দূর দেশের লোক গল্প— ২৪২
চিত্র- অর্ণব মিত্র
ছুঁচোর লেজ লম্বা কেন
মঙ্গোলিয়া (এশিয়া)
চিন্ময় দাশ
[ এক দিকে রাশিয়া, আর বাকি তিন দিক চীনদেশ দিয়ে ঘেরা একটা দেশ। নাম তার মঙ্গোলিয়া। পুরো দেশটাই বলতে গেলে পাহাড় আর মরুভূমি। দেশটাকে একশ’ ভাগ করলে, তার মাত্র এক ভাগ এলাকাতেই মানুষজনের বাস। তারাও আবার যাযাবর জাতের লোক।
কতো হরেক জাতের প্রাণী সেখানে। বুনো উট, এক জাতের ঘোড়া, সাইগা, গজেল, বুনো গাধা, তুষার চিতা, নেকড়ে, গোবি ভালুক ইত্যাদি। আর আছে এক বিশের জাতের হরিণ। সাধারণভাবে, তাদের নাম এল্ক।
এল্ক হরিণ মূলত আমেরিকার পশ্চিম এলাকা এবং কানাডায় পাওয়া যায়। তার মধ্যে আছে রকিজ এবং কলম্বিয়া এলাকাও। তবে, সেছাড়া উত্তর, মধ্য এবং পূর্ব এশিয়াতেও আছে এই হরিণ।
আমাদের আজকের গল্পটি মঙ্গোলিয়ার এল্ক-এর। সে দেশে এদের মারাল নামে ডাকা হয়। মারালের চেহারা বিশাল। পূর্ণ বয়স্ক পুরুষ মারালের ওজন ৪০০ – ৫০০ পাউণ্ড হতে পারে। সাড়ে চার থেকে পাঁচ ফুট উঁচু হয় এরা। মাথায় ঝাঁকড়া আর বড় মাপের শিঙ থাকে। শিঙগুলো গজায় মখমল নামের এক ধরণের আবরণের নীচ থেকে। গ্রীষ্মকালে গরমের দাপটে, এদের গায়ের রঙ গাঢ় বাদামী হয়ে ওঠে। আর, গ্রীষ্ম যখন শেষ হয়ে আসে, তখন মখমলগুলি শুকিয়ে যায়। তার ফলে, ভারি শিঙগুলো ঝরে পড়ে যায় হরিণের মাথা থেকে। ]
শিঙ হোল হরিণের মাথার মুকুট। শিঙ দেখতেও যে ভারি সুন্দর, এ বিষয়ে সকলেই একমত। কিন্তু এই শিঙের জন্যই বিপদেও পড়তে হয় হরিণকে। শিকারির সামনে পড়ে গেলে সর্বনাশ। প্রাণ বাঁচাবার জন্য দৌড়েপালানোর সময়, শিঙ জড়িয়ে যায় গাছের ডালে, লতা পাতার ঝোপে। তা হলেও শিঙ নিয়ে বেশ গর্ব আর অহংকার হরিণদের। তাই নিয়ে একটা মজার গল্প আছে মঙ্গোলিয়ায়।
বড়সড় চেহারার এক এল্ক বন্ধুত্ব করেছিল পুঁচকে চেহারার এক ছুঁচোর সাথে। বনের আর সবাই এই নিয়ে হাসাহাসি করত খুব। হরিণ গা করত না তাদের কথায়। তবে, ছুঁচোর ভারি দেমাক হোত এই বন্ধুত্ব নিয়ে। তার মতো এইটুকুন এক ছোট্ট জীব। বিশাল চেহারার এক হরিণের সাথে তার বন্ধুত্ব। গর্ব তো হবারই কথা।
গলায় গলায় ভাব হরিণ আর ছুঁচোর। সারা দিনে একবার দেখা হতেই হবে তাদের। আর সেই দেখার সময় এটা ওটা হাজার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় দুজনের।
🍂
একদিন কথায় কথায় গরমের কথা উঠেছে। ছুঁচো বলল—আমার মতে গরম কালটা দু’গুণ লম্বা হওয়া দরকার ছিল।
হরিণ সাথেসাথে আপত্তি জানিয়েছে—কী যে বলো তুমি, তার নাই ঠিক। গরমকালটা আমার আদৌ পছন্দ নয়।
--কেন, কেন? পছন্দ নয় কেন?
--পছন্দ হবে কেন? গরম হোল যত রাজ্যের মশা, মাছি আর ডাঁশের রাজত্বকাল। জ্বালিয়ে মারে একেবারে। আমার তো মনে হয়, গরমকালটা না থাকলেই বরং বেশি ভালো হোত।
ছুঁচো বলল—তাহলে কী, শীতকালটা লম্বা হলে ভালো হোত না কি?
--ভালোই তো হোত। মাছি বা অন্য পোকাদের উৎপাত সইতে হোত না।
--কিন্তু চারদিকে পুরু বরফ জমে থাকত। যা শক্ত খুর তোমার। দৌড়ে পালাতে অসুবিধায় পড়তে হোত খুব। মারা পড়তে হোত শিকারির হাতে।
--কী যে বলো তা তুমি। শিকারিরা মারবে আমাকে? অত সোজা কথা নয়, বন্ধু।
ছুঁচো বলল—আসলে মশা মাছি নয় কিন্তু। তোমার গরমে আপত্তির কারণ অন্য।
--আর কী কারণ থাকতে পারে এ ছাড়া?
--আসল কারণ হোল, তোমার ঐ সাধের শিঙগুলো। গরম কালে তো খুলে পড়ে যায় কিম্ভুত কিমাকার জিনিষগুলো।
যেভাবেই বলুক না কেন, ছুঁচো কিন্তু ভুল কিছু বলে নি। এক ধরণের মখমলের ভিতর থেকে শিঙ গজায় মঙ্গোলিয়ার এল্ক হরিণদের। গরমের দিনে রোদের তাত বড়লে, হরিণদের চামড়ার রঙ ঘন বাদামী হয়ে ওঠে। আর মখমলগুলো শুকিয়ে গিয়ে, শিঙ খসে পড়ে যায়।
ছুঁচো বলেছে সত্যি কথাই। কিন্তু শিঙ হোল হরিণের দেমাকের জিনিষ। সেই শিঙ নিয়ে খোঁটা শুনে, হরিণের মেজাজ গেল বিগড়ে। ছুঁচো যে তার প্রাণের বন্ধু, সে কথাও মনে রইল না। চেঁচিয়ে উঠল—তবে রে হতভাগা! শিঙ তুলে কথা বলিস? এত সাহস তোর? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।
হরিণের হাবভাব দেখে ছুঁচো ভড়কে গেল। ভয়ে ছুট লাগিয়ে দিয়েছে বেচারা। হরিণের তো রক্ত চড়ে গেছে মাথায়। পিছন পিছন দৌড় শুরু করেছে সেও। কপাল ভালো। ছুঁচোর গর্তটা তেমন দূরে নয়। টুক করে গর্তে সেঁধিয়ে গেছে সে। কিন্তু কপাল মন্দ। হরিণের একটা পা পড়ে গেছে তার লেজের ডগাটায়।
হরিণের খুর ভয়াণক শক্ত জিনিষ। এদিকে ছুঁচোর লেজ বেশ নরম নরম। লোমও নাই তেমন। ছুঁচো গর্তে ঢুকে গিয়েছে দেখে, হরিণও চেপে ধরে রেখেছে লেজটাকে। ছেড়ে দেওয়া তো দূর, আলগা করবার নামও নাই তার।
যন্ত্রণায় প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে ছুঁচোর। কিন্তু গর্ত ছেড়ে বেরোলেই বিপদ। মাফ চেয়ে এ বারের মতো পার পেয়ে যাবে, তার সম্ভাবনা নাই। উলটে প্রাণেই মেরে ফেলবে হয়তো। গর্তের ভেতরে থেকে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
হরিণেরও মাথায় জেদ চেপে গেছে। হতভাগাটাকে আজ উচিৎ শিক্ষা দিয়ে, তবেই ফিরবে এখান থাকে। দুজনেই অটল। একজন প্রাণের ভয়ে, অন্যজন রাগ আর জেদের বশে। কেউ নড়বার পাত্র নয়।
হরিণের একটাই কাজ। খুরের চাপ আলগা না করা। আলগা পেলেই আরও ভেতরে সেঁধিয়ে যাবে বদমাসটা। সে পা চেপে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। আর ছুঁচো বেচারা যন্ত্রণায় মরে যেতে বসেছে। মাঝে মাঝে লেজটা ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য টান দেয় কেবল।
সারাটা দিন গেল। রাত কেটে আবার সূর্যও উঠল এক সময়। দুজনের কারও নড়বার নাম নাই। দেখতে দেখতে দূপুরও হয়ে এলো এক সময়। এমন সময় হরিণের বউ এসে হাজির সেখানে।
হরিণকে দেখতে পেয়ে, মুখ ঝামটে উঠল—কেমন লোক গো তুমি? কাল থেকে ঘরে ফেরোনি। সারাটা রাত জেগে বসে আছি আমি। এখানে কী করছো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?
হরিণও তখন বেশ ক্লান্ত। বলল—এমনি এমনি কি আর দাঁড়িয়ে আছি বউ? কারণ আছে এর।
--কারণ আছে? কী কারণ, বলো শুনি। কাল সারা দিন সারা রাত ভয়ে ভাবনায় ঘুম নাই আমার চোখে। আর তুমি কারণ দেখাচ্ছো? আগে ঘরে চলো। ঘরে গিয়ে তোমার কারণ শুনবো।
হরিণ বলল—আরে, ঘরে যাবো কী করে? সামনের পা-টাই তো তুলতে পারছি না।
শুনে আঁতকে উঠেছে হরিণী—হায়, হায়। পায়ে কী হয়েছে গো তোমার? কী বিপদ ঘটিয়ে বসলে?
--নারে বউ, না। পায়ে কিছু হয়নি আমার। হরিণ সব কথা খুলে বলল বউকে।
আর যায় কোথায়? আবার হরিণীর মুখ ঝামটা—বলিহারি আক্কেল তোমার। একটা পুঁচকে ছুঁচো। তার সাথে লড়তে গেছো। বনের অন্যেরা যখন শুনবে, মান-ইজ্জত থাকবে কিছু তোমার? ছিঃ-ছিঃ-ছিঃ।
বউর মেজাজ দেখে কুঁকড়ে গেছে হরিণ। কোন রকমে বলতে গেল—না, মানে আমি—
বউয়ের মেজাজ আরও তিরিক্ষী—কোনও মানে টানে নয়। এক্ষুণি ঘরে চলো। নইলে, তোমার একদিন কি আমার একদিন।
রইল পড়ে প্রাণের বন্ধু ছুঁচোকে শিক্ষা দেওয়া। সুড়সুড় করে বউয়ের পেছন পেছন ফিরে চলল বেচারা।
0 Comments