বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৭৩
কলকে
ভাস্করব্রত পতি
'ছলকে পড়ে কলকে ফুলে মধু যে আর রয় না,
চাপার বনে গান ধরেছে ভিনদেশী কোন ময়না' ---
প্রবোধ ঘোষের লেখা এবং অনল চট্টোপাধ্যায়ের সুরে এই গানটি গেয়েছিলেন সঙ্গীতশিল্পী প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। আলোচিত কলকে ফুল ফানেলের মতো আকৃতির। এই ফুল হলুদ, সাদা বা কমলা রঙেরও হতে পারে। তবে সাধারণত হলুদ রঙের কলকে ফুল সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। ফুলগুলি দেখতে হুঁকোর কলকের মতো। তাই বাংলায় এর নাম হয়েছে 'কলকে'। 'কল্কা ফুল' নামেও ডাকা হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়, তুর্কী শব্দ 'কল্গা'র অর্থ হল পাতা। যা থেকে পারস্য দেশে এসেছে 'কল্কা' নামের প্রচলন। এই কলকে পাতাকে মোটিফ করে নানা ধরনের শাড়ি, শাল, নকশিকাঁথা অলংকরণ করা হয়। 'কল্কাপাড়ের শাড়ি' নামটি বেশ জনপ্রিয়।
সাদা কলকে
কলকে ফুলকে বলে হলদে করবী, পীতকরবী, পীত করবীরক, সুগন্ধি কুসুম, কলকি, হলদি কলকি, কড়ি, চায়না করবী ইত্যাদি। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় পাই --
'ক্ষান্ত কার্তিকের
মাঠে — ঘাসের আঁচলে
ফড়িঙের মতো আমি বেড়ায়েছি —
দেখেছি কিশোরী এসে
হলুদ করবী ছিঁড়ে নেয় — বুকে তার
লাল পেড়ে ভিজে শাড়ি করুন
শঙ্খের মতো ছবি
ফুটাতেছে — ভোরের
আকাশখানা রাজহাস
ভরে গেছে নব কোলাহলে'।
এই হলুদ করবী আসলে হলুদ কলকে ফুলকেই বোঝানো হয়েছে। কবি তাঁর রূপসী বাংলা কবিতায় আরও বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছেন এই ফুলের কথা। মধ্যযুগের বাঙালি কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীও এই ফুলের কথা উল্লেখ করেছেন তাঁর কাব্যে --
‘তুলে পুষ্প কুরুবক কুন্দ আর কুরুন্ডক
কমলা কলকে
একে ইংরেজিতে Yellow Oleander, Mexican Oleander, Lucky Nut Tree নামে পরিচিত। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Thevetia peruviana। এটি Apocynaceae পরিবারের অন্তর্গত। এই ফুলের আদি বাসস্থান দক্ষিন আমেরিকা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এই ওয়েস্ট ইন্ডিজে এই গাছের ফল ‘লাকি নাট’ নামে পরিচিত। কলকে ফুলগাছের অন্যান্য প্রজাতিগুলি হল --
Thevetia peruviana
Cascabela peruviana
Cerbera peruviana
Thevetia linearis
Thevetia linearis
Thevetia neriifolia
Thevetia thevetia
Cerbera thevetia
Cascabela thevetia
Cerbera linearifolia
ষোড়শ শতাব্দিতে এক ফরাসী উদ্ভিদবিদ আন্দ্রে থিভেট এই গাছ আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর নামানুসারেই গাছটির জেনাস করা হয় Thevetia। আবার দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলের নামে কিছু স্পিসিসের নামকরণ করা হয়েছে Peruviana। প্রাচীনকালে কলকে ফুলের বীজের মধ্যাংশে ছাঁদা করে মালা বানিয়ে গলায় পরতো এই পেরুর অধিবাসীরা।
হলুদ কলকে
কলকে গাছ ঘন সবুজ। সরু লম্বা লম্বা পাতাযুক্ত। পাতাগুলো সরু ছুরির ফলার মতো তীক্ষ্ণ, সর্পিলভাবে ঘনবিন্যস্ত। পাতাগুলো লম্বায় ১০ থেকে ১৫ সে. মি.। চওড়ায় মোটামুটি ২ সে.মি.। রঙ ঘন সবুজ। বোঁটা ছোট। শাখা প্রশাখা বেশ নমনীয় এবং শীর্ষদেশ ছাতার মতো। এদের সারা দেহ দুধকষপূর্ণ। যেকোনো জায়গায় আঁচড় পড়লেই দুধের মতো তরুক্ষীর নির্গত হয়। গাছ খুব একটা বড় হয়না। গাছের কাণ্ড নাতিদীর্ঘ, মসৃণ এবং সাদাটে ধূসর। খুব একটা বড় আকারের হয়না কলকে গাছ। তাই ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সহজেই চড়তে পারে গাছের ডালে।
আমাদের দেশের আবহাওয়ায় এই ফুল বেশ সুন্দরভাবে অভিযোজন করে নিয়েছে। ইদানিং বড় বড় জাতীয় সড়কের মাঝের ডিভাইডারে কলকে ফুলের গাছ লাগানো হচ্ছে শোভাবর্ধক বৃক্ষ হিসেবে। তাছাড়া কারও কারও মতে এই গাছ নাকি গাড়ি থেকে নির্গত ক্ষতিকর কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করতে সক্ষম। ছোটবেলায় ছেলে মেয়েরা এই কলকে ফুল পেড়ে তার ভেতরের মধু খেতে খুব পছন্দ করতো। আর কলকে ফলের মধ্যে থাকা শক্ত বীজ চিরে অষ্টা খেলা এবং পাঁচঘুঁটি খেলার উপকরণ তৈরি করতো। ষোল শতকে হিসপানি পাদ্রীরা তাঁদের গীর্জার আশেপাশে লাগানোর জন্য কলকে গাছ আমাদের দেশে নিয়ে এসেছিলেন। তাই এখনও অনেক প্রাচীন গীর্জার আশেপাশে কলকে গাছ দেখা যায়। তেমনি এলকার অনেক মন্দিরের লাগোয়া এলাকায় কলকে গাছ লাগানো হত ফুলের প্রাচুর্যতার জন্য। দেবাদিদেব মহাদেবের অত্যন্ত প্রিয় এই ফুলের গাছ। মানুষের বিশ্বাস যে কলকে ফুলের গাছ বাড়িতে রাখলে সৌভাগ্য বৃদ্ধি হয়। তাছাড়া ঐ বাড়িতে নিয়মিত মানুষের আনাগোনা ঘটে। বিদেশেও কলকে ফুল নিয়ে অনেক রীতিনীতি দেখা যায়। দক্ষিণ আমেরিকার বিখ্যাত রেড ইন্ডিয়ানরা মনে করে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কলকে ফুল ও ফল দেখতে পাওয়া আসলে শুভ লক্ষণীয়।
কলকে ফুলের উপকারিতা অনেক। এটি জ্বরনাশক। এর বাকল থেকে তৈরি 'থিবেটিন' নির্যাস জ্বরের জন্য খুবই কার্যকরী। এছাড়াও সিফিলিস, চর্মরোগ, ক্ষতরোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এর ফল খুবই বিষাক্ত। এতে হৃৎপিণ্ডের ক্ষতিকারক গ্লাইকোসাইড থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের থেকে দূরে রাখতে হয় এই ফল। অনেক সময় এই গাছের ফল খেয়ে নানা দুর্ঘটনার সংবাদ শোনা যায়।
🍂
0 Comments