ভাঙা আয়নার মন
পর্ব ৪৯
মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া
||... জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে ||
"কে দেখেছে এমন ঘোড়া–গজনী থেকে গৌড়ে/মর্ত্য থেকে স্বর্গে গেল একটি রাতের দৌড়ে!" বাবা চোখ নাচিয়ে তার দিকে ফিরে হেসে বলল,সেও মাথা নাড়ল। কিসের ছড়া বলে বলে বাপবেটির এত হাসাহাসি? ওয়েটিং রুমে নাতনি কোলে বসে মা ভুরু কোঁচকালো। ছড়া নয় গো শায়েরী।
দুজনেরই তাদের পোস্টিং হয়েছে উত্তরবঙ্গে। পলাশ জয়েন করেছে আগেই। ম্যাটারনিটি লিভের মধ্যেই ছুটোছুটি করে পলাশের কাছাকাছি জায়গায় পোস্টিং জোগাড় হলো তার।অসুবিধে হয়নি। এখানে কে আর সাধ করে আসতে চায়।মা হবার ছুটি শেষে সেও জয়েন করবে।দু মাসের শালিখকে নিয়ে সে চলেছে তাদের সরকারি কোয়ার্টারে।
পলাশ তাদের নিতে এসেছে। নতুন ঠিকানা দেখতে মা বাবাও সঙ্গে এল।মা কদিন থাকলে শালিখের জন্য নতুন জায়গায় সে খানিক গুছিয়েগাছিয়েও নিতে পারবে।
ফার্সি কবি আনোয়ারির সেই মজার অথবা দুঃখের গল্পটা জানো তো? বাবা জিজ্ঞেস করল মাকে।না বাপু একইসাথে মজা আর দুঃখের গল্প আমাদের জানা নেই তাইনা দিয়া ভাই? শালিখকে কোলে করে মা ঝংকার দেয় বাবাকে। ওমা দেখো দেখো হাসে কেমন; সবই দেখি বোঝে গো। এখন থেকেই কেমন সোশ্যাল স্মাইল দিতে শিখেছে দেখো।সব দিদুনরাই তাদের নাতিপুতিকে বেশী বেশী বুদ্ধিমান ভাবে। এখন শোনো না গল্পটা। তুমি বলো তো বাপি।
সুলতান সঞ্চুর একবার কবি আনোয়ারিকে একটা ঘোড়া উপহার দেওয়ার হুকুম দেন। কিন্তু উপহার হিসেবে এমন মৃতপ্রায় এক ঘোড়া কবি পেলেন যে বাড়িতে আনতেই সে ঘোড়ার এন্তেকাল হলো। এদিকে অশ্ব উপহার দিয়ে পুলকিত বাদশাহ পরদিনও দরবারে কবিকে হেঁটে আসতে দেখে অবাক হয়ে ঘোড়া চড়ে না আসার কারণ জানতে চাইলেন। কবি বলেন আজ্ঞে এমন তেজী ঘোড়া যে তাকে বাগে আনা কবির কম্মো নয় এমনকি পৃথিবীর কোনো বীরই তাকে বাগ মানিয়ে চড়তে পারবে না। সে আবার কেমন কথা?আমি বাদশাহ! আমিও পারবো না? এমন গুস্তাকি সম্রাট বরদাস্ত করে কী করে?শাহি ইগোর পারদ চড়ছে দেখে কবি আনোয়ারি ওই গজনী থেকে গৌড়ের শায়েরী শুনিয়ে শেষটায় সুলতানকে ঘোড়ার পরিণতি নিবেদন করেন।সবার সঙ্গে মাও হাসল এবার।
🍂
শশাঙ্কের রাজধানীর নামে তাইলে এই গৌড়
এক্সপ্রেস? তোরা তো দেখি ইতিহাসের মধ্যে থাকা শুরু করবি।মা শালিখকে দোলা দিতে দিতে বলল।এ সি কামরার বালিশ কম্বল দিয়ে পলাশ চটপট সবার বিছানা পেতে ফেলল। শাপলাকে নিয়ে শোবে বলে তার লোয়ার বার্থে বাড়ি থেকে আনা চাদর বিছিয়ে নিল সে। এবার আমায় দাও মা। তুমি আরাম করে বোসো।
সব জায়গারই কিছু না কিছু ইতিহাস আছে বিনু। আমাদের চন্দ্রকেতু গড় যেমন আড়াই হাজার বছরের গঙ্গা রিডি সভ্যতা বুকে বসে আছে তেমনি ঝিনিদের নতুন ঠিকানার কাছে বানগড়ও আড়াই হাজার বছর আগের কোটি বর্ষ আগলে রয়েছে।তবে শশাঙ্কের রাজধানী কিন্তু মোটেও গৌড় না ।গৌড় রাজ্য হলো প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার এক বিরাট অঞ্চল।আর গৌড় নগরী মালদা আর বাংলাদেশের সীমান্ত লক্ষণাবতী শহরের ধ্বংসাবশেষ।গৌড় রাজ্যের রাজা শশাঙ্কের রাজধানীর নাম কর্ণ সুবর্ণ না বাপি?যা এখন মুর্শিদাবাদের কানসোনা।
ঠিক বললি তো যা কাঁচা তুই ইতিহাসে।বাবার কথায় সবার সাথে সেও হাসল। ট্রেনটাও ছেড়ে দিল তক্ষুনি। দুগ্গা দুগ্গা,মা বলে উঠল আজ বুদ্ধ পূর্ণিমা। ভালো একটা দিন।আমরা তাইলে গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে রাজা শশাঙ্কের রাজ্যে চললাম। মহা শৈব শশাঙ্ক কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্বেষী ছিলেন খুব।
বাবার কথায় মেয়ে কোলে আনমনে জানলা দিয়ে মাঠের পারে চলন্ত চাঁদ দেখে তার মনে হলো আজ যাচ্ছি কাল যাচ্ছি বলে ট্রেনের চাকা চলছে তো চলছে।সামনের রাস্তা কি তবে ইতিহাসের দিকেই বেঁকে যাচ্ছে?পেছনে লোহার পাটিতে পড়ে থাকা অসংখ্য চাঁদের দিকে আর পাঁচ জনের মতোই সে কি আর ফিরেও তাকাবে না ? কপিলা বস্তু থেকে উঠে আসা প্রাচীন এই বোশেখের চাঁদ আর তার ভরা কোটাল যেন কবেকার উজানে চলল। তাকে দেখতে পিছন ফিরে তাকাতেই হবে কিন্তু তার তো উপায় নেই।দিনগুলো তবে পুরোনো কালের দিকে চলেছে না কি একেবারে আলাদা কোনো অন্যরকম সময়ের মধ্যে তাকে নিয়ে চলল দূর পাল্লার চলন্ত জানলা।
মেয়েকে বুকের কাছে নিয়ে রাতভর আধো ঘুম আধো তন্দ্রায় সে দেখল পেছনে অনেক মানুষ আগুনের মতো এক লালচে আভার শরীর নিয়ে এগিয়ে আসছে যেন কতকালের যুদ্ধ ও ধ্বংস পেরিয়ে তারা আসছে।মারের মুখ এড়িয়ে সেও যেন হেঁটে হেঁটে আসছে অত মানুষের সাথে। কে যেন ঝাঁকুনি দিচ্ছে তাকে আর বলছে এখন স্রেফ বর্তমান পুরনো কাল আর আগামী দিন বলে আলাদা কিছু হয় না আর ঘুমের জড়তা ভেঙে খুব ভোরবেলা দেখে ট্রেনের কামরায় গুম গুম শব্দ তুলে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ট্রেন ফারাক্কার গঙ্গা পেরোচ্ছে।
সবাই উঠল আরও ঘন্টা দুই পর।
শালিখকে খাইয়ে চাপড়ে চাপড়ে ঘুম দিয়ে মার কোলে দিয়েছে খানিক আগে। স্টেশনে গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিল পলাশ। ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্টেশন থেকে দূরে।জানলা দিয়ে আত্রেয়ী নদী দেখালো পলাশ।
তাদের ভরা ইচ্ছামতীর তুলনায় এত সরু তিরতিরে চরের চাদরে বুক ঢাকা আত্রেয়ীকে দেখে মুষড়ে পড়ল সে। পলাশ আড় চোখে তার মুখ দেখে বলল এ নদী কিন্তু পাল্টে যায় যখন তখন।
কত প্রাচীন এই নদী তা জানিস?বাবা বলল মহাভারতের বনপর্বেও আত্রেয়ীর কথা আছে। তিস্তা অর্থাৎ ত্রিসোতার তিন স্রোত আত্রেয়ী -পুনর্ভবা -করতোয়া। পৌরাণিক মিথে আত্রেয়ীর রূপে নাকি মুগ্ধ হয়েছিল এক দৈত্য ও তিন দেবদূত। তাহলেই বোঝ।
দূর এত সেই আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে।এ আবার দেব দত্যিদের মাথা ঘুরিয়ে দেবে কী? আহা তখন নিশ্চয়ই বর্ষায় ভরা নদী ক্ষুরধারা খর পরশা ছিল।
তাছাড়া কলকলানি ইচ্ছামতীর সঙ্গে এই শান্ত নদীকে মেলাচ্ছিসই বা কেন?দক্ষিণের প্রাণপণ দৌড়ের চাইতে উত্তর বঙ্গের ঢিলেঢালা মোতির মালা টাইপ চলন কিন্তু বেশ লাগে।
জানিস তো যে নদীতে জোয়ারভাটা খেলে রোজই সে বদলায় আর তার সঙ্গে দুপারের মানুষও তো খানিকটে করে বদলে যায়।বাজে বোকো না তো।
ঘড়িঘড়ি অত বদলালে মানুষগুলানইতো অন্যলোক হয়ে যাবে!মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে।
বটেইতো, বাপির তৎক্ষণাৎ তিব্বতের পথ বাতলানোর মতই সিধে উত্তর ,দুবেলা নদী নিজেকেই পাল্টালে নদীপারের মানুষজনও বদলাতে বাধ্য! আত্রাইয়ের চরের শান্ত ঘরকন্নার তুলনায় আমাদের ওই চব্বিশ পরগনার কলোনি লাইফ অনেক হন্তদন্ত আর চালাক চতুর।মরীয়া মানুষজন পেটের ধান্দায় নানান ফিকির খোঁজে ওখানে। আর এখানে পেটের ধান্দা নেই নাকি?তুমি এখানকার কথা জেনে সব বসে আছো ? আরে মেজদা কুমার গঞ্জের বিডিও থাকার সময় কতবার এসেছি না? তখন অবশ্য গঙ্গার ওপর ব্রিজ হয়নি ফারাক্কায়।
আর বরিশালের নদীপারে আমার শ্বশুরবাড়ির যতেক আত্মীয় কুটুমের কথা ভাবলেই হৃদকম্প লাগে।বুঝলে পলাশ,ওই করেই বোধহয় হার্টটা আমার দুর্বল হয়ে গেল।মা কটমট করে তাকাতেই মানে এমন স্বজ্জন মানুষ জন ওই জোয়ার ভাটার দেশের মানুষরা,এমন তারা অতিথিপরায়ণ যে যতক্ষণ কুটুম ডাঙায় আছে মুখে কুলুপ আর বাড়ি ফেরার জন্য নৌকোয় চড়ে বসলে একেবারে নিশ্চিন্দি হয়ে অতিথিদের নৌকো ঘাট থেকে ঠেলে দেওয়ার পর কয়ডাদিন থাইক্যা গ্যালেই পারতা বলার একখানা ক্যারিশমাও তো আছে।কিংবা ধরো সন্ধেয় রাত্তিরে দূরে নৌকোর আলো দেখলেই নিজেদের লম্ফখানা তারা ধামাচাপা দেয় যাতে বাড়ির লোকজন ঘুমিয়ে পড়েছে ভেবে লজ্জায় পড়ে নৌকো না ভিড়িয়ে কুটুম ফিরে যায় এমন বুদ্ধি কজনার আছে বলো?সবই ওই জোয়ার ভাটার খেলা।
তোর বাবার যত আজাইরা কথা। তোমাদের খুলনে জেলার রূপসা মধুমতি নদীতে জোয়ার ভাটা খেলে না নাকি? অবিশ্যি খুলনের লোকেরা আহাম্মক ধরনের হয় বলেই চুপ করে গেল মা। সম্ভবত মনে পড়েছে পলাশদের দেশও খুলনা মনে পড়ায় মানে সবাই না ওই মধুমতির ধারের লোকগুলো শুধু। সবাই মিলে হো হো করে হেসে ওঠায় শালিখের ঘুম ভেঙে গেল।
সত্যিই বর্ষার এক রাতে মেঘের চাপা গুমগুম শব্দ আর টানা তিন দিন অঝোর ধারার শেষে ভোর বেলা নদীর মুখোমুখি সে তো অবাক ।হাইরোডের ধার দিয়ে জল তখন মিশেছে একেবারে দিগন্ত যেখানে মুখ নামিয়েছে সেই অবধি। রাতারাতি পুরো আকাশখানা বুকে ধরা বুনো আত্রাইকে কেমন অচেনা লাগে তার। ধু ধু চর ছাপিয়ে খলখল ছুটে আসা ভরাট স্তনের যুবতি সে নদীকে দেখতে ভিড় করে গাঁ গেরামের মানুষ।
একদিনেই এত বড় হয়ে গেল ? তাইতাই বলে আকাশখানা ধরুক,চেহারা বদলে আবার যে কে সেই। যমুনা রান্না আর ঘরের কাজ করে আর শালিখের সামনে হেসে হাততালি দিয়ে তাই তাই তাই /মামার বাড়ি যাই বলে। মেয়ে কথা শিখে অবধি তাকে তাই তাই বলে ডাকে। আসল নাম ভুলে সিস্টাররা, ফার্মাসিস্ট গগনবাবু,হোমিওপ্যাথির সুরজিৎদা সবাই যমুনাকে আজকাল তাই তাই বলেই ডাকে।
এর মধ্যে মা বাপি, সেজো রাঙা মেসোকে নিয়ে ঘুরে গেল বার তিনেক।শালিখ অনেক কথা শিখেছে। কোয়ার্টারের মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে ঝিনি আর শালিখ চক দিয়ে আঁকিবুকি ছবি আঁকে ঘরভর্তি করে।অ আ ক খ , এ বি সি ডিও লেখে তারা।চক নিয়ে মেঝে জুড়ে এই খেলা মেয়ের ভারী পছন্দ। মেয়ের জন্য জীবজন্তুর কার্টুন এঁকে এঁকে কোয়ার্টারের দেওয়াল ভর্তি করে ফেলেছে সে।তাইতাইর কোলে চড়ে শালিখ তাদের নাম ধরে ডাকে আর হাততালি দেয়।রাতে কোয়ার্টারের সামনে ইউক্যালিপ্টাস আর আকাশমনির ফাঁকে চাঁদ উঠলে মেয়ে কোলে করে ঘুম দিতে দিতে মনে হয় সে যেন ঝিনি না,আর কেউ এসে তার মধ্যে ঢুকে বসেছে।
বর্ষার কদিন পরেই এপার ওপার চর জেগে চিকন হয়ে ওঠে তাদের ছোট নদী।নরম কিশোরীর মত রুপোলি ঢেউয়ের পায়ে পায়ে যেন ভিতু এক মেয়ে লুকিয়ে কার সঙ্গে দেখা করতে যেতে যেতে চলনবিলের রাস্তা হারিয়ে খানিক দিশেহারা হয়ে চলেছে ফের প্রান্তরের দিকে।
হসপিটাল থেকে ফিরতেই তাইতাই নালিশ করে কী দস্যি মেয়ে গো তোমার। একরত্তি পুঁচকির ভয় নাই। কম ট্যাটন এই চেংড়া! অনেকক্ষণ কিছু কচ্ছে না কেন বলে রান্নাঘর থেকে আসে দেখি হাতের মুঠোয় এট্টা ব্যাঙ ধরে দাঁড়ায় আছে ওই বারান্দার কোণে।ফ্যাল ফ্যাল ফেলে দে বলিচ্ছি তা কচ্ছে ফ্যালবো কেন?নরম তো। সাবানে হাত ধুয়ে দিয়েছো?দিছি।ভয় পায়ে ব্যাঙডা গায় পেচ্ছাপ করিল।চ্যান করায় জামা পিনধায় দিছি।
বর্ষায় ব্যাঙরা দল বেঁধে ডাকাডাকি শুরু করলে বেবী ক্যারিয়ারে শালিখকে বেঁধে ছাতা আর টর্চ নিয়ে পলাশ বেরিয়ে পড়ে যায় মেয়েকে নিয়ে। সোনা ব্যাঙেদের কনফারেন্স দেখে খুবই উত্তেজিত বাড়ি ফেরে দুজন। কাজেই ব্যাঙ জিনিসটা নির্ঘাৎ বন্ধু জাতীয় কিছুই ভেবে নিয়েছে মেয়ে ।
ফাঁক পেলেই সেও মেয়েকে নিয়ে নদীর ধারে বেড়াতে যায়। ভুটভুটি নৌকোয় মানুষ পারাপার দেখে।শীত এলেই বুকভর্তি বালুচর নিয়ে বিষন্ন কবিতার পঙক্তির ভেতর গুটিশুটি মেরে যেন ঘুমিয়েই পড়ে । তখন বাঁশ গেঁথে চওড়া সাঁকো তৈরি হয়। সাঁকো দিয়ে সাইকেল বাইক ঠেলে লোকজন ওপারে গিয়ে ওঠে। ওপারে শনের ছাউনিতে বাঁশের মাচা বেঁধে ঘাটিয়াল বসে থাকে পারাপারের পয়সা নিতে। পাগলী গঞ্জের হাটের দিন লোক হয় বেশী।নদীর ফুরফুরে হাওয়ায় হাটুরে মানুষ খানিক বসে যায়।তৈজসপাতির দাম দর নিয়ে কথা বলতে বলতে বিড়ি খায় কেউ খৈনি ডলে। দরমার ছোট্ট পান বিড়ির দোকানও বসে তাই।
চরে ছুটে বেড়ায় হুহু হাওয়ার দৈত্য। সে দেখে মায়াজাল কেটে বেরোতে পারছে না জলের কন্যে। বালির তলায় যেন হারিয়েছে সোনার কাঠি যার ছোঁয়ায় ফিরে পাবে তার প্রাচীন জলোচ্ছ্বাস।
নদীপারের টোপা কুলগাছতলায় তবু আনমনে বসে থাকে কাদের ছায়া। ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান খুঁড়ে দল বেঁধে ফেরে পাতাকুড়ুনির দল।টক-নোনতা স্বাদে ভরে ওঠে শীতলাগা কথারা।
গেল বার বাড়ি থেকে আসার সময় বছর চোদ্দোর বুয়া এসেছে শালিখকে দেখাশোনার জন্য। মায়ের কাছেই ছিল বুয়া। কিন্তু শালিখকে নিয়ে ছুটিতে বাড়ি যেতেই মাসি আমি বলো তোমার সঙ্গে যাব না নিলি গাড়ির পেছুতে উঠে চলি যাব্যান বলো; এই বায়না ধরায় সে নিয়েই এসেছে বুয়াকে। আসলে শালিখের মতো জ্যান্ত খেলনা আর তার সফট টয়গুলোই বোধহয় বুয়ার পছন্দ হয়েছে বেশী।ওরও তো খেলারই বয়স।সন্ধে বেলা দুজনেই তার কাছে পড়তে বসে। একটা ব্যাগে বসার আসন,শ্লেট পেন্সিল,অআ আর এবিসিডির দুখানা বই আর দুধের বোতল নিয়ে বুয়ার সঙ্গে গুটগুট করে ভালো আন্টির ইস্কুলে যায় বছর দুয়েকের শালিখ।
চণ্ডীমণ্ডপে ঠাকুর গড়া দেখতে গিয়ে বসে থাকে রোজ। বাবা আর বুয়ার সাথে পুজোর সময় গ্ৰামের একচালা ঠাকুর দেখতে গিয়ে নাকি সব ইঁদুর পেঁচাদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাত বুলিয়ে দেখেছে। তারপর হাতে ধরা কামড় দেওয়া আপেলখানা রেখে বলেছে সবাই মিলে ভাগ করে খেও।
পাঁচটা টাকা দ্যাও না ও মাসি বলে প্রায়ই বুয়া কেনে কমলা আইসক্রিম।শালিখ লোভীর মতো তাকায় দেখে দুজনের হাতেই দুটো আ্যলপেন লি বের ললিপপ ধরিয়ে দেয় সে। ললিপপ চুষতে চুষতে লাইব্রেরির মাঠে হাঁটতে যায় দুজন।
বি পি এইচ সি তে এসে তার তেমন কোনো বন্ধু হয়নি। পলাশ বরং অনেক বেশি মিশে গেছে এখানকার মানুষজনের সঙ্গে। ঝিনির আপন লাগে কেবল বাঁধের রাস্তায় একলা দাঁড়ালো মস্ত একখানা নিম গাছ আর এই নিঝুম আত্রেয়ী।
নিচু হয়ে তাকালে স্বচ্ছ জলের জলার বালু ,শামুক আর শ্যাওলার অন্য এক পৃথিবী দেখা যায়। পারের কাছে জলে ডুবিয়ে রাখা নৌকোর খোলে গেঁড়িগুগলির সংসার।
"জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে?/তবে কেন, তবে কেন জলে কেন যাবে তুমি/ নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে ?" শঙ্খ ঘোষের কবিতা বিড়বিড় করে সে।কী বলছ মাম্মা? ছড়া বলছ? ছোট্ট শালিখ জামা আঁকড়ে জিজ্ঞেস করে। মেয়েকে সে চেনায় জলের রুপোকথা।
"জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়?/তবে কেন, তবে কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার ?"
কত বৃষ্টি যুগ পেরিয়ে সমস্ত সভ্যতাইতো গড়ে উঠেছিল এই জলের ধারেই সে ভাবে তার চকমকি আগুনে পৃথিবীর পিঠ পুড়ে উঠলেও আজো জলেই ভিজে ওঠে মানুষের যাবতীয় সমর্পণ।
0 Comments