জ্বলদর্চি

স্মৃতিগদ্য /বিষ্ণুপুরের গন্ধ/জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

স্মৃতিগদ্য

বিষ্ণুপুরের পাথরের রথ


বিষ্ণুপুরের গন্ধ

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় 

চোখ বন্ধ করলে সেই কিশোরকে এখনও দেখতে পাই, গোঁফের হালকা রেখা, কৌতূহলী মুখ, পরুষ গলায় কী যেন একটা গানের ভাঙা সুর, হাঁটুর উপর গোটানো পাজামা দ্বারকেশ্বর পার হচ্ছে। প্রথমে তেরো কিমি দূরে কোতুলপুর, তারপর বাসে বিষ্ণুপুর রাহা গ্যারেজ,তারপর দুটো পাথর দরজা পেরিয়ে  ভাঙা রাজবাড়ি,মৃন্ময়ী মন্দির, গুমঘর, কেজি কলেজ  তারপর ভারতী মেসের ভাড়াঘর শেষে রামানন্দ কলেজ। তার স্বপ্নতীর্থ। তেরো কিমির চেয়ে দেড় কিমি কোন অঙ্কে বড়ো হয়ে যায় সে বোঝেনি।

বিষ্ণুপুরে সে শহর খুঁজে পায়নি,পেয়েছে অনেক মন্দির, ছড়ানো ছিটানো কিছু দোকান আর কতকগুলো গ্রাম।

তার গঞ্জগুলোতে অদ্ভুত গন্ধ, সস্তায় দারুণ সব খাবার। আর কিছু উধাও, কিছু পাওয়া যায়। যেমন দেশি ঘিয়ের নিখুঁতি, কড়েনা, গুপচুপ বা কানজিলিপি, টানা (সিঁড়ি)নাড়ু, লবঙ্গ লতিকা, মিষ্টি শিঙাড়া ইত্যাদি। তাতে হারানো গন্ধ কিছুটা মেলে। চটরপটর কাবলি মটর এবং তার কৃপণ নির্মাতা তথা বিক্রেতা মানুষটি আর নেই। মনে হতো একদিন দশটাকার ওই মটর খেতে পারলে ধন্য হবে, কিন্তু তখন এক-দু-টাকাই যে অনেক।


             [] কলেজের গন্ধ  []

রামানন্দ কলেজ বিরাট একটা জগৎ। ডিপার্টমেন্ট তখন বিশাল। নবীনবরণ হবে।স্যারেরা বললেন, তোমরা অংশগ্রহণ করো। সে লিখলো কাঁচাহাতের ছন্দে লেখা কবিতা ' সেই কিশোরে ডাকো '। একেবারে কৈশোরের আবেগঘন শপথের কবিতা। জহর দাশগুপ্ত স্যারের পছন্দ হলো, সানন্দে বললেন,  বাঃ ! ভালো লিখছো তো ! পাঠ করবে। আবেগে জোর গলার পাঠ কেমন হয়েছিল মনে নেই তবে হাততালি ছিল জোর। সেবার স্যার আবৃত্তি করেছিলেন -- 'কেউ কথা রাখেনি'। তা ছিল চমৎকার। সুনীলবাবু ঢুকে পড়লেন মনের গভীরে, আড়িয়াল খাঁ নদীর গন্ধ ভেসে উঠলো। 

নিজেদের পত্রিকা তুলে দেওয়া স্যারেদের হাতে, সঙ্গে বন্ধু বিশ্বজিৎ দত্ত ও অমিত চৌধুরী, পত্রিকা তন্বী এবং পরে দোলা। তাঁদের অবাক হাসিমুখ এখনো মনে পড়ে। খেতাব জুটলো,  'বায়ো ডিপার্টমেন্টের একমাত্র কবি'। শ্রদ্ধেয় রাখহরিবাবু, সরোজবাবু, মানিকবাবু, শক্তিবাবু, সনাতনবাবু, মণিবাবু, দেববাবু, সরোজবাবু, ঊষাদি, লীনাদি এবং আরও অনেকে প্রশ্রয়মুখে উৎসাহ  দিতেন।

তার সৌরভ সবটা  হারায়নি।


              []        লালবাঁধ       []


বিশাল এক জলাশয় চারদিকে লালমাটি, কাঁকর, বালির রংও লালচে। তে-চোখা মাছের সাঁতার। বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কোথাও কোথাও পদ্মবন, জলে শ্যাওলা ও নানান জলজ উদ্ভিদের এক বিশেষ সোঁদাগন্ধ, গ্রামের পদ্মদিঘির গন্ধে মিলে যায়। তখন এইসব পুকুরের জল খাওয়ার প্রচলন ছিল। সাঁতরে মাঝখানে পৌঁছানো ছিল সহজ, ফেরার সময় দম ফুরিয়ে আসে। তাই চিতসাঁতার সবচেয়ে ভালো, ভাসতে ভাসতে পাড়ে আসা যায়। 

তখন তুমুল কবিতাবেলা। বন্ধুদের সঙ্গে সে-সব আলোচনা আর অন্য কোনও জগতে হারিয়ে যাওয়া। লিখেছিলাম ছন্দের কবিতা - 'সেই পথ সেই স্মৃতি '। পত্রিকায় প্রকাশের পর খুব প্রশংসিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, পিসেমশাইকে বোঝানো যায়নি, বন্ধু মানে সে বন্ধুই, রানিবাঁধের বীরখাম গ্রামের অচিন্ত্য হালদার।

সেই লালবাঁধকে দেখে কষ্ট হয়,তার আকার এখন 'L', পরিসর কমে গ্যাছে। আর সেই গন্ধটাও নেই। কেবল বিভিন্ন পুজো,তর্পণ ও আধুনিক আড্ডা চলে। কেবল সদানন্দ দত্ত বাংলা ও ইংরেজি বছরের সংখ্যা গুনে ততগুলো ডুব দিয়ে গিনেস বুকে নাম প্রায় তুলেই ফেলেছেন।



  [] ঝাঁটিমাসি, ঝাঁকামুটে ও মুদিদোকান  [] 


তখন সাইকেলে আসতে আসতে চোখে পড়তো ঝাঁটি ও কুচা কুড়ানি মাসির দল খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে দূর বনের গ্রামগুলি থেকে আসছে। তাদের রোদ, জল, ঠাণ্ডার অনুভূতি মুছে গ্যাছে, কারণ খিদের বাধ্যতা। ওদের জন্য কষ্ট হতো। ঝাঁটি ও কুচা শব্দদুটো পুরো অচেনা ছিল, চিনে গেলাম। গাছের শুকনো ডালপালা হলো ঝাঁটি আর ছোটো করে কাটা জ্বালানি কাঠ হলো কুচা। সেগুলো বিক্রি করে সব্জি,ডাল, তেল, সাবান ও মশলাপাতি না কিনলে তাদের দিন অচল। 

আবার চাষিরা ঝাঁকা ভর্তি সব্জি নিয়ে একইভাবে হেঁটে আসতো, সবজি বিক্রি করেই তাদের দৈনন্দিন জিনিসপত্র কিনতে হবে। ছোটো মুদি দোকানের মালিকেরা করুণচোখে তাদের যাওয়া-আসার দিকে তাকিয়ে দেখে বুঝতাম, এরাই এদের খদ্দের। ওরা না এলে এদের সর্বনাশ। ওদের নিয়ে কিছু লেখালিখি ছিল, মনে হয় হারিয়ে গ্যাছে। 


               [] ভাষার আঘ্রাণ []


বিষ্ণুপুরে ভাষায় একটা আঞ্চলিক টান, অনেক শব্দেও প্রকাশ পেত। যারা দূরের মানুষ তাঁরা সহজেই সেটা ধরতে পারতেন। বর্ধমান ঘেঁষা বাঁকুড়ার ভাষা বর্ধমানের মতোই। তা নিয়ে মজা করলেও তার মাধুর্য স্বীকার করতেই হয়।

কয়েকটি বলা যেতে পারে, কুথা গেল্‌লি, আর লাইরলম, অল অল করে ঘুরে বুলা ইত্যাদি আরও কত যে ছিল ! প্রথমে হেসেছি, পরে ভালোবেসেছি।

অঘ্রানের ধানের গন্ধের মতো তা-ও আর নেই।


🍂
ad

       []  বিষ্টুপুরের হোটেল   []

ভালো হোটেল বলতে রবীন্দ্রস্ট্যাচুর কাছাকাছি ছিল দুটি। একটির খাবারের মান ও দাম দুটোই চড়া, অন্যটি মাঝারি মানের,  দাম ও তাই। এছাড়া সব নিতান্ত সাধারণের হোটেল, মান ও দাম দুটোই কম। মিলচার্জ ২ টাকা ৫০ পয়সা, ছাত্রদের জন্য কনসেশনে  ১ টাকা ৭৫ পয়সা। সে বয়েসের খিদেয় তিনবার এক্সট্রা ভাত, ডাল ও সবজি নেওয়া আর হোটেল মালিকের করুণ মুখ দেখে মুখ চাওয়াচাওয়ি করা আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে আড়ালে মজার গল্প চলতো। এখন চাইনিজ, মোগলাই, দক্ষিণী ও আধুনিক মশলাপ্রধান খাবারের গন্ধে সেই হারানো স্বাদ বা গন্ধ কই ? 


         []    গানবাজনা,মোতিচুর   []


গান বাজনা মোতিচুর তিন নিয়ে বিখ্যাত বিষ্ণুপুরে আসল মোতিচুর পাওয়া যায় না, বদলে তার মতো এক মিষ্টান্ন ও লাড্ডু বিক্রি হয়। পিয়াল গাছ প্রায় অবলুপ্ত, তার বীজের গুঁড়ো নাহলে আসল মোতিচুর হয় না।

আর গান ?  কান পাতলে এখন যে গান শুনি তাতে বিষ্ণুপুরের গন্ধ নেই। বাংলার যে-কোনো শহরে সংস্কৃতিচর্চায় সংগীত যেমন, বিষ্ণুপুরেও তেমন। সম্মিলিত বাদ্যবৃন্দের উদ্দাম উল্লাসে এক, অজস্র শ্রোতা। স্যাক্সোফোনে চেনাগানের সুরে শ্রোতাদের তৃপ্তমুখগুলি দেখে বুঝতে অসুবিধা নেই, ভেসে যাওয়া কতই সহজ। তবু নাকউঁচু কোনও মন বলে, বিষ্ণুপুর কই ? প্রিয় বিষ্ণুপুর, কৈশোর-যৌবনের বিষ্ণুপুর তার সঙ্গে বার্ধক্যের বিষ্ণুপুর মিলছে কই ? ইতিহাসমাখা পাথুরে মাটিতে পা রাখলে যাদের বুকে লেগে যায় মল্লভূমের লাল, এস্রাজের টানে, পাখোয়াজ বোলে দরবারি বৈঠকে, ধ্রুপদের ওমে, সানুনাসিক হারানো সুর ভেসে গেলে শূন্যবুকে হা-হা করে জেগে ওঠেন প্রণম্য জ্ঞান গোঁসাই। রামশংকর, গোপেশ্বর না হোন শ্রদ্ধেয় অমিয়রঞ্জন আছেন, দেবব্রত সিংহ ঠাকুর, অহিদাসবাবু ছিলেন। সেইসব গর্বের দিনগুলি স্মৃতির ক-স্তবক নীচে ঘুমিয়ে গেল হিসেব পাই না। 

রামশংকর মুক্তমঞ্চের অনুষঙ্গে সেই প্রবাদপ্রতিম সংগীতজ্ঞের নাম ভেসে ওঠে। শোনা যায় তাঁর থেকেই না-কি বিষ্ণুপুর ঘরানার খেয়াল গাওয়া শুরু হয়। আবার শোনা যায় বাহাদুর খান বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রবর্তক। অনেক বলেছেন, খান সাহেবের শিষ্য রামশরণ ভট্টাচার্য বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রকৃত প্রবক্তা।

এখন স্বনামধন্য কয়েকজন মাত্র সংগীতসাধক ও শিক্ষক চর্চা করে এবং করিয়ে চলেছেন। তাঁদের জন্য মাঝে মাঝে সুগন্ধময় সুবাতাস পাই। তাঁরা কয়েকটি উচ্চাঙ্গের অনুষ্ঠান করিয়ে বিষ্ণুপুরকে জাগিয়ে রেখেছেন এটাই সান্ত্বনার।

অবশ্য বলতে দ্বিধা নেই, আসল বিষ্ণুপুরি সংগীত গাইলে বা বাজালে সংগীতশিক্ষক ও নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থী ছাড়া শ্রোতা আর কই ? আমার মতো শিল্পী নয় শুধু শ্রোতা যিনি ধ্রুপদ, খেয়াল, যন্ত্রসংগীত একমনে শুনে যাচ্ছেন এমন দেখি না।

শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীতপ্রেমী হয়ে আসরে বসলে দেখি শিল্পীর বাড়ির লোক ও আত্মীস্বজন বাদে তেমন কেউ নেই। আবার সরকারি আয়োজনে বড়ো আসরের শেষ পর্যায়ে হি-হি শীতে জোড়শ্রেণির মন্দির প্রাঙ্গণে ঘোষক, আয়োজকদের প্রতিনিধি এবং শিল্পীদল ছাড়া মাত্র জনা আটেক স্রোতা বসে আছেন। আমি ছাড়া সবাই সংগীতশিক্ষক। তৎকালীন মহকুমা শাসক মহাশয় দুবছর অতি আনন্দের সঙ্গে সসম্মানে আমার হাত ধরে একেবারে সামনের গদিতে তাকিয়া বালিশের পাশে বসিয়েছিলেন।

বিষ্ণুপুরের সুবাস মাখা নানান গন্ধ ভেসে বেড়ায়, শুধু ঘ্রাণকোশগুলিকে জাগিয়ে রাখতে হয়। প্রার্থনা রাখি আজীবন সেইসব সুগন্ধ যেন পাই।

Post a Comment

0 Comments