কমলিকা ভট্টাচার্য
মর্নিং ওয়াক সেরে ঘরে ফিরে বেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে গেল। মধুবাবু একটু অবাক হলেও, তিনি রসিক মানুষ—বলে উঠলেন,
"মাত্র আধা ঘণ্টাও হয়নি বাইরে গেছি, তাও আমার পথ চেয়ে দরজায় অপেক্ষা করছো! ইদানীং তুমি দেখছি আমাকে একদম চোখে হারাচ্ছো।"
কল্যাণী দেবী গম্ভীর গলায় জবাব দিলেন,
"হারাচ্ছি তো বটেই—তবে তোমায় নয়, সুন্দরীকে। সাতটা বেজে গেল, এগিয়ে গিয়ে দেখো, মিত্তিরদের বাড়ির বাইরে ওর জুতোজোড়া আছে কি না?"
মধুবাবু জুতোর ফিতে খুলতে খুলতে বললেন,
"ওর জুতো আমি চিনবো কেমন করে? কী কী যে বুদ্ধি লাগাও! তবে ওর জুতো দেখার দরকার নেই। ওর সাথেই আমার দেখা হয়েছিল, আমি আজ ওকে কাজ থেকে ছুটি দিয়েছি।"
কল্যাণী দেবীর পারা অলরেডি অনেকটাই চড়া ছিল। তার ওপর এইরকম কথা শুনে তিনি একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন,
"কাজের সময় তোমার এইরকম মস্করা আমার ভালো লাগেনা। আজ আবার কী বাহানা করেছে, আসবে না বলে?"
মধুবাবু সোফায় এসে বসলেন, আরাম করে হাত দু’টো সোফার পেছনে প্রশস্ত করে দিয়ে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বললেন,
"আজ মে দিবস—শ্রমিক দিবস, মানে লেবার ডে! বেচারা সারাদিন, সারা বছর কত বাড়িতে কাজ করে। আজকের দিনেও ওকে বাড়িতে ডেকে কাজ করানোটা খুব একটা ভালো লাগতো কি? তাই না করে বললাম—আজ তোর আর আমাদের বাড়িতে কাজ করতে হবেনা। আজ তোর ছুটি। কী খুশিটাই না হলো!"
এবার কল্যাণী দেবীর ধৈর্যের বাঁধ একেবারে ভেঙে গেল। ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন,
"আর এই আমি? চব্বিশ ঘণ্টার বিনা পয়সার কাজের লোক! তাকে কবে লেবার ডের ছুটি দেবে বলতে পারো?"
কথা আরও বাড়ার আগেই কল্যাণী দেবীর মোবাইলটি বেজে উঠলো—
ছেলের ফোন।
"খোকন, একদম ঠিক সময়ে ফোন করেছিস। তুই আমার টিকিটটা করে দে, আমি আসছি তোর কাছে।"
ওদিক থেকে খোকন বলল,
"আর বাবা? বাবা কি একা থাকবে নাকি?"
"তোর বাবার কথা রাখ! তার কি লোকজনের অভাব আছে? সুন্দরী, এলা মাইমা, মঞ্জু বৌদি—আরও কত লোক! বাইরের লোকের জন্যই তার দরদ উথলে ওঠে কিনা!"
খোকন বুঝে যায়, আবার বাবা-মায়ের মধ্যে কিছু একটা খুনসুটি-ঝগড়া চলছে নিশ্চয়ই। ছোটবেলায় এই ঝগড়ার মধ্যে পড়ে সে অনেকবার গুগলি হয়েছে। এখন বড় হয়ে মা-বাবার কুমীরের কান্নার মত কুমীরের ঝগড়াটা সে বেশ উপভোগ করে।
তাই একটু উস্কে দিয়ে বলল,
"বাবা আবার কী করল?"
ওদিক থেকে মধুবাবু চেঁচিয়ে বলতে থাকেন,
"ছেলের কান ভেঙে কোন লাভ হবে না। ওকেই জিজ্ঞেস করো না, লেবার ডের দিনে কাউকে দিয়ে কাজ করানো ঠিক কিনা!"
কল্যাণী দেবী ছেলেকে বলেন,
"তোর বাবা দরদ দেখিয়ে সুন্দরীকে আজ কাজে আসতে বারণ করেছে। কী জানি, লেবার ডে বলে! তাই এখন আমার অনেক কাজ..."
মধুবাবু এগিয়ে এসে ফোনটা কল্যাণী দেবীর হাত থেকে নিয়ে বলেন,
"পরের বার আসবার সময় তোর মার জন্য একটা রোবট আনিস, যে সব কাজ করবে। ওনি খালি বসে বসে মোবাইল করবেন!"
🍂
খোকন বোঝে, এখন ফোনটা না রাখলে সে দারুণভাবে ফেঁসে যাবে। তাই তাড়াতাড়ি কাজের বাহানা করে ফোনটা রেখে দেয়।
কল্যাণী দেবী বলেন,
"ছেলেকে কী বললে? আমি সারাদিন ফোন করি—ছেলেটার একটা ফোন আসে, সেই টুকু সময়ও তোমার জন্য ভালো করে কথা বলতে পারি না! আর আমি কিনা..."
মধুবাবু বলেন,
"আর কথা বাড়িও না, অলরেডি আটটা বেজে গেছে। এরপর বাজারে গেলে সবজি, মাছ—আর বাড়ি এনে রান্না করার দরকার হবে না। সব সেদ্ধ পাওয়া যাবে। যা গরম পড়েছে! আরে যা! এইগুলোর কথাই তো ভুলে গেছি!"
বলে পকেট থেকে দুটি বেশ বড়, ডাঁসা কাঁচা আম বের করলেন। কল্যাণী দেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
"মিত্তিরবাবু গাছের আম পাড়ছিলেন, তাই এই দুটো দিলেন। দুপুরে একটু টকের ডাল বানিও।"
এই কথা বলে আম দুটো কল্যাণী দেবীর দিকে এগিয়ে দিতে গিয়েও ওনার মুখের ভাব দেখে আর সাহস করলেন না। অলরেডি তিনি ঢিল ছুড়েছেন—আর এই শক্ত আম দুটি যদি পাটকেল হিসেবে ফেরত আসে, তাহলে আর রক্ষা নেই! তাই তিনি আমগুলো টেবিলের উপর রেখে সোফায় গিয়ে বসলেন। গলা নামিয়ে বললেন,
"এক কাপ চা দাও। তাড়াতাড়ি বাজারটা সেরে আসি।"
কল্যাণী দেবী মুখ ঝামটা দিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময়ই কলিং বেলটা বেজে উঠলো। কল্যাণী দেবী গজগজ করতে করতে দরজা খুলে দেখলেন—সুন্দরী।
তিনি সুন্দরীকে বললেন,
"কি ব্যাপার তোর?"
সুন্দরী বলল,
"ব্যাপার আবার কি? আমি তো কাকুকে বললাম—মিত্তিরবাবুরা আজ মেয়ের বাড়িতে যাবে, তাই ওদের বাড়িতে আগে কাজ সেরে তারপর তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। কাকিমাকে বল, আটটার নাগাদ এসে যাব।"
কল্যাণী দেবী একবার ঘুরে মধুবাবুর দিকে তাকালেন, তারপর সুন্দরীকে বললেন,
"তোর দেরি হচ্ছে দেখে মোটামুটি আমি সব কাজ সেরে ফেলেছি। আজ তোর আমার বাড়িতে কাজের ছুটি। তবে তুই একটু দাঁড়া।"
কল্যাণী দেবী ভিতরে গিয়ে ছেলের বিদেশ থেকে পাঠানো চকলেটের বাক্স থেকে একমুঠো চকলেট সুন্দরীর হাতে দিয়ে বললেন,
"আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি যা। বাচ্চাদের দিস, নিজে খাস। হ্যাপি মে দিবস!"
সুন্দরী ‘মে দিবস’ মানে না বুঝলেও ওর মুখের হাসি আজ কম পড়ছিল ওর মনের খুশি প্রকাশ করতে।
এদিকে দরজার বাইরে কী হচ্ছে, সেটা মধুবাবু ঠিক ঠাহর করতে পারছিলেন না। সুন্দরী যে এসেছে অথচ ভিতরে আসছে না—তার কারণটা তিনি আন্দাজ করতে পারছিলেন না। ইদানীং কানে একটু কম শুনছেন—তিনি বলেন, ‘বয়সের উপহার’। এদিকে বাইরে গিয়ে আবহাওয়া বোঝারও হিম্মত করতে পারছিলেন না। কল্যাণী একবার ভিতরে এলো, কিছু নিয়ে গিয়ে দিল। তাহলে কি টাকা দিয়ে ওকে বিদায় করে দিচ্ছে? এসব নানা কথা মনে হলেও তিনি বিশ্বাস করেন—কল্যাণী দেবী এসব কিছুই করার মানুষ নন।
বাইরের দরজা বন্ধ করে রান্নাঘরে ঢোকার আগে কল্যাণী দেবী একবার খালি মধুবাবুর দিকে তাকালেন। মধুবাবু তখন একগাল হেসে কিছু একটা বলবেন বলে মুখ খুলবেন কি, তার আগেই কল্যাণী দেবী মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
মধুবাবু মোবাইল খুলে এক গাদা ‘গুড মর্নিং’ মেসেজ দেখতে দেখতে নিজের মর্নিংটি সত্যি সত্যিই গুড হবে কিনা—তার অপেক্ষা করতে লাগলেন।
কিছুক্ষণের জন্য রান্নাঘরে টুকিটাকি বাসনের আওয়াজ ছাড়া বাড়িতে নিস্তব্ধতা।
তারপর সেই নিস্তব্ধতা ভেঙে ঠকাশ করে এক কাপ চা এনে কল্যাণী দেবী মধুবাবুর সামনের টেবিলে রাখলেন আর বললেন,
"আজ সুন্দরীকে মে দিবসের ছুটি দিয়েছি।"
মধুবাবু চায়ে চুমুক দিলেন।
অন্যদিনের চেয়ে চায়ে মিষ্টিটা ওনার একটু বেশি লাগলো...
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
6 Comments
বা:!! খুব সুন্দর।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো ✨️✨️✨️দিদি
DeleteThank you
DeleteThank you
Deleteজমে গেছে গল্প। মধুগুলগুলি
ReplyDeleteThank you
ReplyDelete