মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৫৫
পার্থসারথী দাশ (আঞ্চলিক ইতিহাসকার, গবেষক, খেজুরী)
ভাস্করব্রত পতি
১৯৪২ এর ১৬ ই অক্টোবর। সেদিনটা দুর্গাপূজার মহাসপ্তমী। বাংলায় ১৩৪৯ সন। মহাপ্রলয় এবং ভয়ঙ্করী লোনাবন্যায় খেজুরী সহ মেদিনীপুরের মানুষ প্রবল বিপর্যয়ের মুখোমুখি। প্রায় প্রতিটি মাটির বাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়েছে মাটিতে। খড়ের চাল খসে গিয়েছে। প্রাণ বাঁচানোর আর্তনাদ চারিদিকে। জলময় এবং কর্দমাক্ত সর্বত্র। সেই পথে হাঁটতে হাঁটতে শুকনো ডাঙার সন্ধানে কত পরিবার। দাদার কোলে ছোট্ট ভাই। হঠাৎই পা হটকে কোলের বাচ্চা ছিটকে পড়ে বন্যার জলকাদামাখা নোংরা আবর্জনা যুক্ত জলে। হায় হায় করে উঠলো বাড়ির লোকজন। কয়েক মিনিট পরে খোঁজ মিললো পাঁচ মাসের বাচ্চাটির। না, মৃত্যু হয়নি তাঁর। বেঁচেছিলেন। কাদায় মাখামাখি হয়ে ফিরে এলেন মায়ের বুকে। পরম স্নেহে আদরের 'কানু'কে পিঠে ফেলে চুমুতে ভরিয়ে দিলেন মা।
এই ১৯৪২ এ দেশজুড়ে জ্বলে উঠলো ভারতছাড়ো আন্দোলনের লেলিহান শিখা। সারা দেশ উত্তাল। স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষজন সমবেতভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। এরকমই সময়ে একটা দিন ছিল ১৩৪৯ এর ২৮ শে বৈশাখ (১১ ই মে, ১৯৪২)। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার খেজুরীর প্রত্যন্ত গ্রাম দেউলপোতায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বন্যার জলে ছিটকে পড়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা লোকগবেষক তথা আঞ্চলিক ইতিহাসকার, বিশিষ্ট সাংবাদিক, প্রবন্ধকার 'কানু'। ওরফে অগ্নিসেন, ঈপ্সিতা দাশগুপ্ত, শ্রীনাবিক, অগ্নিহোত্র, আগুন দাদা, কবিরাজ ধন্বন্তরি। 'মেদিনীপুরের মানুষ রতন' পার্থসারথী দাশ।
বাবা সৃষ্টিধর দাশ ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। বাংলা, সংস্কৃত ও ইংরাজীতে অনর্গল কথা বলতে পারা একজন বিদগ্ধ মানুষ। সেইসাথে পাশ করা একজন আয়ুর্বেদ চিকিৎসক। মা ছিলেন পদ্মাবতী দাশ। নিজের গ্রামেই বেড়ে ওঠা। শহরের আলো থেকে অনেক দূরে থেকে নিজেকে অতিসাধারণ মানুষ হিসেবেই তৈরি করেছেন তিলে তিলে।
খেজুরীতে এক সাহিত্য অনুষ্ঠানে পার্থসারথী দাশ
তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার আগেই চিরদিনের মত হারিয়ে ফেললেন বাবাকে। নেমে এলো ঝড়। সংসার সমুদ্রে এক চরম দুরবস্থা। কয়েক দিনেই বাড়ির সঞ্চিত সব অর্থ শেষ। দারিদ্র্যের আঘাতে বাড়ির সকলেরই পড়াশোনা সহ পেটের খাবারে টান পড়ল অচিরেই। উত্তাল নদীতে মাঝিহীন, পালহীন, দাঁড়হীন নৌকার যাত্রীর মত সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ধীরে ধীরে নেমে এলো অন্ধকার। পড়াশোনা তথৈবচ। পড়ার বই নেই। লেখার খাতা নেই। স্কুলে মাইনে দেবার সামর্থ্য নেই। বাড়ির ভাই বোনেদের কেউ পড়া বন্ধ করে দিলেন। আবার কেউ কোনও রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেলেন।
কামারদা মাইনর স্কুলে ১৯৫৪ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন পার্থসারথী। এখানে ষষ্ঠ শ্রেণি পাশ করে ১৯৫৬ তে অজয়া অন্নদা বিদ্যামন্দিরে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হলেন। বিদ্যালয়ের লাইব্রেরি থেকেই নানা বই তুলে পড়া শুরু। বইয়ের প্রতি আলাদা আকর্ষণ তৈরি করে ফেললেন আপনা আপনিই। অসংখ্য ঘাত প্রতিঘাত অতিক্রম করে ১৯৬২ সালে প্রি ইউনিভার্সিটি পাশ করলেন। ভর্তি হলেন নন্দীগ্রাম কলেজে। এখানে থ্রি ইয়ার্স ডিগ্রি কোর্স। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, শিক্ষাবিজ্ঞান, ইলেক্টিভ বেঙ্গলি ছিল কম্বিনেশন। কোনও অনার্স কোর্স চালু হয়নি তখনও।
১৯৬৭ তে সরকারি উচ্চপদে তিনমাস চাকরি করলেও সেখানকার মানসিকতার সঙ্গে খাপ না খাওয়াতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দেন। সেইসাথে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রীটাও অর্জন করলেন। ১৯৬৮ তে হালতু হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতে শুরু করেন। এই ১৯৬৮ তেই বিক্রমশিলা মহাবিহারের অধীনে কলকাতায় 'আয়ুর্বেদ শাস্ত্রী' বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করলেন। একসময় বাবা ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ। তাই এই বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হয়। এরপর ১৯৬৯-৭০ পর্যন্ত সুবদী দেবযানী গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন।
১৯৭০ সালে স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন গ্রামের বাড়িতে। যদিও এর আগেই ১৯৬৭ তে সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন। তখন রাজ্যে প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার। ১৯৬৮ তে হালতু হাইস্কুলে শিক্ষকতা করতে শুরু করেন। এরপর ১৯৬৯-৭০ পর্যন্ত সুবদী দেবযানী গার্লস হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯৭১-৭৫ পর্যন্ত পরিহরা শশিভূষণ বিদ্যাভবনে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ১৯৭৬-৭৭ পর্যন্ত রামচক হাইস্কুলে ছিলেন। এছাড়াও আরও ১৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২-৩ মাস সময়ের জন্য কাজে যোগ দিয়েছিলেন। খেজুরী কলেজে অবৈতনিক অতিথি অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন ১৯৯৯-২০০২ সাল পর্যন্ত।
সাহিত্যচর্চার কারিকুরি শুরু হয়েছিল স্কুল জীবন থেকে। ১৯৬১ সাল রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে 'দেনাপাওনা' গল্পের নাট্যরূপ দিলেন। দারুন জনপ্রিয় হয়েছিল নাটকটি। উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল সর্বত্র। ১৯৬২ সালে নন্দীগ্রাম কলেজের দেওয়াল পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেটিই পরে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল প্রথম লেখা। এখানে লিখেছিলেন তৎকালীন সময়ে ঘটে যাওয়া চিন এবং ভারতের সীমান্ত বিরোধ নিয়ে "সীমান্ত বিরোধের একটি পাতা" নামে একটি প্রবন্ধ।
এরপর লেখেন বোকাচ্চিও-র ছোট গল্প The pot of Basil এর অনুবাদ করা একটি গল্প। আর থেমে থাকেননি। তরতর করে এগিয়ে চললো তাঁর কলম। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে লেখা। 'একটি গল্প', মোপাসাঁর ছোটগল্প অবলম্বনে 'প্যরিস ছাড়তে ভয় করে' সহ আরও অনেক লেখা নিয়মিত লিখেছেন বহু পত্র পত্রিকায়। ১৯৭০ সালে খেজুরীতে ফিরে এসে যৌথ সম্পাদনায় 'অঙ্গীকার' নামে ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ শুরু করেন।
খেজুরী ইতিহাস সংরক্ষণ পর্ষদ (সমিতি), খেজুরী সাহিত্য সম্মিলনী, খেজুরী হেরিটেজ সুরক্ষা সমিতির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তিনি। খেজুরীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, সভ্যতা এবং পরিবেশ বাঁচাতে তিনি একজন লড়াকু সৈনিক। মেদিনীপুর আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা কেন্দ্রের সাথেও অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। নেতাজী পাঠচক্রের পারিবারিক সহায়তা কেন্দ্রতে তিনি উপদেষ্টা। এছাড়াও প্রগতি পরিষদ পাঠাগার, খেজুরী সংস্কৃতি সংসদের সাথে ব্যাপৃত রয়েছেন। খেজুরীর বিভিন্ন এলাকায় থাকা কলাগেছিয়া প্রগতি পরিষদ, পূর্বচড়া নেতাজী পাঠচক্র, অজয়া সর্বোদয় সঙ্ঘ, কামারদা বাড় দেউলপোতা ভাইবোন সংঘ ইত্যাদি সংস্থার সাথে জড়িয়ে রয়েছেন নিজের মনের তাগিদে। ১৯৬৭-১৯৭০ সালে তৎকালীন 'জনসেবক' পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। পরবর্তীতে যুগান্তর, আনন্দবাজার, বর্তমান পত্রিকায় সহযোগী সংবাদদাতা হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
মেদিনীপুর নিয়ে অসংখ্য লেখা লিখে চলেছেন নিরলসভাবে। বর্ষীয়ান এই মানুষটি জেলার বিভিন্ন গ্রামের ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখনীর মাধ্যমে। তিনি লিখেছেন 'চেনামাটির সোঁদাগন্ধ' গল্পগ্রন্থ। সাহিত্য পত্রিকা 'একান্ত পারিবারিক' প্রকাশ করেন প্রতি মাসে। জেলা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য নামী দামি পত্রিকায় লিখে চলেছেন মেদিনীপুর কেন্দ্রীক বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রবন্ধ। 'মহেন্দ্রনাথ করণ রচনা সংকলন' প্রকাশেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। এহেন মানুষটি এই বয়সেও থামিয়ে রাখেননি কলমের সচলতা।
🍂
0 Comments