জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন /পর্ব ৪৭/মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব ৪৭

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 


  || পুরনো দোকানে বিগত আড্ডা...||

                             
ভবানীদা তো বাপির অপারেশনের ডেট পিছিয়ে ডিসেম্বরে দিচ্ছে। ইউরোপের কোথায় কোথায় নাকি কনফারেন্স আছে বলছে আর শীতে হলেই বেটার হবে কী বলিস চায়ে চুমুক দিয়ে দানি বললো।তাইই হোক তবে বাপিকে জানালি? শনিবার মাবাপি আসছে। তখনই বলবো।তদ্দিনে  তারা বেহালা বকুলতলায় ছোট্ট একখানা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে সামান্য বাসন কোসন, দু'ঘরে সিঙ্গল দুখানা খাট  গ্যাস আভেন,ছোট্ট ফ্রিজ আর প্রচুর বইপত্তর,সাজিয়ে বসেছে।  
       শীতের মেলায়  পলাশ কিনল বেতের দুখানা চেয়ার,একটা টেবিল আর বারান্দায় পাতার এক রকিং চেয়ার। ট্রাম ডিপো থেকে ঝিনি কিনেছিল মস গ্ৰিন এক জুট কার্পেট আর দুটো এরিকা পাম। রামকিঙ্করের সাঁওতাল দম্পতির ছবির বেশ বড় সাইজের প্রিন্ট বিক্রি হচ্ছিল বইমেলায়। সাদা বর্ডার দিয়ে বড়ো কাঠের ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে দিলেই ব্যাস। গৃহসজ্জা শেষ। টেরাকোটার পাত্রে একটু মাটি  জলে ভিজিয়ে ডালসমেত নয়নতারা ফুল গুঁজে রাখল কাঁচ বসানো বেতের টেবিলে। 
          ফুলদানি আর কাঁচের গ্লাসে হস্টেলে পোষা মানিপ্ল্যান্টগুলো সে সঙ্গে করেই এনেছে। রান্নাঘরের সাথেই ছোট্ট প্যাসেজে যে নকল ওয়ালনাটের সস্তা খাবার টেবিল আর চেয়ার পেতেছে সেখানেও গাছ রাখে সে। 
           পলাশ না থাকলেই এ পাড়ার বাচ্চারা তার সঙ্গে ভিড়ে যায়।চেয়ার টেবিল সরিয়ে টরিয়ে জায়গা বার করে তারা রুমাল চোর খেলার। রেফারি হতে গিয়ে সেও দুএক পক্কড় খেলে নেয়।ওই কারণেই বাচ্চাগুলো তাকে বড়দের মধ্যে ধরে না।বিকেলে গলির মোড়ে তাকে ফিরতে দেখলেই অরণ্যদেবের ঢাকবার্তার মতো ঝিনি এসেছে ঝিনি বলে বুকু, বুম্বা, বিট্টু,পাপাইদের কাছে খবর চলে যায়।চেঁচায় সবকটা যাব ঝিনি যাব? নাম ধরচিস যে আন্টি বল,কাম্মা বল; মায়েদের ধমক খেয়েও বাচ্চাগুলো অদ্ভুতভাবে তার নাম ধরে ডাকে।
🍂
ad

         কাজের জায়গাতেও একটা দল তৈরি হয়েছে চেনাশোনাদের নিয়ে।  মধুদা আর মিতালীর ঝগড়া বাঁধে প্রায়ই। ওরাও তাদের মতো কোঠারির জুনিয়র ডাক্তার। বাপের বাড়ি ওড়িশায় বলে  গোঁসা করে প্রায়ই মিতা ঝিনির  ফ্ল্যাটে এসে ওঠে ।   
        দেখো দেখি স্রোতস্বিনী মধুদাও নালিশ করে গত সপ্তায় কিনল ওয়ার্ডরোব।আবার মাসতুতো দিদির বিয়েতে ডিনার সেট দেখেই বলে এখনই চাই!
 আ্যতো কিছু লাগে তোর কোন কম্মে রে?আমাদের তো জামাকাপড় এখনো হস্টেলের সেই কালো ট্রাঙ্কে। আলমারিই কেনা হয়নি। খুব কিছু জরুরিও না।নেহাত বইগুলো বাড়িওলার দেয়াল আলমারিতে ধরছে না বলে এই বুক কেসটা কিনতেই হয়েছে।
          আর চাইবিই বা কেন তুই? নিজের শখ ধীরেসুস্থে নিজেই মেটাবি। ন্যাগিং বন্ধ কর আর সরি বলবি বাড়ি ফিরে।বেশ বাবা বলব। দুদিন পর হাসিমুখে বলেছি রে বলেছি শুনে সে আশ্বস্ত হয় । সরি বললি? উহু, তোর বুক কেসটার মতো একটা বুক কেসের কথা! তোকে দেখে মিতা দিব্যজ্ঞান হয় আমার,লোকশিক্ষে হয়।আ্যনাস্থেসিয়ার অর্ণবের কথায় রাগ করে না মিতা ভুবনমোহিনী হাসি দেয়।
‌           অর্ণব আবার ধরে পড়ে তাকেই; জোড়ায় জোড়ায় তোরা দেখি দিব্যি ঝালেঝোলে সংসার ফেঁদে বসেছিস এদিকে এট্টা প্রেম অবধি পেকে উঠল না আমার।দে না তোদের গাইনি ডিপার্টমেন্টের মৃদুলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে। সিরিয়াস? আলবাত। মিতা আর সে তাই  জোরজার করে মৃদুলকে অর্ণবের সঙ্গে কফি খেতে পাঠালো একদিন ।
         নাইট ডিউটিতে দশ তলার লেডিস হস্টেলের রুমেই অনকল থাকতে হয়।ডিনারের আগে মৃদুল ফিরতেই তার থমথমে মেজাজ দেখে কেউ আর ঘাঁটালো না।
        অনেক রাতে অন্ধকার জানলায় দাঁড়ানো মৃদুলের পিঠে সে হাত রাখতেই ফুঁপিয়ে উঠল। আমার লুপাস নেফ্রাইটিস আছে রে। প্রায়ই হসপিটালে আ্যডমিটেড হতে হয়।মা সব গয়না দিদি আর বোনকে দিয়েছে কারণ জানেই তো আমার  বিয়েই হবে না।রেনাল ফেলিওর হয়ে গেলে কদ্দিনে টেঁসে যাই তার নেই ঠিক অথচ অর্ণব এমন পাগল প্রপোজ করেই ক্ষান্ত দেয়নি ,সব শুনেও বিয়ে করতে চায়!
      সত্যিই সিরিয়াস অর্ণব? তুই কি ভাবিস? ফালতু কথায় লাভ আছে?ধর ওর সঙ্গে সম্পর্ক হবার পর বা বিয়ের পর এটা জানতে পারলাম তখন কী করতাম? কিন্তু প্রেম সেই চান্স ফ্যাক্টরের চাইতেও বেশি কিনা সেটা তুইই ভাববি অর্ণব।  
        শোন স্রোতস্বিনী, জন্ম দিতে গিয়ে মা মরেছে আমার।ছোট মা অবশ্য বরাবর ভাইয়ের চেয়ে আমায় বেশি আদর দিয়েছে এমনকি সেবার মাধ্যমিক পরীক্ষার অংক কোশ্চেন টাফ ছিল বলে মাধ্যমিক পর্ষদ ঘোষণা দিল  আবার অংক পরীক্ষা হবে। যারা দেবে না তারা সবাই পাশ আর যারা ইচ্ছুক ভালো নাম্বার পেতে তারা দ্বিতীয়বার দিতে পারে।ভাই জানিস তো একদমই চায়নি আবার বসতে। আমিই খুব জোর করে বসালাম। অংকে ফেল করে সুইসাইড করল ভাই। মা অবশ্য বললো তুই তো ভালোই চেয়ছিলি বড় খোকা। আরো শুনবি? গতবচ্ছর বাবা যাচ্ছিল আমার জন্য মেয়ে দেখতে। ওভার ব্রিজ না ধরে কেন তাড়াহুড়ো রেললাইন পেরোতে গেল আর বাবার সাধ আহ্লাদ সব  রক্ত মাংসের দলা হয়ে ছিটকে পড়ল ডাউন ট্রেনের ধাক্কায় কে জানে। আমাকে জড়িয়ে এই মৃত্যুগুলো সব যদি চান্স ফ্যাক্টর হয় মৃদুলকে ছ 'মাস  ধরে তো দূর থেকে দেখছি, অসুখ নিয়ে কানাঘুষো শুনেওছি। কিসের একটা টান তবু  আর কাল যখন  ও নিজেই বলল   আমি ভাবলাম হাতে সময়  কম থাকলে বিয়েটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলাই ভালো। ছোটমাকে বলেছি। আমার কোনো সিদ্ধান্তেই মার অমত নেই।ভেবলির মতো দেখিস কী? ঝিনি বলে, তোকে দেখে  দিব্যজ্ঞান হয় আমার বুঝলি,লোকশিক্ষে হয়।হো হো করে হেসে ওঠে অর্ণব।
           একতলার ফ্ল্যাটে ঝিনিদের দুখানা ঘর, রান্নাঘর আর দুদিকেই বারান্দা। দোতলায় বাড়িওলা থাকে। পেছনের  বারান্দাটা বেশী পছন্দ কারণ পাঁচিলের ওধারেই একটা জলা।ছটপুজোর হাঙ্গামা ছাড়া সে জলায়  যায় না কেউ। কাজেই বাড়তি নির্জনতার জন্য পেছনের বারান্দায় সে প্রায়ই দাঁড়িয়ে দেখে জলে মাছরাঙা ছোঁ দিচ্ছে।শেষ বিকেলে হেলে পড়া যাগ ডুমুরের ডালে ধ্যানে বসেছে বক।হোক ধ্যাদ্দেড়ে বেহালা তবু খোদ কলকাতাতেই কাজের শেষে এমন নিরালায়  ফিরে শান্তি লাগে তার।
            বাপির ভর্তি হওয়ার আগের রাতে দানিদের  শকুন্তলা পার্কের বাড়িতে ওদের মেয়ে ছোট্ট পুপের জন্মদিন ছিল।কেক কাটা হইচই শেষে টুটুলদি সবাইকে প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছিল। আড্ডার মেজাজ টুকরো হাসি আর কথা ছড়িয়ে ছিল ওদের সাজানো হল ঘরটায়।একটু দূরে বাপির গায়ে ঠেস দিয়ে চুপ করে বসে ছিল সে। বাপি বলল, এমন চাঁদের হাট ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে?
           ওসব বোকা কথা বলে লাভ নেই। চটে উঠল সে।যাবার কথা আসছে কোত্থেকে? কান খুলে শুনে রাখো,আমার আত্মার একটা অংশ তুমি।কাজেই আমি বেঁচে থাকলে তুমিও থাকবে।সিধে হিসেব।এঃ ! কী বিশ্রী এই কান খোলকে সুনলো আর তারো আবার বাংলা! তোর দেখি ভোকাবুলারি দিন দিন পুওর হচ্ছে।কথার মধ্যে ছোড়দা ঢুকে পড়ে।তোর ভোকাবুলারি আর পুওরের দুরবস্থাও তো কম না। বলো দেখি বাপি আমি কি দরিদ্র শব্দকোষ বলবো?
       শব্দ ব্যাবহারে দুজনেরই অভাব বড়ই প্রকট। বাবার কথায় হেসে ওঠে তারা।
          টানা আট ঘণ্টা অপারেশনে আঠেরো ইউনিট ব্লাডের সবটাই দাদাদের বন্ধুরা এসে এসে ডোনেট করল। তবু পরের দিন প্রেসার নেমে গেল চল্লিশের ঘরে।  লাউঞ্জে শুকনো মুখে বসে থাকে  তারা। 
       নিচু গলায় মা বলে,তোর বিয়ের পর কী যে হলো, কেমন মনমরা হয়ে পড়ল তোদের বাবা।তার মনে পড়ে বিয়ের পরদিন সে চলে আসার সময় দেখে কোনদিক না তাকিয়ে খালিপায়ে পুকুরের দিকে চলে যাচ্ছে তাদের বাবা আর দৌড়ে সে খামচে ধরছে তার পাঞ্জাবির হাতা।কেমন ধুলোমাখা বনেটের মতো মুখ তুলে  চুপ করে আছে বাবা।ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকের মধ্যে ঢুকে সে কাঁদছে ছোটবেলার এক কান্না। অনেক দিন আগের সন্ধেবেলা তাদের বাবা জেল থেকে ফিরে এলে সে যেমন বড়দের মতন শব্দহীন অভিমানে ফুঁপিয়ে উঠেছিল  আজ ঠিক তার উল্টো সময়ে দাঁড়িয়ে সে বাবাকে জড়িয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। যেন আয়না ভাঙার মতো  টুকরো টুকরো হয়ে গেছে তার অতীত জীবন।
      অসুবিধে নেই,এই বাড়ি, আমি,আমরা সবাই তোমারই তো রইলাম; দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বাবা এই একটা কথাই কোনোমতে বলতে পারল। ছোড়দা, টুটুলদি তাকে জড়িয়ে গাড়ির কাছে আনতে আনতে সে পেছন ফিরে দেখল ঘাটের রানায় বসে পড়েছে বাপি। 
             বেতের কুনকে ভরে চাল নিয়ে আসে ছোট পিসিমা। ঝিনি মা,মায়ের আঁচলে ফেলে দে।সে মাথা নেড়ে না বলে। ঋণ শোধ করব না।মা পলাশের হাত জড়িয়ে কাঁদে।টুটুলদি কাঁদতে কাঁদতে তাকে চুমু খেলে সে মনে মনে বলে এই আদরটুকুই নিয়ে যাচ্ছি আমি।আর কিছু মনে নেই আমার।গাড়ি ছাড়ার আগেও সে আর একবার দেখার চেষ্টা করে তার বাবাকে কিন্তু ভিড়ে ঢাকা পড়ে গেছে ঘাটলায় বসে থাকা তার বাবার ফুলে ফুলে ওঠা পাঞ্জাবির পিঠ।
         হসপিটাল থেকে রাতে মাকে নিয়ে সে ফিরে আসে।দুদিন পর জ্ঞান ফিরলেও ভুল বকছিল বাপি। মা আর দানিকে চিনতেও পারল না।
      তাকে দেখে অবশ্য বাবা বলল চমৎকার ঘরদোর সাজিয়েছে দ্যাখো। কোথায় সাজালো?এই যে এই রাজবাড়িটার কথাই বলছি।বি এম বিড়লার আই সি ইউকে রাজবাড়ি বলছে শুনে ঝিনি আর কিছু না বলে দুম করে গগনে গরজে মেঘ ঘন বরষা/কুলে একা বসে আছি নাহি ভরসা/রাশি রাশি ভারা ভারা/ধান কাটা হলো সারা/ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা বলে থামলে ;বাবা বলে আরো বলো। সোনার তরী পুরোটা শুনিয়ে বলল কার কবিতা? কার আবার রবি ঠাকুর।
         দু কলি ব্যাথা যখন আনে আমায় তোমার দ্বারে  গেয়ে জিজ্ঞেস করে এটা কার গান? পুরোটা না করে থামো কেন? রবি ঠাকুরের গান নিয়ে বলার কী? আমি কে সেটা তো বলো? বিরক্ত করো না ঝিনুক।গানটা গাও।সিস্টার এগিয়ে এসে বললেন এই আপনার মেয়ে? কোনো উত্তর এলো না। 
           উনি বারবার বলছেন মেয়ের কথা।সিস্টার বলেন কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে বাংলায় এম এ করছে ওনার মেয়ে। আপনিই মেয়ে তো?সে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
       হাসিখুশি নার্স দিদি যেতেই বাপি, তাড়াতাড়ি ভালো হও তো দেখি। কলেজ স্ট্রিট যাব দুজনে মিলে,বই কিনব।আর বাড়ি গিয়ে পুকুরঘাটে পা ডুবিয়ে বসে থাকব তাই না ও বাপি। বাপি অন্যমনস্ক মাথা ঝাঁকালো। গানটা?সে মৃদু গলায় গানটা গেয়ে বলল মাকে পাঠাই আর একবার?
        তোদের বাবাকে আর ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারব না বোধহয়।মা খুব কাঁদছিল। কাউকে চিনতে পারছে না। ভুল বকছে। বাপির বি পি খুব কমে গেছে মা। সোডিয়াম লেভেলটাও নেমে গেছে।তাই কিছুটা কনফিউজড। ইলেক্ট্রোলাইট কারেকশন হলেই ঠিক হয়ে যাবে সব।চিনতেও পারছে।তোকে বলল? হ্যাঁ। আর দানি তো ভবানীদার সঙ্গে কথা বলছে ওই দ্যাখো। তুমি শান্ত হও।
        অপারেশন নিয়ে স্যাটিসফাইড আমি।নর আ্যড্রিনালিন ইনফিউশন শুরু করেছি।বি পি ঠিক উঠে যাবে।থ্রি পার্সেন্ট সোডিয়াম ক্লোরাইড  চালু হয়েছে।দানির সাথে কথা বলতে বলতে ভবানীদা এগিয়ে এল। পলাশ, টুটুলদি সবাই ঘিরে এল। আশা করছি কাল থেকে আরও ইমপ্রুভ করবে।ছোড়দার কাঁধ চাপড়ে বলল ভবানীদা। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে একটা পরিবারে এতজন ডাক্তার বিস্ময়কর বলে হেসে হাত নেড়ে চলে গেল।
          সবাই স্বস্তি পেল খানিকটা । ঝিনি শুধু ঠোঁট কামড়ে ভাবছিল যে মানুষ নিজের স্ত্রী পুত্র কে চিনতে পারার অবস্থায় নেই সেই  অর্ধচেতনাতেও রবীন্দ্রনাথ থাকতে পারেন?
       তাকে চিনলেও তার পেশা ভুলে গেছে বাবা। তাকে জোর করে ডাক্তারি পড়ানোয় কি বাপির অবচেতনে কোনো অপরাধবোধ আছে? শারীরিক সংকট আর  বিপন্ন এই বিভ্রান্তির মধ্যে আজ সন্তানের চাওয়া আর নিজের চাওয়া এক হয়ে ভেসে উঠল চেতনার উপরিতলে?
           কোঠারিতে ডিউটির সময় ঝিনি দেখে ফেডেড জিনস, রঙচটা টিশার্ট  খুব ছোট করে ছাঁটা চুলে বালকের মতো এক মুখ কারো সাথে মেশে না। লিফট বন্ধ থাকলে সিঁড়ি দিয়ে সটান ছ'তলায় উঠে যায়। রাউন্ড দেবার সময় সিস্টারকেও ডাকতে চায় না।
        পেশেন্টর ড্রিপ চালাতে কী একটা প্রবলেম হচ্ছিল ওর। নাইট ডিউটি ছিল তার। বললো হেল্প করব? নো থ্যাঙ্কস বলেও যখন পারলো না, আবার হাত বাড়ালো সে ।এবার হেলপটা নিল কিন্তু ধন্যবাদ বলেই চলে গেল। সিস্টার দুজন নিজেদের মধ্যে বুজবুজ করে কী বলল আর ভুরু কুঁচকে নিজের কাজ সারতে সারতে সে ভাবল কেন এই মেয়ে এত
 দলছুট জানতে হবে।
          বন্ধমুঠি খুললো আস্তে আস্তে।ও তৃণা।নয় ভাইবোন। অসম্ভব দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে করে পৌঁছেছে এখানে।বাবা নেই এটাই বলেছিল।
সেদিন নাইট ছিল ঝিনির।  টাকা যা পাঠাই মাকে তার বেশী দেব না আর তোমাকে তো নয়ই।নেশার টাকা নিতে আ্যদ্দুর চলে এসেছো? এটা নিয়ে বেরোও এক্ষুনি। গার্ডকে বলছি রাখছি আর  এলে ঢুকতে যেন না দেয়।পাশের ঘরে চাপা গলায় তৃণার হুঙ্কার শুনে ঘুম ঘুম চোখে সে দুই রুমের কমন দরজায় দাঁড়িয়ে দ্যাখে রোগা পাকানো চেহারার বুড়ো মতো কাকে যেন ধমকাচ্ছে । তিনশো টাকা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে ভদ্রলোক তাড়াহুড়ো করে চলে যেতেই তার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে শুকনো হেসে বললো ,বাবা। অবাক হয়ে কিন্তু তুই যে বলেছিলি...। আসলে মালটা বেঁচে আছে! 
              হতভম্ব সে তাকিয়ে আছে দেখে তৃণা দাঁতে দাঁত চেপে এক গাদা ছেলেমেয়ের জন্ম দেওয়া আর কারখানার কাজের টাকা পেলেই নেশায় চুর মাকে ঠ্যাঙানো ছাড়া কিচ্ছু করেনি। এসব জঞ্জালের বাঁচার রাইট নেই।খুন তো করতে পারি না তাই সবাইকে বলি মরে গেছে। 
       ডাইনিং এ যাচ্ছি আমি।ব্রেকফাস্ট খেয়ে রাউন্ড দিয়ে চুল কাটতে যাব। তুই ধীরেসুস্থে আয়। কোথায় যাবি চুল কাটতে? আমি ফুটপাতের ওই যে বিহারী বুড়ো বাক্স পেতে বসে ওর দোকানে যাই ।লোকটা ভদ্র।মাস তিনেকের  মতো বেশ মুড়িয়ে কেটে দেয়।
           সে ভাবে কত ঘেন্না  জমলে বাবাকে এভাবে বলা যায়!রাগ হয় না বরং আরও মায়া হয়। পশ টাইপের ভদ্দোর সমাজকে আগে ভাগেই রিজেক্ট করবার জন্যে এতদিনে ওর ওই চুলের আর্মি ছাঁট, ধর্মতলার ফুটপাত থেকে কেনা জিন্স আর ছেলেদের টিশার্ট গুলোর মানে একটু একটু পরিষ্কার হয়। 
           কোঠারির অনেক জুনিয়র ডাক্তারই বেশ নাক উঁচু টাইপ।এই যেমন ডিনার টেবিলে বারতা বললো,
কী করে টলারেট করিস স্রোতস্বিনী?ভীষণ গাঁইয়াতো!আমিও তো গাঁইয়া রে, সমস্যা নেই, কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে যায় লংস্কার্ট।
       ছোট থেকে নিশ্চই অনেক না -এর সঙ্গে তার দেখা হয়েছে। নিজেকে তাই একটু অস্পষ্ট রাখতেই তৃণা পছন্দ করে।কোঠারির দুটো বছর  সময়ের ফাঁক ফোকরগুলো এই মেয়ে কিন্তু ভরে দিচ্ছে। ন্যাশনাল লাইব্রেরির সামনের বাগান বা আলিপুরের রাস্তায় রাস্তায় খালি খালি হাঁটে তারা। খেপ খাটতে পলাশ  কোঠারি ছাড়াও যায় বেলভিউ,উডল্যান্ডস, পার্ক চিলড্রেন সেন্টারে ।পিজি তে পেডিয়াট্রিকস নিয়ে হাউসস্টাফশিপটা বড্ডো কাজে লাগছে ওর।এস এন সি ইউ এর নিউ বর্ন বেবীদের রাতভর অ্যাটেন্ড করতে জুনিয়র ডাক্তারদের ডেকে নেয় স্যাররা। প্রায়দিনই তার এক্সট্রা ডিউটি থাকে।
          ডিউটির পর কাজেই  বকুলতলার ভাড়া বাড়ি ঢোকার  তাড়া থাকে না তার।আর তৃণা তো পাকাপাকি  রেসিডেনসিয়াল।সন্ধে রাত্তিরে  তাই নিঝুম এগলি ও গলি তারা দুজন নিজেদের বাঁকা চোরা ছায়ার সঙ্গে হাঁটতে থাকে। ন্যাশনাল লাইব্রেরীর পাশের রাস্তায় মস্ত গাছগুলোকে আবিষ্কার করে কখনও।ঝিনি,দ্যাখ দ্যাখ নাগকেশর! তৃণা,ম্যাগনোলিয়া ওটা।স্বর্ণচাপার পাশেই সোঁদাল ফুটেছে কত। সপ্তায় যে দুদিন নাইট থাকে তার , দশতলায়  হস্টেলের জানলার কাঁচ সরিয়ে দিলে আকাশ ঢুকে যায় ঘরে। আলো নিভিয়ে মাউথঅর্গানে  সুর তোলে তৃণা। সে গায়... আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে... ঋতুর ছিল প্রিয়  এই গান। ফিসফিসিয়ে নিজেকে বলে সে। গান থামিয়ে কী বিড়বিড় কচ্ছিস স্রোতস্বিনী?
         জন্মদিনে ন হন্যতে কিনে লিখলো...বন্ধুত্ব কথাটার সঙ্গে দেখা হয়নি বহুদিন। শব্দটাকে ভুলতে বসেছি যখন,তখন যার সঙ্গে দেখা..।
       একটা ছোট্ট কাফেতে প্রায়ই তারা কফি খেতে যেতে। জন্মদিনের সন্ধেয় তৃণাকে সেখানেই কফি আর পেস্ট্রি খাওয়ালে পাগলি বাজালো ইয়ে দোস্তি...। একটা ভালো মাউথ অর্গান কিনে দিসতো। কোথায় পাওয়া যায়? নিউমার্কেট বা কলেজস্ট্রিট খুঁজবি। আচ্ছা।
        বাপির অপারেশনের জন্য ছুটি নিয়েছিল সে ।তার পরেই একটা হেলথ সেন্টারে কন্টাক্ট সার্ভিসের ইন্টারভিউ এবং জয়েন করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল  হঠাত করেই। যোগাযোগ ছিল না তৃণার সাথে। একদিন ওর খোঁজ নিতে কোঠারি গিয়ে শোনে ভোপাল চলে গেছে ও। ঠিকানা দিয়ে যায়নি।দেবার মতো কেউ অবশ্য ছিলও না।
            পুরনো দোকানে বিগত আড্ডা /বিগত ঝগড়া বিগত ঠাট্টা...ফেরার রাস্তায় সেই ছোট্ট কফিশপটায় চোখ পড়লে বিড়বিড় করে সে।
           একটা পারফিউমের শিশি, একটা মাউথ অর্গান হারিয়ে গেল গোটা  জীবন থেকে কিংবা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকলো,যেন কোনোদিনও ছাড়বে না তাকে।
            বহতা সোঁতা কখনও উজানে ফেরে কী ?
খেয়ালি,ব্যাকুল সে তো কেবল বয়ে যায় ছলোছলো উৎস থেকে মোহনারই দিকে।তাতে মেশে আরও কতো নতুন জলের ধারা।
       স্রোতে তবে  মিশে গেছে অসংখ্য জলে আঁকা মুখ? কোনখান থেকে আজ এক আঁজলা তুলে বলবে সে এটা তুই ঋতা।এটা তৃণা আলোলিকা .
কৃষ্ণকলি,কল্লোল বা প্রলয়। মিশে আছে বুকে বসত করা নিবিড় সব ছায়ামানুষ।
         ঝিনি ভাবে প্রতিটি সম্পর্কের মধ্যেই তাহলে ভাঙনের ভয় নিয়ে পেন্সিল স্কেচের মতো রোগা এক সাঁকো  আনমনে দোল খায় হাওয়ার হাওয়ায়।যার দুপারেই ভালবাসা আর মায়া একাকার হয়ে থাকে।কার কাছে যাবে সে?
      একা হাঁটতে হাঁটতে দেখে জলের ধারে ছোট ছোট ঘাসফুল। ফিরোজা, নীলচে,মভ ,হায়াসিন্থ কত রঙ হয়ে ফুটে আছে প্রাণ নির্জনে।কার অপেক্ষায়? ফিসফিস করে বলে ওদের.. "বন্ধু! কী খবর বল। কতদিন দেখা হয়নি.…"!

Post a Comment

0 Comments