মার্কেজের খোঁজে
(তৃতীয় পর্ব)
মলয় সরকার
এয়ারপোর্ট এলাকা ছাড়ালে একটু এগিয়ে আমরা এগোতে লাগলাম সেই একপাশে দেওয়াল ঘেরা শহর আর একপাশে সমুদ্রের মাঝের রাস্তা দিয়ে ।
এরকম দেওয়াল ঘেরা প্রাচীন শহর আগে দেখিনি এমন নয়। প্রথম দেখি চীনে। চীনের পিং ইয়াং শহরটি এমনই উঁচু দেওয়াল ঘেরা, তবে দেওয়ালের উচ্চতা আরও বেশী। আর চীনের প্রাচীর নিজেই তো তার প্রমাণ। আসলে রাজ্যকে সুরক্ষিত রাখতে, রাজ্যের বা নিদেন রাজধানীর বাইরে পরিখা, দেওয়াল ইত্যাদির ব্যবস্থা সব দেশের রাজারাই করতেন।এই দেওয়াল ঘেরা শহরটি স্প্যানিশদের তৈরি।
ডান দিকে দেখি, সমুদ্রের নীল জল আর তার বালিয়ারী। বালিয়ারী কিন্তু সরু ফালি, এক চিলতে।
সমুদ্র দেখলেই আমার মনে হয় দূর দিগন্তের ডাক, হারিয়ে যাওয়ার হাতছানি। আসলে মনের মধ্যে যে যাযাবর বাসা বেঁধে অসুখের মত ঘাপটি মেরে বসে থাকে, সাধারণ অবস্থায় সভ্য ভদ্র বাবুদের মত, সে-ই সুযোগ পেলে বসে থাকার আরামকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেহটাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।আর মনটা ডানা মেলে দূরান্তের পরিযায়ী পাখির মতন।
সমুদ্রের নীল জল মনের কোণায় ছবি ফেলেই “ নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা-” হয়ত দূরে শৈলচূড়ায় সাগর বিহঙ্গেরা কোথাও ঘর বেঁধে রয়েছে। তার সঙ্গে মনের দার্শনিক ভাব এগিয়ে এসে জোড় বাঁধে , অনন্ত এই নীল জলরাশির শ্বেতধবল ফেনপুঞ্জের উথালপাথাল তরঙ্গবিক্ষোভের দিকে একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেই।
এই বালিয়ারী দেখে মনে হয় যেন বাইরের বালি এনে ফেলে কৃত্রিম ভাবে তৈরী করা হয়েছে। তাতেই নানা রকম ছাতা টাঙিয়ে লোকে আনন্দ করছে, স্নান করছে, বাচ্চারা মজা করছে।ছোট ছোট ছাউনি করে কোল্ড ড্রিংক্স এবং ওই জাতীয় জিনিসপত্র বেচার দোকানও রয়েছে বেশ কিছু। তবে ট্যাক্সি থেকে বুঝলাম, বাইরে বেশ গরম। এই গরমে আমরা যে স্নানের মজা করতে পারব না, তা বুঝলাম। তবে হঠাৎ এত ঠাণ্ডা থেকে এসে এত গরমে অসুবিধা হবে কিনা জানি না।দেখা যাক-
যাই হোক, হঠাৎ দেখি গাড়ী বাঁক নিল বাঁ দিকে, পাথুরে দেওয়ালের দিকে। দেখি, একটা জায়গায় দেওয়াল কেটে রাস্তা করা আছে, গাড়ি ঢুকছে শহরের মধ্যে। মনটাও একটা বাঁক নিল, যখন দেখলাম, বাস্তবিকই আমরা ঢুকে পড়লাম সত্যি সত্যিই একটা ইতিহাস ঘেরা আবর্তের মধ্যে।
শহরর রাস্তায় যাত্রীর খোঁজে ঘোড়ার গাড়ি
অনেক দূরে দেখলাম সমুদ্রের ধার বরাবর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আধুনিক শহরের চালচিত্র, বিশাল বড় বড় ফ্ল্যাটের সারি। আমার কাছে লাগল বড় বেমানান, এই প্রাচীন শহরের পাশে।যদিও বড়ই বিসদৃশ, তবু বাস্তবকে মেনে নিতেই হবে, স্বীকার করতেই হবে আধুনিকতার দাবীকে।
সারা পৃথিবীতেই, যেখানেই আমি ইতিহাসকে ছুঁতে গেছি, সে নিজের দেশই হোক বা বিদেশই হোক, আমার একটা জিনিস ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, ইতিহাস মানেই প্রাচীনতা। তাকে যখন ছুঁতে যাই, তখন হারিয়ে যেতে চাই সেই প্রাচীন যুগে, মন চলে যায় সেই প্রাচীন ঐতিহাসিক পরিমণ্ডলে। হঠাৎ করে সেখানে বর্তমানের অনুপ্রবেশ মন মেনে নিতে চায় না।বিদ্রোহ করে ওঠে। সিনেমাতেও সফল চিত্রকাররা অভিনয় হয়ত করিয়েছেন বর্তমানের বাস্তব জমিতেই, কিন্তু গল্প যখন উপহার দিচ্ছেন, কাট ছাঁট করে দর্শককে নিয়ে হাজির করছেন সেই ইতিহাসের প্রান্তরে, যাতে দর্শক নিজেকে পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন।
(এক জায়গাতে, আমার আজও মনে আছে, তপন সিংহের ছবি দেখছি ‘ঝিন্দের বন্দী’। ছবি যখন জমে উঠেছে, সেই ঝিন্দের আবহাওয়ায়, হঠাৎ দেখি, একটি দেওয়ালে বিজ্ঞাপন ‘’ জালিম লোশন, দাদের ঔষধ”। ব্যস সব তাল কেটে গেল। হয়ত পরিচালক, ব্যাপারটি খেয়াল করেন নি।)
ঢোকার মুখেই দেখি পুরানো শহরের ছবি। রাস্তা সব সরু সরু, কোন জায়গায় একটা গাড়ি যেতে পারে, কোন জায়গায় অনেক কষ্টে দুটো বা পাশ কাটাতে পারে। তবে রাস্তার দুপাশে বিশাল উঁচু উঁচু বাড়ি, এতটুকু ছাড় নেই কোন বাড়ির সঙ্গে কোন বাড়ির বা রাস্তার সঙ্গে বাড়ির। শহরে কোথাও ঘাস বা সবুজের চিহ্ন নেই, ফুটপাথের গাছ ছাড়া। বাড়ির কোন নম্বর বা নেমপ্লেট ও দেখছি না। ট্যাক্সি ড্রাইভারও দেখি, খুঁজে পাচ্ছে না গন্তব্য। একে জিজ্ঞসা করে, ওকে জিজ্ঞাসা করে। শেষে খুঁজে বের করল বাড়ি। আসলে
এটা তো কোন হোটেল নয়। এটা একটা এ আর বি এন বি, একজনের বাড়ি।
ঢোকার মুখেই দেখি খুব উঁচু এক সিঁড়ি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে হবে, তবে যাওয়া যাবে রিসেপসনে। ট্যাক্সিওয়ালা দেখেই বুঝল, বুড়ো বুড়ির পায়ের অবস্থা শোচনীয়। সে সমস্ত সুটকেশ তুলে নিয়ে দিয়ে গেল দোতলায়, নিজে থেকেই।আমরাও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম ,সঙ্গে কিছু গুঁজেও দিলাম হাতেই।সেও খুব খুশী মনে চলে গেল।
ঘরের এক কোণে, সিঁড়ি দিয়ে উঠেই রিসেপসনে দেখি, একটি ছেলে বসে আছে।আর, বেশ বড় ফাঁকা পুরানো দিনের বিরাট বারান্দা মুছছে, আমাদের দেশের সাধারণ বাড়ির ঘর মোছার ‘ঠিকে ঝি’য়ের মত দেখতে একজন। বাড়িটা দেখেই আশ্চর্য লাগল। দেখে মনে হল বাড়ির বয়স অন্ততঃ চারশ বছর হবে। বিশাল মোটা থাম ও দেওয়াল দিয়ে তৈরী, অন্ততঃ ত্রিশ ইঞ্চির দেওয়াল। আর তেমনই উঁচু ছাদ। দেওয়ালের চুনকামও ঠিক আমাদের পুরানো জমিদার বাড়ির মতই।বারান্দায় আধ -কোমর সমান সিমেন্টের রেলিং দিয়ে ঘেরা।
রিসেপসনের ছেলেটিও, মোটেই ঝাঁ চকচকে কেতাদুরস্ত হোটেলের মত নয়, আমাদের দেশের মফঃস্বলের যে সমস্ত হোটেলে , যা হোক একটা ছেলেকে বসিয়ে রাখা হয় রিসেপসনে, একেবারে যাতে খালি না থাকে ,সেরকমই। আসল কন্ট্রোল থাকে দূরে মালিকের হাতেই অর্থাৎ ওর নিজস্ব কোন ক্ষমতা নেই। ছেলেটি বসে আছে একটা গেঞ্জি পরে , পাজামা পরা পা দুটোকে আলস্যভরে সামনে ডেস্কের উপরে তুলে হেলান দিয়ে মোবাইলে কিছু দেখায় নিমগ্ন হয়ে। তার চোখে তখন মোবাইলের স্ক্রীন ছাড়া দুনিয়ার কিছুই আকর্ষণীয় নয়, অন্য সব কিছুই বিরক্তিকর। এমন ভরা দুপুরে আলস্যে শরীর যখন এলিয়ে পড়ছে, হোটেলে ভিড়ও তেমন নেই, মাথার উপরে ছড়ি ঘোরানোরও আপাতঃ কেউ নেই, তখন এরকম একটা দৃশ্য আশা করা যায় বৈ কি!
ফাঁকা ব্যালকনি দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ, তাতে উড়ে বেড়াচ্ছে ইতস্ততঃ কিছু চিলের দল।নীচে রাস্তায় লোক চলাচল কমে এসেছে, রোদের জন্যই বোধ হয়।কখনও কখনও দু একটা ফিরিওয়ালা যাচ্ছে।
🍂
আওয়াজ আসছে।
আমরা সাধারণতঃ যে সমস্ত হোটেলে যাই, তাদের যা কায়দাকানুন, সেগুলো রপ্ত হয়ে গেছে, তবে এরকমটা চট করে পাই না। তাই একটু অন্যরকম লাগল বৈ কি। ভাবলাম, মন্দ নয়।
অবহেলাভরে আমাদের সব কাগজপত্র দেখার পর ও যা বলল, তা কিছুই বুঝলাম না । কারণ ও স্প্যানিশ ছাড়া কিছুই বোঝে না বা বলতেও পারে না। অগত্যা দ্বারস্থ হলাম মোবাইলের গুগল ট্রান্সলেশন এপের। বুঝলাম, এখানে আমাদের এই গুগল ট্রান্সলেশন ছাড়া এক পা-ও চলবে না ।একবার ও বলে এপের সাহায্যে আর একবার আমরা বলি এপে, আর ও সেটা পৌঁছে দেয় ওর মালিকের কাছে। সেখান থেকে আসে নির্দেশ। এরকম টরেটক্কার খেলা চলল খানিকক্ষণ।
এখানে ছেলেটির নাম লেইদার।
শেষে লেইদার বলে, এখন তো বেলা বারোটা বাজছে, বেলা তিনটের আগে ঘর দেওয়া সম্ভব নয়।শুনে তো আমাদের মাথায় হাত ! এত যাত্রার ক্লান্তি নিয়ে এই ভর দুপুরে, বাইরে রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে, এখন কোথায় একটু হাত পা ছড়িয়ে স্নান করে বিশ্রাম নেব, তা নয়, এখন এখনে বসে থাকতে হবে তিন ঘন্টা! কেন?
কারণ কি! না, যে ঘরটা দেব, সেটা এখনও পরিষ্কার হয় নি। অগত্যা— বসে রইলাম।বুলবুল তো অধৈর্য হয়ে আমার উপর চাপ দিতে লাগল, বল ওকে যেমন তেমন একটা ঘর আপাততঃ দিতে।
কিছুক্ষণ পরে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে বললাম, তুমি আমাদের অপরিষ্কার ঘরেই দাও। আমরা অন্ততঃ মাল গুলো নিয়ে তো রাখি, বা একটা চেয়ারে ঘরে বসে থাকব । মনে ভাবলাম, অন্ততঃ জামা প্যান্টটা খুলে দরজা বন্ধ করে ফ্যান চালিয়ে একটু হাল্কা হতে তো পারব।
যাই হোক , শিকে ছিঁড়ল বেড়ালের ভাগ্যে।শেষে তাতেই রাজী হল। নিয়ে গেল তিনতলার একটা ঘরে।ঘরটা বড় এবং ভালই। সব আছে ঘরে ওয়াসার, ফ্রিজ, কিচেন, চেয়ার -টেবিল ,ফ্যান ইত্যাদি। গিয়ে দেখি, একটি বয়স্কা মহিলা ঘর পরিষ্কার করছে। তাকে কিছু বলে, আমাদের বলল, এখানে একটু অপেক্ষা করুন তাহলে।
মহিলাটি মুচকি হেসে, চট করে ভিতরের শোয়ার ঘরটি ঝকঝকে করে দিয়ে বলল, এই ঘরে আপনারা আরাম করুন, ততক্ষণে আমি বাকী ঘরটা সাফ করে দিচ্ছি। আমরা তার ব্যবহারে , যেন হাতে স্বর্গ পেলাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম আমরা।আমরা প্রথমেই একজন সাধারণ ‘ঘর মোছার ঝি’য়ের কাছ থেকে যে ব্যবহার পেলাম, তাতেই মনে হল এ দেশ আর আমার গ্রাম বাংলার তফাত কি! সাধারণ মানুষের মন এমনই সুন্দর আর মোছা ঘরের মতই নিষ্কলুষ, তাই বোধ হয় মার্কেজ খুঁজে পান তাঁর গল্পের উপাদান এদের মধ্যেই , বাস্তব আর যাদু মিশিয়ে।
আসলে মার্কেজের দিদা তাঁকে ছোটবেলায় গল্প বলতেন ভূত প্রেত যাদু এইসব নিয়ে। তার ফলে হয়ত তাঁর মনে শিশুকাল থেকেই এই যাদু মাখা কথা বলার একটা প্রবণতা জন্মায়।
ক্রমশঃ-
0 Comments