চেনো, তাহলে বল, সে মেয়েটি কে? তোমার এক্স কেউ নাকি? 
-বাজে কথা ছাড়ো। কী কী বাজার আনতে হবে বলো। 
      মঞ্জুষ বেশ বিরক্তি নিয়েই জামা কাপড় চেঞ্জ করতে গেল। পর্ণার এই এক সমস্যা। সে পারতপক্ষে ওর সাথে লেখা নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। তবু প্রকাশিত লেখা তো আর লুকিয়ে রাখা যায় না। লেখার সময়ই বা সে কীভাবে লেখাগুলোকে আড়ালে রাখবে?
   পর্ণার সাথে মঞ্জুষের দাম্পত্য সাত বছরের। ভালবাসার বিয়ে। বলতে গেলে মঞ্জুষের লেখার প্রেমে পড়েই আকৃষ্ট হয়েছিল পর্ণা। মঞ্জুষ যখন মাস্টার্স করছিল, পর্ণা তখন এক বছরের জুনিয়র ছিল ইউনিভার্সিটিতে। অন্য স্ট্রিম যদিও, তবে প্রেমের পরিণতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। পর্ণা কি আদপে সন্দেহবাতিক? বহুবার মনে মনে কথাটা চর্চা করেছে মঞ্জুষ, কিন্তু কখনও তার এমনটা মনে হয়নি। বিয়ের বছর তিনেক পরে একটা ইস্যু এসেছিল ওদের, তবে পাঁচ মাসের মাথায় ওটা মিসক্যারেজ হয়ে যায়। তারপর থেকে আর কোন সম্ভাবনাও তৈরি হয়নি, টুকটাক চিকিৎসা চললেও এই নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামায়নি। নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক যে খারাপ না ভালো, অনেকসময় সেটাও ঠিকমতো বুঝতে পারেনা মঞ্জুষ।
   নন্দিনীর সংলাপটা ওকে বড় বিপদে ফেলে দিয়েছে। সজলের কথার সূত্র ধরে অনেকখানি ভেবে ফেলেছিল সে, নন্দিনীর এই বাক্যের পরে আর সেসব টেকে না। মঞ্জুষ কি এমন মেয়ে তার নিজের জীবনে দেখেছে? পর্ণা তখন বলছিল, গল্পের প্রতিটি চরিত্রের মতো কেউ না কেউ বাস্তব জীবনেও থাকে। নন্দিনী কি তার চেনা কেউ? নন্দা, তোর্সা, মালিনী বা আরও যে কজন মেয়ে জীবনে সামান্য হলেও প্রভাব ফেলেছিল তাদের কেউ কি নন্দিনীর মতো টকটক করে কথা বলতো? মনে তো পড়ে না তেমন। 
পর্ণার সাথেও এই নিয়ে কথা পারতপক্ষে না বললেই খুশি হয় মঞ্জুষ। বিয়ের বছরখানেক পর থেকেই সে খেয়াল করেছে পর্ণা ওর গল্পের মেয়ে চরিত্রগুলোকে তেমন নিতে পারেনা। ওদের ত্রুটি ধরে, নিন্দা করে। অনেকবার মঞ্জুষ সমস‍্যাটা বুঝতে চেয়েছে, কিন্তু স্পষ্ট হয়নি তার কাছে কোনও কিছুই। পর্ণা নিজের মতের সমর্থনে আনাড়ি যুক্তি সাজিয়ে গেছে শুধু। ওর সব থেকে বড় অস্ত্র যেটা, সেটা সে একেবারে শেষে ছেড়ে আলোচনার থেকে উঠে যায়, 'আমি মেয়ে, আমি বুঝি! তোমরা লেখকরা নিজেদের যুক্তি মেয়েদের কথায় চাপিয়ে দিলে হবে?' যতদিন যাচ্ছে পর্ণার বিরোধিতা যেন তত বেড়ে যাচ্ছে। মঞ্জুষ বাংলা ভাষার মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত লেখক। লেখকবৃত্তি থেকে ওর সংসার চলে না, ঠিক কথা; ও নিজে একটা সরকারি কলেজে পড়ায়, কিন্তু ওর লেখাটা এখন ওর একটা অত্যাবশ্যকীয় দিনচর্যা। কিন্তু নন্দিনীর ব্যাপারে একটু খোঁজখবর করা দরকার। বাড়িতে এই নিয়ে সব কথা প্রকাশ‍্যে বলা একটু সমস্যার। বাজারে গিয়ে একটু আড়াল খুঁজে মঞ্জুষ ফোন লাগালো ওর এক বন্ধু প্রণবেশকে। 
-কী খবর রে প্রণব? ঘুম ভেঙেছে?
-কী যে বলিস? আমি কি তোর মত লেখক মানুষ? নিজের মুড মতো চলি, বাজার করি? ছুটির দিন মানে আমাদের কাছে কাজের দিনের থেকেও বেশি হেক্টিক। সংসারের জ্বালা তো বাওয়া বিয়ে করেও বুঝলে না! 
-এই তোর শুরু হলো কাঁদুনি গাওয়া! লেখক বলে পর্ণা আমাকে রেহাই দেয়? 
-তুই এখন বাইরে নির্ঘাৎ! এত ডায়লগ দিচ্ছিস যখন! 
-বাজারে এসেছি; লেখা মাঝপথে ফেলে আসতে হল। 
-আহা রে! কপট সমবেদনার ভান করল প্রণবেশ। খানিক বাদে বলল, বাজারে এসে ফোন করতে হচ্ছে, ব্যাপারটা কী? গোপন কিছু? 
-না না গোপন কিছু না। আবার গোপনও। 
-মানে? হেঁয়ালি করিস না।
-আসলে বাড়িতে এখনকার আলোচ্য বিষয়টা একটু এম্বারেসিং হবে, তাই বাইরে থেকে কথা বলছি। 
-তা বলে ফ‍্যাল। 
-প্রণব আমরা যখন কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম, তখন এমন কেউ মেয়ে ছিল, যে মুখে মুখে কাটা কাটা কথায় জবাব দিত?
-কেন রে? এমন মেয়ের খোঁজ নিয়ে এখন কী লাভ? 
-এমনিই। আমার গল্পের এক চরিত্র - তাকে নিয়ে ভাবছি। ওর আদলটা ঠিক আমার বোধগম্য হচ্ছে না - তাই ভাবছিলাম কোনও একটা ছাঁচে এসে পড়ে কিনা!
-সেরকম তো কত মেয়ে ছিল! মধুলিকা, পাপড়ি, মৌকণা ... ওরা ভীষণ ট‍্যাঁকস ট‍্যাঁকস কথা বলতো! 
-না না সেরকম না। ধর এমন একটা মেয়ে - যাকে ছেলেরা কোনও কথা বলতে বিশেষ সাহস করত না - বিশেষ করে ভাটের কথা! কেউ কি এমন ছিল - যে কড়া এবং নির্মম কথা এমন ভাবে মুখের উপর শুনিয়ে দিত - যাতে দ্বিতীয়বার আর তার মুখোমুখি হওয়ার কথা কেউ ভাবতো না?
-সেরকম ছিল তো! ভুলে গেলি?
-কে রে? 
-তোর ফার্স্ট ক্রাশ ইউনিভার্সিটিতে! 
-কে? হেঁয়ালি না করে নামটা বল।
-আরে সেঁজুতি রে! 
মঞ্জুষ খানিকক্ষণ চুপ করে বলল, সেঁজুতিটা কে বলতো? 
-বাঃবাঃ! ভুলে গেলি? ছিঃ ছিঃ! এমন দীর্ঘল চোখের সৌদামিনী, ফর্সা, ভীষণ মনোহারিনী'র নাম ভুলে গেলি? ধিক্ তোর লেখক সত্ত্বা! আরে টার্জান রে! 
হো হো করে হেসে উঠল মঞ্জুষ। ওঃ লেডি টার্জান! কী নামের কী অপভ্রংশ ভাব! সেঁজুতি যদি টার্জান হয়ে যায়, মনে থাকে কী করে? 
-ন্যাকামো মারিস না মঞ্জুষ। ফ্রেশারস-এর দিন নেকু নেকু গলায় বলতে গেছিলি, 'সেঁজুতি তুমি নিজেই জ্বলো, নাকি কেউ জ্বালায়?' কেমন থোঁতা মুখ তোর ভোঁতা করে দিয়েছিল! এই দশ-বারো বছরে ভুলে গেলি? মঞ্জুষের মনটা হঠাৎ একটু মগ্নতায় ডুবে গেল। মেয়েটি ভীষণই সপ্রতিভ গলায় বলেছিল, 'আমি তো সত্যি সত্যি সেঁজুতি নই, ওটা আমার নাম মাত্র।' পাশ থেকে কে যেন একটা পাকা ছেলে বলে উঠেছিল, 'বেশ তো সেঁজুতির মানে বলে তা দিয়ে একটা বাক্য রচনা করে ফ‍্যালো।' সেঁজুতি বলেছিল, 'এই শব্দটার মানে আর এটি কার রচনা -এই ক'বছরের জীবনে এতবার বলে আর শুনে ফেলেছি যে এখন আর এই ধরনের বোকা বোকা প্রশ্ন শুনলে হাসি পায়। ভালো কিছু বলার থাকলে বলুন, নইলে স্টেজ থেকে নেমে যাচ্ছি।' 
প্রণবেশ বলল, কী রে পুরনো প্রেমের ব্যথা কষ্ট দিচ্ছে? মঞ্জুষ একটা গালি দিয়ে বলল, 'পুরনো ব্যথাটা কার?' ওই দিনের পরে আর দ্বিতীয় কোনও দিন আমি টার্জানের সাথে কথা বলেছি বলে মনে পড়ে না। ব্যথা তো ছিল তোর! প্রেমপত্র লিখে পুড়িয়ে পর্যন্ত ফেলেছিলি! আমার বিশ্বাস জীবনে দ্বিতীয়বার প্রেমপত্র লেখার তোর আর সাহস হয়নি। কী রে ঠিক বলছি তো? 
-যা বলেছিস ভাই! জীবনে সেই প্রথম আর শেষ প্রেমপত্র! 
-কী যেন লিখেছিলি তুই? কবিতা?
-শালা বাঙালি ছেলেরা প্রেমপত্র লিখতে কবিতা লিখবে না তো কী শায়েরী লিখবে? তাই বলে এত অপমান? সব বন্ধুদের সামনে এসে বলল, 'আগে ছন্দ শিখুন, বাংলা বানান শুদ্ধ করে লিখতে শিখুন তবে মেয়েদের প্রেমপত্র দেবেন।' 
-শেষে তো মারাত্মক একটা উপদেশও তোকে দিয়ে গিয়েছিল প্রণব! বলেছিল, ইউনিভার্সিটি পড়া মেয়েরা আর যাই হোক মূর্খ ছেলেকে বয়ফ্রেন্ড বানাবে না। আপনি বরং মাধ্যমিক ফেলটেল এমন মেয়েকে চিঠি লিখে হাত পাকান। সেই ভয়ে দুই বছর তুই আর সেই চেষ্টাতেই গেলি না। বাপের পছন্দেই ছাদনাতলায় বসলি। 
-ঠিকই বলেছিস। ব‍্যাটাচ্ছেলের নাম টার্জান না দিয়ে আরও খারাপ একটা কিছু রাখলে হত। একটা বুনো! 
-টার্জান কিন্তু মন্দ বলে নি তোকে। তোর এখনও লিঙ্গ শুদ্ধি হয়নি। ও ব্যাটাছেলে নয়, মেয়েছেলে! 
-তুই লেখক হয়েও কোন ঠিকটা বললি? মেয়েছেলেটা কি ঠিক কথা? 
-ওটা ছন্দে মিল দিতে গিয়ে বলে ফেলেছি। যাক্ গে, ওর নাম টার্জান কে দিয়েছিল বলতো প্রণব?
-সম্ভবত মলয়! 
-হঠাৎ  টার্জান নামটা কেন দিয়েছিল বলতো? ও তো রীতিমতো সুন্দরী। ছেলে ছেলে ব্যাপারটা তো ছিলনা ওর মধ্যে -  যতদূর মনে পড়ে! 
-টার্জান বলবে না তো কী বলবে? কোনও মানুষের সাথে ভদ্রভাবে কথা বলতে পারতো ও? ওর একটা কেউ বন্ধু ছিল? সবার থেকে দূরে থাকতো। গাছের তলায় বসে কুকুরের গলায় হাত বোলাতো! শুধু তোর বউয়ের সাথে যা একটু আধটু কথাবার্তা হত ওর। ভদ্র সমাজে বসবাসের অনুপযুক্ত। 
-টার্জানের খবর রাখিস কিছু? 
-না রে। ওর নাম নিলেই আমার মুখ চোখ লাল হয়ে যায় এখনও।
-অনুরাগে নাকি? মজা করল মঞ্জুষ। 
-পাগল! অপমানে। 
-বিয়ে থা কিছু করেছে জানিস?
-ওকে কে বিয়ে করবে? প্রজাপতি নির্বন্ধে যদিও বা কোথাও ভিড়ে থাকে, এতদিনে নিশ্চিত ডিভোর্স। দ‍্যাখ্ গিয়ে কুকুর বিড়াল নিয়ে সংসার করছে হয়তো। 
-প্রণব, ওর কারেন্ট ডিটেলসটা দিতে পারবি? অ্যাটলিস্ট ফোন নাম্বার? 
-না রে ভাই। তোকেও বলছি ওদিকে আর পা মাড়াস না, কী অপমান করে দেবে ঠিক নেই।
-আমার ওর সাথে একবার দেখা করা দরকার। এতদিন বাদে কী আর বলবে? কিছু বললে শুনে নেবো। 
-এত কী দরকার মঞ্জুষ! তোরই তো গল্পের চরিত্র; যেমন গড়বি - তেমন গড়াবে...
-তুই বুঝবি না প্রণব। তুই কিছু একটা কর। 
-তুই পর্ণাকে বলে দ‍্যাখ না। ওর সাথেই টার্জানের কিছুমাত্র যোগাযোগ ছিল। পারলে ওইই কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পারে।

                 (২)
   নন্দিনীকে নিয়ে কিছু একটা ভাবার দরকার। মঞ্জুষ সজলকে দিয়ে  যেভাবে কথা বাড়াতে চায়, নন্দিনী কিছুতেই সেই ফাঁদে পড়তে চায় না। এভাবে চললে তো গল্পটা এগোবে না। ভালো-মন্দ কোনও পরিণতি দূরে থাক -  দু-পাতা লিখতেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ওর। অন্য প্লট নিয়ে অন্য কোন গল্প লেখাই যায়; কিন্তু নন্দিনীর দুর্বোধ্যতার টান থেকে ও কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না। গতকাল রাতে ও স্বপ্ন দেখল নন্দিনীর চরিত্রটাকে। সজলের বদলে সরাসরি ওর সাথে সংলাপ চলছিল ওর। মঞ্জুষ আবেগে ওর হাতটা ছুঁয়ে বলেছিল, 'জানো নন্দিন্, তুমি সঙ্গে না থাকলে আমার কোনও লেখা আসে না, কোনও শব্দ আসে না। মনে হয় সমস্ত শব্দ আর অক্ষর যেন তোমার রহস্যকুণ্ড থেকে এক এক করে এসে আমার সামনে দাঁড়ায়; তাদের মধ্যে কেমন যেন একটা দৃপ্ত ভাব, আমার কাছে ধরা দেওয়ার জন্য ওদের কোন আকূলতা নেই, বরং একটা দয়াভাব আছে। শব্দ অক্ষরগুলো যেন সব তোমার আদলে এসে নিজেরাই অদল বদল করে বসে যাচ্ছে কাগজের পিঠে। নন্দিন্, ভয় হয়, তুমি সামনে এসে না দাঁড়ালে যদি শব্দরাও হারিয়ে যায়! নন্দিনী নিরাসক্ত মুখে বলল, 'ডোপিং জিনিসটা মোটেই আইনানুগ নয় মঞ্জুষদা। আমি না থাকলে যদি লেখা না আসে, তবে সেটা মোটেও ভালো কথা নয়। নিজের জোরে লিখতে শিখুন।' বলেই খুব ঝটকা দিয়েই হাতটা ছাড়িয়ে নিয়েছিল তার। সেই ছাড়িয়ে নেওয়ার অসম্মানটুকু এসে এখন লাগলো মঞ্জুষের গায়ে। স্বপ্নটা ফুরানোর আগে মঞ্জুষ একবার আবেগ নিয়ে বলেছিল, 'তোমার মধ্যে কি ভালোবাসা বলে কিছু নেই নন্দিন্? তুমি ভালবাসতে জানো না?' নন্দিনী হঠাৎ করে ভূতের মত গায়েব হয়ে যেতে যেতে বলেছিল, 'যাকে বাসবো, সেই বুঝবে। সবার তো এসব কথা জেনে কাজ নেই।'

অনেকক্ষণ ধরে সাদা পৃষ্ঠা নাড়াচাড়া করতে করতে ক্রমশ ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছিল মঞ্জুষের। পর্ণা কফি নিয়ে এ ঘরে ঢুকেই প্রশ্ন করল, 'কী ব্যাপার, লেখালেখি না করে ছাদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে কী দেখছ?' 
-ভাবছি। 
-কেন, মেয়েটা লেজে খেলাচ্ছে বুঝি! 
-তোমার আবার শুরু হয়ে গেল পর্ণা! তুমি জোর করে আমার ভাবনাকে উল্টোখাতে বওয়াতে চাও কেন?
-তুমিই বা এত রিজিড কেন? মাথায় যেমন ডায়লগ আসবে কুশীলবকে সেসব বলতে দেবে। তারা কী বলবে না বলবে সেটা যদি ওরাই ঠিক করে দেয়, তবে ওটা তো বাস্তবের জীবন হয়ে গেল! 
-ও তুমি বুঝবে না পর্ণা। 
-বুঝিয়ে দিলেই বুঝব। 
-ছাড়ো। বসো এখানে। 
-আমি বসলে তোমার লেখা আরো পালাবে মঞ্জুষ। ছাড়ো। আমার অন্য কাজ আছে। 
-আরে বসই না। তোমার সাথে টার্জানের যোগাযোগ আছে?
-টার্জান? মাথাটাথা তোমার গোলমাল হয়ে গেছে নাকি ওইসব ছাইপাঁশ লিখে লিখে? 
-ওঃ সরি! টার্জান মানে সেঁজুতি। তোমার পরের ইয়ারের। 
-ও হঠাৎ টার্জান হতে যাবে কেন?
-সে অন্য গল্প! তোমার সাথে ওর যোগাযোগ আছে?
-হ্যাঁ। কেন? 
-ওর ফোন নাম্বারটা একবার দিতে পারবে? কথা বলতাম। 
-হঠাৎ তোমার এমন দুর্বুদ্ধি মাথায় চাপলো কেন? ও তোমার ফোনে পাত্তা দেবে? সামনা সামনিই ওর সাথে ছেলেরা দুটোর বেশি বাক্য চালাতে পারত না -  ফোনে তো আরও খারাপ। একবার বাটনে হাত রাখলেই ঝুপ করে সব কথা বন্ধ করে দেওয়া যাবে। দেখা করতে হলে ও যেখানে চাকরী করে সেখানে চলে যাও। 
-ও কোথায় চাকরী করে? 
-ওই মেদিনীপুরের দাঁতন বলে একটা জায়গা আছে ওখানকার কোনও এক স্কুলে। 
-ওখানে আমি কী বলে যাব? 
-সে আমি ম্যানেজ করে দেবো। কিন্তু যাবেটা কেন? 
-আমার মনে হচ্ছে আমি যদি সেঁজুতিকে কিছুক্ষণ স্টাডি করি আমার এই গল্পের চরিত্রটাকে কিছুটা বুঝতে পারা যাবে।
-কক্ষনও নয়। সেঁজুতি আদৌ এইরকম খেলোয়াড় মেয়ে নয়। ও  স্ট্রেট ফরওয়ার্ড। উচিত কথা বলে, ন্যাকামো করে না। 
মঞ্জুষের রাগ হচ্ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে পর্নার সাথে ঝগড়া করার মুড ছিল না। সর্বোপরি সেঁজুতির সাথে ইমিডিয়েট দেখা করাটাও তার খুব জরুরি মনে হচ্ছিল। সে কোনও মতে নন্দিনীর চরিত্র থেকে বের হয়ে যেতে চাইছিল না। বলল, 'আমি কীভাবে সেঁজুতিকে অ্যাপ্রোচ করব?' 
পর্ণা বলল, 'ভেবে দেখি। ওকে তো সরাসরি বলে যাওয়া যাবে না। আমি কায়দা করে ওর স্কুলের ঠিকানা ফিকানা জেনে রাখবো। তুমি কোনও একটা কাজের বাহানায় কাছাকাছি বেলদা শহরে গেছো বলে ওকে সারপ্রাইজ দিতে পারো।' 
-যদি জানতে চায় ঠিকানা কোত্থেকে পেলাম? 
-তখন বলবে আমি দিয়েছি। এই বাহানায় অন্তত কিছুক্ষণ দেখা তো করতে পারবে। 

                       (৩)
    নিজের ভিজিটিং কার্ডটা পিয়নের হাতে দিয়ে একটা ঘরে অপেক্ষা করতে লাগলো মঞ্জুষ। ও জেনে বুঝেই বিকেলের হাফে এসেছে যাতে সেঁজুতি 'ক্লাস আছে' এই অছিলায় ওকে ফিরিয়ে দিতে না পারে। আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট পরে সুন্দর শাড়ি পরা এক ভদ্রমহিলাকে দেখে মঞ্জুষ কিছুটা থমকে গেল। ভীষণ সুশ্রী, গম্ভীর আভিজাত্যে ভরা এক মুখ; মঞ্জুষ সদ্য সদ্য পুরনো অ্যালবাম ঘেঁটে দেখা সেঁজুতির মুখের সাথে মেলাতে পারলো না। চোখে চশমা লেগেছে, চুলটা খোঁপা, আগে সেঁজুতি কোনওদিন চুল বেঁধে আসতো না; সব সময় পনিটেল করা থাকতো। ভদ্রমহিলাকে দেখে মঞ্জুষ উঠে দাঁড়াতেই, উনি বললেন, 'বসুন। আপনি মঞ্জুষ চক্রবর্তী, মানে আমাদের এক বছরের সিনিয়র সেই মঞ্জুষ চক্রবর্তীই তো?' 
-হ্যাঁ। মোটে তো একবছরের সিনিয়র, তুমি আমায় আপনি  আজ্ঞে করো না। তুমি করেই কথা বলো। 
-আপনার সাথে 'তুমি' করে কথা বলার মত নৈকট‍্য কোনওদিন ছিল কি? 
   না, এই মেয়েটার টার্জানই বটে! কথার ঝাঁজ এখনও আছে। তবে কিনা মঞ্জুষ আজকাল লেখালেখি করে বলে চট করে বাক‍্যে অপ্রতিভ হয় না। কথাটা গায়ে না  মেখেই বলল, সব নৈকট‍্যই যে দ্বিপাক্ষিক হবে তার তো কোন মানে নেই সেঁজুতি। আমার 'তুমি' বলা নিয়ে যদি আপত্তি তোল, তাহলে আমার বরং একটু অস্বাচ্ছন্দ্য হবে। অবশ্য তুমি চাইলে 'আপনি' 'আজ্ঞে' করতে পারি। 
   খানিকটা যেন হাসি খেলে গেল সেঁজুতির মুখে। বলল, 'বেশ তো, প্রাথমিক সম্বোধন যে যেমনটা করেছে তেমনটাই বহাল থাকুক। আপনি হঠাৎ এখানে যে?' 
-বেলদা এসেছিলাম একটা কাজে। আসবো শুনে পর্ণা বলল, 'তবে একবার সেঁজুতির সাথে দেখা করে এই শাড়িটা দিয়ে এসো।' 
-হঠাৎ? পর্ণাদি তিন-চারদিন আগে ফোন করে স্কুলের লোকেশন ইত্যাদি জেনে নিচ্ছিল বটে, কিন্তু কিছু পাঠাবে তেমন তো হিন্টস্ দেয়নি! 
-সারপ্রাইজ দেবে ভেবেছিল বোধহয়। 
-ব্যাপারটা আমার ঠিক মাথায় ঢুকছে না এখনও। পর্ণাদি আজ এতগুলো বছর তো কখনও জামা কাপড় পাঠায়নি আমায় - হঠাৎ আজ কেন? 
-ও কিছু না। পুজোর ঠিক আগে আগে বলেই হয়তো পাঠিয়েছে। আমি আসলে এদিকেই আসছিলাম তো! 
-বেলদায় আপনার কাজটা ঠিক বুঝলাম না। কলকাতা থেকে লোকে বেলদায় কী এমন কাজে আসবে? অফিসের কাজ? 
-না, না। অন্য বিষয়। মঞ্জুষ এতদিন প্ল্যান করে রাখা একটা বাহানা বানিয়ে বলতে গিয়েও চুপ করে রইল। সেঁজুতি বলল, 'আসলে বিষয়টা আমার ঠিক হজম হচ্ছে না মঞ্জুষবাবু। আপনার আসার প্রকৃত কারণটা যেন আপনি গোপন করে যাচ্ছেন বলে আমার মনে হচ্ছে। সেটা আমার জানা যে খুব জরুরী এমন নয়, তবু আপনার অস্বাচ্ছন্দ‍্যটা যেন আমি পড়তে পারছি। ঠিক আছে, আপনার কী দেওয়ার আছে দিন; আমি উঠবো।' 
   মঞ্জুষ একটু চুপ করে বলল, আমার ফেরার ট্রেন খড়্গপুর থেকে রাত সাড়ে দশটায়। আমি ঘন্টা দুয়েক তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
-আপনি চাইলেই তো হবে না মঞ্জুষবাবু; আমাকেও চাইতে হবে। আপনার সাথে দু'ঘণ্টা কথা বলার মতো কোনও বিষয় আমার মাথায় নেই। স‍্যরি। 
   কথাটায় যথেষ্ট প্রত্যাখ্যান আছে। তবু আজ মঞ্জুষ মরিয়া। সর্বোপরি আজ ও সেঁজুতির সাথে কথা না বলতে পারলে পর্ণার আওয়াজ খাবে। পর্ণা বলেছিল, 'যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্ব, কিন্তু টিকে থাকার দায়িত্ব তোমার।' মঞ্জুষ বলল, 'বেশ তো, তুমি শুধু সময়টুকু দাও, বিষয়ের ভাবনা আমার।'
-সময়টুকুই বা আপনাকে দেব কেন? 
-চেনা মানুষকে তেরো বছর বাদে দেখলে একটু সময় দেওয়াই যায় সেঁজুতি, ওতে কোন দোষ হয় না। 
-তেরো বছর আগে যার সাথে কেবল দুটো বাক্যের বিনিময় হয়েছিল এবং যা নিয়ে পরের দু'বছর একবারও কথা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও পক্ষে কোনও ইচ্ছে ছিল না, তাকে কি চেনা বলে? 
   ঈষৎ চমকে উঠল মঞ্জুষ। সেঁজুতি সেই ফ্রেশার্সের দিনের কথা মনে রেখেছে? ও এবার বেশ সপ্রতিভ ভাবে বলল, 'তেরো বছর আগের দু'লাইন বাক্য বিনিময়কে যে মনে রাখতে পারে, সে চেনার থেকে একটু বেশি সেঁজুতি।'
-আপনি এখন অনেক সপ্রতিভ কথা বলেন মঞ্জুষবাবু! সেঁজুতি হাসল।
-তোমার এই অস্ত্র দিয়ে আজ আর আমাকে ফেরাতে পারবেনা সেঁজুতি। চলো, বরং কোথাও গিয়ে বসি। এখানে সুবর্ণরেখা নদী আছে না আশেপাশে? 
-হ্যাঁ, মিনিট দশেক হাঁটতে হবে। পারবেন তো? 
-তুমি সঙ্গে থাকলে পথকে ভয় কি? 
-লেখকেরা বুঝি এভাবে ফ্লার্ট করে? 
-তুমি জানো, আমি লিখি?
-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ই তো আপনি লিখতেন। ইদানীং নাম হয়েছে, পত্রপত্রিকায় আপনার লেখা বের হয় দেখেছি।
-তুমি আমার লেখা পড়ো? 
চুপ করে রইল সেঁজুতি। চুপচাপ কেটে গেল সারাটা পথ। চারদিকে শুধু কাশের গুচ্ছ। মৃদু হাওয়ায় কাশের দোলায় শেষ বিকেলের আলো পিছলে পড়ে কেমন যেন স্বর্গীয় এক আভা দিচ্ছে। খানিক বাদে মঞ্জুষ বলল, 'সেঁজুতি তুমি কি বেদান্ত দর্শন জানো?' 
-জানি বলতে? 
-এই ধরো, সৃষ্টির কারণ, মোহ-  এইসব? 
-আপনি কি এতদূরে আমার সাথে বেদান্ত নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন? 
-না, এটা তার গৌরচন্দ্রিকা।
-আপনি পরিষ্কার করে বলুন তো মঞ্জুষবাবু, আপনি ঠিক কি কারনে আমার এখানে এসেছেন?
   নদীটার ওপাশটায় একটা লাল ফ্রক পরা শ্যামলা মেয়ে একমনে কিৎকিৎ খেলছে একা একা। মুখে একাকিত্বের আফসোস নেই, প্রকৃতির এই নির্জনতার ছায়া নেই - নিজের মনে নিজেই মুগ্ধ হয়ে খেলে চলেছে। মঞ্জুষ বলল, 'এই মেয়েটি যে একমনে খেলে চলেছে,  এও কি মোহমুগ্ধ নয়?' 
-জগৎ যদি মিথ্যা হয় তবে মেয়েটি মোহমুগ্ধ বইকি? 
-কিন্তু এই ছ'সাত বছর বয়সে তার কি সেরকম কোনও কামনা তৈরি হয়েছে? 
-কেন নয়? এই যে কিঞ্চিৎ খেলে সে আনন্দ পাচ্ছে এটাই তার কামনা। 
-ভালোই বলেছ সেঁজুতি। আচ্ছা ধরো, বহু মানুষ তো এই মোহকে জয় করার চেষ্টা করছে! তুমিও কি সেই দলে? 
-হঠাৎ আপনার এরকম মনে হল কেন? 
-এমনিই। এখানে চা পাওয়া যায় না? 
-বাজারের দিকে যেতে হবে। যাবেন? 
-না। এই নদীর তীরটা ভালো লাগছে। পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতাটা পড়েছ - 'নদীর কাছে নারীর কাছে/ বুকের বিপুল ব্যথার কাছে/ বেদনাবহ যেসব কথা বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলাম'... আজ নদী আর নারী একসাথে এক ফ্রেমে... 
-আমি তো আপনার নারী নই মঞ্জুষবাবু... 
-তুমি যাঁর নারী, তিনি কোথায়?
-নারীকে বুঝি সবসময় কারোর হতেই হয়? বাল‍্যে পিতার,যৌবনে ভর্ত্তার আর বার্দ্ধক‍্যে পুত্রের? 
-না, তা নয়। আচ্ছা সরাসরি জিজ্ঞাসাই করি, বিয়ে করো নি তুমি?
-দেখে বোঝা যাচ্ছে না? 
-আজকের অনেক নারীবাদী তো এসব চিহ্ন বহন করে না। সুতরাং ওই দেখে অনুমান করলে ঠকতে হয়। 
-আমাকে কি আপনার নারীবাদী বলেই মনে হয়? বা এতদিন মনে হতো? 
-না বোধহয়। তুমি মুখের উপর কটুবাক্য বলতে বটে, তবে নারীবাদী কখনওই মনে হয়নি। যাইহোক, তুমি প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো! 
-আমার কাছে এসেছেন, মিনিমাম হোমওয়ার্ক করে আসেন নি।
-উপায় ছিল না। সোর্স খুঁজে পাইনি। 
-পর্ণাদিকে জিজ্ঞেস করলেই পারতেন। 
-করিনি যখন, বুঝতেই পারছো, করা যেত না। যাইহোক, কথায় কথায় বুঝতে পারছি তুমি বিয়ে করো নি। কিন্তু বিয়ে না করার কারণটা বলবে? 
-আপনাকে বলব কেন? 
-তোমাকে কিছুটা বুঝতে পারবো তাহলে! 
-আপনি আমায় বুঝবেন - সেটা আমার কাছে কাঙ্ক্ষিত হবে কেন? 
-দরকার আছে সেঁজুতি। তোমায় একটু বুঝবো বলেই এতদূরে এসেছি। তুমি প্লীজ বলো! 
-আপনি কি আমার জীবনী লিখবেন? 
-ঠিক তোমার জীবনী নয়। আমি একটা গল্প লিখছিলাম গল্পটার নায়িকা অনেকটা তোমার মত। যখনই তার মুখে কোনও সংলাপ বসাতে চাই, সে এমন মন্তব্য করে বসে, আমার গল্প আর এগোয় না। তাই ভাবলাম, যদি তোমাকে কিছুটা বুঝতে পারি, তাহলে হয়তো আমার লেখাটা এগোবে।
-আমাকে দু'ঘণ্টায় বুঝে নেবেন? আপনাকে তো তাহলে দেবতাদের চেয়েও বেশি পারদর্শী বলতে হয়!একটু থেমে আবার বলল, তবে একটা কথা, আপনি এমন মেয়েকে নিয়ে গল্প ভাবলেন কেন? 
-সত‍্যি সেঁজুতি, আমি তোমাকে ভেবে গল্পটা লিখতে শুরু করিনি। লিখতে গিয়ে মনে হয়েছে ওই মেয়েটা অনেকখানি তোমার মত!
-আমার মতো বলতে? আমার সম্বন্ধে আপনার ধারণাটা ঠিক কেমন শুনি! 
-সত্যি বলবো? 
-বলুন 
-আমার কথা যদি ঠিকঠাক হয়, তবে স্বীকার করবে তো? নাকি তোমার বরাবরের অভ্যাস মতো চুপ করে এড়িয়ে যাবে? 
-আপনার ভাবনার সাথে আমি ডেফার করলে আপনি যদি ওটাকে আমার মিথ্যাচার ভাবেন, তখন কি হবে? 
-এটাই তোমার প্রতি আমার প্রথম ধারণা সেঁজুতি - তুমি স্পষ্ট বক্তা এবং সত্যনিষ্ঠ। তোমাকে একশো শতাংশ বিশ্বাস করা যায়। 
-আপনি দেখেই বুঝে গেলেন? 
-সে যেভাবেই বুঝি! আমি তোমাকে একশো শতাংশ বিশ্বাস করি। আমার ভয় তোমার মিথ্যে নিয়ে নয় সেঁজুতি, তোমার নিরুচ্চার থাকা নিয়ে। তুমি দয়া করে চুপ থেকো না। 
-বেশ, বলুন। নিজেকে যতটুকু চিনি তার সঙ্গে যদি মেলে আমি স্বীকার করব। 
-সেঁজুতি তুমি জানো, তোমাকে আমাদের বন্ধুরা কী বলে ডাকতো? 
-ভালো কিছু বলত না তা বুঝি, কিন্তু এগজ্যাক্টলি কী বলতো, জানি না। 
-তোমাকে বলতো, টার্জান! 
-কেন আমি কি বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াই নাকি? -লোকজনদের সাথে মেলামেশা করতে পারো না বলে হয়তো। 
-আপনিও এই নামে ডাকতেন বুঝি? 
মঞ্জুষ হাসলো। একটু থেমে বলল, 'তোমাকে বাইরে থেকে যেমনই মনে হোক, আমার বরাবরই মনে হতো তুমি ভেতরে খুবই নরম, খুবই উদাস এবং কল্পনাপ্রবণ। তবে তুমি খুবই রিজিড। 
সেঁজুতি চুপ করে রইল। একটু পরে বলল, 'আপনি লেখক বলে কি লোকের মন পড়তে পারেন? যার সাথে কখনও কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি, সে যদি এরকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছোয় - সেটাকে একটা খোশামুদে বাক্য বলা যায় নাকি? 
-আমি তো এমনি এমনি বলছি না সেঁজুতি! ইউনিভার্সিটিতে আমি রীতিমতো তোমাকে ফলো করতাম। যে মেয়ে গাছের তলায় বসে কুকুর বেড়ালের গায়ে হাত বোলাতো, রাস্তার পাগলটাকে টিফিন খাওয়াতো, মাঝে মাঝে উদাস চোখে আকাশের মেঘ গুনতো, তাকে কি এরকম বিশেষণ দেওয়া যায় না? 
-আপনি এতটা মাইনিউটলি আমাকে দেখতেন, বুঝতে পারিনি তো কোনওদিন। 
-সেঁজুতি, এইরকম একটা পরিবেশে আজকে আমার অতি নির্জন একটা কথা তোমায় বলতে ইচ্ছে করছে, আমি জানি এতে কারও কোনও ক্ষতি-বৃদ্ধি নেই, তবু... জীবনে প্রথম যে নারীর প্রেমে পড়েছিলাম... সেটা তুমি... প্রথম দিন তোমার ওই বুদ্ধিমত্তা দিয়ে আমার প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া... তোমার সপ্রতিভতা দিয়ে পুরো হলকে নিশ্চুপ করে দেওয়া... তোমার ওই উদ্ধত চুলের কাঁপা... 
চুপ করে রইল সেঁজুতি। মঞ্জুষের মনে পড়ল, সজলের কথায় নন্দিনী এভাবেই চুপ করে থাকে। কিন্তু সজলের মতো নিশ্চুপ হয়ে গেলে আজ মঞ্জুষের চলবে না। বেশ খানিকক্ষণ নীরবতার পর সে বলল, 'দেখ সেঁজুতি কী সুন্দর সূর্যটা গাছের আড়ালে ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে!' 
  সেঁজুতি শুধু ছোট্ট একটা 'হুঁ' বলে দায় সারলো।
মঞ্জুষ বলল, 'দ‍্যাখো, প্রকৃতির মধ্যে আশ্চর্য একটা উদাসীনতা আছে; এরা কত সহজে সব কিছুর চলে যাওয়া মেনে নেয়!' সেঁজুতি বলল, 'ওই যে কিছুক্ষণ আগে আপনি মায়া-মোহের কথা বলছিলেন না! প্রকৃতি জানে, সত্যিকারের চলে যাওয়া বলে কিছু নেই, আসলে ওটা একটা মায়ার জাল!' 
-ঠিক বলেছো। আচ্ছা সেঁজুতি তুমি কী কী করতে ভালোবাসো?
-ঠিক জানিনা মঞ্জুষবাবু। আমি শুধু দিন আর রাত কাটাই।
-বই-টই তো নিশ্চযই পড়ো?
-হাতের কাছে পেলে পড়ি। 
-তোমার একা লাগে না? 
-একাকীত্ব আমি উপভোগ করি।
-বিয়ে কেন করলে না? 
-সব কথার কি কোনও উত্তর হয় মঞ্জুষবাবু? হয়ে ওঠেনি।
-তোমার বাবা-মা? 
-গত হয়েছেন দুজনেই, বছর পাঁচেক হল। 
-তোমার পরিবারে আর কে কে আছেন? 
-বড়দা আছে, ব্যাঙ্গালোরে থাকে।
-ওনারা চাপ দেন না?
-মাঝে মধ্যে বলে...
-তুমি চুপ করে এড়িয়ে যাও, তাই তো? 
মৃদু হাসলো সেঁজুতি। সে হাসির মধ্যে এমন একটা মায়া আছে, মঞ্জুষ সেই মায়ায় ভিজে গেল। খুব নরম গলায় বলল, 'তুমি কি কখনও কাউকে ভালোবাসোনি সেঁজুতি?

   চারদিকে বেশ আঁধার হয়ে এল যেন ঝুপ করে। নদীর ওপারের গাছের সারিগুলো যেন গাঢ় নীল ক্যানভাসের সামনে কেবল কালো কালো অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নদীর জলেও যেন মেঘের ছায়া অস্পষ্ট। মঞ্জুষ খানিকটা সাহস করে ওর বাঁহাতটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে চাপ দিয়ে বলল, 'বলবে না?' সেঁজুতি হাতটা ছাড়িয়ে নিল না ঠিকই, কিন্তু বোঝা গেল না আদৌ সেই হাতে কোনও ঔৎসুক্য আছে কিনা! মঞ্জুষ নিজে থেকেই হাতটা ছেড়ে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'আমাকে কি মনের সামান্যতম একটা কোণও ছুঁতে দেওয়া যায় না? 
-এইটুকু জানতে পারলে বুঝি আপনি মন ছুঁতে পারতেন? 
-তা হয়তো নয়! তবু... 
   একটু চুপ থেকে মঞ্জুষ আবার বলল, ' তোমার রিলেশন না হওয়ার কারণ হিসেবে কি তোমার এই আপাত কাঠিন্যকেই ধরে নেব? তোমার খোলসে ঢুকে থাকা অনুভূতি কারও কাছে প্রকাশ না হওয়াটাই হয়তো মেইন ফ‍্যাক্টর!
-আপনি কী ধরে নেবেন, কী ধরবেন না - এটা আপনার বিষয় মঞ্জুষবাবু; আমার কিছু এই নিয়ে বলার নেই। কিছুটা কঠিন শোনালো সেঁজুতির গলা। একটু পরে বলল, 'অন্ধকার হয়ে এসেছে। চলুন, এবার আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। 
-কেউ তো তোমার অপেক্ষায় নেই সেঁজুতি! কিছুটা যেন অনুনয়ের মতো শোনালো মঞ্জুষের কথা! 
-কে বলল আপনাকে? বিয়ে না করলেই বুঝি কেউ অপেক্ষা করতে পারে না?
-আহা, এত কঠিন করেই বা বলার কী আছে সেঁজুতি! কেউ থাকে তোমার সাথে? 
-মানুষ কেউ থাকে না। 
-তাহলে? 
-আপনি না লেখক মঞ্জুষবাবু? আপনার 'সন্ধ্যাচর' গল্পটাতে তো দিব্যি নায়িকার ঘরটাকে জ্যান্ত একটা চরিত্র বানিয়ে ফেলেছিলেন। আপনার নতুন গল্পের নায়িকা আপনাকে যদি এমন ভেবলু বানিয়ে দেয়, আপনি গল্প শেষ করবেন কী করে?
  গল্পটা সেঁজুতির পড়া - এই ভাবনাতেই অনেকক্ষণ ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছিল মঞ্জুষের। কিন্তু ওর কথাটার উত্তর দেওয়াটাও চাই। তাই বলল, 'ও গল্প শেষ হবে না সেঁজুতি, নন্দিনীর হৃদয়ের খবর আমার এখনো অধরা। চলো, সত্যিই অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে।'
   বাসস্ট্যান্ডে এসে মঞ্জুষ বলল, 'চা খাবে?' 
-চলুন। ওই দিকে একটা মিষ্টির দোকান আছে, ওরা ভালো চা বানায়। 
   চা খেতে খেতে মঞ্জুষ বলল, 'আচ্ছা সেঁজুতি, তোমার মত যারা খুব চাপা, তাদের ভালোবাসা কীভাবে প্রকাশ পায়? লোকে বুঝবে কী করে? 
-লোকের বোঝার দরকার কী মঞ্জুষবাবু? যাকে ভালোবাসে, সে ঠিক বুঝবে!' 
চমকে উঠল মঞ্জুষ। এরকম একটা ডায়লগ তো স্বপ্নে এসে নন্দিনী বলেছিল! তবে কি নন্দিনী কোথাও সেঁজুতিরই ছায়া? পর্ণা কি তবে ঠিক কথাই বলেছিল?

                    (৪)
   লেখাটা নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে মঞ্জুষ। রোজ নিয়ম করে লিখতে বসে বটে, তবে এক-দু লাইনের বেশী লেখা এগোয় না। সজল কোনওভাবেই মঞ্জুষের মতো খেই খুঁজে কথা বলতে পারে না। প্রতিদিন যেন ওদের মধ্যে কথার লড়াই জারী হয়, অবধারিত ভাবে সজল তাতে হেরে ফিরে আসে। এতদিন টুকটাকভাবে পর্ণা সেঁজুতির কথা জিজ্ঞাসা করেছে, কী কথা হল, লেখার নন্দিনী সেঁজুতির মতো কিনা - ইত্যাদি; কিন্তু আজ যেন সেও আগ্রাসী। বেশ গ্যাঁট হয়ে মঞ্জুষের পাশে বসে আছে। পরের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে, মঞ্জুষের ইচ্ছা করছে না, তবু উপায় নেই। 
-কী গো, তোমার নন্দিন কি আমাদের সেঁজুতির আদলে গড়া?
-অনেকটা। 
-সেঁজুতির সাথে দেখা করে এসে কি মিলটা আরও বাড়লো? 
-এসে আর তেমন লিখলাম কই! তবে চরিত্রের মিল আছে অনেক।
-আর সজল কে, তুমি?
-একদমই না। সব কিছু এভাবে পার্সোনিফিকেশন করো না পর্ণা!
-এইতো কিছুদিন আগেও মানতে চাইছিলে না লেখার চরিত্রগুলো বাস্তব জীবনের কারো না কারোর আদলে হয়!
-আমি এখনো মানি না পর্ণা। নন্দিনীর সাথে সেঁজুতির কিছুটা মিল আছে বলে - সবক্ষেত্রে এটাই প্রযোজ্য হবে, তা নয়। 
-আমি মানি না। 
-তোমার মানা না মানার উপর তো লেখা নির্ভর করবে না পর্ণা।
-লেখক যেহেতু তুমি, লেখা নিশ্চই নির্ভর করবে। 
-মানে? 
-ধরো সেঁজুতি যদি নন্দিনী হয়, তবে সজল কি অন্য কেউ হবে?  তুমি সেঁজতির ভেতরে ঢুকতে চাইছো, তাকে আবিষ্কার করতে চাইছো, তাহলে সজলের চরিত্রে কি তোমার চাহিদার ছাপ পড়বে না? 
-যদি পড়েও - তাতে কি অসুবিধা?
-দ‍্যাখো মঞ্জুষ, তুমি যে কোনও একটা বিষয় বাছো, হয় তোমার লেখা, নয় আমি! 
-বিনিময় দুটো তুলনীয় বিষয়ের হয় পর্ণা। লেখা কি তোমার তুল্য একটা জিনিস? 
-তাহলে লেখা ছেড়ে দাও। আমাকে যদি সত্যি চাও, তুমি আর লিখবে না। যদি লেখ শুধু আমাকে নিয়েই লিখবে। 
-এটা আবার কী কথা পর্ণা? একটা মানুষকে নিয়ে একটা লেখাই হয়। বৈচিত্র‍্য আসবে কোত্থেকে?
-তোমার মত পুরুষ তো তাহলে দাম্পত্যে বৈচিত্র‍্যের জন্য নিত্য নতুন নারী খুঁজবে। 
-কী আবোল তাবোল বকছ, পর্ণা?
-বিষয়টা তো একই হল। সারাজীবন এক স্ত্রীতে যদি বৈচিত্র‍্য খুঁজে পাওয়া যায় - তবে তাকে কেন্দ্র করে গল্প লিখলে সেটা ফোটানো যাবে না কেন? যে পারে না, সেটা নিশ্চই তার লেখনী শক্তির ব্যর্থতা!
-এই নিয়ে তোমার সাথে আমার তর্ক করতে মোটেও ইচ্ছে করছে না পর্ণা। তুমি ও ঘরে যাও। 
-ও ঘরে নয় মঞ্জুষ, আমি এখন বাপের বাড়ী যাচ্ছি। তুমি যদি চাও, তাহলে বরাবরের মত।
-মানেটা কী? এই সামান্য বিষয়ে এইভাবে এক কথায় চলে যাওয়া যায়?
-এক কথা কে বলল? গত সাত বছর ধরে তোমার এই নির্যাতন আমি সহ্য করছি। এতদিন প্রমাণ করতে পারিনি। এতদিনে তুমি নিজের মুখে স্বীকার করলে, তোমার এই চরিত্র তোমারই এক্স গার্লফ্রেন্ডের আদলে। 
-এক্স গার্লফ্রেন্ড? কী আবোল তাবোল বকছো? 
-তুমি কি আমায় বোকা ভাবো মঞ্জুষ? তুমি ভেবো না তোমাকে আমি এমনি এমনি সেঁজুতির সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। আমার প্রমাণের দরকার ছিল। তুমি যাবার আগে আমি সেঁজুতিকে সব কথা বলে রেখেছিলাম। ও তোমার সাথে ওর সমস্ত কথোপকথন রেকর্ড করে পাঠিয়েছে। 
    কেউ যেন একশ  ভোল্টের শক্ দিল মঞ্জুষকে। মানুষ এতখানি নীচে নামতে পারে? আর সেঁজুতি! সেও এরকম বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করবে? বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল মঞ্জুষ। বলল, 'আমি এমন কিছু কথা তার সাথে আলোচনা করিনি, যেটা শুনে তুমি কোনও কিছু প্রমাণ করতে পারবে। আমি এখনো তোমাকে চলে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করছি। কিন্তু লেখার বিনিময়ে নয়। আমি তোমার শর্তে লিখতে পারবো না।' 
-বেশ, তুমি তোমার লেখা নিয়েই থাকো। তবে তোমার এক্স নিয়ে বেশী স্বপ্ন দেখার চেষ্টা করো না। ও সজলের হবে না। ওর স্কুলেরই একটি টিচার আছে ওর থেকে বছর চারেকের ছোট। ও এখন তার হৃদয়ে বসত করছে। চলি।
   উঠে গেল পর্ণা। পাশের ঘরে খুটখাট জিনিসপত্র গোছানোর আওয়াজ পেল মঞ্জুষ। একটু বাদে বাড়ির সামনে ট্যাক্সি দাঁড়ানোর আওয়াজও পেল সে। জোর করে আটকানো তার স্বভাব নয়। জানলা দিয়ে পর্ণার চলে যাওয়া দেখল সে। বাইরে পড়ন্ত রোদে শরতের মন খারাপ লুটিয়ে পড়ছে রাস্তায়। সমস্ত মনখারাপই তো একটা মোহ। স্বয়ং ঈশ্বর সৃষ্টির বাঁধন পরে এই মায়াজালে কেন ধরা দিলেন? সবই কি শুধু নিজের সাথে নিজের খেলা প্রাণের খেলা যে! 

                      (৫)
   বছর খানেক কেটে গেছে। পর্ণা ফেরেনি। সে আর ফিরবেও না, সম্ভবত। আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্স যদিও হয়নি, কোনও পক্ষ গা করেনি বলেই। মঞ্জুষের সেই লেখাটা আর হয়নি। এখন লেখা অনেক কমে গেছে তার। তেমন করে আর উদ্যম আসে না। মনে হয় সব সম্পর্কগুলোই তো বানানো। যতই বানানোর খেলা চলে - তার মনে হয় সে ততই ঈশ্বরের সৃষ্টির খেলার মতো নিজেই মোহের জালে ক্রমশ জড়িয়ে যায় শব্দে আর অক্ষরে। এরা তো রক্ত-মাংসের নয়, অথচ তারা ওর কাছে প্রতিনিয়ত অভিমানের ঝাঁপি খুলে বসে, হৃদয়ের গোপন অলিগুলির সন্ধান দেয়। তারা কল্পনার হয়েও অনেক বেশি বাস্তব। তবু নামডাক হয়েছে যখন, কিছু লেখা তো লিখতেই হয়। বেশ রাত হয়েছে। একটা ঐতিহাসিক গল্পের পটভূমিকা নিয়ে লিখছিল সে; পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যুর পর সংযুক্তাকে বন্দী করে নিয়ে গেছে বিদেশী সৈন্য বাহিনী, হঠাৎ করে অচেনা নাম্বারের ফোন...হ্যালো! 
-মঞ্জুষ চক্রবর্তী বলছেন তো? 
-হ্যাঁ। আপনি? 
-আমি সেঁজুতি। 
-হঠাৎ? 
-আরে কী কষ্ট করে আপনার ফোন নাম্বার জোগাড় করলাম, কল্পনাও করতে পারবেন না। পর্ণাদিকে ফোন করলেই আপনাকে যোগাযোগ করতে পারতাম। কিন্তু ভাবলাম, সারপ্রাইজ দিই... 
   আজ যেন বড্ড বেশী কথা বলছে সেঁজুতি! এত প্রগলভতা ওকে ঠিক মানায় না। মঞ্জুষ একটু ঠান্ডা গলায় বলল, 'কী জন্য এই ফোন?' 
-আরে আমাদের স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান এ বছর। সবাই জোর করে আমাকে কালচারাল সেক্রেটারি বানিয়েছে। বড় কোনও লেখককে এনে একটা সেশন চালাতে হবে। আমি  ভাবলাম, আমার চেনার মধ্যে আপনি সবচেয়ে বড় লেখক -  আপনি যদি কাইন্ডলি পারমিশন দেন আমাকে আর কষ্ট করতে হয় না। 
-তুমি যে আমাকে বড় লেখক মনে করেছ, এজন্য ধন্যবাদ। ডিটেইলসটা পাঠিও। আমারও তো কলেজ থেকে ছুটি নিতে হবে। 
-যাক্ বাঁচালেন। পর্ণাদি কই? ওকে দিন একটু। 
   মানুষ প্রেমে ট্রেমে পড়লে কি চরিত্র বদলে যায়? এত ন্যাকা তো কখনও ছিল না সেঁজুতি! মঞ্জুষ একটু দৃঢ় গলায় বলল, 'এতখানি তুমি নিজেকে বদলে ফেলেছ সেঁজুতি, ভাবতেই পারি না।' 
-কেন? কী হয়েছে? 
-তুমি ঠোঁটকাটা, স্পষ্ট বক্তা ছিলে, সেটাই তোমাকে মানাতো! এইরকম ন্যাকামি আমার একদম সহ্য হচ্ছে না! 
-আরে কী করলাম তাই তো বুঝছি না! 
-পর্ণাদির খবর তুমি জানো না? 
-না! কী হয়েছে পর্ণাদির? 
-পর্ণা আমার সাথে থাকে না বছরখানেক। 
-কেন? 
-তুমি নিজেও তো সেই মিশনের কুশীলব! অথচ তুমি জানো না?
-ভালো করে পরিস্কার করে বলুন তো সব কথা, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না! 
-আমি যে তোমার কাছে গিয়েছিলাম - কেন গেছিলাম, পর্ণা তোমাকে আগাম বলেনি? 
-কিছুটা ইঙ্গিত দিয়েছিল। বলেছিল আপনাকে বুঝতে না দিতে। 
-আর সেজন্য তুমি অভিনয় করে গেলে আমার সাথে সারাক্ষণ?
-আমি তো সেরকম কিছু অভিনয় করিনি। কথার পিঠে যেরকম কথা এসেছে - তাই তো বলেছি!
-আমাদের যা কথাবার্তা সব তুমি মোবাইলে রেকর্ড করে পর্ণার কাছে পাঠাতে পারলে? 
চুপ করে রইল সেঁজুতি। আবার সেই স্ট্রাটেজি! এবার কর্কশ গলায় মঞ্জুষ বলল, 'সব সময় চুপ করে থাকলে বিষয় থেকে পালানো যায় না সেঁজুতি। সত্যিটা স্বীকার কর। 
   খানিকক্ষণ চুপ থেকে সেঁজুতি বলল, 'যে কথায় আপনার মন পুরোপুরি সায় দেয় না - সে কথা আপনি বিশ্বাস করেন না বলে অন্যের কাছে বলেন কেন? মন জিতবেন বলে? 
-মানে? 
-সেদিন আপনি আমার সম্বন্ধে যে মূল্যায়ন করেছিলেন, তা কি ভুলে গেছেন? 
-ভুলে যাইনি, সেজন্যই অবাক হয়েছি। 
-আমাকে যদি একশ শতাংশই বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে অবাক হবার কষ্টটা পেলেন কেন?
-তার মানে তুমি রেকর্ড টেকর্ড কিছু দাওনি? বাঁচালে আমায়! আমাকে এইটাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছিল সেঁজুতি! তুমি এমনটা করবে এটা কষ্টকল্প! 
-থাক্! ভাবতে যখন পেরেছেন, সেটাই অনেক! এখন আর এই নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। 
-আসলে পর্ণা এমন করে বলল... আচ্ছা, পর্ণা কি তোমাকে আমাদের কথাবার্তা রেকর্ড করে দিতে বলেছিল? 
-না, না সেসব কিছু বলেনি।শুধু বলেছিল, আপনার একটা লেখার জন্য আমার সাথে একটু কথা বলা দরকার। আমি যেন আপনার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলি। আর কিছু বলেনি। 
-ওঃ সেজন্যই তুমি আমার সাথে কথা বলেছ? 
-সেটাই যে কারণ, তা নয়।পর্ণাদি না বলে দিলেও হয়তো আমি কথা বলতাম। 
-এর মধ্যে তোমার সাথে পর্ণার কথা হয়নি? 
-তিন-চারবার হয়েছে। 
-এখানে না থাকা নিয়ে কিছু বলে নি? 
-না। ইনফ্যাক্ট আপনার বিষয় নিয়ে কোনও কথা হয়নি। 
-আচ্ছা, পর্ণা এমন কেন করলো বলতে পারো? 
-ও চলে গেল কেন? 
-আমার লেখালেখি ও একদম সহ্য করতে পারতো না। ওর বক্তব্য, কিছু লিখলে ওকে নিয়েই লিখতে হবে, অন্য কাউকে নিয়ে নয়। 
-ও এসব নিয়ে কখনও কোনও কথা আমাকে বলেনি। আমার মনে হয় এটা সিম্পলি ওর ইমম্যাচিউরিটি। আপনি কথা বলুন। এত ছোট্ট বিষয় নিয়ে সেপারেশন তো কাঙ্ক্ষিত নয়। 
-ও বোঝা-শোনার বাইরে চলে গেছে সেঁজুতি। ও আমাকে আল্টিমেটাম দিয়ে গেছে। কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না, ও অকারণ মিথ্যা বলল কেন? 
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে সেঁজুতি বলল, 'আপনি লেখক মানুষ, ভালো করে খতিয়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন।' 
-সত্যি সেঁজুতি, আমার খুব ইচ্ছে করছিল তোমায় সেদিন ফোন করে জিজ্ঞাসা করি। সত্যি বলে থাকলে দুটো কথা শুনিয়ে দিই।
   সেঁজুতি চুপ করে রইল। মঞ্জুষের হঠাৎ নন্দিনীর কথা মনে পড়ল। সেও তো পাল্টা জিজ্ঞাসা করত না - 'করলেন না কেন?' এরা এরকমই। কথার পিঠে কথা বসিয়ে গড়িয়ে চলা - এদের ধাতে নেই। মঞ্জুষ নিজেই বলল, 'কিন্তু পারলাম না।' 
অনেকক্ষণ বাদে সেঁজুতি বলল, 'আপনার ভারী ইগো!' 
-কেন? 
-আমাদের প্রথম দেখার দিন থেকে ভাবুন, সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। 
-তুমি বিয়ে করছো কবে? 
-হঠাৎ বিয়ে নিয়ে কথা কেন? আপনি কি আমার গার্জেনের রোল নেবেন নাকি? 
-না মানে, কত দিন ঝুলিয়ে রাখবে বেচারাকে? 
-কোন্ বেচারা? 
-তোমার কলিগ যে গভীর ডুবুরীর মত তোমার হৃদয়ের অতল ছুঁতে পেরেছে! 
  একটু চুপ থেকে হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠলো সেঁজুতি। 'ওঃ, এটাও পর্ণাদির ইনফরমেশন বুঝি?' অনেকক্ষণ হেসে একটু অ-সেঁজুতি সুলভ কণ্ঠে বলল, 'আপনি একটা আস্ত হাঁদারাম! যাক্ গে, আপনার ওই গল্পটা লেখা হয়েছে?' 
-না। 
-বাঃ! এতদূর মিছিমিছি দৌড়ে এসে নিট রেজাল্ট জিরো! পরে দোষ দেবেন, আমার অসহযোগিতার জন্যই আপনার গল্পটা লেখা হয়নি। 
-দোষ দেব না। তবে ওই গল্পটা লেখা মুশকিল। পাঠক গল্পের একটা ক্লাইম্যাক্স চায়। শূন্যে কোনও সম্পর্ককে রেখে ছেড়ে দেওয়া যায় না বাস্তবের মত।
-আপনি গল্পটা লিখুন। সবার জন্য নাই বা লিখলেন আমার জন্য লিখুন। যখন আমার এখানে স্কুলের সুবর্ণজয়ন্তীতে আসবেন, আমাকে আলাদা করে দেবেন। তবে হ্যাঁ, টাইপ করা কাগজে নয় আপনার হাতের লেখায়। 
-তুমি হঠাৎ ওই লেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে গেলে কেন? ওটা তো তোমার স্বভাব বিরুদ্ধ! 
-না, আসলে আমিও জানতে চাই লেখক এর কল্পনায় আমার গতিপথটা ঠিক কোন্ কক্ষপথে।
-লাভ? 
-লেখক নায়িকার হৃদয়ের কতটুকু তল পেলেন - সেটাও তো পরীক্ষা করা দরকার ! আমি কিন্তু লেখাটার অপেক্ষায় থাকবো। 
   খোলা জানালা দিয়ে এক ঝলক ঠান্ডা হিমেল বাতাস ঢুকে এল ঘরে। সারা পৃথিবী জুড়ে স্থলে, জলে, সত্যি সত্যিই বিন্দু বিন্দু মোহের প্রসারিত জাল। কে কখন  তাতে ধরা পড়ে, সে খবর শুধু সময়ই জানে। উঠে গিয়ে আস্তে করে জানলাটা লাগিয়ে দিল মঞ্জুষ।

Post a Comment

3 Comments

  1. খুব ভালো লাগলো গল্প টা।

    ReplyDelete
  2. খুব সুন্দর ।

    ReplyDelete
  3. Onobodyo.....🙏❤

    ReplyDelete