দূর দেশের লোকগল্প— ২৩৯
চিত্র- অর্ণব মিত্রসুইডেন (উত্তর ইউরোপ-এর স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ান দেশ)
এক রাখাল মেয়ের গল্প
চিন্ময় দাশ
এক গ্রামে থাকত একটি মেয়ে। বাড়িতে বুড়ো বাবা আর মা। ভারি অভাবের সংসার। ভেড়া চরিয়ে সংসার চালাতে হোত মেয়েটিকে।
একদিন ভেড়া চরাচ্ছে। এক সময় হোল কী, হঠাৎই একটা ভেড়াও চোখে পড়ছে না। এতগুলো ভেড়া! কোথায় গেল, কোথায় গেল? ভয় পেয়ে গেল মেয়েটা। ঘরে তিন-তিনটা পেট। ভেড়া না থাকলে পেট চলবে কী করে?
এদিক খোঁজে, ওদিক খোঁজে। কোত্থাও নাই। হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে কখন যে সামনের পাহাড়ে চড়ে পড়্রেছে, খেয়াল নাই মেয়ের।
পাহাড়ে এক জায়গায় বড়সড় এক ফটক। তার ভিতরে ঢুকে পড়েছে মেয়েটা। ভিতরে ঢুকে আর এক চমক। বড় একটা টেবিল পাতা। থরে থরে খাবার সাজানো টেবিলে। সে সব খাবার স্বপ্নেও দেখেনি গরীবের মেয়েটি।
আরও অবাক ব্যাপার। পাশেই সুন্দর একটা পালঙ্ক। বিশাল এক সাপ শুয়ে আছে তাতে। মেয়েকে অবাক করে, সাপ বলে উঠল—চাইলে, বসে পড়তে পারো টেবিলে। চাইলে, খেতেও পারো পেট ভরে। তার পর এই বিছানায় গড়িয়েও নিতে পারো ইচ্ছে হলে।
মেয়েটা হতভম্ব। বুঝতে পারছে না কী করা উচিত। সাপ বলল—কিন্তু মন না চাইলে, কিছুই কোর না।
মেয়েটা কিছুই করল না।
এবার সাপ বলল—খানিক বাদে এক দল লোক আসবে এই গুহায়। খানা-পিনা করবে। নাচানাচি করবে। তাদের সাথে নাচতে বলবে তোমাকে। কিছুতেই রাজি হয়ে যেও না।
কথা শেষ না হতেই হুড়মুড় করে একদল লোক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। টেবিলে তো খাবার সাজানোই ছিল। খাওয়া-দাওয়ার সাথে নাচানাচি হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল তাদের। একজন বলল—এই মেয়ে, আয় এদিকে। নাচবি আমাদের সাথে।
কথা কানে তুলল না মেয়েটি। ফাঁক বুঝে গুহার বাইরে বেরিয়ে এল। সেখানে অবাক হয়ে দেখল, তার ভেড়ার পুরো পালটা সামনে চরে বেড়াচ্ছে। মনের আনন্দে ভেড়া নিয়ে বাড়ির পথ ধরল মেয়ে।
পরের দিন। আবার ভেড়া চরাতে বেরিয়েছে। খানিক বাদে ভেড়াদের দেখা নাই কোথাও। এক্কেবারে আগের দিনের মতো। খুঁজতে খুঁজতে আবার সেই গুহায় ঢুকে পড়েছে। আগের দিনের মতো টেবিলে খাবার সাজানো। সাপও শুয়ে আছে পাশের পালঙ্কে।
মেয়েকে অবাক করে, সাপ একই কথা বলে উঠল—খাবার সাজানোই আছে। চাইলে, বসে পড়তে পারো। কেউ কিছু বলবে না। চাইলে খেতেও পারো পেট ভরে। আরামের জন্য খানিক ক্ষণ এই বিছানায় গড়িয়েও নিতে পারো ইচ্ছে হলে।
মেয়েটা আবার হতভম্ব। বুঝতে পারছে না, কী করা উচিত। সাপ গতকালের মতই বলল— কিন্তু মন না চাইলে, কিছুই কোর না।
সেদিনও মেয়েটা কিছুই করল না।
এবার সাপ বলল—খানিক বাদে এক দল লোক আসবে এই গুহায়। খানা পিনা করবে। তাদের সাথে নাচতে বলবে তোমাকে। কিছুতেই রাজি হয়ে যেও না।
সবে কথা শেষ হয়েছে। হুড়মুড় করে একদল লোক ভেতরে ঢুকে পড়েছে। টেবিলে তো খাবার সাজানোই ছিল। খাওয়া-দাওয়ার সাথে নাচানাচি, হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল তাদের। আজও একজন বলল—এই মেয়ে আয় এদিকে। নাচবি আমাদের সাথে।
কথা কানে তুলল না মেয়েটি। সবাই নাচানাচি করছে। ফাঁক বুঝে বাইরে বেরিয়ে এল মেয়ে। অবাক হয়ে দেখল, আজও তার ভেড়ার পাল সামনে চরে বেড়াচ্ছে। মনের আনন্দে ভেড়া নিয়ে বাড়ির পথ ধরল মেয়ে।
পরের দিন, মানে তৃতীয় দিন। সেদিনও একই ঘটনা। ভেড়ার পাল খুঁজতে গিয়ে গুহায় ঢুকে পড়েছে মেয়ে। সেদিন কিন্তু সাপের অন্য গলা। নরম গলায় বলল—শোন গো, মেয়ে। টেবিলে খাবার সাজানো আছে। বসে পড়ো। চিন্তা কোর না। পেট ভরে খেয়ে নাও।
সাপের আজ অন্য রকম গলা। মেয়েটি অবহেলা করল না সে কথা। খেয়ে নিল। পেট ভরেই খেলো। গরীবের মেয়ে। এমন সুস্বাদু উপাদেয় সব খাবার, ছুঁয়েও দেখেনি জীবনে।
সাপ বলল—এসো, এবার একটু গড়িয়ে নাও এই বিছানায়।
এ কথাও অবহেলা করল না মেয়ে। শুয়েই পড়ল বিছানায়। সাপ বলল— তোমার হাতটা রাখো আমার বুকে। এবার একটা কাজ করো। আমাকে একটা চুমু খাও আলতো করে।
মেয়েটা থমকে গিয়েছে শুনে। সাপকে চুমু খাওয়া? সাপ বলল—যদি ভয় করে, কিংবা লজ্জা, তাহলে তোমার ওড়নাটা উঁচিয়ে ধরো। আড়াল গড়ে দাও তোমার আমার মাঝে।
তাই করল মেয়েটি। ওড়না টেনে আড়াল করেছে। অমনি এক অবাক করা কাণ্ড। একেবারে ভোজবাজি যেন। কোথায় ভয়ঙ্কর বিশাল সাপ! তার জায়গায় সুপুরুষ এক রাজকুমার।
এত সুন্দর কোনও পুরুষ স্বপ্নেও দেখেনি গাঁয়ের রাখাল মেয়ে। চোখের পলক পড়ছে না তার। তাকিয়ে আছে, তো তাকিয়েই আছে।
হাসি মুখে রাজকুমার বলল—এক ডাইনি থাকে এই পাহাড়ে। সেই ডাইনিই আমাকে সাপ করে আটকে রেখেছে। একদিন শিকারে এসেছিলাম। আমার ঘোড়া লুকিয়ে দিয়েছিল। খুঁজতে খুঁজতে ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। খাবার সাজানো ছিল টেবিলে। খেয়েও ফেলেছিলাম। তাতেই তো আমাকে সাপ বানিয়ে বন্দী করে রেখে দিয়েছে।
মেয়েটা শুনছে অবাক হয়ে। মুখে কথা নাই। রাজকুমার বলল—তুমিও যদি খেতে, কিংবা ঐ লোকগুলোর সাথে নাচতে, তুমিও বন্দী হয়ে যেতে। যাই হোক, আর এক মূহুর্তও দেরি নয়। চলো বেরিয়ে যাই এখান থেকে।
তার পরে কী হোল?
গুহা থেকে বেরিয়ে ভেড়ার পাল নিয়ে মেয়েটি তার গ্রামের পথ ধরল। রাজকুমারও নিজের রাজধানিতে ফিরে চলল, জীবন ফিরে পেয়ে। না কি, বাইরে বেরিয়ে মেয়েটির হাত ধরে নিজের রাজবাড়িতে চললো রাজার ছেলে। সেখানে ধুমধাম করে বিয়ে হোল দুজনের। সুখে দিন কাটতে লাগল তাদের।
সেসবের কোনও খবরই ঠিকঠাক জানা হয়নি আমাদের। যারা এ গল্প পড়ছো, তোমরা নিজেরাই ভেবে নাও।
0 Comments