ফ্রক
কমলিকা ভট্টাচার্য
রাত দশটা বাজে। বাবা এখনো বাড়ি আসেনি। জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে একটি ছোট্ট মেয়ে। দূরের ল্যাম্পপোস্টে আলোপোকা ঝাঁক বেঁধে উড়ছে।
সে অবাক হয়ে তাকিয়ে সেদিকে। একরাশ প্রশ্ন—দিনের বেলায় এরা কোথায় লুকায়? কেন ওরা আলোর দিকে যায়? ওরা তো পাখি নয়, তবে কেন ডানা?
বাবা কেন এখনো আসছে না? বাবার কাছেই তো সব প্রশ্নের উত্তর থাকে। বাবা এখনো কেন আসছে না?
দিদির ইংরেজি বইয়ের ভিতরে একটা গল্প আছে—হ্যাপি প্রিন্স, সেই গল্পটা তার খুব প্রিয়। দিদি স্কুলের ব্যাগ গুছিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে চুপি চুপি ব্যাগ থেকে বইটা বার করে রেখেছে—পাতা নম্বর ৬৩।
বাবা এলে বাবা তাকে গল্পটা পড়ে শোনাবে।
এই একই গল্প সে রোজ শোনে বাবার কোলে মাথা রেখে। আর তার চোখের জলে বাবার লুঙ্গি ভিজে গেলে, বাবা বলে,
—“তুই কাঁদলে আমি আর বলব না।”
সে তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে বাবার কাছে জানতে চায়,
—“রাজপুত্র কেন কাঁদে? তবে তার নাম হ্যাপি প্রিন্স কেন?”
বাবা বলে,
—“ওর একটা সুন্দর মন আছে, ঠিক আমার রানীর মতো। তাই।”
বাবার স্বরে সমস্ত গল্পের চরিত্র সামনে এসে পড়ে ছোট্ট মেয়েটির। সে ঘুমিয়ে পড়ে।
বাবা প্রায়ই কাজের ব্যস্ততার মাঝে একদিন হঠাৎ রাতে ফিরে বলত,
—“পাহাড় আমাকে ডাকছে। কাল খুব ভোরে বেরোবো। যে জেগে উঠবে, সে আমার সাথে যাবে।”
🍂
ছোট্ট মেয়েটি বাবারই এনে দেওয়া লাল সুটকেস, যেটা ছিল সবার থেকে আলাদা—যখন সবার কাছে স্কুলে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স তার এই লাল বাক্স তাকে সবার থেকে আলাদা রাখতো। বাবা বলত আমার রানী সবার থেকে আলাদা।
তার সেই অভিনব বাক্সে সে ভরে নিত হাতের কাছে যা পেত।
তারপর বাক্সটায় মাথা রেখে বাইরের চৌকিতে ঘুমিয়ে পড়ত—যাতে বাবা তাকে ফেলে না যেতে পারে।
সেই বাবার পাহাড়ে যাওয়া, বাগান করার, বাজি বানানোর—সব কাজের একমাত্র সঙ্গী ।
রোজ বাড়ির সামনে দিয়ে এত সাইকেল যায়, তবু বাবার সাইকেলের প্যাডেলের আওয়াজ, বাবার সাইকেলের কিরিং কিরিং—তার সব জানা।
দরজায় সে হাত পায় না, তাই চেয়ারে চড়ে দরজার পাশে দাঁড়ায়।
দূর থেকে বাবার আসা টের পেলে ছুটে গিয়ে দরজা খুলবে।
বাবা তো কোনোদিন খালি হাতে আসেনা—কোনোদিন মিষ্টি, কোনোদিন উজ্জ্বালার পাপড়ি চানাচুর, ক্ষীরের গুজিয়া, চকলেট, বরফি, সন্দেশ না-হলে মিষ্টি পাউরুটি, কুমড়ো মিঠাই, নারকোলের মিষ্টি—না জানি কত কী!
আজ জানলার উপর দাঁড়িয়ে মেয়েটি ঘুমে ঢুলতে থাকে। বারবার জানলার গরাদে মাথা ঠুকে যায়, আবার চোখ রগড়ে বাইরে তাকায়।
পোকাগুলো কমে এসেছে আলোর ধার ঘিরে।
বাবা এখনও কেন আসছে না?
মা ডাকে শুয়ে পড়তে।
না, তাকে জেগে থাকতেই হবে।
বাবার সাইকেলের আওয়াজ।
জানলা থেকে লাফিয়ে দুটো ঘর পেরিয়ে চেয়ারে চড়ে সে দরজা খুলে সোজা বাবার কোলে।
বাবা গান ," রানী! রানী! আমার আদরিনী!"
বাবা তার হাতে একটা সুন্দর রঙিন প্যাকেট তুলে দেয়।
প্যাকেট খুলে তার মুখে হাসির ঝরনা।
সেই জামাটা!
পুতুলে পড়ানো ছিল, শোকেসে ছিল!
বাবাকে সে জড়িয়ে ধরে।
বাবাকে জড়ালেই বাবা বলেন
"রানী !রানী! রানী! আমার আদরিনী!"
তারপর সে ছুটে চলে যায়।
মা বলে,
—“এত দেরি হল যে?”
বাবা বলে,
—“হরি বস্ত্রালয়ের শোকেসে সেদিন জামাটা ওর খুব পছন্দ হয়েছিল। মালিক বলেছিল, দোকান রাতে বন্ধ হলে তবেই পুতুলের গা থেকে জামা খুলে দেওয়া যাবে। তাই দোকান দশটায় বন্ধ হলে তখনই নিয়ে এলাম।”
মা বললেন,
—“তুমি সেই সন্ধ্যে সাতটা থেকে দাঁড়িয়ে ছিলে ওই ফ্রকটার জন্য?”
ততক্ষণে সরোজ নতুন ফ্রকটা পরে এসে বাবার সামনে দাঁড়ায়।
বাবা তার দিকে তাকিয়ে বলে,
—“দাঁড়িয়ে ছিলাম এইজন্য। দেখো একবার চেয়ে—দেখো আমার রানীকে!
কিরকম মানিয়েছে!”
রানী বলে,
—“বাবা, এখন আমাকে হ্যাপি প্রিন্সের গল্পটা বলো। চল।
দিদির বইটা আবার রাতেই ব্যাগে ভরে রাখতে হবে।"
লাল টুকটুকে ফ্রকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে আমার রানীকে ,বাবা হাসেন মনে মনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে।
বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ছে সে...
1 Comments
খুব সংবেদনশীল লেখা। আমাদের সবার জীবনের সঙ্গে সংপৃক্ত। খুব ভালো লাগল।
ReplyDeleteসুদাস ভট্টাচার্য্য